অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৪.

0
390

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪.

ভাগ্য ভালো থাকায় কিছুটা সমতল জায়গায় এসে ল্যায়লা পড়ে। ফাতিহ আর ইসাম ততক্ষণে দৌড়ে তার কাছে চলে এসেছে। ল্যায়লা শরীরের বরফের কণা ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে বসে। ইসাম এসেই বলে,

” তুমি আবার সুইসাইড করতে যাচ্ছিলে? তাও এখান থেকে লাফ দিয়ে? ”

ফাতিহ ইসামকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

” সুইসাইড এটেম্পট করে নি, পা পিছলে পড়ে গিয়েছে। ”

ল্যায়লা ফাতিহর উপর বিরক্ত হয়। এই ছেলে কিভাবে বুঝলো সে পা পিছলে পড়ে গিয়েছে? এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ল্যায়লা চোখ তুলেও তাকাতে পারছে না। ফাতিহ এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

” ধরে উঠে এসো। ”

ল্যায়লা ফাতিহর বাড়িয়ে দেওয়া হাতকে অগ্রাহ্য করে। নিজে একাই উঠে দাঁড়ায়। ফাতিহ চুপচাপ হাত ফিরিয়ে নেয়। সে এটাই আশা করছিলো। বরং এই মেয়ে তার সাহায্য গ্রহণ করলেই সে অবাক হতো। ইসাম হেসে এরাবিক ভাষায় ফাতিহকে বলে উঠে,

” আমার মনে হয় ল্যায়লা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিলো। তাই পা পিছলে পড়ে গিয়েছে। অবশ্য আমাদের মতো গুড লুকিং দুজন ছেলে সাথে থাকলে মেয়েদের চোখ ফেরানো দ্বায়। ”

ফাতিহ কোনো কথা না বলে ল্যায়লার দিকে এগিয়ে যায়। ফাতিহকে নিজের কাছাকাছি আসতে দেখে ল্যায়লা ঘাবড়ে পিছিয়ে যেতে চায়। ফাতিহ বলে,

” তোমাকে ছুঁবো না। চুপচাপ দাঁড়াও। ”

ল্যায়লা কোনো জবাব দেয় না। কিন্তু সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। আগ্রহী দৃষ্টিতে দেখতে থাকে ফাতিহ কি করে। ফাতিহ নিজের ব্যাগ থেকে একটি মাঝারি আকারের বেল্ট বের করে। বেল্টের একপাশের আংটা নিজের ব্যাগের সাথে আটকে অপরপ্রান্তের আংটা ল্যায়লার ব্যাগে আটকে দেয়। ল্যায়লা ব্যস্ত গলায় বলে,

” প্রয়োজন নেই। ”

” যতক্ষণ আমাদের সাথে আছো ততক্ষণ ঝামেলা এড়াতে চাইলে আমি যেভাবে বলছি সেভাবে চলো। তোমার উপর কোনো হুকুম জারি করছি না আমি কেবল নিজেরা বিপদ এবং ঝামেলা মুক্ত থাকতে চাইছি। ”

ইসাম পিছন থেকে টিটকারির সুরে বলে,

” তুই দেখি ল্যায়লার খুব খেয়াল রাখছিস! ”

ফাতিহ এরাবিক ভাষায় বিদ্রুপের সুরে বলে উঠে,

” এই ঝামেলা বিদায় করতে পারলে আমি দু রাকাত নফল নামাজ আদায় করবো। ”

__________

তারা তিনজন যখন সমতলে পৌঁছায় তখন প্রায় রাত ১০ টা বেজে ১৩ মিনিট। কিছুটা হেটে রাস্তার কাছাকাছি আসতেই দেখে সম্পূর্ণ রাস্তা নীরব এবং নির্জীব। ল্যায়লা নিজের ব্যাগ থেকে বেল্টের আংটাটি খুলে ফেলে। ফাতিহ চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে ল্যায়লাকে প্রশ্ন করে,

” কোথায় যাবে এড্রেস বলো। আমি ড্রপ করে দিচ্ছি। ”

ল্যায়লা শান্ত স্বরে বলে,

” প্রয়োজন নেই। আমি নিজে যেতে পারবো। ”

ইসাম হেসে বলে,

” আমরা জানি সেটা। যেই মেয়ে একা অ্যাটলাস শৃঙ্গে চড়তে পারে সে সমতলেও চলতে পারবে তা আমাদের জানা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এতটুকু যেহেতু একসাথে এসেছি তাহলে বাকি পথটুকু এগিয়ে দিতেও আমাদের কষ্ট হবে না। ”

ল্যায়লা একই স্বরে বলে,

” আমি একা চলে অভ্যস্ত। সম্পূর্ণ পথচলার মতো সহচরের প্রয়োজন নেই আমার। ”

কথাটুকু বলে ল্যায়লা চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। ফাতিহ নিজেই বলেছিলো যে একবার সমতলে পৌঁছে গেলে যে যার রাস্তা মাপবে। কিন্তু এরকম জনমানবশূন্য রাস্তায় মধ্যরাতে একটা মেয়েকে একা যেতে দেওয়ার মতো বিবেকহীনও সে নয়। তাই বাধ্য হয়ে সে বলে,

” এইখানে যতদূর পর্যন্ত চোখ যায় সম্পূর্ণটা বারবারিয়ানদের আস্তানা। সকল বারবারিয়ানরা খারাপ না। কিন্তু কিছু শতাংশ বারবারিয়ানরা এই রাতের অন্ধকারে ওঁৎ পেতে থাকে কোনো নারী দেহ খুবলে খাওয়ার আশায়। আমি জানি তুমি মৃত্যু চাও। কিন্তু এমন অসম্মানজনক মৃত্যু নিশ্চয়ই কখনো নিজেকে উপহার দিতে চাও না? ”

ফাতিহর কথাগুলো কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই ল্যায়লার সম্পূর্ণ শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। কি হতে পারে ভেবেই তার হাতের তালু কাপতে থাকে। ফাতিহ জবাবের অপেক্ষা না করে আবার বলে,

” জানি আমাদের প্রতিও তোমার বিশ্বাস নেই। আমি বিশ্বাস করতেও বলছি না। কিন্তু আল্লাহর নামে শপথ করে প্রতিজ্ঞা করছি যে, যতক্ষণ তোমাকে তোমার ঠিকানায় পৌঁছে দিতে না পারছি, ততক্ষণ তোমার এবং তোমার সম্মানের মুহাফিজ হয়ে থাকবো। ”

ল্যায়লা ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকায়। ফাতিহ আর ইসাম তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। ল্যায়লা নিজের দৃষ্টি আড়াল করে মাথা নত করে চুপচাপ তাদের দিকে এগিয়ে যায়। শান্ত স্বরে বলে,

” কাশবাহ বাব ওউরিকা হোটেল। ”

ফাতিহ মাথা নেড়ে হেঁটে নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। গাড়িতে উঠার সময় ইসাম আগেই দৌড়ে পিছনের সিটে গিয়ে বসে। ল্যায়লাও পিছনের সিটে গিয়ে উঠে বসতে নিলে ফাতিহ শান্ত স্বরে সুধায়,

” আমাকে কি ড্রাইভার মনে হয়? ইসাম সামনে আয়। ”

ইসাম আরামে সিটে গা এলিয়ে দিয়ে বলে,

” সরি ব্রো। কিন্তু আমার শরীর এখন প্রচুর রেস্ট চায়। আমি এখানে আরাম করেই ঠিক আছি। ”

কথাটুকু বলে ইসাম ল্যায়লার দিকে তাকিয়ে বলে,

” ল্যায়লা। প্লিজ তুমি দয়া করে সামনে গিয়ে বসো। তাহলে আমি একটু আরাম করে পা উঠিয়ে বসে যেতে পারবো। ”

কথাটুকু বলেই ইসাম বিড়ালের মতো আকুতিভরা দৃষ্টি নিয়ে ল্যায়লার দিকে তাকায়। ল্যায়লা আর কথা না বলে ফাতিহর পাশের সিটে বসতে বসতে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

” নাটকবাজ। ”

ল্যায়লার কথা ফাতিহর কর্ণগোচর হয় না। সে একদিকে ফিরে সামান্য হেসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

__________

কাশবাহ বাব ওউরিকা নামক এই দূর্গম, নৈমিত্তিক হোটেলটি আন্দ্রে হেলার গার্ডেন থেকে ১০ কি.মি এবং মারাকেশ মেনারা বিমানবন্দর থেকে ৪১ কি.মি দূরে। হোটেলে পৌঁছাতে তাদের আরও ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। ইসাম অনেকক্ষণ আগেই পিছনে ঘুমিয়ে পড়েছে। ল্যায়লাও হয়তো বেশ ক্লান্ত ছিলো তাই বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারে নি। জানালায় মাথা হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

ফাতিহ হঠাৎ শান্ত দৃষ্টি মেলে একবার পাশে তাকায়। মুহূর্তেই সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। আবার সে পাশ ফিরে ল্যায়লার দিকে তাকায়। চোখ বুজেও যেন তার ঘন কালো নেত্র পল্লবের মাঝে সে একঝুলি মন খারাপের গল্প জমিয়ে রেখেছে। এরাবিক ভাষায় ল্যায়লা অর্থ মধ্যরাত। কারো নামের অর্থ তার জীবনে কতখানি প্রভাব ফেলে তা সম্পর্কে ফাতিহ অবগত নয়। কিন্তু ল্যায়লা আর গভীর মন খারাপ নামক অনুভূতি যে একই সুতোয় বাধা তা নিয়ে সে নিশ্চিত।

ল্যায়লার কোলে থাকা ক্যামেরাটা আচমকা পড়ে যেতে নিলেই ফাতিহ তা একহাত বাড়িয়ে ধরে ফেলে। সে সতর্কতার সহিত তা আবার আগের জায়গায় রাখতে নিলেই ল্যায়লা হঠাৎ আতংকিত সুরে না বলে চোখ মেলে। ফাতিহ বিব্রত হয়ে পড়ে। সে ভাবে ক্যামেরা রাখতে নেওয়ার সময় সে হয়তো ভুল করে ল্যায়লার ঘুমের ডিস্টার্ব করেছে। কিন্তু পরক্ষণেই সে লক্ষ্য করে ল্যায়লার ভাবমূর্তি দ্বারা বিরক্তি না উল্টো আতংকিত মনে হচ্ছে। ফাতিহ ধীর স্বরে প্রশ্ন করে,

” আর ইউ ওকে? ”

ল্যায়লা একমুহূর্তের জন্য ফাতিহর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে জানালার বাহিরে নিবদ্ধ করে। তার নিজের এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে হাতের তালুতে নিজের নখ দাবিয়ে দেওয়াটা ফাতিহর দৃষ্টিগোচর হয় না। গতকাল থেকে তার এই মেয়ের প্রতি ধারণা ছিলো যে এই মেয়ে মহাবিপদ সংকেত ১০ এর অনুরূপ। কিন্তু এই মুহুর্তে তার ধারণা পাল্টেছে। এখন তার মনে হচ্ছে সে তার পাশে রহস্যের চোরাবালি নিয়ে ঘুরছে।

চলবে…

[ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here