অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ২৪.

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৪.

” এখান থেকে চলে যান। ”

কথাটি বলেই ল্যায়লা মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিতে নেয়। কিন্তু ইয়াসির বাধা দেয়। শান্ত স্বরে বলে উঠে,

” আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই। ”

” আমি আপনাদের জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। এখন আর কারো উপর বোঝা না আমি। দয়া করে চলে যান। ”

ইয়াসির এবার কিছুটা জোরে দরজা ধাক্কা দেয়। ধাক্কার ফলে ল্যায়লা সামান্য পিছিয়ে যায়। তার চোখেমুখে আতংক। ইয়াসির উৎকণ্ঠিত স্বরে সুধায়,

” আমাকে ভয় পাওয়া বন্ধ করো ল্যায়লা। আমি তোমার ক্ষতি করবো না। ”

” ক্ষতি করা বাকি রেখেছেন আপনি? ”

ল্যায়লার শান্ত স্বরে বলা কথাটা শুনে ইয়াসির চুপ হয়ে যায়। তারপর বলে উঠে,

” তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি। একবার আমার কথা শুনো তারপর যা শাস্তি দিবে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিবো। ”

ইয়াসিরের কথায় তীব্র অপরাধবোধ পরিলক্ষিত হয়। ল্যায়লা কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

” পাঁচ মিনিটের মধ্যে যা বলার বলে চলে যাবেন। ”

ইয়াসির মাথা নেড়ে ঘরে প্রবেশ করে ডান পাশের লিভিং রুমে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ল্যায়লা মেইন দরজা সম্পূর্ণ খোলা রেখেই লিভিং রুমে প্রবেশ করে। হাতে থাকা ফোনটা সে শক্ত করে আগলে রেখেছে। যেন কোনো বিপদ হলেই সাথে সাথে সাহায্যের জন্য কাউকে কল করতে পারে। ইয়াসির সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ঘটনাটা পর্যবেক্ষণ করে। এতে অবশ্য সে অবাক হয় না। ল্যায়লার তাকে অবিশ্বাস করাটাই মানায়।

ল্যায়লা দূরে একটি সোফায় বসে ইয়াসিরকেও বলে,

” বসতে পারেন। ”

ইয়াসির চুপচাপ দূরে একটি সিঙ্গেল সোফায় বসে পড়ে। ল্যায়লা চরম অস্বস্তি নিয়ে বলে,

” বলুন। ”

ইয়াসির এক মুহুর্ত ল্যায়লার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

” আই এম সরি ফর হোয়াটএভার আই ডিড। ”

” আচ্ছা। যেতে পারেন এখন। ”

ইয়াসির অবাক হয়। সে ভেবেছিলো ল্যায়লা নিশ্চয়ই রিয়েক্ট করবে। সে চাচ্ছেও ল্যায়লা রিয়েক্ট করুক। নিজের রাগ, অভিযোগ সব ঝেড়ে ফেলুক তার উপর। কিন্তু ল্যায়লার এমন নির্লিপ্ত জবাব তার হজম হচ্ছে না। সে প্রশ্ন করে,

” তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো? ”

” তার আগে আপনি আমার তিনটা প্রশ্নের উত্তর দিন। ”

ইয়াসির উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ল্যায়লা প্রশ্ন করে,

” আপনার কি মনে হয়? পৃথিবীতে আমি সবথেকে বেশি ঘৃণা কাকে করি? ”

ইয়াসির মুহুর্তেই জবাব দেয়,

” আমাকে। ”

” ভুল। ”

ইয়াসির অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। ল্যায়লা আবার প্রশ্ন করে,

” আপনার কি মনে হয় আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি? ”

” না। ”

” আবার ভুল উত্তর। ”

এবার শেষ প্রশ্নটা করে ল্যায়লা,

” আপনি দেশ ছেড়ে কেন গিয়েছিলেন? ”

” পড়াশোনার জন্য। ”

” ভুল। ”

ল্যায়লা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করে,

” আমি পৃথিবীতে সবথেকে বেশি ঘৃণা করি রাদিফ আমীর ও আমাল শ্রিকিকে। যাদের কারণে আমার অস্তিত্ব আছে। আবার যারাই আমার অস্তিত্ব মুছে ফেলেছে। উনাদের প্রতি আমার ঘৃণার তীব্রতা সবথেকে প্রখর। ”

ইয়াসির ল্যায়লার চোখে স্পষ্ট সেই ঘৃণা দেখতে পায়। ল্যায়লা আবার বলে,

” আর আপনাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি বহু আগে। কারণ আপনার বিচার করার ক্ষমতা আমার নেই। ছোট ছিলাম। নিজের সকল অভিযোগ আল্লাহর কাছে জমা রেখেছি। আপনার বিচারও উনার হাতে ছেড়ে দিয়েছি। এখন বাকিটা উনার হাতে। ”

ইয়াসির লজ্জায় মাথা নত করে রেখেছে।

” আপনার শেষ উত্তরটাও ভুল। আপনি পড়াশোনার জন্য দেশ ছাড়েন নি। আপনি লজ্জায় পালিয়েছেন। প্রতিদিন একই বাসায় আমাকে ফেস করার ভয়ে। নিজের করা ভুল প্রতিদিন মনে পড়ার ভয়ে। ”

ইয়াসির ল্যায়লার সামনে এসে ফ্লোরে হাঁটু ঠেকে বসে। পরপর বলে উঠে,

” আমি পালিয়ে গিয়েও শান্তি পাই নি। প্রতি মুহুর্তে অপরাধবোধে ভুগেছি। আল্লাহ তোমার অভিযোগ শুনেছে। আমি এক মুহুর্তও শান্তি পাই নি। অনুশোচনা আমাকে প্রতিনিয়ত পুড়িয়েছে। এখনো পুড়ছি। শাস্তি দাও। আমি এই বোঝা আর বইতে পারছি না। ”

ইয়াসির কথাটুকু বলতে বলতে নিঃশব্দে কেদে দেয়। আবার বলে উঠে,

” আমি সবসময় আব্বুর ভালোবাসা চাইতাম। কিন্তু আব্বু আমাকে ভালোবাসে নি। আব্বু শুধু নিজের দায়িত্বটুকু পালন করেছে সবসময়। আমাল আন্টি আর তুমি আমাদের জীবনে আসার পর আমার সবসময় মনে হতো তোমাদের কারণেই আব্বু হয়তো আমায় ভালোবাসে না। আমাল আন্টিকে দেখলে মনে হতো উনি ওই বাসায় আমার আম্মুর জায়গা দখল করতে এসেছে আর তোমাকে দেখলে মনে হতো তুমিও একদিন আব্বুর মন থেকে আমাকে মুছে দিয়ে নিজে জায়গা করে দিবে। অসহ্যকর লাগতো আমার তোমাদেরকে। ধীরে ধীরে আমি আব্বুর ভালোবাসা পাওয়ার আশা ছেড়ে দেই। উল্টো উনাকে ঘৃণা করতে শুরু করি। আমাকে আর আম্মুকে ভালো না বাসার জন্য। উনি সবসময় ঝামেলামুক্ত থাকতে চাইতো। সেজন্যই আমি পণ করি আমি উনার জীবনের সবথেকে বড় ঝামেলা হবো৷ যেটাকে উনি না ঝেড়ে ফেলতে পারবে আর না সহ্য করতে পারবে। কিন্তু আমার আব্বুকে রাগানোর চেষ্টার মাঝে তোমার উপর করা অন্যায় আমাকে ভেঙে দেয়। তুমি যে কয়দিন হাসপাতাল ছিলে আমি জাহান্নামের আজাব ভোগ করেছি। ভেবেছি তুমি সুস্থ হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে সময়ের সাথে। কিন্তু কিছু ঠিক হয়নি। সেদিনের পর থেকে আমি আর ভালো নেই। আমার ভুলের শাস্তি আল্লাহ আমাকে তিলে তিলে দিয়েছে। আ’ম সরি ল্যায়লা। আমাকে মাফ করার প্রয়োজন নেই। পারলে ঘৃণা করো আমাকে৷ তোমার ক্ষমা আমার জন্য সবথেকে বড় শাস্তি হবে। এই শাস্তি আমাকে দিও না। ”

ইয়াসিরের চোখমুখের নাজেহাল অবস্থা। তার কণ্ঠস্বর বেশ নিরস হয়ে পরেছে। ল্যায়লারও এবার চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে। সে কম্পিত সুরে বলে উঠে,

” আরেকটা প্রশ্ন করি ইয়াসির ভাইয়া? ”

ইয়াসির মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই ল্যায়লা করুণ স্বরে প্রশ্ন করে,

” মা বাবা কখনো আমাকে ভালোবাসে নি কেন? ”

একটা প্রশ্নের মধ্যে যেন এক আকাশ অভিযোগ, অনুভূতি, আক্রোশ, আফসোস সব ঢেলে দিয়েছে ল্যায়লা। ইয়াসির একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দেয়,

” কারণ উনাদের কাছে সন্তান আছে, কিন্তু হৃদয় নেই। ”

__________

” শুনো, আমি অলরেডি হানিমুন প্যাকেজ বুক করে ফেলেছি। বিয়ের পরের দিনই আমাদের ফ্লাইট। একমাস কারো সাথে যোগাযোগ রাখবো না। দেখি কোন শালা আমার হানিমুনে বাগড়া দেয়। ”

ইসামের কথা শুনে নাহাল ফোনের অপরপাশ থেকে চোখ কুচকে প্রশ্ন করে,

” এক মাস কে হানিমুনে যায়? ”

” ইসাম শাহমীর যায়। আমার জল্লাদ দাদার যন্ত্রণায় তো মন খুলে প্রেমটাও করতে পারলাম না। এখন কি হানিমুনটাও ঠিক করে ইঞ্জয় করবো না নাকি? ”

ইসামের কথার মাঝেই তার ফোনে কল আসে। ইসাম ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে ল্যায়লা কল করছে। সে নাহালকে বলে উঠে,

” আমি তোমাকে পরে কল দিচ্ছি। একটা কল এসেছে। ”

নাহাল কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

” তোমার ওই মোনা ডার্লিং আবার কল করেছে? ”

” ধ্যাৎ। ওর সাহস হবে নাকি আমাকে কল করার? লাস্টবার তুমি ওকে যেই ধোলাই দিয়েছো আমাকে কল করার অপরাধে, ওর চৌদ্দ গোষ্ঠীরও আর সাহস হবে না আমার সাথে ফ্লার্ট মারার। এখন ল্যায়লা কল দিয়েছে। ”

ফোন রাখতেই নাহাল ভাবতে থাকে ল্যায়লার কথা। মেয়েটার সাথে তার একবার কেবল দেখা হয়েছে। চেহারা তার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। আচ্ছা ফাতিহর সাথে কি ল্যায়লার আর কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই? সে আর ইসাম তো খুব করে চায় কোনো একটা মিরাক্কেল ঘটুক। দুজনকে বেশ ভালো মানিয়েছিল।

__________

” কালকে তোমাদের সেমি ফাইনাল। বেস্ট অফ লাক জানাতে কল করলাম। ”

ল্যায়লার কথা শুনে ইসাম বলে,

” সামনে বিয়েও করছি। সেটার জন্য বেস্ট অফ লাক বলবে না? ”

” বিয়ের করো আগে। কংগ্রেচুলেশন অবশ্যই জানাবো৷ ”

ইসাম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রশ্ন করে,

” আর কাউকে বেস্ট অফ লাক জানাবে না? ”

ল্যায়লার শান্ত মন হঠাৎ অশান্ত হয়ে পড়ে। সে থেমে প্রশ্ন করে,

” সবাই ভালো আছে? ফিরুজে খালা কেমন আছেন? ”

” সবাই ভালো আছে। ফাতিহও খারাপ নেই। ”

ইসামের কথা শুনে ল্যায়লা বলে উঠে,

” আচ্ছা এখন রাখি। আমার কাজ আছে। ”

কথাটুকু বলেই ল্যায়লা ফোন কেটে দেয়৷ ইসাম ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা ফাতিহকে এতো ইগনোর করে কেনো? ইসামের রুমের দরজায় নকের শব্দ হতেই সে উঠে গিয়ে দরজা খুলে। ফাতিহ রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইসামকে দেখে সে প্রশ্ন করে,

” ডিনার করবি না? ফুল টিম অলরেডি লাউঞ্জে চলে গিয়েছে। ”

ইসাম ইচ্ছে করে শুনিয়ে বলে,

” ওহ! খেয়াল ছিলো না আমার। আসলে ল্যায়লার সাথে কথা বলছিলাম তো। ”

ফাতিহ সামান্য হেসে বলে,

” ভালোই ফ্রেন্ডশিপ হয়েছে তোদের। সুইসাইডের ভূত পুরোপুরি মাথা থেকে নেমেছে ওর? ”

” হ্যাঁ। শুধু ভূত মাথা থেকে নামে নি বরং ওর লুজ স্ক্রুও ঠিক হয়ে গিয়েছে। এখন আর কাউকে চড় থাপ্পড়ও মারে না। ”

ফাতিহ স্লান হেসে বলে,

” কারণ এখন আর কারো তাকে বাঁচানোর প্রয়োজন পড়ে না। ”

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here