অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ২৭.

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৭.

সময়ের গতি কখনো কখনো এতো দ্রুত চলে যে চোখের পলকেই মাস পেরিয়ে গেলেও তা বুঝার উপক্রম থাকে না। ল্যায়লার আজ বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা। তার বাস ছাড়বে রাত ৮ টায়। এখন মাত্র বিকেল ৪ টা বাজে।

__________

ইয়াসিরের আব্বুর মৃত্যুর আজ ৪০ দিনও পার হয়নি। কিন্তু এর মাঝেই ইয়াসির নিজেকে যথেষ্ট সামলে নিয়েছে। তার বাবার ব্যবসার সব দায়ভার এখন তার উপর এসে পড়েছে। এই ব্যবসার প্রতি তার কখনো খুব একটা ইন্টারেস্ট না থাকলেও নিয়তির দায়ভার হিসেবে সে এই দায়িত্ব পালনের চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এই দেশে কিংবা এই বাড়িতে থেকে সে তা পারবে না। এই বাড়ি কেবল তিক্ত অনুভূতিতে পরিপূর্ণ। সেজন্যই সে আমালকে তার প্রোপার্টির অংশ বুঝিয়ে দিয়ে নিজে নিজের ব্যবসা নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর পরিকল্পনা করেছে।

__________

লিভিং রুমে বসে দাঁত দিয়ে নিজের নখ খুঁটতে খুঁটতে চারিদিকে অস্থির চোখে তাকাচ্ছে ল্যায়লা। জীবনে প্রথমবারের মতো আমাল নিজ থেকে তাকে কল করে জরুরি তলবে ডেকেছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ল্যায়লা তাই এই বাসায় আবার এসেছে। ৬ টার মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে তার বাসায় গিয়ে ব্যাগ নিয়ে আবার বাস স্ট্যান্ডেও যেতে হবে।

ল্যায়লার অপেক্ষা শেষ হয়। আমাল ধীর পায়ে এসে ল্যায়লার পাশে সোফায় বসে। আমালের কাজে ল্যায়লা অবাক হয়। লিভিং রুমে এতোগুলা সোফা থাকতে আমাল তার পাশে এসে বসলো কেনো?

আমাল ধীর স্বরে মেয়েকে প্রশ্ন করে,

” কেমন আছো ল্যায়লা? ”

ল্যায়লার বুকে সূক্ষ্ণ ব্যাথা হয়। এতো বছরে তো কখনো তার মা এই খবর জানতে চায় নি যে ল্যায়লা কেমন আছে? তাহলে আজ এই প্রশ্ন করে সে কি বুঝাতে চাইছে? মনের প্রশ্ন মনে চেপে রেখে ল্যায়লা মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলে,

” শত বছর জাহান্নামে পার করে অবশেষে মুক্তি পাওয়া মানুষ যতটা ভালো থাকে ঠিক ততটাই ভালো আছি। কিন্তু আপনার হঠাৎ এই বিষয়ে কৌতূহল জাগলো কেন? আমাকে নিয়ে ভাবা তো আপনার কাজ নয়। যে কারণে ডেকেছেন তা স্পষ্ট করে বললেই খুশি হবো। ”

আমাল একহাতে ল্যায়লার গাল ছুঁয়ে দিয়ে বলে,

” মা কি কোনো কারণ ছাড়া মেয়ের সাথে দেখা করতে পারে না? ”

ল্যায়লা হতবিহ্বল স্বরে বলে,

” কে মা? আপনার সন্তান আছে আমার জানা ছিলো না। আমি তো জানি আপনি নিঃসন্তান। ”

আমাল আহত হয়। ফারদিনের মৃত্যুর পর সে অনেকটাই ভেঙে পড়েছে তা তার চেহারা দেখেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। তিনি ভাঙা স্বরে চাপা আর্তনাদ করে,

” ল্যায়লা! ”

ল্যায়লা ব্যস্ত পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

” অকারণে সময় নষ্ট আমার পছন্দ না। আসছি। ”

আমাল দ্রুত উঠে ল্যায়লার একহাত ধরে বলে,

” আমি অনেক একা হয়ে পড়েছি ল্যায়লা। এই এতো বড় বাসায় আমার নিজেকে খুব একা লাগে। নিজের সন্তান থাকা সত্ত্বেও আমি নিজের জীবনের বাকি দিনগুলো একা কাটাতে চাই না। ”

ল্যায়লা ঝাড়ি মেরে আমালের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। তারপর কঠিন স্বরে বলে উঠে,

” ওহ! এতো বছর পর নিজের একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য তাহলে আপনি আমাকে ডেকেছেন? আপনি আজকে অনুভব করছেন একাকিত্বে জীবন পার করা কতটা কঠিন? কেবল তো দুই দিন হলো এই একাকিত্বের সাথে আপনার পরিচয়। আর আমি বড় হয়েছি এটাকে নিজের সঙ্গী করে। আপনার চোখের সামনে যখন প্রতিনিয়ত আমি নিঃস্বর মতো ছটফট করতাম তখন আপনার এতো অনুভূতি কোথায় ছিলো? ”

মন খারাপে আবিষ্ট ল্যায়লার চোখ দিয়ে তখন ঝরঝর করে পানি বের হচ্ছে। সে ক্রোধ মিশ্রিত সুরে বলে,

” যখন আমার নিজের পরিবারের সবথেকে বেশি প্রয়োজন ছিলো সেই সময় আপনারা কোথায় ছিলেন? আপনার কাছে তো আজীবন আমি আপনার স্বাধীন জীবনের কাঁটা ছিলাম। সেই কাঁটাকে তবে আজ কেন প্রয়োজন পড়ছে আপনার? ”

আমাল কোনো জবাব দেয় না। সে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয়। এতদিন পর ল্যায়লার ভিতরে পুষে রাখা রাগ এবং কষ্ট বেরিয়ে আসায় সে বেসামাল হয়ে পড়ে। লিভিং রুমের কেবিনেটের উপর রাখা কাঁচের শো পিস গুলো সে ঢিল মেরে ভাঙা শুরু করে। আমাল বেশ ভয় পেয়ে যায় কিন্তু কাছে যাওয়ার সাহস হয়না তার। জিনিসপত্র ভাঙার শব্দে রান্নাঘর থেকে মিথিলা আন্টিও ছুটে আসে। ল্যায়লা চিৎকার করতে করতে বলে উঠে,

” নিজেকে ঘৃণা করে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা কতটা কঠিন আপনার জানা আছে? আমি প্রতিনিয়ত নিজেকে ঘৃণা করে বড় হয়েছি। কারণ আমার অস্তিত্বের ভাগিদার আপনি। আমার শরীরে আপনার এবং রাদিফ আমীরের রক্ত বয় কথাটা মনে পড়তেই যে কতবার আমার ইচ্ছে করেছে নিজেকে রক্তশূণ্য করে মৃত্যু দেই, সে সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে? ”

ল্যায়লার অবস্থা দেখে মিথিলা আন্টিও কেঁদে দেয়। মেয়েটা কতটা অবহেলায় বড় হয়েছে তার চাক্ষুষ সাক্ষী তিনি নিজে। কতদিন যে নামাজে বসে এই মেয়ের জন্য তিনি দোয়া চেয়েছেন সেই হিসাবও উনার জানা নেই। ল্যায়লা আবার চিৎকার করে বলে উঠে,

” কতবার আমি সুইসাইড এটেম্পট করেছি আপনার সেই হিসাব জানা আছে? ”

আমাল করুণ সুরে ডাকে,

” ল্যায়লা, শান্ত হও। ”

ল্যায়লা আরেকটা কাঁচের শো পিস ফ্লোরে ছুড়ে মেরে বলে উঠে,

” আপনি আমার মা নন। আপনি আমার জীবনের সবথেকে বড় ট্রমা। মরে যাবো কিন্তু আর জীবনেও আমি এই ঘরে ফিরে আসবো না। এটাই শেষবার। ”

কথাটা বলেই ল্যায়লা ভাঙা কাঁচ মারিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। ফ্লোরে ততক্ষণে তার পায়ের ছোপ ছোপ রক্তের দাগ বসে গিয়েছে। আমাল শ্রিকি ধপ করে সোফায় বসে পড়ে।

__________

অবসাদের বাতাস গায়ে মাখিয়ে হুড়মুড় করে ল্যায়লা বের হতে নিয়েই ইয়াসিরের সাথে ধাক্কা খায়। আচমকা এই তিনে সন্ধ্যা বেলায় ল্যায়লাকে বাসা থেকে বের হতে দেখে ইয়াসির অবাক হয়। তার থেকেও বেশি অবাক হয় ল্যায়লার অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া আর রক্তাক্ত পা দেখে। ইয়াসির বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,

” ল্যায়লা, কি হয়েছে? এভাবে ছুঁটছো কেন? ”

ল্যায়লা কিছু বলতে পারে না। কেবল ভেজা চোখে তাকিয়ে রয়। ইয়াসির এক মুহুর্ত সময় নিয়ে কঠিন স্বরে প্রশ্ন করে,

” মিসেস আমাল কিছু বলেছেন তোমাকে? ”

ল্যায়লা ঝাপসা চোখে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

” আমি আর কখনো এই বাসায় আসবো না। ”

সাথে সাথেই চেতনা হারিয়ে তার অবহেলিত দেহটা ঢলে পড়ে। পড়ে যাওয়ার আগেই ইয়াসির তাকে আগলে ধরে।

__________

ল্যায়লার জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করে। নিজের নেতিয়ে যাওয়া শরীরটাকে টেনে সে উঠে বসে। দুই পায়ের উপরে করা জুলুমের ফলস্বরূপ সেখানে এখন শুভ্র রঙা ব্যান্ডেজ দ্বারা মোড়ানো। ল্যায়লা চারিদিকে তাকিয়ে দেখে কেবিনে এখন কেউই নেই। নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ঘড়ির কাঁটা এখন রাত ৭ টার কাঁটায় স্থির।

ল্যায়লা বেড ছেড়ে নেমে কোনোমতে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সাথে সাথে পায়ের ব্যাথাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তবুও ধীর পায়ে সে দেয়াল ধরে ধরে রুম থেকে বের হয়। এখানেও কেউ নেই। শান্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে সে হসপিটালের ওয়েটিং এরিয়া তে যায়। এখানে তেমন একটা মানুষ নেই।

আচমকা ল্যায়লার কানে ভেসে আসে ওয়েটিং এরিয়ার টিভির নিউজের শব্দ। নিউজে খবর পাঠিকার বলা শব্দগুলো তার কানে ধাক্কা খেতে থাকে বারবার।

ইয়াসির ল্যায়লার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,

” ওহ! তুমি এখানে। আমি আরও তোমাকে খুঁজছিলাম। ”

ল্যায়লা অনুভূতি শূন্য স্বরে বলে উঠে,

” আমি মরক্কো যেতে চাই এই মুহুর্তে। ”

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here