অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ১. ( অবতরণিকা

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১. ( অবতরণিকা )

উত্তর আফ্রিকার মাগরেবের একটি পর্বতশ্রেণী হলো অ্যাটলাস পর্বতমালা। মরক্কো, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ার মধ্য দিয়ে প্রায় ২৫০০ কি.মি প্রসারিত এটি। এই অ্যাটলাস পর্বতমালার সর্বোচ্চ চূড়া হলো তুবকাল। যার উচ্চতা ৪১৬৭ মিটার। বলা হয়ে থাকে যে সম্পূর্ণ মরক্কোতে এটিই সবথেকে উঁচু পর্বত।

বছরের শেষ এবং নতুন বছরের আগমন লগ্ন হিসেবে এখন শীত ঋতু বিরাজ করছে মরক্কোতে। তুষারের চাদরে ঢেকে আছে সম্পূর্ণ অ্যাটলাস পর্বত। সেই বরফে ঢাকা পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়া তুবকালের উপরে দাঁড়িয়ে আছে একজন যুবতী। একে তো শীতের রাত তার উপর পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়া হওয়ায় ঠান্ডার পরিমাণ এখানে অত্যাধিক অনুভব হচ্ছে। কিন্তু সেই শীতের তীব্রতা যেন মেয়েটিকে কোনো ভাবেই ছুঁতে পারছে না। গত দু’দিন হাইকিং করে পর্বতের চূড়ায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে সে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ের হাইকিং এর পরেও কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই তার মুখে। সে নিষ্প্রাণ দৃষ্টি মেলে একবার নিজের হাতের স্মার্ট ওয়াচের দিকে তাকায়। তাপমাত্রা এই মুহুর্তে -৫°। মেয়েটি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে আপনমনে কাউন্ট ডাউন শুরু করে।

” ১০, ৯, ৮, ৭, ৬, ৫, ৪, ৩, ২, ১। ”

এটুকু বলেই সে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে তাকায়। ঘড়ির কাটা এখন ঠিক বারোটা ছুঁয়েছে। তার ঠোঁটের কোণে বেদনার হাসি ফুটে উঠে। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,

” হ্যাপি বার্থডে ল্যায়লা। ”

এটুকু বলে সে এক পা দু পা করে পর্বতের সীমানার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পর্বতের এককোণে পড়ে রয় তার ব্যাগপ্যাক এবং একটি ক্যামেরা। পর্বতের চূড়ার একদম প্রান্তে এসে দাঁড়ায় মেয়েটি। আর এক পা এগোলেই সোজা মৃত্যুকূপের অতলে হারিয়ে যাবে। তুষারের চাদরের গহীনে তার লাশের হদিসও মিলবে না। মৃত্যু ফাদের দিকে একবার তাকিয়ে নিজের দু’হাত মেলে দেয় সে। ধীরে ধীরে তার চোখ জোড়া বুজে আসে। মুহুর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠে একটি দৃশ্য। দৃশ্যটির মূল কেন্দ্র বিন্দু হচ্ছে একটা মৃত্যুকে ঘিরে। যেই মৃত্যুর দৃশ্য অত্যন্ত বীভৎসকর। মেয়েটি চোখ খুলে তাকায়। কাপা কাপা গলায় বলে উঠে,

” এইটা আমার জীবনের সবথেকে আনন্দের জন্মদিন হতে চলেছে। নিজেকে আমি নিজের জীবনের সবথেকে সুন্দর এবং কাঙ্ক্ষিত উপহার দিবো আজ। যা কেউ কখনো আমায় দিতে পারে নি। মুক্তি। আমার আর মুক্তির মাঝে এখন কেবল এক কদমের ফারাক। ”

কথাটা বলেই মেয়েটা নিজের শরীরের ভার সামনের দিকে ছেড়ে দেয়। মৃত্যুকে আলিঙ্গনের ঠিক আগ মুহুর্তে সে অনুভব করে কেউ একজন তাকে পিছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে তার মৃত্যু ফাঁদ থেকে তাকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা হকচকিয়ে যায়। সেই হাতের বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করে। চূড়ার প্রান্ত থেকে কিছুটা দূরে আসতেই সেই পুরুষালি হাত জোড়া থেকে মুক্তি পায় সে। সাথে সাথে ক্রোধে ফেটে পড়ে মেয়েটি পিছনে ফিরে সেই আগুন্তকের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।

আগুন্তক হতবিহ্বল চোখে তার দিকে ফিরে তাকায়। সাথে সাথে মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠে,

” হাউ ডেয়ার ইউ? ”

মুহুর্তেই আগুন্তকের চেহারার ভাব পরিবর্তিত হয়। বিস্ময়ের জায়গায় তার চেহারায় নেমে আসে ক্রোধের ছাপ। এরাবিক ভাষায় আগুন্তক মেয়েটিকে শাসিয়ে বলে,

” হাল ফাকদতা আকলাকা? মাদহা কুন্ত সাতাফালু? ”

যার অর্থ,

” তোমার কি মাথা নষ্ট? কি করতে যাচ্ছিলে? ”

মেয়েটি কোনো জবাব দেয় না। ফোসফোস করতে থাকে। একবার সে তার সামনে দাঁড়ানো আগুন্তকের দিকে তাকায়। পরক্ষণেই আবার রক্তচক্ষু নিয়ে সেই আগুন্তকের থেকে কয়েক হাত পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন পুরুষের দিকে তাকায়। মেয়েটি এবার হাতের আঙ্গুলে তুড়ি বাজিয়ে দু’জনকে শাসিয়ে বলে উঠে,

” ডোন্ট ডেয়ার টু ইন্টারফেয়ার ইন মাই ম্যাটার। স্টে এওয়ে ফ্রম মি। ”

আগুন্তক দুজন একে অপরের দিকে তাকায়। তারা কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটা দৌড়ে গিয়ে আবার ঝাঁপ দিতে নেয় পর্বত থেকে। আবারও সেই একই আগুন্তক তাকে দৌড়ে গিয়ে বাধা দেয়। এবার সে আর মেয়েটাকে ছাড়ে না। তার দু’হাত কোমরের পিছনে নিয়ে শক্ত বন্ধনে তাকে আবদ্ধ করে রাখে। মেয়েটা সাথে সাথে গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করতে করতে বলে উঠে,

” লিভ মি! আই সেইড লিভ মি। ”

সাথে সাথে সেই আগুন্তকঃ পুরুষটি ঝাঁঝালো স্বরে এবার ইংরেজিতে বলে উঠে,

” জাস্ট শাট আপ। ইউ আর আউট অফ ইউর মাইন্ড রাইট নাও। আই ওন’ট টেক এনি রিস্ক। ”

” দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস। ”

কথাটুকু বলেই মেয়েটা আবার ছোটার জন্য ছটফট ও চেঁচামেচি করতে থাকে। অনেকক্ষণ চেষ্টার পরেও ব্যর্থ হয়ে ক্রোধে এবার মেয়েটির দু গাল ছাপিয়ে অঝোরে জল নামে। কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটার শরীর হেলে পড়ে সেই আগুন্তকের উপর। সাথে সাথে দুজন আগুন্তক আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মেয়েটা জ্ঞান হারিয়েছে বুঝতে পেরে তাকে একহাতে আঁকড়ে ধরে তার চেহারার দিকে তাকাতেই সেই আগুন্তকঃ দেখে মেয়েটার নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তার পিছনে থাকা পুরুষটি এরাবিক ভাষায় চেঁচিয়ে উঠে,

” ফাতিহ! এই মেয়ের কি হলো? ”

ফাতিহ হতভম্ব ও বিচলিত হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। গালে আলতো করে এক দুটো থাপ্পড় দিয়ে মেয়েটিকে ডাকার চেষ্টায় ব্যস্ত সে। নাহ। মেয়েটা চোখ খুলছে না। কি এক মুশকিল! ফাতিহ একবার চারিদিকে তাকায়। তুষারপাত ধীরে ধীরে বাড়ছে বৈকি কমছে না। সে চিন্তিত স্বরে বলে,

” এই অবস্থায় তো এই মেয়েকে নিয়ে উপত্যকায় পৌঁছানোও সম্ভব না। প্রচুর তুষারপাত হচ্ছে। পাহাড়ের গা এখন সম্পূর্ণ পিচ্ছিল। ”

তার পাশে থাকা পুরুষটি বলে,

” তাহলে কি করবি? ”

ফাতিহ একহাত বাড়িয়ে মেয়েটার গাল ছুঁয়ে দেখে। বরফে জমে একদম ঠান্ডা হয়ে আছে। এইবার মেয়েটাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার পরখ করে সে। মনে মনে সে নিশ্চিত হয় এই মেয়ের মাথা খারাপ। নাহয় এই তুষারপাতের মধ্যে কেউ গরমের পোশাক না পড়ে পর্বতে আসে নাকি? অবশ্য ফাতিহ যতদূর বুঝতে পারছে, এই মেয়ে এখানে মরার উদ্দেশ্যে এসেছে। আর মৃত পথযাত্রীর কাছে শীত গ্রীষ্ম সবই এক। সে কিছুটা তাড়া দেখিয়ে তার পাশের জনের উদ্দেশ্যে বলে,

” ইসাম। এখানেই তাবু টানানোর ব্যবস্থা কর তাড়াতাড়ি। শি নিডস হেল্প। ”

ইসাম মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। সে তাড়াতাড়ি ব্যস্ত পায়ে নিজের কাধের ব্যাগপ্যাক থেকে তাবু টানানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র বের করে কাজে লেগে পড়ে। যতটা দ্রুত সম্ভব তাবু টাঙানো হতেই ফাতিহ মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে তাবুর ভিতরে প্রবেশ করে। তারপর দ্রুত গতিতে নিজের শরীরের জ্যাকেট খুলে মেয়েটার গায়ে দিয়ে দেয়। মেয়েটার এক হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে মালিশ করতে থাকে।

ইসাম তখনই বাহির থেকে স্বশব্দে বলে,

” ফাতিহ। মেয়েটা বাংলাদেশী। ”

ফাতিহ ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাবুর বাহিরে দাঁড়ানো ইসামের দিকে তাকায়। ইসামের সামনে মেয়েটার ব্যাগ, একটি ক্যামেরা এবং হাতে পাসপোর্ট। ফাতিহ বলে,

” এতক্ষণে বুঝতে পেরেছি। ”

” কি? ”

” এই মেয়ে অন্য দেশের হওয়ায় আমাদের দেশের শীতকালীন আবহাওয়ার সাথে অভ্যস্ত নয়। তার উপর ঠিকঠাক গরম কাপড় না পড়ে পাহাড়ের উপর চড়েছে। অতি নিম্ন তাপমাত্রায় চেতনা হারিয়ে ফেলেছে এবং নাক দিয়ে রক্ত এসে পড়েছে। ”

ইসাম চিন্তিত সুরে বলে,

” এটা কি চিন্তার বিষয় না? ”

ফাতিহকে কিছুটা শান্ত দেখায় এই মুহুর্তে। সে বলে,

” না। ওর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলে আপনাআপনি চেতনা ফিরে পাবে। ”

” আর রক্তপাত? ”

” সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে। ”

এটুকু বলে ফাতিহ নিজের ব্যাগপ্যাক থেকে একটা ব্ল্যাংকেট বের করে মেয়েটার সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে দেয়। তারপর কিছু টিস্যু দিয়ে তার নাক হতে গড়িয়ে পড়া রক্ত সাবধানে মুছে দেয়। কাজটুকু শেষ করেই ফাতিহ তাবু থেকে বেরিয়ে পড়ে। সে বের হয়ে দেখে ইসাম এখনো মেয়েটার ব্যাগ নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। ফাতিহ কিছুটা বিরক্ত প্রকাশের সুরে বলে,

” অপরিচিত কারো ব্যাগ ঘাটাঘাটি করা ঠিক না ইসাম। ”

ইসাম এবার ব্যাগটা রেখে দেয়। ফাতিহকে অনুসরণ করে সেও পর্বত চূড়ার সীমানা প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে বলে,

” আমি শুধু মেয়েটা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু শুধু নাম আর নাগরিকত্ব সম্পর্কেই জানতে পারলাম। ”

কথাটুকু বলে ইসাম ফাতিহর দিকে তাকায়। ফাতিহ ভাবলেশহীন ভাবে নিচের গভীর খাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ইসাম এবার কিছুটা হেসে বলে,

” মেয়েটার নাম ল্যায়লা। ল্যায়লা আমীর। সুন্দর না? ”

এবারও ফাতিহ নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকে। ইসাম কিছুটা মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে ঠাট্টার স্বরে বলে,

” নামটা সুন্দর হলেও মেয়েটার মাথায় সমস্যা আছে নিশ্চিত। মেয়েটার ব্যাগে একটা বোর্ডিং পাস দেখেছি। তিন দিন আগে ও মরক্কোতে পৌঁছেছে। কিন্তু ওর যদি উদ্দেশ্য সুইসাইড এটেম্পট করাই হবে তাহলে তো সেটা বাংলাদেশে করলেই পারতো। এতো দূর ভ্রমণ করে আবার হাইকিং করে এই পর্বতে এসেই কেন মরতে হবে? জীবনে প্রথম এমন হাই বাজেট সুইসাইডিক্যাল কেস দেখলাম। ”

ফাতিহ এবার নিজের নীরবতা লগ্ন ভেঙে শান্ত স্বরে বলে উঠে,

” আমার প্রিয় জায়গাটা মৃত্যুকূপে পরিণত হয়ে গিয়েছে দেখছি। ”

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here