#আবছা_আলোয়_তুমি
শেষ পার্ট
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পিয়াসী একজন ভালো বউ, ভালো ভাবি। বাড়ির সকলেই ও-র উপর সন্তুষ্ট। তবুও নিজের দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারে না মনির।
সকালের মিষ্টি রোদ মুখে পড়তেই চোখ খোলে পিয়াসী। সম্পূর্ণ রাস্তা ঘুমিয়ে কাটিয়েছে সে, জীবনের প্রথম সমুদ্রকে এতোটা কাছ থেকে দেখতে পাবে, ভাবতেই মনটা খুশিতে ভরে যাচ্ছে তাঁর। মনির পাশের সীটে বসে আছে। ছেলেটা গাড়িতে ঘুমাতে পারে না। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তাঁকে।
–” আমরা চলে এসেছি বুঝি?”
–” না এখনও কিছুটা পথ বাকি। তুমি তো সারাপথ ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলে, যদিও আমার জন্য ভালো হয়েছে। ঘুমন্ত তুমিটাকে বড্ড সুন্দর লাগে। ”
পিয়াসী মুচকি হাসে। উত্তরে কিছুই বলে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সবকিছু দেখতে থাকে।
হোটেল রুমে বসে আছে মনির-পিয়াসী। সকালে কিছু খাওয়া হয়নি তাঁদের। মনির বাইরে থেকে কিছু কিনে আনবে ভাবছে, কিন্তু তাঁর শরীর বড্ড ক্লান্ত। হাঁটতে ইচ্ছে করছে না।
–” আপনি একটু বিশ্রাম করুন, আমি গিয়ে কিছু কিনে নিয়ে আসছি। ”
মনির মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। পিয়াসী রুম থেকে বেরিয়ে আসে। বেশ তাড়াতাড়ি ফিরে আসে পিয়াসী। দু’জনে মিলে সকালের নাস্তা সেরে নেয়। মনিরের শরীর যেন আর চলছে না, বিছানায় পিঠ এলিয়ে দেয় সে। পিয়াসী ঘুরে ঘুরে রুমটা দেখতে থাকে। যদিও তাকালে সবটা দেখা যায়। তবুও প্রতিটা জিনিসকে ছুঁয়ে দেখতে চায় মেয়েটা।
সারাটাদিন বেশ ভালোই কাটে দু’জনের।
আজ রাতের আকাশে কোন তারা নেই। চারপাশ গাঢ় অন্ধকারের ঢেকে আছে। সাগর পাড়ে মনিরের কাঁধে মাথা দিয়ে বসে আছে পিয়াসী। সামনে বিশাল কালো সমুদ্র, উপরে অন্ধকার আকাশ। তবুও সবকিছু উপভোগ্য লাগছে ওঁদের কাছে। মনির পিয়াসীর হাত ধরে বসে আছে। নিজের মনের সাথে যু’দ্ধ করে মনির ঠিক করেছে সে পিয়াসীর সাথেই থাকবে। অকারণে অতীত সামনে আনার কোন মানেই নেই।
–” আপনার কোন বোন গাড়ি এক্সিডেন্টে নিহত হয়েছিল? ”
পিয়াসীর প্রশ্নে চমকে উঠে মনির। তবুও নিজেকে সামলে বলে, ” আমার কোন বোন মারা যায়নি তো। কে বলেছে তোমায় এসব? ”
পিয়াসী একদম শান্ত হয়ে বসে আছে। চারদিক যেন একদম নিস্তব্ধ!
–” আপনিই বলেছিলে! ”
মনিরের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। এসব কি কথা বলছে পিয়াসী। মেয়েটা হয়তো মজা করছে কিন্তু মনিরের কেমন যেন লাগছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।
–” কবে বলেছি তোমাকে এসব কথা?”
–” বারো বছর চারমাস আগে!”
–” কিসব বলছো তুমি পিয়াসী? মাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো তোমার?”
–” আমার মাথা ঠিকই আছে। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন। অবশ্য এতদিন আগের কথা মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক। ”
–” পিয়াসী!”
মনির কোন কথা খুঁজে পায় না। এই মুহুর্তে কি বলা উচিত বা কি করতে হবে কিছু জানে না সে৷ পিয়াসী সবটা জেনে গেছে কি করে! নাকি আগে থেকেই সব জানতো? যদি সবকিছু জানতো তাহলে কেন বিয়ে করেছে মনিরকে?
–” আমি আর আগের মতো নেই পিয়াসী। আমি অনেক বদলে গেছি। ”
পিয়াসী হাসে। হাসির শব্দে চারিপাশ মুখরিত হয়ে ওঠে।
–” প্রথমে আমিও তেমনটাই ভেবেছিলাম। হয়তো আপনি অনেক পাল্টে গেছেন। কিন্তু মাস খানেক আগে ভুলটা শুধরে গেছে। ”
মনিরের ইচ্ছে হয় পিয়াসীর গ’লা চে’পে ধরতে কিন্তু পারে না৷ কোন এক অচেনা শক্তি তাঁর হাত পা অবশ করে দিয়েছে। মাথাটা কেমন ঝিম ধরা, চারপাশ বড্ড অন্ধকার!
তারপর আর কিছুই মনে করতে পারে না মনির। অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ে বালির উপরে। শেষ মুহূর্তে মনে পড়ে পিয়াসী তার জন্য কফি নিয়ে এসেছিল সন্ধ্যায়। স্বাদটা একদম আদা-লেবু দেওয়া কফির মতো। আদো কি কফিতে আদা লেবু দেওয়া ছিল!
জ্ঞান ফিরে নিজেকে একটা বন্ধ ঘরে আবিষ্কার করে মনির। চেয়ারের সাথে হাত পা বাঁধা তাঁর। পিয়াসী একা নিশ্চয়ই তাকে এভাবে বাঁধতে পারে না। কে আছে পিয়াসীর সাথে!
চোখ তুলে তাকাতেই নজরে আসে ওসি সাহেবকে। হ্যাঁ উনি সেই পু’লি’শ অফিসার যে সবুজের মামলা তদন্ত করেছিলেন। প্রথমে মনে হয় লোকটা খবর পেয়ে মনিরকে সাহায্য করতে এসেছে, পরক্ষণেই ভুলটা ভাঙে যখন তাঁর মুখের বিশ্রী হাসিটা চোখে পড়ে।
–” একে কি করে মা’র’তে চাও পিয়াসী? সকাল হলে ঝামেলা। ”
–” সব সত্যিটা জানিয়ে!”
মনির ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে পিয়াসীর দিকে, জ্ঞান ফিরেছে তাঁর। ভাঙা গলায় বলে, ” পিয়াসী তোমার সাথে এই লোকটা কে? আমাকে এভাবে আটকে রেখেছ কেন?”
–” যে বুঝেও না বোঝার ভান করে তাকে কিছু বোঝাতে যেও না পিয়াসী। সকাল হলে সমস্যা হবে। ”
পিয়াসী কিছু বলে না, মনিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতদিন এই লোকটাকে মা’রার জন্য অপেক্ষা করতো আজ কেন পারছে না সে। নিজের দ্বিধা কাটিয়ে বলে, ” যে আমার সুন্দর শৈশবটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, তাঁকে কি করে বাঁ’চি’য়ে রাখি বলেন? রাতের পর রাত ঘুমাতে পারিনি৷ মা’য়ের হাহাকার, বাবার আফসোস দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। সুখের সংসারে এই একটাই তো কাটা হয়ে উঠেছিলো। ”
–” সবুজকে কে মেরেছে পিয়াসী?”
–” আমি! আপনার বন্ধু চরিত্র অনেক বেশি ভালো ছিলো, তাই পরিচয় দিয়েই কথা বলেছি, এক রাতের নিমন্ত্রণ দিয়েছিলাম। সে-ও আসতে রাজি হয়ে গেলো। আর মামলা চাপা দিতে তো মারুফ আছে। ”
–” আমায় মে’রে ফেলবে তুমি? আমি না তোমার স্বামী?”
–” কেউ নয় আপনি আমার। আপনি শুধু মাত্র একজন খু’নি, যে আমাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিয়েছে। ”
–” আমি আগের মতো নেই বিশ্বাস করো তুমি, সত্যি বলছি খুব ভালোবাসি তোমাকে। ”
মারুফ দৌড়ে মনিরকে মা’র’তে আসে। কয়েকটা ঘু’সি দিতেই নেতিয়ে পড়ে মনির।
–” মাসখানেক আগে একদিন মোবাইল রেখে ওয়াশরুম গিয়েছিলেন আপনি। কৌতুহল বশত আপনার মোবাইলটা হাতে নিয়েছিলাম। ওয়ালপেপারের উপর আমার ছবি দেওয়া থাকলেও আপনার ফেজবুক আইডি জুড়ে অসংখ্য মেয়ে বান্ধবী। ফেজবুক আইডির পাসওয়ার্ড বদলে নিজের মোবাইলে আইডিটা লগইন করে নিলাম। ব্যাস! আপনার সব খবর আমার কাছে চলে আসতে লাগলো।”
–” তুমি পাসওয়ার্ড বদলে দিলে কি করে?”
–” ওটিপি দিয়ে, অবশ্য মোবাইলে ওই সীমটাই ছিলো বলে কাজটা করতে পেরেছি। ”
মনির আর কিছুই বলে না, দিন পনেরো আগে অফিসের সুন্দরী কলিগ মিতালীর সাথে একান্তে সময় কাটিয়েছে। ডজনখানেক মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক তাঁর। সে এখন চাইলেও পিয়াসীকে কিছু বোঝাতে পারবে না।
–” এতো কিছুর পরেও আপনাকে আমি সত্যিই মাফ করে দিতাম, যদি কুমারীর ক্ষতি করতে না চাইতেন। ”
অফিসের দারোয়ানের পনেরো বছরের মেয়ে কুমারী। কলিগের সাথে মিলে তাঁকে ধর্ষণ করার পরিকল্পনা করেছিল মনির। সব কথা ম্যাসেন্জার দিয়ে বলতো বলে পিয়াসী সবটা জেনে গিয়েছে।
পিয়াসী আর দেরি করে না, ড্রাগসের ইনজেকশনটা মনিরের ঘাড়ে পুশ করে দিলো। মনিরের জীবন প্রদীপ আজই নিভে যাবে। এরপর একটা নখ দিয়ে মনিরের সারা শরীরের আঁচড় কেটে দেয় পিয়াসী। এটা সেই কুকুরের নখ যার আঁচড়ের দাগ সবুজের শরীরেও ছিল।
শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে ভাঙা গলায় মনির বলে ওঠে, ” পিয়াসী সত্যি তোমাকে ভালোবাসি।”
কথাটায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না পিয়াসী। যে ভালোবাসে সে বিশ্বাস নষ্ট করে না। তবুও চোখের কোণে পানি জমে তাঁর। কেন কাঁদছে পিয়াসী! উত্তরটা পিয়াসী নিজেও জানে না। বারো বছর ধরে সবুজ আর মনিরকে খুঁজে বেড়িয়েছে সে, বারো বছর আগে সেদিনের ঘটনা জানার পর মনির আর সবুজের মুখ মনে এঁকে রেখেছে ঘৃণায়। মনিরকে খুঁজেছে সারা শহরে, গ্রামে, মফস্বলে! অবশেষে বাবাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে মনিরের বাড়িতে, সব পরিকল্পনা আজ সফল হলো তাঁর। এতটা পথ পিয়াসীর পাশে থেকেছে মারুফ। মারুফ পিয়াসীর প্রেমিক। ছেলেটা পুলিশে চাকরি করে বলে বেশ সুবিধা হয়েছে তাঁর।
–” পিয়াসী চলো এখান থেকে।”
মনিরের লাশের সামনে বসে ছিল পিয়াসী। মারুফের কথায় উঠে দাঁড়ালো। পিছন ফিরে জড়িয়ে ধরলো মারুফকে। তারপর ঘাড়ে পুশ করে দিলো ড্রাগস ইনজেকশন!
–” একি পিয়াসী! আমার সাথে কেন এমনটা করলে? আমি তো ভালোবাসি তোমাকে। ”
–” মিথ্যা বলো না মারুফ। তুমি আমাকে ভালোবাসনি, তুমি ভালোবেসেছ আমার অঢেল সম্পত্তিকে। ”
–” এসব কি বলছ তুমি? না না এ সত্যি নয়। প্লিজ আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চলো, আমি বাঁচতে চাই। ”
–” কখনোই না মারুফ। মনে পড়ে তুমি কিছুতেই এসব কাজে আসতে চাওনি। সবুজের হ’ত্যায় কোন প্রকার সাহায্য করতে চাওনি। আমি হাজারবার বলেছি তোমার আমি সবুজকে মা’র’তে চাই কিন্তু তুমি না করতে। সেদিন হঠাৎ সবুজের ছবি দেখে আমার সঙ্গী হলে কেন?”
–” ভেবেছিলাম ভালোবাসি যখন তখন পাশে থাকা উচিত। ”
–” মিথ্যা কথা! কারণ সবুজের স্ত্রী তোমার প্রেমিকা। তাছাড়া তুমি আমাকে ভালোবাসলে একটা কেস চাপা দিতে দশ লাখ টাকা দাবী করতে না। খোঁজ নিয়ে জেনেছি তুমি ওই টাকা দিয়ে নবনীতাকে হীরার হার কিনে দিয়েছ। ”
–” তুমি এসব কি করে জানলে পিয়াসী?”
–” মারুফ আমি সেই মেয়ে, যে বারো বছর আগের ঘটনা এখনও মনে রেখেছি। মনির আর সবুজকে খুঁজে বের করেছি। এসব কাজ আমার তেমন কঠিন মনে হয় না এখন। ”
মারুফ আর কিছু বলতে পারে না, ঢলে পড়ে মেঝেতে। পিয়াসী দু-হাত দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে নেয়। আজ বড্ড ক্লান্ত লাগছে তাঁর, একটা লম্বা ঘুমের প্রয়োজন। জীবনের শুরুটা মনির সবুজ অন্ধকার করে দিয়েছিল, মারুফের বিশ্বাসঘাতকতা পিয়াসীকে কষ্ট দেয়নি, বরং পাথর করে দিয়েছিল। সাত বছরের সম্পর্ক ভুলে মারুফ নবনীতার প্রেমে পড়েছে! কথাটা জানার পর আর কিছু ভাবতে পারেনি পিয়াসী। মনিরের মতো তাঁকেও বিদায় করে দিয়েছে। আচ্ছা পৃথিবীতে কি একজনও পুরুষ নেই যাকে বিশ্বাস করা যায়!
লা’শ দুইটা ওখানে রেখেই বাইরে চলে আসে পিয়াসী, সাগরের পানিতে গোসল শেষে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা দেয়। তাঁকে এ শহর ছাড়তে হবে, যেতে হবে বহুদূর!
সমাপ্ত