#আঁধারে_আলোর_হাতছানি
#লেখনীতে_মাহমুদা_মায়া
৬ষ্ঠ পর্ব
আতিফ ও হায়দার হাসি ঠাট্টা করলেও, আলোর কাছে আঁধারের হার মানার কারণ সম্পর্কে জানে না। জানার চেষ্টাও করে নি। আঁধারের সাহায্যে আলো গণিতে ভালো করতে শুরু করে। কিন্তু আঁধার, আলোকে পড়ানোর পরিবর্তে এক পয়সাও নেয় নি, আর নিবে না বলে জানিয়েছে। কিন্তু সপ্তাহের একদিন আঁধার আলোকে পড়ায় না। সেদিন কি করে, কোথায় যায় তা একমাত্র আঁধার’ই জানে। সপ্তাহের সেই একদিন সোমবার।
তেমনই এক সোমবার। আলোদের এলাকার গলি দিয়েই আঁধার নিরবে হেঁটে চলছে। চলতে চলতে আবারও সেই সুমধুর নারী কন্ঠের কুরআন তেলওয়াত শুনতে পায়। প্রতি সোমবারেই আঁধার তার গন্তব্যের পথে দাঁড়িয়ে কুরআন তেলওয়াত শুনে। আজও শুনছিল। হঠাৎ কুরআন তেলওয়াত থেমে যায়। কিন্তু তেলওয়াত শেষ করার মতো নয়। আঁধার বুঝতে পারে যে নারী কুরআন তেলওয়াত করছে, সে বিরতি নিয়েছে। একই সাথে আঁধার দ্বিতীয় নারী কন্ঠ শুনতে পায়। নারী কন্ঠের কথোপকথনে আঁধার বেশ হতবাক হয়।
“কুরআন তেলওয়াত করছিস?” দ্বিতীয় নারী কন্ঠের প্রশ্ন।
“হ্যাঁ, মা। কিছু বলবে?” তেলওয়াতকারীর প্রশ্ন।
“হ্যাঁ, তোর শিক্ষক কি একদমই বেতন নিবেন না বলেছেন? অন্য কিছুর বিনময়ে তো পড়াচ্ছেন না, আলো?”
“না, মা, অন্য কোন কিছুর বিনিময়ে না। তিনি আমার সিনিয়র। এখন আয়াশ যদি আমায় ফ্রিতে পড়াতো, এখানে কি আয়াশের অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতো?”
এতদূর কথোপকথন শুনে আঁধার থমকে যায়, স্তব্ধ হয়ে যায় সে। এতদিন সে আলোর বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে তার কুরআন তেলওয়াত শুনতো!! আর একবারের জন্যও কন্ঠ পরিচিত মনে হয় নি তার। বেশ অবাক লাগে ব্যাপারটা। চিন্তাভাবনা একপাশে রেখে আঁধার নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলার সিদ্ধান্ত নেয়।
আলো ও তার মায়ের মাঝের কথোপকথন ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। আলো আর কুরআন তেলওয়াত করে নি। জানালা খোলা ছিল বলে জানালা লাগানোর জন্য এগিয়ে আসে। জানালার কাছে আসতেই সে আঁধারকে দেখতে পায়, যে আনমমে হেঁটে যাচ্ছিল। আলোর খানিকটা খটকা লাগে। আজ সোমবার,তার উপর প্রায় মাঝরাত। এসময় আঁধার এদিকে কোথায় যাচ্ছে! আলো চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে সাবধানে আঁধারকে অনুসরণ করতে থাকে।
অজান্তে দুজন একত্রে বেশ অনেকটা পথ অতিক্রম করে। আলোর বাড়ির মতোই একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায় আঁধার। আলো গাছের আড়ালে লুকিয়ে বাড়িটি দেখে অবাক। সে আনমনে বলে উঠে,
“এটা তো আফসানা আন্টির বাড়ি। আঁধার এখানে কি করছে?”
আরেকটু খেয়াল করলে আলো একজন মহিলাকে বাড়ির বাহিরে কারো জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে দেখে। আঁধার ধীরে ধীরে মহিলাটির দিকে এগিয়ে যায়। একটু ভাব নিয়ে অভিনয় করে গলা ঝেড়ে আঁধার বলে,
“মিসেস আফসানা।”
মহিলাটির চিন্তামগ্ন ধ্যান ভেঙে যায় আঁধারের কথাতে। চমকে উঠে পাশ ফিরে তাকায়। হাসিমাখা মুখ নিয়ে আঁধারকে জড়িয়ে ধরে। আঁধারও হেসে আফসানাকে জড়িয়ে ধরে। এই প্রথমবার আলো আঁধারকে হাসতে দেখেছে। আফসানা নামক মহিলাটির দিকে তাকিয়ে আঁধার বলে,
“কেমন আছ, মা?”
“তুই এসেছিস, এখন আমি অনেক ভালো।”
আফসানা ও আঁধারের কথোপকথন শুনে আলো অবাকের সপ্তম আসমানে উঠে যায়, এমন অবস্থা। সে বিরবির করে বলে,
“আফসানা আন্টি আঁধারের মা হলে, মিসেস আমেনা?”
“এতো দেরি করে এলি কেন আজ? খাবার তো ঠান্ডা হয়ে আসছে। চল, খেয়ে নিবি আগে,” আফসানা আঁধারকে ঘরে টেনে নিতে নিতে বলে।
“মা, শাক দিয়ে ছোট মাছের ঝুল করেছ তো? আমি কিন্তু ওটা ছাড়া খাবো না,” আঁধার ছোট বাচ্চাদের মতো আবদার করে বলে।
“তোর পছন্দের সব কিছুই করেছি।”
আফসানা বেগম ও আঁধার বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। আফসানা বেগম ও আঁধারের মাঝের কথোপকথন আলোকে বেশ ভাবাচ্ছে। কথা বলার সময় একদম ব্যতিক্রম এক আঁধারকে দেখেছে আজ। এই আঁধারের মাঝে নেই গাম্ভীর্যতা, নেই এটিটিউড, টাকার গরম, মাস্তানি, অভদ্রতা, কিছুই নেই। আলো ছোট এক বাচ্চা আঁধারকে দেখেছে আজ, যেমনটা পাখি তার নীড়ের বাচ্চার কাছে ফিরে গেলে ছোট বাচ্চার ব্যবহারে দেখা যায়।
খাবার টেবিলে বসার পর আফসানা কিছু খুঁজতে থাকে। আঁধার বলে,
“কি হয়েছে, মা?”
“ফোনটা কোথায় রেখেছি মনে করতে পারছি না।”
“বাহিরে ফেলে এসেছ হয়তো। আমি দেখে আসছি,” বলে আঁধার টেবিল থেকে উঠে যায়।
উঠানে এসে আঁধার মেঝেতে মোবাইল পরে থাকতে দেখে তা উঠিয়ে নেয়। তখনই কিছুটা, সামান্য কিছুটা দূরে তার চোখ যায়। সেখানে আলো আড়াল থেকে চিন্তা করতে করতে বেরিয়ে যায়। উল্টো দিকে ঘুরে হাঁটে সে। আঁধারকে খেয়াল করে নি। মুহুর্তে আঁধারের রাগ উঠে যায়। সে রাগ মিশ্রিত কন্ঠে আলোকে ডাকে। হঠাৎ আঁধার ডাকায় আলো ভয়ে ছিটকে উঠে। ভয়ে ভয়ে পিছু ঘুরে তাকায় সে। নিজেকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করে এবং আঁধারের উপস্থিতি সম্পর্কে অবগত ছিল না এমন অভিনয় করে। আঁধারের উচ্চস্বরে ডাক শুনে আফসানা বেরিয়ে আসে৷ সে আঁধারকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগে আলোকে দেখতে পায়। মুচকি হেসে এগিয়ে আসে আলোর দিকে। আফসানা বেগম বলেন,
“আরে আলো, তুমি এতো রাতে এখানে?”
“আসলে, আন্টি,” মিথ্যা বলতে পারছে না আলো।
আঁধারের দিকে চোখ পরতেই ভয়ে সব কথা জড়িয়ে যাচ্ছে তার। আঁধারও রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। আফসানা বেগম আলোকে জোরপূর্বক নিয়ে আসে। আঁধারের উদ্দেশ্যে কিছু বলার আগেই আঁধার গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“আমি ভালোমতো চিনি এই মেয়েকে।”
“তোমরা চেনো একে অপরকে? বেশ ভালো তো। কিন্তু, আলো। এতোরাতে এদিকে কি করছ তুমি?” আফসানা বেগম প্রশ্ন করেন।
“আসলে,,, আন্টি,,” আলোকে বলতে না দিয়ে আঁধার বলে,
“হাঁটতে বেরিয়েছিল হয়তো। এতোরাতে একা একটি মেয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া ঠিক না।”
আঁধার বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। আলো তো ভয়ে কাঁপছে। আলোকে নিয়েই আফসানা বেগম বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। আঁধার খাবারের সময় একবারের জন্যও আলোর দিকে তাকায় নি। চুপচাপ মজা করে, তৃপ্তি মিটিয়ে ধীরে ধীরে খাচ্ছে৷ আলো যে এখানে উপস্থিত সেদিকে আঁধারের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। খাওয়া শেষে আফসানা বেগম আঁধারকে বলেন,
“আঁধার, আলোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয় তো বাবা।”
আঁধার কোন কিছু না বলে আফসানা বেগমের কথা মান্য করে আলোকে নিয়ে বের হয়। নির্জন নিরিবিলি রাতে দুজন চুপচাপ হেঁটে চলেছে। দুজন রাস্তার দুই প্রান্তে হেঁটে চলেছে। নিরবতা ভেঙে আঁধার গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
“পিছু নিয়েছিলে আমার। কেন?”
“আসলে,, আমি,,” আলো আমতাআমতা করে বলে।
“যা পারবে না তা না করে সত্যটা বলো।”
“এতোরাতে এদিকে দেখে অজান্তে পিছু নিয়ে ফেলেছি। সরি,” আলো একদমে বলে উঠে।
আঁধার নিজের হাঁটা থামিয়ে দেয় আলোর দিকে তাকায় সে। আলো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আঁধার হাতদুটো প্যান্টের পকেটে নিয়ে বলে,
“আফসানা আমার মা, আমার জন্মদায়িনী। আমার সতেরো বছর বয়সে বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতি সোমবার মায়ের কাছে আসি আমি।” কিছুক্ষণ থেমে সে আবার বলে,
“এখন কি এই ব্যাপারটা নিয়েও আমায় ব্লাকমেইল করবে? করলে করতে পারো, আই ডোন্ট কেয়ার। তোমার কথা না মানলে সবাইকে জানিয়ে দিবে? দাও জানিয়ে। তোমার বুঝা আমি আর টানতে পারব না। লাইফটা আমার হেল করে দিয়েছ। প্রাত্যহিক নিয়মে ব্যাঘাত ঘটিয়েছ। ভোরের আলো ফোটার আগে কল, দুপুরে কল, বিকালে, রাতে, মাঝরাতে কল আর কল। এটা না করলে ফাঁস করে দিব, ওটা না করলে পড়ব না। এনাফ! আমি আর নিতে পারব না এসব। জাস্ট ডু হোয়াটএভার ইউ লাইক উইথ মাই সিক্রেটস। বাট স্টে আউট অফ মাই লাইফ।”
আঁধার রাগান্বিত হয়ে সবটা বলে উঠে। আঁধারের কথাগুলো শুনে আলো কান্না করে উঠে। সে কি এমন করেছে যে আঁধারের জীবন জাহান্নামে পরিণত হয়েছে! এটা ভেবে পাচ্ছে না। আলো মাথা নীচু করেই বলে,
“ক্ষমা করবেন আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। আমি শুধুমাত্র আপনার ভেতরের ভালোমানুষটাকে পূর্ণরূপ দিতে আপনার সাহায্য করছিলাম। প্রতি বেলা কল দিয়েছি নামাজ আদায়ের জন্য৷ এতে আপনার মাঝের অশান্তি দূর হবে বলে। কিন্তু ভাবিনি যে আপনার জীবনের সাধারণ নিয়মের ব্যাঘাত ঘটাবো। গণিতেও মুটামুটি এখন ভালো করছি। আর পড়াতে হবে না আমায়। আপনার সিক্রেটও কাউকে জানাবো না। ক্ষমা করবেন আমায়।”
আলো দেরি করে না। চুপচাপ দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যায় নিজের বাড়িতে। সেদিন রাতে প্রচুর কান্না করে আলো। কাউকে ভালো কাজের জন্য তাগাদা দিয়ে এতো কথা শুনতে হলো তাকে। সে কি খারাপ কিছু করছিল! তার উপকার করাতে সেও আঁধারের উপকার করছিল।
কিন্তু আঁধার বেশ খুশি হয়। এখন থেকে কারো হুমকি জ্বালাতন সহ্য করতে হবে না বলে। সে বেশ ভালো একটা ঘুম দিয়ে রাত পার করে দেয়।
চলবে,,,,,, See less