চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা শেষ পর্ব

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
শেষ পর্ব

🍂🍂🍂

🍂বর্তমান🍂

ডায়েরি শেষ হতেই থম মেরে বসে রইলো নুর। এর পর কি হলো জানার আকাঙ্ক্ষা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে উঠে দরজা খুলতে নিতেই কানে এলো আযানের ধ্বনি। নুর দাড়িয়ে পড়লো। আগে নামাজ পড়াটাই বেশি জরুরি মনে হলো। সে ওযু করে এসে নামাজ পড়লো। নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ দোয়া করলো শুভ্রতা আর চন্দ্রের জন্য। নামাজ শেষে সে উঠে পা বাড়ালো তিলোত্তমার ঘরের উদ্দেশ্যে। ঘর থেকে বের হতেই দেখা মিললো তিলোত্তমার। সে হয়তো নিচে যাচ্ছিলো। তাকে দেখতেই তিলোত্তমা তার কাছে এলো।

~ডায়েরি পড়া শেষ?

নুর মাথা দোলালো।

~চা খাবি?

তিলোত্তমা সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে রান্না ঘরে গেলো। তার পেছন পেছন নুরও রান্না ঘর অব্দি গেলো। তিলোত্তমা চা বানাচ্ছে।

~ডায়েরির পরের থেকে শুনতে চাই। যা শুভ্রতা লিখতে পারেনি।

তিলোত্তমা চায়ের পাতিল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নুরের দিকে তাকালো। মলিন মুখে বলল,

🍂শুভ্রতা মৃত্যুর দিন🍂

মাগরিবের নামাজের পর কুরআন পড়ছে তিলোত্তমা। পড়া শেষে কুরআন তুলে রাখতেই আচমকা কেউ ঘরের দরজা একটানা ধাক্কাতে লাগলো। তিলোত্তমা ভড়কে গেলো। দরজা খুলতেই নজরে এলো রেনুর কান্নামাখা মুখশ্রী। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে এলো তার।

~ক..কি হয়েছে? কাঁদছো কেনো?
~আপামনির অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। জলদি মাহতাব ভাইরে কল দেন।

তিলোত্তমার মাথা কাজ করা যেনো বন্ধ হয়ে গেছে। দ্বিতীয় কথাটা তার কানে ঢুকেইনি। সে রেনু কে সামনে থেকে সরিয়ে দ্রুত শুভ্রতা আর চন্দ্রের রুমে গেলো। শুভ্রতা বিছানায় ছটফট করছে। চিত্রা তাকে জড়িয়ে ধরে এটা সেটা বলার চেষ্টা করছেনা। তার হাত পা মালিশ করছে রাত্রি। চন্দ্র সারা ঘরে পায়চারি করছে আর কাউকে কল করছে। কল রিসিভ হতেই সে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে গর্জে উঠলো। তিলোত্তমা সেদিকে কান দিলো না। সে ছুটে গেলো বান্ধবীর কাছে। শুভ্রতার নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। শ্বাস নিতে যেনো কষ্ট হচ্ছে তার। বারে বারে আর্তনাদ করে উঠছে সে।

~চ… চন্দ্র!

শুভ্রতার এক ডাকে ফোন পকেটে পুড়ে তার কাছে ছুটে এলো চন্দ্র।

~একটু ধৈর্য ধরো জান, আমি এখনি তোমাকে হাসপাতালে নিচ্ছি।

তাকে কোলে তুলতে চাইলো চন্দ্র। তার হাত ধরে বাঁধা দিলো শুভ্রতা। লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো,

~সময় নেই বেশি। একটু কাছে বসুন।

চন্দ্র সময় ব্যয় না করে শুভ্রতার হাত জোড়া নিজের হাতের মাঝে নিয়ে তার মাথাটা রাখলো নিজের কোলে। চন্দ্র করুন গলায় বলে উঠলো,

~এমন করে বলো না শুভ্রতা। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।
~বাঁচতে হবে চন্দ্র। নিজের জন্য… বাঁচতে হবে।
~নো! প্লীজ!

শুভ্রতা চিত্রা, তিলোত্তমা, রাত্রি আর রেনুর দিকে তাকালো। তখনই ঘরে প্রবেশ করলো অরণ্য, মাহতাব, অর্ণব, অনিকা আর উসমান। শুভ্রতা অরণ্যের দিকে চাইলো,

~ভাইয়া, আমার চন্দ্রের খেয়াল রেখো। তাকে সুন্দর, চঞ্চল, এক মায়াবতীর সাথে বিয়ে দিও। খেয়াল রেখো সে যেনো ওনাকে আমার মত না কাঁদায়। আর… আর নুরকে মাফ করে দিও।

বলেই দুর্বল হাসলো শুভ্রতা। অরণ্য আর অর্ণব শুভ্রতার এক পাশে বসলো। শুভ্রতা এক দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে চেয়ে রইলো। অর্ণব নিঃশব্দে কান্না করছে। তার একমাত্র কাছের মানুষ মারা যাচ্ছে। সে আবারো একা হয়ে যাচ্ছে। সে অসহায় গলায় বলল,

~আমাকে একা রেখে যাস না শুভ্র। তুই ছাড়া আমার পরিবার বলতে কেউ নেই। আমি একা হয়ে যাব।
~আমার পর তোর পরিবার হিসেবে কাউকে আমি তোর জন্য রেখে যাচ্ছি অর্ণব।

বলেই সে তরীর দিকে তাকালো। তরী ওড়নায় মুখে চেপে কাঁদছে। শুভ্রতা মলিন হাসলো।

~একটু জড়িয়ে ধরবেন চন্দ্র?

চন্দ্র কান্নারত চোখে তাকে দেখলো। সময় ব্যয় না করেই তাকে জড়িয়ে ধরলো। শুভ্রতাও ধরলো। সে কলমা পড়তে লাগলে চন্দ্র বিনয়ের সুরে বলতে লাগলো,
~প্লীজ যেয়ো না।

শুভ্রতা তখনও তার আলিঙ্গনে। হঠাৎই শুভ্রতার হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এলো। তার নিষ্প্রাণ দেহখানা স্বামীর বুকে পড়ে রইলো। চন্দ্র উন্মাদের ন্যায় চিৎকার করে উঠল,

~মা! আমার শুভ্রতা!

অরণ্য কাঁদতে কাঁদতে চেষ্টা করলো চন্দ্রের হাতের বাঁধন থেকে শুভ্রতাকে ছাড়িয়ে নিতে। চন্দ্র তার হাতের বাঁধন শক্ত করে আর্তনাদ করে কাঁদতে লাগলো। জ্ঞান হারালেন অনিকা। তিলোত্তমা মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। চন্দ্রের থেকে কোনো মতে শুভ্রতাকে ছাড়ালো মাহতাব, অর্ণব আর অরণ্য। তবে তাতে কোনো লাভ হলো না। সে ছুটে এসে ফের জড়িয়ে ধরলো তার প্রেয়সীর নিষ্প্রাণ দেহখানা। সারা ঘরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো চন্দ্রের কান্নার আওয়াজ। একজন প্রেমিকের তার ভাঙ্গা হৃদয়ের আর্তনাদ।

~আল্লাহ! আল্লাহ! আমার শুভ্রতাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও, আমি আর কিছু চাই না। আমি আমার শুভ্রতাকে চাই।

~মা আমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। তুমি আল্লাহকে বলো না আমার শুভ্রতাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে।

চন্দ্র উন্মাদের ন্যায় বিলাপ করতে লাগলো। ছেলের দুঃখ সহ্য করতে না পেরে মুখ ফিরিয়ে নিলেন চিত্রা। প্রেয়সী হারানোর বিষাদ হয়তো সহ্যের বাহিরে হয়ে গেলো চন্দ্রের জন্য। হঠাৎই সে শান্ত হয়ে বসে রইলো। তাকে চুপ হতে দেখে তার দিকে ফিরে চাইলেন চিত্রা। মিনিট পার হয়ে গেলো। সে শুভ্রতাকে জড়িয়ে আগের মতোই বসে। চন্দ্র এক পলের জন্যও সেখান থেকে নড়লো না। আর না নড়লো তার চোখের পাতা। অরণ্য কিছু একটা আন্দাজ করে থমকে গেলো। সে কাঁপা হাতে চন্দ্রের গায়ে আলতো করে ধাক্কা দিলো। সাথে সাথেই চন্দ্র শুভ্রতার পাশে নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলো। চিত্রা মৃদু চিৎকার দিয়ে ছেলের কাছে এলেন। ডাকতে লাগলেন তাকে। অরণ্য থম মেরে বসে রইলো। চিত্রা কাতর গলায় ছেলেকে ডেকে চলেছেন। কিন্তু সে উঠছে না। না তার চোখের পাতা নড়ছে আর না তার শ্বাস প্রশ্বাস চলছে। কপাল চাপড়ে হায় হায় করে কাঁদতে লাগলেন চিত্রা। নিজের ডাক্তারির যোগ্যতার ওপরও যেনো বিশ্বাস হলো না অরণ্যের। তার মনে হলো সে ভুল চেক আপ করছে চন্দ্রের। সে মাহতাবকে বললো,
~ওকে হাসপাতাল নিয়ে যাই চল।

মাহতাব ভাঙ্গা গলায় বললো,
~আর নিয়ে কি লাভ ভাইয়া? সব তো শেষ।

অরণ্য মাথা ঝাঁকালো।
~ও মরতে পারে না। বুড়ি আমায় বলেছে ওর খেয়াল রাখতে। আমি কি জবাব দিবো আমার বুড়ির কাছে?

প্রশ্ন করলো অরণ্য। মাহতাব মুখ শক্ত করে দাড়িয়ে রইলো। বুকে পাথর চেপে বললো,

~ওমর, ওনাদের দাফন কাফনের ব্যবস্থা করো।
~না! চন্দ্রকে আমি হাসপাতালে নিয়ে যাবো। প্লীজ মাহতাব! আমার বিশ্বাস ও মরেনি। ও মরতে পারে না।

অরণ্যের জেদের কাছে হার মেনে তাকে হাসপাতালে নিতেই হলো। সেখানেও ডাক্তার ঘোষণা করলো চন্দ্র মৃত। রিদিতাদের কল করে জানালো রাত্রি। খবর পাওয়া মাত্রই ছুটে আসে তারা। সারা রাত অরণ্য চেষ্টা করে নুরকে জানানোর। নুর কল ধরে না। টেক্সট করলেও দেখে না। ভোরের দিকে না পারতে নিতাকে জানায় অরণ্য।

🍂বর্তমান🍂

চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে ছাদের রেলিংয়ে রেখে দিলো তিলোত্তমা। তপ্ত শ্বাস ফেলে শুভ্রনীল আকাশের দিকে চেয়ে বলল,

~তুই আসতে খুব দেরি করে ফেলেছিস নুর। এতোটা দেরি করা তোর উচিত হয়নি।

নুর আহত চোখে চাইলো। কিছুই বলার নেই। ক্ষমা চাইবে নাকি ক্ষমা করবে? কার কাছে কে ক্ষমা চাইবে? কে কাকে ক্ষমা করবে? এখানে যে কম বেশি সবাই দোষী। নুরও আকাশের দিকে চেয়ে রইলো। ভাবনায় পড়লো। তার কি উচিত হবে রুপাকে ক্ষমা করা? অরণ্যের কাছে ক্ষমা চাইলে কি অরণ্য তাকে ফিরিয়ে দিবে? মানুষটা তো কোনো ভুল করেনি। তবুও সাজা পেলো, কঠিন সাজা। সে কি তাকে ক্ষমা করবে কখনো?

🍂২৭ বছর পর🍂

দরজা ধাক্কানোর বিরক্তিকর শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো মেয়েটির। কানে বালিশ চেপে সে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে উঠলো,
~লিভ মি এলন! আই নিড স্লিপ।

মেয়েটির কথায় দরজা ধাক্কানো বন্ধ হলো না। তা তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। সে বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো। তখনও কেউ এক টানা দরজা ধাক্কিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা বিরক্ত হলো। চেঁচিয়ে বলল,

~কুম্ভকর্ণের জাত না আমি। জেগে গেছি, নাউ স্টপ!

দরজা ধাক্কানো থেমে গেলো। মেয়েটি এতক্ষণ নিজের মধ্যে বেড়ে উঠা রাগী সত্তাকে ধাতস্থ করলো। বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে দিলো। অমায়িক হেসে রেনু দাড়িয়ে। মেয়েটির মনের কোণে জমে থাকা ক্ষুদ্র অভিযোগ তার এক হাসিতেই ছুটে পালালো। রেনু তার ঘরে প্রবেশ করলো। আলমারি থেকে সাদা এম্বোডারী একটা থ্রী পিস বের করে দিয়ে বললো,
~ভুলে গেছেন আজকে কি? তিলোত্তমা আপামনি তো ভোর থেকে উঠে রেডি হয়ে আছে।

মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। খাটে বসে মাথা চেপে বললো,

~আমার তো এই দিনে মায়ের সামনে যেতেই ইচ্ছে করে না। আমাকে, ভাইকে বা ওকে দেখলে কেঁদে বুক ভাসায় উনি।

রেনু ফিক করে হেসে দিলো।

~শুভ্রতা আপামনির হৃদয়ের খুবই কাছে ছিলেন যে আপনি!

মেয়েটি বরাবরের মতোই অবাক কন্ঠে বললো,

~তার মৃত্যুর দেড় বছর পর পৃথিবীতে এসেছি আমি। আর আমি কিনা ওনার হৃদয়ের খুব কাছে ছিলাম? কি অদ্ভুত!

~সেসব চিন্তা রেখে জলদি রেডি হয়ে আয় কায়া।সকাল থেকে হাজার দফা কল দিয়েছে তোর মা।

কায়া হেসে নুরকে জড়িয়ে ধরলো।

~কি করবো বলো? এই ঘরে এলেই আমার শান্তি লাগে, ঘুম ভালো হয়।

নুরের ঠোঁটের হাসিটা যেনো মিলিয়ে গেলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো অতীতের অসংখ্য স্মৃতি। নুর চেষ্টা করলো ঠোঁটের হাসি বজায় রাখতে। কায়াকে রেডি হতে বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। নিচে আসতেই দেখা মিললো তিলোত্তমার সাথে। মাত্রই এসেছে সে। তাকে দেখতেই সে তার কাছে গেলো,

~কেমন আছিস?
~আলহামদুলিল্লাহ।

নুর জবাব দিলো। দরজার দিকে তাকাতে লাগলো বারেবার। লোকটা এবারও আসেনি।

~তার আশা ছেড়ে দে নুর। সে ফিরবে না।

নুর মলিন হাসলো। মানুষটা সত্যিই ফিরবে না? এত বছরেও রাগ কমেনি তার? নুর হতাশ হয়ে সোফায় বসলো।
~সারাজীবন ওই মানুষটার আশায় একা রয়ে গেলি। সেও ফিরলো না আর তুইও কারো হলি না। এভাবে জীবনটা নষ্ট না করলেও পারতি।

নুর মুচকি হাসলো।

~সে নিজেও তো অন্য কারো হয়নি তিলো। আমি কি করে হতাম!

তিলোত্তমা হতাশ হয়ে বসে রইলো। অরণ্যের কাছে ক্ষমা চাইলেও ক্ষমা করেনি অরণ্য। শুভ্রতার এই ইচ্ছাটা সে পূরণ করতে পারেনি। সে পারেনি নুরকে মেনে নিতে। যে একবার ভুল বুঝে চলে যায়, সে আবারো এই ভুল করবে না তার কি গ্যারান্টি? সে এখন কানাডা থাকে। সাথে নিয়ে গিয়েছিল নিজের মা বাবাকে। তারাও যে নুরকে মানতে পারেনি। গত সাতাশ বছরে এক বারের জন্যেও দেশে ফিরেনি অরণ্য। রেনু আর মজিদ এর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর। তাদের ১৫ বছরের একটা মেয়েও আছে। অর্ণব আর তরীরও একটা মেয়ে আছে। মাহাদ আর রিদিতার ২টা যমজ মেয়ে। উপমা তার স্বামীর সাথে কিশোরগঞ্জ থাকে দুবছর হলো। আগে ঢাকাতেই থাকতো। বড় ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছে পড়া লেখার জন্য। আর ছোট ছেলে তাদের সাথেই থাকে। আজ তারাও আসবে এ বাড়ি। রুপা আর ইয়াদ বিয়ে করে এখন শুভ্রতার বাড়ির পাশের বাড়িতেই থাকে। বিয়ের পর পরই এই বাড়ি কিনেছে ইয়াদ। শুভ্রতার মৃত্যুর খবর শুনে আত্মহত্যা করেছিল সকাল। তার বাবা মা হাজার চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারেনি। ছেলের শোকে চিত্রাও না ফেরার দেশে পারি জমান ওদের মৃত্যুর ৩ বছরের মাথায়। আশহাব মাহবুবও মৃত্যুবরণ করেছেন ১৭ বছর হলো। শুভ্রতাদের ব্যবসাটা এখন অর্ণব আর তিলোত্তমা দেখাশুনা করে। ইতির খবর কেউ জানে না। আবসারের মৃত্যুর পর পরই শহর ছেড়ে চলে যান উনি। মাহতাব আর তিলোত্তমার এক মেয়ে, এক ছেলে। তাদের ছেলের সাথেই বিয়ে ঠিক হয়েছে অর্ণব আর তরীর মেয়ের। সবাই ঠিক আছে শুধু ঠিক হলো না অরণ্য আর নুরের সম্পর্ক। শুভ্রতার এই ইচ্ছা বাদে একে একে সব স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে নুর। তবে অরণ্যের ক্ষমা অর্জন করতে পারেনি আজও।
_________________________________

কবরস্থানে দাড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধ নারী। মাথার ওপর বিশাল এক আম গাছের ছায়া। গায়ে তার সাদা সুতির শাড়ি, চোখে তার মোটা ফ্রেমের চশমা, মাথার চুলে হালকা পাক ধরেছে। চশমা খুলে সে তার অশ্রুসিক্ত চোখদুটো মুছে নিলো। সামনে তার জোড়া কবর। ডানপাশের কবরে সে হাত রাখলো। অস্বচ্ছ চোখ হতে আরো দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে কাঁপা গলায় বলে উঠলো,

~তোর যাওয়ার আজ ২৭ বছর হলো শুভি। তোর স্বপ্ন তোর বন্ধুমহল পূরণ করেছে। তোর বাড়িটা আবারো হাসি আনন্দে ভরে উঠেছে। এক বাড়িতেই বৃদ্ধাশ্রম আর এতিমখানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেনো বড়রা সন্তানের আর ছোটরা মা বাবার কমতি না অনুভব করে। তোর জন্যে বরাদ্দ ঘরটা আজ তিলোর মেয়ে কায়ার। আমিও রুপাকে ক্ষমা করেছি। তোর সব স্বপ্ন পূরণ হয়েছে শুভি। শুধু একটা বাদে… অরণ্যর ক্ষমা অর্জন করতে পারিনি আমি। ক্ষমা করিস।

~এই ঝাড়বাতি!

পরিচিত মেয়েলি কন্ঠ কানে ভেসে আসতেই দ্রুত চোখের জ্বল মুছলো নুর। কোমরে হাত ঠেকিয়ে বললো,

~কতবার বলেছি আমাকে ঝাড়বাতি বলবি না?
~বলবো বলবো, হাজারবার বলবো, কোটিবার বলবো। আর বাড়ি গিয়ে তিলো মামনিকে এটাও বলবো যে ঝাড়বাতি আজ আবারো কেঁদেছে।

তার কথা শুনতেই কান মলে দিলো নুর। মেয়েটা ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো,
~আই! আই! আই! শুভ্রতা ব্যাথা পাচ্ছে তো ঝাড়বাতি! এ কি ধরনের অসভ্যতা? আমি কি তোমাকে সঠিক আদর্শ দিয়ে মানুষ করতে পারিনি?

তার কথা শুনতেই কান ছেড়ে খিল খিল করে হেসে উঠলো নুর। মেয়েটা কান ডলতে ডলতে বললো,

~এক শুভ্রতার সামনে দাঁড়িয়ে আরেক শুভ্রতার কান মলে দিলে? ফুপা আর ফুপির সামনে আমার মান থাকলো? ফুপি! এই মহিলা ভীষণ জ্বালায় আমায়। তুমি কি বলো? এর নামে একটা পুলিশ কেস ঠুকে দেই?

শুভ্রতার কবরের দিকে চেয়ে বলল শুভ্রতা। নুর হাসলো।
~যার কাছে বিচার দিচ্ছিস সে এই ব্যাপারে জীবনেও সায় দিবে না।

~এই যে নূরানী! আপনার জন্য মা ওয়েট করছে আর আপনি এখানে এই পাগলের বক বক শুনছেন?

কারো কথায় সেদিকে তাকালো নুর। ২৬ বছরের এক যুবক তীক্ষ্ণ চোখে তাদের দিকেই চেয়ে। রোদের আলোয় তার বাদামি মনি আরো আকর্ষণীয় লাগছে। মাথার চুলগুলো বেশ গুছিয়ে রাখা। নুর হেসে বলল,
~হ্যা যাচ্ছি। শুভির সাথে একটু কথা বলছিলাম।

নাক ফুলালো শুভ্রতা। বিড়বিড় করে বললো,
~নাম ওনার চন্দ্র অথচ গ্রহণ হয়ে আমার পেছনেই লেগে থাকে এই লোক। জাস্ট বিরক্তিকর!

নুর যেতেই তার ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ালো ছেলেটি। সে শুভ্রতার মাথার ঘোমটা ঠিক করে দিয়ে চন্দ্র আর শুভ্রতার কবরের দিকে চেয়ে বলল,

~এই যে চাচু, চাচী! মিট মাই প্রেয়সী। সুন্দর না?

শুভ্রতা কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে তাকে দূরে সরালো। ছেলেটার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। মাহতাব আর তিলোত্তমার ছেলে সে। ভাইয়ের স্মরণে ছেলের নাম রেখেছে চন্দ্র। অন্যদিকে তরী আর অর্ণবের মেয়ে শুভ্রতা। সে মাহতাবের মতোই বোনের প্রীতিতে একমাত্র কন্যার নাম রেখেছে শুভ্রতা। শুভ্রতা কড়া গলায় জানালো,

~আমি মোটেও আপনার প্রেয়সী না।

চন্দ্র হাসলো। দু হাত পকেটে গুজে হাটা ধরলো অভিমানী প্রেয়সীর পেছন পেছন। গেটের কাছাকাছি এসেও পেছন ফিরে এক পলকের জন্য পেছন ফিরে চেয়ে ফের শুভ্রতার দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলল,
~শুধু কিয়ামত পর্যন্ত না অনন্তকালের জন্য শুভ্রতা শুধু চন্দ্রের আর চন্দ্র শুধু শুভ্রতার।

চন্দ্রের কথায় শুভ্রতা ঠোঁট বাকালো। চন্দ্র মুচকি হেসে বলল,

~ইউ হেভ টু ওয়েট টিল আওয়ার ওয়েডিং চন্দ্রাবতী।

-সমাপ্তি-

(শেষ~~~ আশা করি গল্পটা ভালো লেগেছে 🥹 হ্যাপি রিডিং~)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here