আকাশে তারার মেলা পর্ব ২০+২১

#আকাশে_তারার_মেলা
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -২০

তুলির চোখ ছাপিয়ে জল নেমে এল। কষ্টের অশ্রু নয়। এই অশ্রুগুলো সুখময় কিছু মুহুর্তের স্বাক্ষী। চোখ মেলে সম্মুখে আদ্র কে আবিষ্কার না করলেও আঁখিদ্বয়ে ভেসে উঠেছে পরিচিত কিছু মুখ। অতিশয় ভয়ে চুপসে যাওয়া মনটা নিমিষেই সতেজ হয়ে উঠল। আনন্দের জল গড়াতে লাগল মনের গহীনে। এতো বড় সারপ্রাইজ তো তুলি কখনও পায় নি। আহান, ঝুমু, সায়েরা বেগম, রাদিফ সাহেব, আমরিন,নিবিড়, অন্তু,পায়েল,ইনশিতা, রনক, রিমি,সাগর সবাই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। রাদিফ সাহেবের হাতে একটা চকলেট কেক। এতো রাতে সবাই কে নিজের চোখের সামনে দেখতে পেয়ে মুখে হাত চেপে কেঁদে দিল তুলি। বিশেষ করে আহান ও ঝুমু কে দেখতে পেয়ে তুলি বিস্মিত। এতো রাতে এখানে ওদের উপস্থিতি সত্যিই খুবই বিস্ময়কর। আর এই বিস্ময়কর ও এতো সুন্দর কাজ টা কার তুলি বেশ ঠাওর করতে পারছে। আদ্র তুলির কল্পনায় ছিল না বরং বাস্তব টা কেই যেন কল্পনার রাজ্য বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যেই মানুষ টা সবাই কে জড়ো করে সারপ্রাইজ দিয়েছে তুলি কে সারা ঘরময় চোখ বুলিয়েও তুলি তার হদিস পেল না। কোথায় গেল আদ্র? এখনই তো তার সামনে ছিল? ভালোবাসার সবটুকু অনুভূতি দিয়ে তার চোখের জল শুষে নিয়েছিল। এতটুকু সময়ে কোথায় গায়েব হয়ে গেল? রাদিফ সাহেব এগিয়ে এলেন। কেক টা টেবলি রেখে তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,,–” হ্যাপি বার্থডে মাই প্রিন্সেস।”

প্রিন্সেস? শব্দ টা তুলির হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়তে লাগল অনবরত। কতটা স্নেহ করলে নিজের মেয়ে ভাবলে একজন বাবা এই নামে ডাকতে পারে। তুলির চোখের জল আজ আর বাঁধ মানবে না। এতো সুখ তো তুলি কখনও পায় নি। অতি সুখে যে মানুষ কেঁদে দেয় তুলির তার চাক্ষুষ প্রমাণ। কখনও ভাবে নি পরিবার হারিয়ে আবারও এতো সুন্দর একটা পরিবার পাবে সে। কেন সবাই তাকে এতো ভালোবাসে? তুলি পারবে তো আগলে রাখতে ভালোবাসা গুলো? রাদিফ সাহেবের হাত টা ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। সবার মুখে মৃদু হাসি। কান্না ভেজা কন্ঠে বলে উঠল-

–” আপনাদের ধন্যবাদ জানালে সেটা অপরাধ হবে। তাই ধন্যবাদ জানাব না বাবা বরং জেনে রাখুন আমি খুব খুব বেশি ভালোবাসি আপনাদের সবাইকে।”

রাদিফ সাহেব হালকা হেসে তুলির চোখের পানি মুছে দিলেন। হাত টা ধরে নিয়ে এলেন কেকের কাছে। কেক টা কাটতে বললেন। তুলি সবার দিকে একপলক তাকিয়ে সূক্ষ্ম হাসল। কেক টা কেটে রাদিফ সাহেব কে খাওয়াল সবার আগে। রাদিফ সাহেব ও সায়েরা বেগম চলে যেতেই পায়েল, রিমি, আমরিন,ইনশিতা এসে শক্ত করে জরিয়ে ধরল তুলি কে। রিমি ও পায়েল একসাথে মুচকি হেসে বলল –” শুভ জন্মদিন আদ্রর বউ।”

ইনশিতা আর আমরিন তুলির দুই গালে হাত রেখে বলে উঠল- ” শুভ জন্মদিন ভাবী।”

এগুলো যেন তুলির জন্য উইশ নয় বরণ এক রক্তিম লজ্জার সমারোহ । লজ্জায় থম মেরে রইল তুলি। এক এক করে সবাই উইশ করল। আহান ও ঝুমু কাছে আসতেই তুলির ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে এল। ঝুমু কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আহানের দিকে তাকিয়ে বলল –” তোমাদের সবাইকে যে একত্রিত করেছে সেই মানুষ টা কোথায় ভাইয়া? হঠাৎ করে কোথায় হারিয়ে গেল?”

তুলির আদ্র কে দেখার অস্থিরতা বুঝতে পেরে সবাই ফিক করে হেসে দিল। আহান কোনো জবাব না দিয়ে বাকি সব ছেলেদের নিয়ে বের হয়ে গেল। তুলি হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে পড়ল। সবাই তার কথায় হাসল কেন বুঝতে পারছে না সে। একটু আগেও তো আদ্র ছিল। গভীর রাতে সবাইকে জ্বীনে পায় নি তো? ভেবেই তুলি এক নজর সবার দিকে তাকাল। চোখ গেল আমরিনের হাতে থাকা কালো একটা গাউনের দিকে। গাউন টা অসম্ভব সুন্দর। আমরিন গাউন টা এগিয়ে দিয়ে বলল–” গাউন টা পড়ে আয় জলদি। হাতে মাত্র দশ মিনিট সময় আছে।”

বাকরুদ্ধ হয়ে গেল তুলি। সবাই কি পাগল হয়ে গেল? কিসের দশ মিনিট? তুলির চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে –” আমার আদ্র কোথায়? একটু আগেই তো ছিল। চোখের পলকে কোথায় উদাও হয়ে গেল? ”
তুলি কে নড়তে না দেখে আমরিন গাউন টা হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঠেলে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিল। বাকি সবাই হাসতে হাসতে নিচে চলে গেল। কে বলবে এটা গভীর রাত? এ বাড়িতে অবস্থান থাকা প্রত্যেক টা মানুষের জন্য যেন এটা খুশির রাত। আর এই খুশিতে ঘুম ও যেন পালিয়ে গেছে। তুলি মাত্র কয়েক মাসেই সবার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। গাউন টা পরে বের হয়ে আসতেই আমরিন সুন্দর করে তুলির চুলটা বেঁধে দিল। বেনুনি করে ঘাড়ের একপাশে রাখল। তুলি কে দাঁড় করিয়ে একটা কালো ফিতা দিয়ে চোখ টা বেঁধে দিল। আতকে উঠল তুলি। আমরিনের হাত চেপে ধরে বলল –” কি করছিস?চোখ কেন বেঁধে দিলি?”

মুচকি হাসল আমরিন। তুলি কে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল–” নিশি রাতে তোর পরীক্ষার পালা।”

তুলি না বুঝে একনাগাড়ে প্রশ্ন করতে লাগল। আমরিন কোনো জবাব না দিয়ে তুলি কে বাড়ির বাহিরে নিয়ে আসল। ছেড়ে দিতেই তুলি ভয়ে উচ্চস্বরে ডেকে উঠল আমরিন কে। কোনো সাড়াশব্দ নেই আমরিনের তবে দূর থেকে ঝি ঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে। একটা হিমেল হাওয়া তুলির গা ছুয়ে যেতেই সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠল। নাকে এসে লাগল চিরচেনা সুবাস। মুহুর্তেই তড়িৎ বেগে বুকের ভেতর কিছু একটা এসে ধাক্কা খেল। ঠোঁটের কার্নিশে জড়ো হল মুগ্ধময়ী হাসি। হাতড়ে হাতড়ে এক কদম এগিয়ে যেতেই দু হাত ঠেকল কারো বুকে। স্থির হয়ে পড়ল তুলি। একটুও সময় ব্যয় না করে প্রচন্ড বেগে আছড়ে পড়ল মানুষটার বুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাও করে কেঁদে উঠল।

–” কোথায় ছিলেন আপনি আদ্র? অফূরন্ত ভালোবাসায় নিমজ্জিত করে গায়েব হয়ে গেলেন? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল কেউ আমার শ্বাসরুদ্ধ করে দিয়েছিল। এভাবে হুট করে হারিয়ে যাবেন না। আমার কষ্ট হয়। প্রচন্ড ব্যাথা হয় হৃদপিণ্ডে। ”

নিজের সাথে গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল আদ্র। ঘাড়ে আলতো করে চুমু খেল। কানের পাতায় ঠোঁট ছুঁয়ে ধীর স্বরে বলে উঠল-” এভাবে কাঁদবে না তুলা। এতো রাতে এভাবে কাঁদলে মানুষ জ্বীন-ভূত ভেবে ভয় পেয়ে যেতে পারে।”

আদ্রের রসাত্মক কন্ঠ শুনে তুলি জোরে একটা কামড় বসিয়ে দিল আদ্রর বুকে। স্তব্ধ হয়ে গেল আদ্র। ঠোঁট দুটো এখনও তুলির কান স্পর্শ করে রেখেছে। হৃদয়ের স্পন্দন দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। তুলি কে নিজের সাথে মিশিয়ে নেশাময় সুরে বলে উঠল- ” আমার বুকে তোমার দেওয়া ভালোবাসার দ্বিতীয় স্পর্শ। তুমি কি আমার বুকের ঝড় টা টের পাচ্ছ? এলোমেলো হয়ে পড়ছি আমি। অবাধ্য হয়ে পড়ছে মন। কেন এমনটা করলে এ মুহুর্তে?”

আদ্রর আবেগ মাখানো ভালোবাসাময় আর্তনাদ টের পেতেই অভিভূত হল তুলি। এক শীতল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। নেশা মিশ্রিত কথাগুলো তুলির অন্তরে ছড়িয়ে পড়ল দ্রুত বেগে। বরফের মতো গলে যাচ্ছে তুলি। আদ্র কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই চারপাশ থেকে মুখরিত হল আওয়াজ। আদ্র ও তুলি উভয়ের কানে এসে ঝংকার তুলল একটা বাক্য—” আমরা কিছু দেখি নি ভাই। আমরা কিন্তু কিছু দেখি নাই। ” বাক্য টা কানে পৌঁছতেই দু’জন দুজনকে ছেড়ে দিল। চোখ থেকে কালো কাপড় টা সরাতেই আদ্র কে দেখে অসীম মুগ্ধতা এসে গ্রাস করে নিল তুলি কে। কালো জ্যাকেটে আদ্র কে ভীষণ সুন্দর লাগছে। তুলির ইচ্ছে করছে আদ্র কে লুকিয়ে ফেলতে। এতো সুন্দর হতে পারে একটা ছেলে? নিজের উপর লাল গোলাপের পাপড়ি পড়তেই ঘোর থেকে বেরিয়ে এল তুলি। চারদিকে তাকিয়ে দেখল সবাই ওদের উপর গোলাপের পাপড়ি ছিটাচ্ছে। এতো এতো সুন্দর মুহুর্ত তো তুলি তার কোনো জন্মদিনেই পায় নি। এসব মুহুর্ত শুধু মাত্র একটা মানুষের জন্যই পেয়েছে তুলি। সারাজীবন এই মানুষ টাকে পাশে চায় তার। কোনোদিনও যেন বিচ্ছেদ না আসে এটাই আল্লাহর কাছে একটা চাওয়া তুলির। আদ্র সবাইকে তাড়া দিয়ে বাইকে উঠল। একে একে সবাই বাইকে উঠে গেল। তুলি এখনও মুগ্ধ চাহনি নিক্ষেপ করে রেখেছে আদ্রর দিকে। হাতে টান পড়তেই আদ্রর পিছনে উঠে বসল। কিন্তু গাউন টা সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তার। আদ্র নেমে গাউন টা ঠিক করে দিল। উঠে বাইক স্টার্ট দিতেই বাকি সবাই স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল। তুলির জীবনে বাইকে উঠা ও প্রথম। ভয়ে আদ্রর দুই বাহু জরিয়ে চোখ বুজে আদ্রর পিঠে মুখ গুজে ফেলল তড়িঘড়ি করে। বুকটা ধরফর করতে লাগল আদ্রর। এই মেয়েটা তার হার্ট এট্যাক করিয়েই দম নিবে। আলতো হেসে বাইক চালাতে চালাতে বলল–

–” মাথা উঠিয়ে রাতের আঁধার টা অনুভব করো তুলা।”

–” আমার ভয় লাগছে। যদি পড়ে যায়?”

–” আমি থাকতে কিসের ভয়? একটা আঁচড়ও লাগতে দিব না তোমার মোলায়েম দেহে। নিজে রক্তাক্ত হয়ে যাব তবুও তোমার গায়ে রক্তের দাগ টুকুও লাগতে দিব না।”

এমন কথা শুনলে কোনো মানুষ স্বাভাবিক থাকতে পারে? তুলিও পারছে না নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে। মনের অনুভূতি গুলো কেও ধরে বেঁধে গুছিয়ে নিতে পারছে না। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল-

–” আপনি আর এমন করে কথা বলবেন না আদ্র।”

বাঁকা হাসল আদ্র। তুলির মনোভাব বুঝতে পারছে সে অনাসয়ে। না দেখেও দিব্যি অনুভব করতে সক্ষম হচ্ছে তুলির অস্থিরতা। সাবলীলভাবে বলল,,

–” তুলা একবার মাথা তুলো। মনে জড়ো করে নাও প্রখর অনুভূতি মেশানো এই ঘোর অমানিশা টা কে। কেমন হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে প্রতিবার।”

আদ্র কে জড়িয়ে ধরে রেখেই মাথা তুলল তুলি। তীব্র বাতাসে তুলির অবাধে পড়ে থাকা চুলগুলো উড়তে লাগল। অসম্ভব রকম ভালো লাগা ছেয়ে গেল মন প্রাণ জুড়ে। বাতাসের বেগে কানে এসে যেন কেউ চুপিসারে বলে যাচ্ছে –” তুই অমানিশার মাঝে ও এক মুঠো আলো। যেই আলোতে তোর ডাক্তার সাহেবের ঠোঁটের কোণে হৃদয় নাড়ানো হাসির ঝলক দেখা যাচ্ছে। ”

আনমনেই হাসল তুলি। আদ্রর পিঠে মাথা এলিয়ে বলল,,

–” আপনি ডাক্তার হলেন কেন ডাক্তার সাহেব? ”

তুলির অদ্ভুত প্রশ্নে ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে এল আদ্রর। এই মেয়ের উদ্ভট কথাগুলোই আরো মন কেড়ে নিয়েছে তার।

–” এমন প্রশ্ন কেন?”

–” আপনি বাইক চালাতে পারেন। আবার আপনার চোখ দুটো ও নেশা ধরানো। দেখতেও খুব খুব বেশি হ্যান্ডসাম আপনি। আপনার না নায়ক হওয়ার উচিত ছিল। ডাক্তার কেন হলেন?”

–” বাবার ইচ্ছে ছিল তাই। ”

বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে গেল তুলি। নরম স্বরে বলে উঠল-

–” বাবা কে খুব ভালোবাসেন তাই না?”

–” হুুম।”

–” তাহলে এভাবে অভিমান চেপে রেখেছেন কেন? আপনি জানেন বাবাও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে।”

–” অভিমান নয়। শুধু নিজের কাছেই নিজে লজ্জিত সেইদিনের বিহেভিয়ারের জন্য। ”

–” বাবাও লজ্জিত ওনার ভুল ধারণার জন্য। আপনি ওনার সাথে একবার ভালো করে কথা বললে দেখবেন ওনার খুব ভালো লাগবে।”

–” অবশ্যই বলব তুলা।”

____
বাইক এসে একটা বাড়ির সামনে থামল। আদ্র নেমে তুলি কে ধরে নামাল। বাকি সবাই ও দাড়িয়ে আছে। সবাই স্বাভাবিক থাকলেও স্বাভাবিক নেই অন্তু ও পায়েল। পায়েলের মেজাজ চওড়া। অন্তু কে যেভাবে পারছে ধুয়ে দিচ্ছে। বেচারা অন্তু চুপ করে সব শ্রবণ করে নিচ্ছে। আদ্র তুলির হাত ধরে এগিয়ে এসে পায়েল কে থামাল।

–” কি হয়েছে পায়েল?”

–” কি আর হবে? তোর এই ফালতু ফ্রেন্ড বাইক ও ঠিকভাবে চালাতে পারে না। আমার কোমর টা শেষ। ”

–” এতো যত্ন করে ভালোবেসে চালিয়ে আনলাম তবুও এমন বললা বউ? আজ ভালোবাসি বলেই এতো অত্যাচার সহ্য করি। নয়তো কবেই উগান্ডা তে পাড়ি জমাতাম। ”

অন্তুুর কথা শুনে সবার হেসে লুটোপুটি খাওয়ার অবস্থা। আদ্র হাসতে হাসতে বলল–” হয়েছে চল। আজ কিন্তু আমার বউয়ের বার্থডে। অন্তত ওর খাতিরেই ঝগড়া অন্য একদিন করিস। আপাতত মনের খাতায় লিখে রাখ।”

আরেকদফা হাসির রোল পড়ে গেল। গেইট খুলে ভিতরে প্রবেশ করল সবাই। শহর থেকে কিছুটা দূরে বাড়ি টা। বেশি বড় না। তিনটা কক্ষের একতলা একটা বাড়ি। চারদিকে ফুলের সমারোহ। বাগান বাড়ি বললেও ভুল হবে না। ঘুরে ঘুরে পুরোটা বাড়ি দেখল তুলি। চোখ জুড়িয়ে গেল তার। আদ্রর হাত টা চেপে ধরে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠল-

–” বাড়িটা কার আদ্র?”

–” তোমার ও আমার।”

অবাক হল তুলি। বিস্ময়ের সাথে বলল,,

–” আমাদের মানে?”

সবাই ড্রইং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তুলি ও আদ্র বাড়ির পেছনের দিকটায়। পেছন থেকে তুলির পেটে দু হাত রেখে জড়িয়ে ধরল আদ্র। হালকা কেপে উঠল তুলি। পেটে বিরাজমান আদ্রর হাতের উপর হাত চেপে ধরল।

–” ছোট্ট এই বাড়িটা আমি আমাদের জন্য বানিয়েছি। মাঝে মাঝে দু জন এসে ছোট্ট একটা সংসার গড়ে যাব। রেখে যাব আমাদের ভালোবাসার হাজারো স্মৃতি।”

তুলির মনে উদয় হল কাগজের ব্যাপার টা। তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন করল,,

–” কাগজগুলো কি এই বাড়ির ছিল?”

–” উহু! কাগজ টা তো আমাদের সংসার জীবনে পদক্ষেপের প্রমাণ ছিল। ”

কথাটা বোধগম্য হল না তুলির। আদ্রর কথায় রহস্য ভরপুর মনে হচ্ছে তার নিকট।

–” মানে?”

–” মানে টা নাহয় বিয়ের দিনই জেনে নিও তুলা।”
#আকাশে_তারার_মেলা
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -২১

ব্যাগপ্যাক নিয়ে পরিপাটি হয়ে তুলি দ্রুত বেগে নিচে আসল।আহান ও ঝুমু মাত্র সবার থেকে বিদায় নিয়ে বের হচ্ছিল তখনই তুলি হাপাতে হাপাতে পিছু ডাকল। থমকে গেল আহান ও ঝুমু। তুলির হাতে ব্যাগ দেখে প্রচন্ড অবাক হল সবাই। সায়েরা বেগম কাছে এসে বিস্মিত গলায় বললেন,,

–” তুই কোথায় যাচ্ছিস তুলি?”

–” আম্মু আমি কুমিল্লা যাব আহান ভাইয়ার সাথে।”–এক নিশ্বাসে কথাটা বলে থামল তুলি।

তুলির জবাব শুনে স্থবির হয়ে গেলে সায়েরা বেগম। বাকি সবাই ও ব্যাপক বিস্মিত। আমরিন এগিয়ে এসে বলল,,

–” পাগল হয়েছিস তুলো? দু’দিন বাদেই তোর বিয়ে। পরশু দিন গায়ে হলুদ। তুই এখন কুমিল্লা যাবি?”

–” বিয়ে বলেই তো যেতে চাচ্ছি। বিয়ের আগে একবার নিজের জন্মস্থানে যেতে চাই। ওনি তো যেতে দিত না। এখন যখন সুযোগ পেয়েছি মিস করতে চাই না। আজ আর কালকের তো ব্যাপার। পরশু ঠিক সকালে আহান ভাইয়া, মামা-মামী, খালা মণির সাথে চলে আসব।”

–” তোর মাথা টা খারাপ হয়ে গেছে। জ্বরের ঘোরে আবল তাবল বকছিস। ভাইয়া কে কিন্তু আমি বলি নি তোর জ্বর এসেছে। ওনি সকাল সকাল ইমারজেন্সি থাকায় বের হয়ে গেছেন। একবারও যদি জানতে পারেন তোর জ্বর হয়েছে কোথাও যাওয়া তো দূরের কথা ঘর বন্দি করে রাখবে। ওয়েট আমি এখনই বলছি।”

আমরিন ফোন টা বের করতেই তুলি খপ করে ছিনিয়ে নিল। করুন স্বরে সবার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল-

–” আব্বু- আম্মু আমাকে যেতে দাও প্লিজ। আমার খুব ইচ্ছে করছে একবার বাড়িতে যেতে। আমায় যেতে দাও প্লিজ। আমার জ্বর সামাল দেওয়ার অভ্যেস আছে। আমি একদম ঠিক আছি। গায়ে হলুদের দিন সকালে আমি চলে আসব।”

সায়েরা বেগম এগিয়ে এসে কপালে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বর কিছুটা কমেছে। সকালের দিকেই জ্বর এসেছে। আদ্র শুনলে সব ফেলে ছুটে চলে আসবে, অস্থির হয়ে পড়বে তাই সায়েরা বেগম আর জানান নি। নিবিড় কিছু মেডিসিন দিয়েছে আর ওনি যতটুকু পেরেছেন সেবা করেছেন তুলির। এক ঘন্টা আগেও যেই মেয়েটা বিছানা থেকে উঠতে পারছিল না এখন কুমিল্লা যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। নিজের জন্মস্থানের প্রতি সবারই আলাদা টান থাকে তুলির ক্ষেত্রে ও তেমনটাই। মেয়েটার করুন চাহনি উপেক্ষা করতে পারলেন না তিনি। আবার ছেলের জন্য ও চিন্তা হচ্ছে। বাড়িতে এসে তান্ডব চালাবে তুলি কে দেখতে না পেলে। তবুও তিনি তুলির আবদার ফেলতে পারলেন না। গালে হাত রেখে বললেন,,

–” সাবধানে যাস। আদ্র আসলে কি করবে আমি জানিনা। এখন তো তুই যাচ্ছিস কিন্তু আদ্র আসার পর যা হবে তার জন্য কিন্তু আমি দায়ী হব না বলে দিলাম।”

তুলি তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। সায়েরা বেগম কে শক্ত করে জরিয়ে ধরে বলে উঠল-

–” অসংখ্য ধন্যবাদ আম্মু। আমি কিন্তু আবার ফিরে আসব তোমাদের মাঝে। আর এবার একদম পার্মানেন্ট হয়ে যাব তোমাদের পরিবারে। সারাজীবন তোমাদের সাথেই কাটাব।”

–” তুই আমাদের পরিবারেরই একজন মা। এখন শুধু সুস্থ ভাবে ফিরে আসিস। তোর আম্মু তোর অপেক্ষায় থাকবে। ”

–” আচ্ছা আম্মু। ”

আমরিন, ইনশিতা, রাদিফ সাহেব সবাই কে বিদায় জানিয়ে তুলি গাড়িতে উঠে বসল। তখনই হাতের মোবাইল টা মৃদু শব্দ করে উঠল। স্ক্রিনে চাইতেই চক্ষুদ্বয়ে ভেসে উঠল আদ্রর মেসেজ। তুলির মলিন চেহারায় এক ফোঁটা হাসির ঝলকের দেখা মিলল। উপর থেকে মেয়েটা নিজেকে যত স্ট্রং দেখায় ভিতর থেকে তার চেয়েও অধিক নরম। এই যে জ্বরে তার ভিতর টা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে তবুও উপর থেকে নিজেকে বেশ স্ট্রং জাহির করেছে সে। মেসেজ টা ওপেন করে মনের কুঠিরে বাক্যগুলো তটস্থ করে নিল তুলি।

~❝আমি আজ অবিশ্রান্ত। আমার তুলার শ্যামারঙা মুখটা দেখার জন্য বড্ড তৃষ্ণার্ত আমি। ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে যায়। আলিঙ্গন করে নেই নিজের দুই বাহুতে। ডাক্তার হয়ে খুব বড় ভুল করে ফেলেছি। সবার হার্টের সেবা করতে গিয়ে নিজের হৃদপিণ্ডটা কে পুড়াচ্ছি।❞

মেসেজ টা পড়ে তুলি দু চোখ বুঁজে সিটে মাথা এলিয়ে দিল। বাক্য গুলো তুলির হৃদয় জুড়ে অনাবিল শান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে। অনুভূতি গুলো গভীর হতে গভীরতম হচ্ছে। গলাটাও প্রচন্ড পিপাসিত হয়ে উঠল। মনে পড়ে গেল জন্মদিনের সেই রাতের কথা। সেদিন হয়তো একটু বেশিই আবেগী হয়ে উঠেছিল। নিজেকে তলিয়ে দিয়েছিল আদ্রর নেশাময় চাহনিতে।

★সেদিন,,,

আদ্রর কথার মানে ঠাওর করতে না পারলেও তুলি অনুভবের অন্তরালে হারিয়ে যেতে লাগল। মন বলে উঠল- ” বিয়েটা আজই কেন হল না? আজ হলে তো আজই এই শান্তির ছায়ায় ঘেরা বাড়িটা তে ছোট্ট একটা সংসার গড়ে ফেলতে পারতাম। সবাই কে দেখিয়ে বলতে পারতাম এটা আমার ডাক্তার সাহেবের বানানো শুধু একটা বাড়ি নয়। এটা তো আমাদের ভালোবাসার চাদরে মোড়ানো ছোট্ট একটা ভালেবাসাময় সংসার।”

ঘাড়ে কোমল ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই ভাবনার অন্তর থেকে বেরিয়ে এল তুলি। দু চোখের পাতা এক করে পেটে বিচরণ করা আদ্রর হাত টা খামচে ধরল। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া কন্ঠে অস্ফুটস্বরে ডেকে উঠল,,

–“ডাক্তার সাহেব!!”

–“হু।”

–” আপনি আমার হৃদয়ের সুবাসিত ফুল। যেই ফুলের সুবাসে আমার মন অবাধ্য হয়ে পড়ে প্রতিবার। প্রাণ পণে ছুটে যায় সুবাসিত সেই ফুল কে একবার শুধু একটি বার অনুভবে ছোঁয়ার আশায়।”

প্রেমময় বাক্যগুলো নিজের অজান্তেই গড়গড় করে বলে বসল তুলি। রোবটের মতো দাড়িয়ে আছে আদ্র। তুলির পেটে রাখা হাত দুটোও ঢিল হয়ে এসেছে। অনুভূতি গুলো নিমিষেই যেন থমকে গেল। আদ্রর কোনো রেসপন্স না পেয়ে তুলি লজ্জায় চুপসে গেল। এতোক্ষণে বুঝতে পারল অতিরিক্ত আবেগে আর ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ায় কেমন কথা বলে বসেছে। ধীরে ধীরে আদ্রর দিকে ঘুরে তাকাতেই চাঁদের আলোয় চোখে পড়ল আদ্রর ঠোটের কোণে ফুটে থাকা মুগ্ধময় হাসিটা। একদম স্থির অথচ অধরে হাসি। ঢুক গিলল তুলি। এই হাসি তুলির অনলে পুড়ানো হৃদয় কে ও শান্তি দিতে সক্ষম। মাঝে মাঝে তুলির মনে হয় তুলি যদি জীবনে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে ও থাকে তখন আদ্রর মুখের হাসি টা যেন তাকে এক রাশ প্রশান্তি এনে দিবে। মুহুর্তের মধ্যে গুড়িয়ে দিবে, নিঃশেষ করে দিবে সবটুকু কষ্ট। আদ্রর জ্যাকেটে খামচে ধরে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুলি।কোনো হেলদোল নেই আদ্রর। এবার বেশ সংশয়ে ভুগছে তুলি। কথাটা কেমন প্রভাব বিস্তার করেছে আদ্রর মনে সঠিক বুঝতে পারছে না সে। জ্যাকেট থেকে দু হাত কিছু টা ঢিল করতেই চেপে ধরল আদ্র। তুলির গালে ভালোবাসার আলতো ছোঁয়া একে দিল অতি সন্তর্পণে। অতিশয় মোলায়েম কন্ঠে বলল,,

–” আমি যদি তোমার জীবনের সুবাসিত ফুল হয় তবে তুমি তো আমার পরিচর্যাকারী। যার পরিচর্যা বিহীন মুর্ছে যাব আমি। নিঃশেষ হয়ে ঝরে যাবে আমার অস্তিত্ব। ”

শ্রুতিমধুর কথাগুলো কর্ণকুহর হতেই তুলি দ্রুত বেগে মাথা গুঁজে দিল আদ্রর বুকে। ধরা গলায় বলে উঠল-

–” আমার সবটুকু দিয়ে আগলে রাখব আপনাকে। কখনও ঝরে পড়তে দিব না। কখনও কেউ আপনার কাছ থেকে আমাকে সরাতে পারবে না।”

–” তুমি চাইলেও আমি সরতে দিব না। খুন করে ফেলব একদম। বহুবছর বাঁচার ইচ্ছে আমার তোমার সাথে। ”

নিস্তব্ধ অনুভূতি নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে রইল তুলি। খুন হতেও রাজি সে আদ্রর হাতে। কারণ আদ্র কে ছাড়া যে সে নিজেই বিলীন হয়ে যাবে। চোখ বুঁজে আদ্রর হৃদস্পন্দন অনুভবে মত্ত হয়ে পড়ল। আচমকা হাতে টান পড়তেই নড়ে উঠল তুলি। চোখ মেলে তাকাতেই দেখল ঝুমুর ঠোঁট নাড়ানো। কিছু হয়ত বলছে কিন্তু ভাবনায় এতোটাই বিভোর ছিল তুলি কিছুই শুনে নি। গাড়িও কখন থেমেছে সেই খেয়াল ও নেই। ভালো করে উঠে বসতেই ঝুমু বলে উঠল-

–” ঠিক আছো তুলি?”

–” ঠিক আছি ভাবী। কিছু বলছিলে?”

–” হুম। তোমার ভাইয়া বলছিল কিছু খাবে কিনা?”

–” পানি! পানি খাব ভাবী।”

–” আচ্ছা পানি নিয়ে আসতে বলেছি আমি। আর কিছু খাবে না?আহান বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।”

–” আর কিছু লাগবে না ভাবী।”

আর কিছু না বলে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইল তুলি। আদ্র কে সামান্য সময়ের ব্যবধানেই খুব মিস করছে মেয়েটা। ইচ্ছে করছে ফিরে যেতে। আবার ইচ্ছে করছে একটা দিন কুমিল্লায় কাটাতে। বিড়বিড় করে বলল–” আমি আপনার টানে আবারও ফিরে আসব আদ্র। আবারও ফিরে আসব আপনার ভালোবাসা পাওয়ার লোভে।”
_______

রোগী দেখা শেষ করে তড়িঘড়ি করে মোবাইল টা পকেটে ঢুকিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এল আদ্র। মেজাজ তুঙ্গে উঠে আছে তার। বুকের বা পাশ টায় আজ মৃদু ব্যাথা করছে। মনটা কেমন শূন্য শূন্য হয়ে আছে। তার বিশেষ কারণ হল সকাল থেকে তুলি কে দেখতে না পারা টা। মেয়েটার বাচ্চা বাচ্চা কন্ঠস্বর টাও আজ শুনে নি সে। ভীষণ বিরক্তি লাগছে তার নিজের পেশার উপর। সকালেই বেরিয়ে এসেছে। ওটি শেষ করে রোগী দেখা কম্পলিট করে মাত্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অজস্র ক্লান্তি ভর করে রেখেছে। আদ্রর এই ক্লান্তি গুলো তুলি কে এক নজর দেখলেই যেন সেড়ে যাবে। গাড়িতে উঠতে নিলেই কোথা থেকে সামিরা দৌড়ে এসে উপস্থিত হল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল আদ্র। সামিরা হালকা হেসে বলল,,

–” কেমন আছো আদ্র?”

–” এখন এসব বলার সময় নেই আমার হাতে।”

সোজাসাপ্টা জবাব দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল আদ্র। সাথে সাথেই সামিরা পাশের সিটে উঠে বসল। প্রচন্ড অবাক হল আদ্র। রক্তিম হয়ে আসল দু চোখ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

–” এগুলো কেমন ফাজলামি? তুই আমার গাড়িতে কেন উঠেছিস?”

–” আসলে তোমাদের বাসায় যাব ভাবী কে দেখতে। হসপিটালে এক ফ্রেন্ডের সাথে এসেছিলাম। তোমাকে দেখে ভাবলাম তোমার সাথেই চলে যায়।”

চোখ বুঁজে রাগ টাকে কিছুটা দমিয়ে নিল আদ্র। কোনো কথা না বলে গাড়ি স্টার্ট দিল। সামিরা ও কিছু না বলে সারা রাস্তা চুপ করে থাকল। গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে বাড়িতে ঢুকে গেল আদ্র। দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে তুলির রুমের সামনে আসল। সায়েরা বেগম ভীত মন নিয়ে পিছু পিছু আসলেন। রুমে ঢুকে চারদিকে চোখ বুলিয়ে তুলি কে কোথাও পেল না আদ্র। বেলকনিতে ও নেই। ওয়াশরুমের দরজা ও বাইরে থেকে লাগানো। তার মানে তুলি ওয়াশরুমে ও নেই। তরতর করে তুলি কে দেখার তৃষ্ণা বেড়ে গেল আদ্রর। বুকের যন্ত্রণা টাও প্রখর হতে লাগল। সায়েরা বেগমের দিকে ঘুরে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই চোখ গেল দেয়ালে টেপ দিয়ে আটকে রাখা সাদা চিরকুটের দিকে যাতে তুলির স্পষ্ট সুন্দর হাতের লেখা।

~”প্রথমেই আমি দুঃখিত ডাক্তার সাহেব। আপনি তো যেতে দিতেন না তাই না বলেই চলে গেলাম। আজ নিয়ে মাত্র দুটো দিন থাকব।”

চেপে রাখা রাগ তীব্র আকার ধারণ করল আদ্রর। চিরকুট টা হাতে নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিল। সায়েরা বেগমের দিকে না তাকিয়েই চলে গেল নিজের রুমে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসে নিজের দু হাত দিয়ে মাথার চুল মুষ্টিবদ্ধ করে নিল। যার কাছে ছুটে এল চোখের তৃষ্ণা মেটাতে সেই গায়েব। হাতের কাছের ফ্লাওয়ার বাজ টা খুব জোরে দেয়াল বরাবর মেরে দিল যা প্রচন্ড আওয়াজ তুলে খন্ড খন্ড হয়ে পড়ে রইল ফ্লোরে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে তুলি কে কল দিতেই ফোন বন্ধ পেল। চরচর করে রাগ চেপে বসল মাথায়। নিজেকে এলোমেলো লাগছে আদ্রর। ক্লান্তি, রাগ সব মিলিয়ে বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেছে মনটা।


দক্ষিণা হাওয়ার তালে তালে তুলির চুল গুলো অবাধে উড়ছে। ছাদের কার্ণিশ ঘেষে দাড়িয়ে আছে অনেক্ষণ যাবত। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। প্রখর রোদ্দুরের তাপের অস্তিত্ব ও বিলীন হয়ে গেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে কল্পনায় আঁকছে আদ্রর হাসোজ্জল চেহারা টা কে। মনে পড়ে যাচ্ছে আদ্রর প্রথম দিনের বলা সেই কথাটা। আজকাল তার কাছে তুলি নামের চেয়ে তুলা নামটাই বিশেষ পছন্দ। মাত্র কয়েক ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু এখনই তুলির দম বন্ধ হয়ে আসছে আদ্র কে ছাড়া। নিজেকে শূন্য শূন্য লাগছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি নিঃশ্বাস টুকু সঙ্গ ছেড়ে দিবে। কোনোমতে রাত টা পার করে ফিরে যাবে তুলি। মোবাইল টা চার্জ না থাকায় বন্ধ ছিল। অন করে আদ্রর নাম্বারে কল দিতেই ফোন বন্ধ পেল। ফের কল দিতেই আবারও বন্ধ পেল।

আদ্র রাগ করে নি তো? আমি বোধ হয় ভুল করে ফেলেছি। কেন যে টানে টানে চলে এলাম? আর যাদের জন্য আসলাম তারা ফিরেও তাকাল না। কথাগুলো ভেবেই হতাশার দীর্ঘ একটা শ্বাস বের হয়ে আসল বুক চিরে। এসেই মামার বাড়িতে গিয়েছিল তুলি। মামা হাসিমুখে কথা বললেও দূর দূর করে দিয়েছেন মামী। আহানের কাছ থেকে জানতে পারল এতোদিন সব খরচ সবকিছুর দায়িত্ব আদ্র বহন করেছে। তুলির মামা এক টাকাও খরচ করেন নি তুলি কে ঢাকা পাঠানোর পর। নিজের পাওনা থাকা সত্ত্বেও তুলি কিছু বলতে পারে নি। বলবেই বা কিভাবে? এই মানুষ গুলোও তো তার আপনজন। এক টাকাও চায় না তুলির। তার জীবনের সব চাওয়া তো আদ্র কে ঘিরেই। কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে গড়িয়ে পড়া জল টুকু মুছে নিল তুলি। পিছন ফিরে ঝুমু কে দেখতে পেয়েই বলে উঠল-

–” আমি তো সেই কখন থেকেই রেডি হয়ে ছাদে দাড়িয়ে বাতাস খাচ্ছিলাম। এতোক্ষণ লাগল তোমার?”

তুলির কথায় মৃদু হাসল ঝুমু। গালে হাত রেখে বলল,,

–” চলো।”


রাত এগারোটা বাজে। আহানের রুমে ঝুমু ও খালা মণির সাথে আড্ডা দিতে ভীষণ ব্যস্ত ছিল তুলি। আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু ছিল আদ্র ও তার পরিবার। সবার সম্পর্কে নতুন করে বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠেছে। ওনারা চিনলেও আদ্রর পরিবারকে নতুন করে উপস্থাপন করল। আদ্রর কথা বলতে গিয়ে মনে ভীষণ ভালো লাগা, লজ্জা দুটোই করছিল। যার প্রভাব এখনও বর্তমান। বুকটাও হাহাকার করছে। এই নিশি রাতেই ছুটে যেতে মন চাইছে আদ্রর কাছে। কাল সকালেই বেরিয়ে পড়বে ঢাকার উদ্দেশ্যে। চাপানো দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করতেই অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে গেল তুলি। হাতড়ে হাতড়ে লাইট অন করতেই নিলে কেউ প্রচন্ড জোরে চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। ধুক করে উঠল তুলির বুকটা। ভয়ে চিল্লাতে নিলে মুখে চেপে ধরল অজ্ঞাত ব্যাক্তি। হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রম তুলির। বুকের ধরফরানি বেড়ে গেল বহুগুণ। নিজেকে ছাড়ানোর প্রাণ পণ চেষ্টা করতেই তীব্র ধাক্কা অনুভব করল। তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ল বিছানায়। বাতাসে জানালার পর্দা এলোমেলো হতেই রুমে এসে চাঁদের মৃদু আলো প্রবেশ করল। পিলে চমকে উঠল তুলির।

#চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here