অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ২.

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২.

ল্যায়লার তাবুর পাশে আরেকটা তাবু টাঙিয়ে সেখানে ইসাম আর ফাতিহ অবস্থান করছে। রাতের শেষ প্রহর পেরিয়ে ধীরে ধীরে নতুন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ইসাম তাবুতে একপাশে ফিরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। ফাতিহ তাবু থেকে বের হয়ে পর্বত চূড়ার সীমানার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সারারাত সে দু চোখের পাতা এক করে নি। তার মনে কিঞ্চিৎ চিন্তা ছিলো এই মেয়ের জ্ঞান ফিরতেই যদি সুযোগ বুঝে পাহাড় থেকে ঝাপ দেয়? তুষারপাত এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। তবুও পশ্চিম আকাশে কাঙ্ক্ষিত সূর্যের দেখা মিললো না। দেখা পাওয়ার কথাও না। শীতের সময় এখানে সূর্যের দেখা পাওয়া দুষ্কর।

রাতে কথায় কথায় ইসাম ফাতিহকে ল্যায়লা নামক মেয়েটি সম্পর্কে আরেকটি তথ্য জানায়। তা হলো আজ মেয়েটির জন্মদিন। তার পাসপোর্টের বার্থ ইয়ার অনুযায়ী আজ সে ২০ বছর পেরিয়ে ২১ এ পা দিলো। ফাতিহ ভেবে পায় না একটা মানুষ নিজের জন্মদিনের দিনই কেনো নিজের জীবন শেষ করে দিতে চাইবে? সে আর বেশিক্ষণ ভাবার সময়ও পায় না। আচমকা সে তাবু হতে মেয়েটির কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।

ফাতিহ তৎক্ষণাৎ সেই তাবুর সামনে যেতে নেয়। কিন্তু তার আগেই ল্যায়লা তাবু থেকে বেরিয়ে পড়ে। আর সাথে সাথে সে ফাতিহর মুখোমুখি হয়। ফাতিহ ইংরেজিতে নম্র স্বরে প্রশ্ন করে,

” ঠিক আছো? বেশি ঠান্ডা লাগছে? ”

ল্যায়লা সাথে সাথে ক্ষুব্ধ বাঘিনীর মতো ফাতিহর দিকে তেড়ে যায়। কাঠখোট্টা স্বরে সে বলে,

” তোমার সাহস কিভাবে হয় আমার পথের বাধা হওয়ার? কে তুমি? ”

ফাতিহর শীতল চেহারা মুহুর্তেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। এই মেয়ে নম্র ভাষা বুঝে না তা ইতিমধ্যেই তার জানা হয়ে গিয়েছে। ফাতিহ ক্রোধান্বিত স্বরে সুধায়,

” আমাকে আগে বলো তুমি কে? এখানে মরতে কেনো এসেছো? পরিবার পরিজন বলতে কিছু নেই তোমার? এতো বড় স্টেপ নেওয়ার আগে একবারও তাদের চিন্তা মাথায় এলো না? ”

” আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তোমার এতো আগ্রহ কেনো? ”

” তোমার কিংবা তোমার ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি কেবল ভাবছি তোমার পরিবার এবং কাছের মানুষের কথা। যে মরে যায় সে সকল কিছু থেকে মুক্তি পেলেও তার পিছনে ফেলে যাওয়া মানুষগুলো সেই বেদনার বেড়াজাল চিরে কখনো বের হতে পারে না। ”

ল্যায়লার রাগ এবার আকাশচুম্বী পর্যায় পৌঁছায়। সে কটমট চোখে ফাতিহর দিকে তাকিয়ে বলে,

” শুনো ছেলে! খবরদার আর জীবনে আমার সামনে আসবে না। ”

ফাতিহর রাগ চরমে পৌঁছায়। এইটুকু মেয়ে কিনা তার সাথে এই ভাষায় কথা বলছে? গুনে গুনে এই মেয়ে তার থেকে নয় বছরের ছোট। অথচ কথার ধরন কি বেপরোয়া! তাদের চেঁচামেচিতে ইসামের ঘুম ভেঙে যায়। সে তাবু থেকে বের হতেই দেখতে পায় ল্যায়লা এবং ফাতিহ একে অপরের দিকে বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইসাম হালকা গলা ঝেড়ে আকর্ষণ নেওয়ার চেষ্টা করে। সাথে সাথে দুজন তার দিকে তাকায়। ল্যায়লা এবার আর কোনো কথা না বলে নিজের তাবুতে ফিরে গিয়ে নিজের ব্যাগ এবং ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। নিচে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সে সামনে এগিয়েও আচমকা থেমে যায়। ফিরে এসে নিজের গায়ের বড়সড় জ্যাকেটটা খুলে ফাতিহর দিকে ছুড়ে মেরে আবার নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সে। ফাতিহর এবার ধৈর্যের সীমা ভাঙ্গে। সে পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলে,

” অকৃতজ্ঞ মেয়ে। যেখানে ইচ্ছে গিয়ে মরো তুমি। কিন্তু আমার সামনে জীবনেও মরতে আসবে না। ”

ল্যায়লা ফাতিহর কথাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পর্বতের ঢালু পথ পেরিয়ে নিচে নামার জন্য অগ্রসর হয়। ইসাম এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব ঘটনা দেখছিলো। এবার সে বলে উঠে,

” তোর এভাবে বলা উচিত হয় নি ফাতিহ। মেয়েটা হয়তো কষ্ট পেয়েছে। ”

ফাতিহ ইসামের উপর বিরক্ত হয়। প্রশ্ন করে,

” তোর এই মেয়েকে নিয়ে কখন থেকে চিন্তা শুরু হলো? ”

” কাল রাতে তুই ওর জীবন বাঁচানোর পর থেকেই। সারারাত এই মেয়ের জন্য আমরা জেগে ছিলাম। একটু তো মায়া জন্মাবেই তাই না? ”

” এতো মায়া জন্মালে এই মেয়ের পিছু নে। আমাকে জ্বালাবি না। ”

কথাটা বলেই হনহনিয়ে ফাতিহ তাবুর ভেতর প্রবেশ করে। ইসাম কিছুক্ষণ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ফাতিহর পিছু পিছু তাবু গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু মনে মনে ল্যায়লাকে নিয়ে কিছুটা চিন্তা রয়েই যায়।

__________

অ্যাটলাস পর্বতে উঠার পথে পাহাড়ের গায়ে হাতে গোনা কিছু সংখ্যক বাড়ির দেখা পাওয়া যায়। সেই বাড়ি গুলোতে এখানের স্থানীয় বারবাররা থাকে।

প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ফাতিহ আর ইসাম কেবল অর্ধেক পথ নেমেছে। এখনো অর্ধেক পথ বাকি। এখন তারা কিছুটা সমান জায়গায় পৌঁছেছে। সামনেই একটি ছোট ইটের তৈরি ঘর দেখা যাচ্ছে। তা দেখে ইসাম ফাতিহকে উদ্দেশ্য করে বলে,

” ফাতিহ। আমাদের কাছের সম্পূর্ণ পানি শেষ। এখনো অর্ধেক পথ বাকি। এই বাড়ি থেকে পানি নিয়ে নেই কিছুটা। ”

ফাতিহ একবার সামনের বাড়িটার দিকে তাকায়। বাড়ির দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। বাড়ির বাইরে কেবল একটি ব্যাটারি চালিত লাইট জ্বলছে। ফাতিহ বলে,

” তুই গিয়ে তাহলে পানি নিয়ে আয়। আমি এখানে অপেক্ষা করছি। ”

ইসাম সম্মতি জানিয়ে যেতে নেয় তখনই ফাতিহ পিছন থেকে তাকে ডাক দেয়। ইসাম তাকাতেই ফাতিহ বলে,

” মাস্ক পড়ে নে। আর মাথায় ক্যাপও দিয়ে নে। ”

ইসাম প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো। সে তাড়াতাড়ি মাস্ক আর ক্যাপ বের করে পড়ে নেয়। ফাতিহও একই কাজ করে। কেউ যেনো তাদের না চিনতে পারে এই ব্যাপারে বেশ সতর্ক থাকতে হবে তাদের।

__________

বার কয়েক দরজার কড়া নাড়ার পর একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ দরজা সামান্য ফাঁক করে মাথা বের করে ভ্রু কুচকে ইসামের দিকে তাকায়। ইসাম সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলে,

” আসসালামু আলাইকুম। আমাদের কাছে পানি শেষ হয়ে গিয়েছে। আর ঢালুতে পৌঁছাতেও এখনো অর্ধেক পথ বাকি। আমাদের কিছুটা পানি দেওয়া যাবে? ”

লোকটা কোনো কথা না বলে ইসামের হাতের বোতল নিয়ে দরজা ভিতর থেকে লাগিয়ে দেয়। ইসাম এতে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তাকে কি দেখতে খুব ভয়ংকর লাগছে নাকি? সাধারণত তো পর্যটকরা বারবারদের ভয় পায়। এখানে তো উল্টো ঘটনা। একজন বারবার তাকে ভয় পাচ্ছে। ইসামের ভাবনার মাঝে দরজা সামান্য ফাঁক করে লোকটা মাথা বের করে তার দিকে বোতল এগিয়ে দেয়। তারপর তড়িৎগতিতে দরজা লাগিয়ে দেয়। দরজা লাগানোর আগে ইসামের চোখ ঘরের ভিতরের দিকে পড়ে এক মুহুর্তের জন্য। সে চুপচাপ পানির বোতল নিয়ে ফাতিহর কাছে ফিরে যায়।

ফাতিহ ইসামের হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে মাস্ক নামিয়ে কিছুটা পানি পান করে নেয়। ইসাম কিছুটা ভাবুক স্বরে বলে,

” লোকটা বেশ অদ্ভুত ছিলো। ”

ফাতিহ গলা ভিজিয়ে বলে,

” কেমন অদ্ভুত? ”

” সালামের জবাব পর্যন্ত দিলো না। এমনকি একটা কথাও বললো না। ”

ফাতিহ হেসে বলে,

” ভালোই তো। বারবারদের সাথে কথা বলে তো আমাদের কোনো লাভ নেই। এখন চল। ”

কথাটুকু বলেই ফাতিহ লম্বা লম্বা কদম ফেলে সামনের দিকে এগোয়। ইসামও কিছু একটা ভাবতে ভাবতে ফাতিহর পিছু পিছু বেশ খানিকটা নেমে আসে। আচমকা সে বিস্ফোরিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠে,

” ল্যায়লা! ”

ফাতিহর কদম থেমে যায়। সে ভ্রু কুচকে ঘাড় ঘুরিয়ে ইসামের দিকে তাকায়। বিরক্তি মিশ্রিত সুরে বলে,

” তুই এখনো ওই মেয়েকে নিয়ে ভাবছিস? ওই মেয়ে জাহান্নামে যাক, আমাদের তাতে কি? ”

ইসাম আতংকিত সুরে বলে,

” একটু আগে ওই বারবারের বাসার দরজার এককোণ দিয়ে আমি তার বাসার ভেতর কিছুটা দেখতে পাই। সেখানে ল্যায়লার ক্যামেরা দেখেছি আমি। ”

ফাতিহ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,

” সেটা তো আমাদের দেখার বিষয় না। ”

ইসাম দু কদম এগিয়ে এসে বলে,

” ফাতিহ, আমার মনে হচ্ছে ল্যায়লা ওই বারবারের ঘরে আছে। ”

” থাকুক। বারবাররাও বিরক্ত হয়ে কিছুক্ষণ পর এই পাগলকে নিজের রাস্তায় ছেড়ে দিবে। ”

ইসাম বিরক্ত হয়। সে বলে,

” তুই আমার কথা বুঝতে পারছিস না। যদি ওই বারবার ল্যায়লাকে আটকে রাখে? মেয়েটা ভীনদেশী। আমি আর তুই ছাড়া হয়তো কেউ ওকে চিনেও না, যে এসে ওকে বাঁচাবে। ”

ফাতিহ ইসামের কথাকে পাত্তা না দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। খানিকটা দূরে গিয়ে সে রাগে পায়ের কাছে থাকা বরফগুলোকে লাথি মারে। বিরক্তির সুরে সে উপরে তাকিয়ে বলে উঠে,

” আল্লাহ, এ কোন বিপদ এনে ঝুলালে গলায়? এই মেয়ের আমার সামনেই কেনো বিপদে পড়তে হবে? এটাই শেষ বার। আর জীবনেও আমি কেউ মরে গেলেও ফিরে তাকাবো না, সাহায্য তো দূরের বিষয়। ”

এটুকু বলেই সে ইসামের দিকে হেটে আসতে থাকে। ইসামের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। তার বিশ্বাস ছিলো ফাতিহ কাউকে বিপদে ফেলে একা যেতেই পারে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here