অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৩.

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩.

ধীরে ধীরে চোখ খুলে ল্যায়লা। চারিদিক বেশ ঝাপসা লাগছে তার। ধীরে ধীরে তার চোখের সামনে সব স্পষ্ট হয়ে আসে। তার মুখের উপর সামান্য ঝুঁকে তার নাম ধরে ডাকছে একজন পুরুষ। পুরুষটির মুখে মাস্ক পড়া দেখে ল্যায়লা ঠিক চিনতে পারছে না তাকে। সে কপাল কুচকে তাকিয়ে রয়। তা দেখে সাথে সাথে পুরুষটি নিজের মাস্ক খুলে ফেলে আর একহাত ল্যায়লার মাথায় রেখে ইংরেজিতে প্রশ্ন করে,

” তুমি ঠিক আছো? আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। ”

ল্যায়লা সাথে সাথে একহাতে ফাতিহর গাল বরাবর ঘুষি মেরে বলে,

” তুমি? তোমার সাহস কি করে হয় আমাকে ছোঁয়ার? ”

ফাতিহ হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। ল্যায়লা কথাটুকু বলে উঠে বসে। চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে দেখে সে। একটি ছোট এক কামরার ঘরের এক কোণে একটি চৌকির ন্যায় খাটের উপর সে শুয়ে আছে। তার পাশেই এতক্ষণ ফাতিহ বসা ছিলো যাকে আপাতত সে ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। তাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে গতকালে চূড়ায় দেখা অপর আগুন্তকঃ এবং নতুন আরেকজন আগুন্তকঃ। তাদের দুজনের চোখেই বিস্ময় পরিলক্ষিত হচ্ছে।

ল্যায়লা চোখ কুচকে নিজের মাথা চেপে ধরে। হঠাৎ উঠে বসায় তার মাথার ভেতরটা ভনভন করছে। সে ইংরেজিতে প্রশ্ন করে,

” আমি এখানে কি করছি? তোমরা আমাকে কোথায় এনে আটকে রেখেছো? উদ্দেশ্য কি তোমাদের? ”

ফাতিহ নিজের রাগ সংবরন করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। চোখের ইশারায় ইসামকে কিছু একটা বলে। ইসাম মাথা নেড়ে তার পাশের লোকটাকে ধীর স্বরে কিছু একটা বলে তাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। ল্যায়লা সম্পূর্ণ ঘটনাটা সন্দিহান দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে।

ইসাম বেরিয়ে যেতেই ফাতিহ এগিয়ে গিয়ে দরজাটা চাপিয়ে দেয় কিছুটা। তারপর ল্যায়লার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কিন্তু নিচু স্বরে বলে,

” শুনো মেয়ে। ভোর বেলা আমার মুখে জ্যাকেটটা ছুঁড়ে আসার ফলস্বরূপ অতি ঠান্ডায় তুমি অনেকটা পথ এসে আবার জ্ঞান হারাও। এবং এই বাড়িটা যেই বারবারিয়ান ভদ্র লোকের তিনি তোমাকে পেয়ে নিজের বাসায় নিয়ে আসে। ঠান্ডায় তোমার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিলো। তারওপর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় লোকটা ঘাবড়ে যায়। আমি আর ইসাম নিচে নামার পথে বোতলে পানি নেওয়ার জন্য এই লোকের বাসায় আসি। তখন ইসাম বাহির থেকে বাসার ভেতরে তোমার ক্যামেরা লক্ষ্য করে। আমরা ভাবি হয়তো তুমি কোনো বিপদে পড়েছো। তাই বাঁচাতে এসে দেখি তোমার জ্ঞান নেই আর লোকটা ভয়ে তটস্থ। ”

ল্যায়লা একধ্যানে সব কথা শুনে। ফাতিহ এবার বিদ্রুপের সুরে হেসে বলে,

” আর তোমাকে দ্বিতীয় বারের মতো বাঁচাতে আসার ফল তো পেয়েই গেলাম। ”

ল্যায়লা কিছু বলতে নিবে কিন্তু তার আগেই তার কাশি পায়। ঠান্ডা হয়তো তার বুকে বসে গিয়েছে। ল্যায়লা কাশতে কাশতে আশেপাশে তাকিয়ে পানি খুঁজে। ফাতিহ তার সামনে একটি পানির বোতল এগিয়ে দেয়। ল্যায়লা একবার পানির বোতলটার দিকে তাকায় আবার ফাতিহর দিকে। ফাতিহ স্পষ্ট দেখতে পায় ল্যায়লার চোখেমুখে অবিশ্বাস এবং তার থেকে পানির বোতল নেওয়ার অনাগ্রহ। সে বিরক্ত হয়। এখনো এই মেয়ের এতো অবিশ্বাস? সে পানির বোতলটা ল্যায়লার পাশে রেখে অপরদিকে ফিরে নিজের ব্যাগ কাধে তুলে নেয়।

ল্যায়লা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিজের কাশি কমার। কিন্তু কমছে না দেখে সে বাধ্য হয়ে চোখমুখ খিচে বোতল থেকে কিছুটা পানি পান করে সে। এতে সে কিছুটা শান্ত হয়। ফাতিহ নিজের মাস্ক পড়ে নিতে নিতে স্বাভাবিক স্বরে বলে,

” বারবার ঠান্ডায় জ্ঞান হারিয়ে যদি মানুষের উপর বোঝ না হতে চাও তবে তোমার পাশে থাকা জ্যাকেটটা তুলে পড়ে নাও। আর এখন কোনো ঝামেলা ছাড়া চুপচাপ আমাদের সাথে নিচে যাবে। একবার সমতলে পৌঁছে গেলে তোমার যেখানে ইচ্ছে সেখানে চলে যেও। ”

ফাতিহর বলা প্রথম কথাটুকু ল্যায়লার গায়ে লাগে খুব৷ সে কখনোই কারো উপর বোঝ হতে চায় না। কোনো মূল্যেই না। সে চুপচাপ জ্যাকেটটা তুলে পড়ে নেয়। তারপর নেমে বিছানার পাশে থাকা তার ব্যাগটা কাধে এবং ক্যামেরাটা গলায় ঝুলিয়ে নেয়। ফাতিহ সম্পূর্ণ দৃশ্যটা দেখে আড়ালে সামান্য হাসে। তার ধারণা সঠিক হয়েছে। এই মেয়ে একমাত্র কঠিন ভাষা বুঝে। বেরিয়ে যাওয়ার আগ মুহুর্তে ফাতিহ হঠাৎ পিছনে ফিরে ল্যায়লার দিকে তাকায়। ল্যায়লা কিছু বুঝে উঠার আগেই ফাতিহ একটি কানটুপি তার মাথায় পড়িয়ে দিয়ে বলে,

” সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এসেছে। বাহিরের তাপমাত্রা এখন আরো নিচে নামবে ধীরে ধীরে। আর এই সময় ঠান্ডা বাতাস কান দিয়ে গেলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। শুধু শুধু আমার জন্য ঝামেলা তৈরি না করে এটা পড়ে থাকো। ”

কথাটুকু বলেই ফাতিহ বেরিয়ে যায়। ল্যায়লা বিরক্ত হয় কিছুটা। সে যা করতে চায় না তা-ই তার করতে হচ্ছে।

__________

বাড়িটা থেকে বের হতেই ল্যায়লা দেখে তিনজন পুরুষ একসাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ল্যায়লার চোখ যায় ফাতিহর দিকে। সে হেসে কিছু একটা বলছে। ল্যায়লা চুপচাপ এগিয়ে যায় তাদের দিকে। ফাতিহ আর ইসামের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা বারবারিয়ান লোকটা হেসে তাশেলহিত ভাষায় ল্যায়লাকে কিছু একটা বলে। ল্যায়লা কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। ফাতিহ হেসে লোকটাকে তাশেলহিত ভাষায় জবাব দেয়,

” আসলে ও বারবারিয়ান দের তাশেলহিত ভাষা বুঝে না। কিন্তু আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ ওর খেয়াল রাখার জন্য। ”

__________

সেই বারবারিয়ান লোকটার থেকে বিদায় নিয়ে ফাতিহ, ল্যায়লা, ইসাম নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে কিছুক্ষণ হলো। ফাতিহ তাদের তুলনায় কিছুটা সামনে হাঁটছে। পিছনে রয়েছে ইসাম এবং ল্যায়লা। ইসাম হঠাৎ ল্যায়লার পাশে এসে হাঁটতে থাকে। ল্যায়লা আড়চোখে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। ইসাম হেসে ইংরেজিতে বলে,

” হ্যালো। আমি ইসাম। ”

ল্যায়লা জবাব দেয় না। সে নিজের মতো চলতে থাকে। ইসাম আবার বলে,

” বাই দ্যা ওয়ে, একটা প্রশ্ন ছিলো। তোমাকে এখানে এসে মরার বুদ্ধি কে দিয়েছে? কারণ যে দিয়েছে সে খুব ভালো বুদ্ধি দিয়েছে। আজকালকার জেনারেশনের ছেলে মেয়েরা দেখি হয় ইদুরের বিষ খেয়ে বা ফিনাইল খেয়ে সুইসাইড করে। ইয়াক! সেই তুলনায় তোমার রুচি ভালো। ভালো জায়গা চুজ করেছো। ”

ল্যায়লা চোখ গরম করে তাকায় ইসামের দিকে। সাথে সাথে ইসাম কিছুটা দূরে গিয়ে নিজের একহাত গালে রেখে বলে উঠে,

” দেখো। ফাতিহকে মারো সমস্যা নেই। কিন্তু আমাকে মারার কথা চিন্তাও করবে না। তোমার সুইসাইড কেস যেমন হাই বাজেট তেমন আমার এই চেহারাও অনেক হাই বাজেটের। তোমার ধারণা নেই কতো মেয়ের হৃদয়ে বাস করে আমার এই হাই বাজেট ভিজুয়্যাল। ”

ল্যায়লা এবারও পাত্তা না দিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। ইসাম আশাহত হয়। মেয়েটা তার সাথে সাইলেন্ট মুডে চলে গেলো কেন? ফাতিহর সাথে তো হাই ভলিউম মুডে থাকে। ইসাম কিছুটা দৌড়ে এসে ফাতিহর সাথে দাঁড়ায়। ফাতিহ হাঁটতে হাঁটতে বিদ্রুপ করে এরাবিকে প্রশ্ন করে,

” ভাও পেলি না? ”

ইসাম কলার নাচিয়ে বলে,

” আমি ওর থেকে পাত্তা খুঁজছিলাম না। ওর মতো এগ্রেসিভ মেয়েদের থেকে আমি দূরে থাকি। কিন্তু যেহেতু ওর প্রতি আমার একটু মায়া লেগেছে তাই ওকে সিস্টার লিস্টে রেখেছি আমি। ”

ফাতিহ হেসে বলে,

” এই নতুন লিস্ট কবে খুলে বসলি আবার? ”

” যেই মুহুর্তে তুই ওই বারবার লোকের কাছে ওকে নিজের স্ত্রীর পরিচয় দিলি। ”

ইসামের কথা শুনে ফাতিহ সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে ল্যায়লার দিকে তাকায়। যে আপন মনে হাঁটতে ব্যস্ত। ভাগ্যিস এই মেয়ে তাদের ভাষা বুঝে না। ফাতিহ সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

” লোকটাকে আমার তেমন একটা সুবিধার মনে হচ্ছিলো না। মেয়েটাকে নিয়ে তার উদ্দেশ্যও বেশি একটা ভালো ঠেকছিলো না আমার। তাই ঝামেলা বিহীন ভাবে ওইখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এমনটা বলেছি। দেখলি না স্ত্রীর পরিচয় দেওয়ার পর লোকটার মুখ কেমন চুপসে গিয়েছিল? ”

” তা ঠিক। বারবারদের সাথে শুধু শুধু ঝামেলায় না জড়ানোই ভালো। ভাগ্য ভালো যে এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের চিনতে পারে নি। নাহলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হতো। ”

তাদের কথার মধ্যেই হঠাৎ কিছু একটা গড়িয়ে পড়ার শব্দ হয়। ফাতিহ আর ইসাম পাশে তাকিয়ে দেখে ল্যায়লা গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। দুজনেই সাথে সাথে চিৎকার করে উঠে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here