অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৩২.

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩২.

পর্বত চূড়ায় ভেজা ঘাসের উপর পাশাপাশি বসে আছে ফাতিহ এবং ল্যায়লা। ল্যায়লার অনামিকা আঙুলে ক্ষাণিকক্ষণ আগে ফাতিহর পড়িয়ে দেওয়া আংটি। ল্যায়লা নির্নিমেষ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করে,

“ তুমি বিয়েতে কাকে কাকে ইনভাইট করবে? ”

ফাতিহ ঘাড় ঘুরিয়ে ল্যায়লার দিকে তাকায়। একগাল হেসে জবাব দেয়,

“ ফ্যামিলি, ফ্রেন্ডস, পরিচিত সবাইকে। ”

ল্যায়লা নিজের ভাঁজ করা পা দ্বয় দু’হাতের সাহায্যে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে এনে ঠেঁকে। পরপর সে বলে উঠে,

“ আমার কাউকে বলার নেই। “

ফাতিহর মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সে মলিন মুখে তাকায় ল্যায়লার দিকে। ল্যায়লা কথাটা বলেই সামান্য হেসে আবার বলে উঠে,

“ বিয়েতে নাকি কনের বাবার প্রয়োজন হয় কনের অভিভাবক হিসেবে। এখন অভিভাবকহীন কনেকে কিভাবে বিয়ে করবেন ফাতিহ সাহেব? “

ফাতিহ নিজের ডান হাতের কনিষ্ঠা আঙুল দ্বারা ল্যায়লার বাম হাতের কনিষ্ঠা আঙুল পেঁচিয়ে ধরে কোমল স্বরে বলে,

“ আমার বিয়ের জন্য শুধু কনেকে প্রয়োজন। বাকি সব ব্যবস্থা আমি করে নিবো। ”

__________

দেশ বিভেদে বিভিন্ন দেশে আলাদা আলাদা আনুষ্ঠানিকতা এবং সংস্কৃতি মেনে বিয়ের আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। মরক্কোও এর ব্যতিক্রম নয়। মরক্কোতে মোট তিন থেকে চার দিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একটি বিয়ে সম্পন্ন হয়।

জাতীয় দলের অধিনায়ক ফাতিহ আরাব এই সপ্তাহেই বিয়ে করতে চলেছে সেই খবর ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সকলেই উদগ্রীব হয়ে আছে পাত্রী কে তা জানার জন্য। অনেকেই এই সুযোগে বিভিন্ন ফেক ডেটিং রিউমারস ছড়াতেও কার্পণ্য করছে না। কিন্তু যাকে ঘিরে মিডিয়া এতো বিভোর সে মগ্ন ল্যায়লাতে কেবল।

একটি মরক্কোর দম্পতি ম্যারেজ এক্ট অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ে করার জন্য প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেট পেয়ে তবেই যাত্রা শুরু করতে পারে। বিয়ের দিন কনের অভিভাবক ওয়ালিয়ের উপস্থিতিতে সমস্ত কাগজপত্র নোটারিয়ের কাছে উপস্থাপন করা হয়। ওয়ালি সাধারণ কনের বাবা হয়। কনের বাবা ইন্তেকাল করে থাকলে কনের বড় ভাই কিংবা মামা এই দায়িত্বটা পালন করে। তাছাড়া দুজন সাক্ষীরও প্রয়োজন আছে। কাগজপত্রে স্বাক্ষর হওয়ার পর, দম্পতিকে তাদের পরিচিত সকলকে জানানোর জন্য একটি বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে যে তারা আইনত এবং শরিয়ত মোতাবেক এখন স্বামী স্ত্রী।

__________

বিয়ে পড়ানোর জন্য জায়গা হিসেবে নির্ধারণ করা হয় হাসান দ্বিতীয় মসজিদে। মসজিদে আপাতত উপস্থিত রয়েছে ফাতিহর পরিবার, ইসাম, নাহাল, ল্যায়লার নানুবাড়ির সদস্য এবং জাতীয় দলের কোচ এবং কয়েকজন খেলোয়াড়। সকলেই ফর্মাল গেটাপে রেডি হয়েছে। মহিলারা পায়ের গোড়ালি সমান লম্বা ফ্রক কিংবা স্কার্ট এবং মাথায় স্কার্ফ জড়িয়ে রেখেছে। ল্যায়লা একটি অফ হোয়াইট রঙের লং গাউন পড়েছে। অলংকার হিসেবে শুধু কানে মুক্তা পাথরের দুল এবং হাতে হীরের আংটি। তার মাথায় ঝুলছে একটি সাদা ভেইল।

নোটারি এবং ইমাম সাহেবের বরাবর বসেছে ফাতিহ এবং ল্যায়লা। তাদের একপাশে সাক্ষী হিসেবে রয়েছে ইসাম এবং নাহাল। ল্যায়লার পক্ষ থেকে ওয়ালির দায়িত্ব পালন করেছে তার একমাত্র মামা। তার নানা এবং মামা এই বিয়েতে অনেক খুশি। একেতো পাত্র হিসেবে ফাতিহকে তাদের বেশ পছন্দ হয়েছে। আর তাছাড়া আমাল তাদের ছেড়ে গিয়ে যেই কষ্ট দিয়েছে, ল্যায়লার ফিরে আসার মাধ্যমে সেই কষ্ট অনেকটাই মুছে গিয়েছে।

বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন পেপারে সিগনেচার করার আগ মুহুর্তে ল্যায়লার হাত যেন বরফ শীতল হয়ে জমে যায়। ফাতিহ ল্যায়লার বাম হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিতেই যেন সে এক উষ্ণ ভরসার ছোঁয়া পায়। সাথে সাথেই সে সিগনেচার করে দেয়। ল্যায়লার সিগনেচার করা শেষ হতেই ফাতিহর দিকে পেপারস এগিয়ে দেওয়া হয়। সিগনেচার করার সময় ফাতিহর হাতে নিজের গিফট করা কলম দেখে বেশ অবাক হয় ল্যায়লা। ফাতিহ তার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ তোমার জন্য জীবনের প্রথম এবং শেষ অটোগ্রাফ এই নিকাহনামাতে দিয়ে দিলাম। ”

__________

“ তুমি তো বলেছিলে আমার আগে বিয়ে করবে না মামা। কিন্তু এখন সুন্দরী মামী পেতেই আমার আগেই বিয়ে করে ফেললে। ভেরী ব্যাড মামা। “

হামযার অভিযোগ শুনে ল্যায়লা আর ফাতিহ দুজনেই ফিক করে হেসে দিলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফারাহ এবং তার স্বামী আলি ছেলের কথা শুনে মিটিমিটি হাসছে। আলি হাসতে হাসতে বলে উঠে,

“ শালা সাহেব। আমার ছেলের সাথে খুব অন্যায় করে ফেললে তুমি। ”

ল্যায়লা হামযাকে কাছে টেনে বলে উঠে,

“ মামী তোমার জন্য মেয়ে খুঁজে দিবো নি। “

হামযা এক লাফে ল্যায়লার কোল থেকে নেমে বলে উঠে,

“ মামী। প্লিজ আমাকে কোলে নিও না। আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। আমাকে কোলে নিলে সবাই আমাকে বাচ্চা ভাববে। কিন্তু তুমি চাইলে আমার জন্য তোমার থেকে বেশি সুন্দর মেয়ে খুঁজে দিতে পারো। ”

ফারাহ বিড়বিড়িয়ে বলে,

“ বাপের মতো হয়েছে একদম। বিয়ে পাগল। ”

__________

সী বীচের কাছেই একটা প্রাইভেট রিসোর্ট বুক করা হয়েছে আজকের জন্য। কালকে সবাই রাবাতে ফিরে যাবে। তারপরের দিন থেকে বিয়ের আয়োজন শুরু হবে সম্পূর্ণভাবে।

ঘড়ির কাঁটা প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই। ফাতিহ বসে আছে রিসোর্টের লাউঞ্জ এরিয়াতে। তার সাথে রয়েছে আলি এবং ইসাম। যারা আপাতত সম্পূর্ণভাবে হাসি থাট্টায় ব্যস্ত। না নিজেরা যাচ্ছে আর না ফাতিহকে যেতে দিচ্ছে। ফাতিহ মনে মনে ভাবছে ল্যায়লার কথা? কি করছে ও? ঠিক সেই মুহুর্তে দেবদূতের ন্যায় ফারাহ এসে উপস্থিত হয় সেখানে। গরম চোখে আলির দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ তুমি এখনো এখানে কি করছো? “

আলি হেসে বলে উঠে,

“ শালাকে বিবাহিত জীবন মেইনটেইনের টিপস দিচ্ছিলাম। “

ফারাহ কমোরে হাত রেখে ফাতিহর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ তুই তোর রুমে যা। “

ফাতিহ যেন এই মুহুর্তের অপেক্ষায়ই ছিলো। সে সাথে সাথে বড় বড় পা ফেলে সেখান থেকে প্রস্থান করে। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আলি এবং ইসাম আবারও স্ব শব্দে হেসে উঠে। ফারাহ এবার ইসামের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ নাহাল তোর জন্য ওয়েট করছে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ রেগে আছে। জীবন বাঁচাতে চাইলে এখুনি যা। “

বলা হয়ে থাকে পুরুষ মানুষের সকল ভয় একপাশে এবং বউয়ের ভয় অন্যদিকে। ইসাম সাথে সাথে উঠে চলে যায়। আলির হাসি হাসি মুখ এবার বউয়ের রাগী চেহারা দেখে নিভে যায়। ফারাহ রাগ মিশ্রিত সুরে বলে,

“ নিজের বিয়ের দিন তো রাত ৮ টা বাজেই রুমে চলে গিয়েছিলে। আর এখন আমার ভাইকে রাত ১২ টা পর্যন্ত নিজের সাথে বসিয়ে রেখেছো। “

“ আরে, আমি তো ফাতিহর স্বাধীন জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার শোকে দুঃখ প্রকাশ করছিলাম। “

ফারাহ চোখ কুচকে আলির দিকে তাকিয়ে রয়।

__________

গায়ের কোট সন্ধ্যার দিকেই খুলে কোথায় যেনো রেখেছিলো ফাতিহ। আপাতত সাদা শার্টের স্লিভ গোটাতে গোটাতে সে তার রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রুমের দরজার সামনে যেতেই ফাতিহ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। পর মুহুর্তেই সে আলতো হাতে নব ঘুরিয়ে রুমে প্রবেশ করে। অন্ধকার রুমে মৃদু আলোতে ল্যায়লাকে কোথাও না দেখতে পেয়ে ফাতিহ দরজা লক করে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়।

বারান্দায় গাউনের উপর গায়ে সাদা একটা শাল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে ল্যায়লা। বেশ হীম শীতল আবহাওয়া। মাথায় এখন আর সেই ভেইলটা নেই। ফাতিহ এগিয়ে গিয়ে একহাতে ল্যায়লার খোপা টেনে খুলে দিয়ে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। ভাবুক ল্যায়লা অবাক হলো না। বরং নিজেকে আরো ছেড়ে দিলো ফাতিহর বাহুডোরে। ফাতিহ ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলো,

“ ঠান্ডা লাগছে? “

“ উমহু। “

ফাতিহ নড়লো না। একই ভঙ্গিতে ল্যায়লাকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ল্যায়লা এবার নিজ থেকেই ফাতিহকে ডাকে,

“ ফাতিহ? “

“ হুম। “

ল্যায়লা ফাতিহর দিকে ফিরে বলে উঠে,

“ ফর দ্যা ফার্স্ট টাইম আ’ম ফিলিং আই হ্যাভ এ ফ্যামিলি। “

ল্যায়লার চোখেমুখে স্পষ্ট খুশি দেখতে পায় ফাতিহ। তা দেখে সে হেসে ল্যায়লার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। পরপরই ল্যায়লার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,

“ মে আই? “

লজ্জা মিশ্রিত ল্যায়লা দু’হাত ফাতিহর কাধে রাখতেই ফাতিহ আর অপেক্ষা না করে নিজেদের মাঝে থাকা কিঞ্চিৎ দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয়। পরমুহূর্তেই ল্যায়লাকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে রুমের দিকে অগ্রসর হতে হতে ধীর স্বরে বলে উঠে,

“ দীর্ঘ অপেক্ষার ফল তুমি হলে, এমন অপেক্ষা হাজার বছর সই। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here