কথা দিলাম পর্ব -০১

নিজের হাতে নিজের বোনকে বিয়ের জন্য সাজিয়ে দিচ্ছি, যেমন তেমন ভাবে নয়! খুব সুন্দর ভাবে, একদম রানীদের মতো করে। আমার স্বামী আহ! ভুল বললাম। আমার প্রাক্তন স্বামী আমার বোনকে দেখে আজকে চোখ ফেরাতে পারবে না। বোনকে সবার শেষে মাথার উপর ভেলটা ভালোভাবে বসিয়ে, আয়নার দিকে তাকিয়ে কানে কানে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কি রে? সাজ সুন্দর হয়েছে তো?’

বোন কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দু-বাহু ধরে আমাকে একটু পিছিয়ে দিয়ে, নিজে এগিয়ে এলো। তারপর হঠাৎ করেই আমাকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলতে শুরু করলো,

‘দিদি, দিদি, দিদি! তুই এই দুনিয়ার সবথেকে ভালো দিদি। আই উইশ, প্রত্যেক বোন জানো তোর মতই দিদি পায় জীবনে।’

‘আচ্ছা এবার থাম। নাহলে বিয়েতে বসার আগে মাথা ঘুরে এখানেই পরে থাকবি। বিয়ে করতে হবে না আর তখন।’

আমার কথা শুনে ও ঝট করে থেমে গেলো আর মুখ থমথমে করে বললো,

‘দিদি প্লিজ! এসব অশুভ কথা বলিস না। তুই খুব ভালো ভাবেই জানিস আমি “ওকে” কতটা ভালোবাসি। একদমই পারবো না “ওকে” ছাড়া থাকতে।’

‘হ..হম জানি তো। আর তোর “ও” তোকে ছাড়া থাকতে পারবে না। তাই জন্যেই তো বললাম সাবধানে।’

বোন আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আর বললো,

‘উফ! আমার যে কি খুশি লাগছে আমি তোকে বলে বোঝাতে পারবো না। থ্যাংকস দিদি। তুই যদি এত বড়ো স্যাক্রিফাইস না করতিস তাহলে আমার জীবনে এই খুশির দিনটা আসতোই না। কিন্তু আমি তোকে বিয়ের আগেই বলে দিয়েছিলাম যে তোর বর শুধুমাত্র আমাকে ভালোবাসে, তুই এই বিয়ে করিস না। তখন যদি আমার কথা শুনতিস তাহলে আজকে এই দিনটা তোকে দেখতে হতো না।’

‘ছাড় না এখন এসব কথা। বাদ দে এইসব, অতীতের কথা মনে করে এখনকার আনন্দটা মাটি করিস না। চল, এইবার নীচে যেতে হবে তো?’

‘অবশ্যই! ও নীচে যাবে আমার সাথে। তোমার সাথে নয় সিয়ারা।’

আমি বুঝতে পারলাম গলার স্বরটা দরজার কাছ থেকে এসেছে। কিন্তু সেদিকে ফেরার শক্তি পাচ্ছি না, কেমন জানো স্তব্ধ হয়ে রয়েছি। না, আমাকে তো সবকিছুর মুখোমুখি হতেই হবে। আমি নিজেকে দেওয়া কথা তো ভাঙতে পারিনা, কিছুতেই না। সাহস করে পিছন ফিরতেই দেখলাম বরের বেশে দাঁড়িয়ে আছে আমার মনের মানুষটা। বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো কেমন জানো। কি সুন্দর, কি অমায়িক লাগছে তাঁকে দেখতে। সে আমার বোনের দিকে নিজের ডান হাত বাড়িয়ে দিতেই আমার বোন তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের বাম হাত তাঁর ডান হাতের উপর রেখে, তাঁর খুব কাছে চলে যায়। এই দৃশ্য দেখে আমার চোখ জলে ভরে ওঠে আর সাথে সাথে একটা অন্য দৃশ্য ভেসে ওঠে যেখানে আমার বোনের জায়গায় আমি নিজেকে দেখতে পাই। আমার মানুষটা যেখানে আমাকে বলছে,

‘ভালোবাসি সিয়ারা। “কথা দিলাম” তোমার এই হাত কখনও ছাড়বো না আমি। তোমার এই হাতটা নিজের হাতে আবদ্ধ করে, তোমাকে পাশে নিয়ে জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটা নিতে চাই।’

ক্রমশ মলিন হয়ে যাচ্ছে এই দৃশ্য আমার চোখের সামনে থেকে। আবারও আমার জায়গায় নিজের বোনকে দেখতে পাচ্ছি। বুকের ভিতরে একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে। কষ্টটাকে চাপতে চাপতে এখন এই কষ্টটাই আমার গলা চেপে ধরেছে। দমবন্ধ লাগছে, অস্বস্তি হচ্ছে। চোখের সামনে রঙিন পৃথিবী অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো, নিমিষে সবকিছু ফিকে হয়ে গেলো আমার কাছে।

‘কাট, কাট, কাট!’

হঠাৎ মাইকে একটা মধ্যবয়স্ক লোকের আওয়াজ শুনে সবাই সজাগ হলো নাহলে এতক্ষন সামনে চলা একপাক্ষিক বিরহ-বেদনা উপলব্ধি করতে ব্যস্ত ছিল সবাই। মধ্যবয়স্ক লোকটি উত্তেজিত হয়ে মাইক হাতে নিয়ে আবারও বলে উঠলো,

‘এসব কি হচ্ছে? স্ক্রিপ্টে তো এসব কিছুই ছিলো না। সিয়ারা, সিয়ারা! উঠে পরো, তোমার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কোনো সিন স্ক্রিপ্টে ছিলো না।’

মধ্যবয়স্ক লোকটির কথা শুনে বরের বেশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি মেঝেতে লুটিয়ে পরে থাকা সিয়ারার কাছে ছুটে গেলো। ডাকতে লাগলো তাকে,

‘সিয়া! এই সিয়া! ডিরেক্টর কাট বলে দিয়েছে। এইবার ওঠ, উনি কিন্তু ভীষণ রেগে যাচ্ছেন। কি রে?’

ছেলেটি সিয়ারার হাত ধরে টেনে উঠাতে গেলে দেখে সিয়ারার হাত নুইয়ে পরে গেলো আবার মেঝেতে। আরেকবার সিয়ারার হাত ধরে ছেড়ে দিলে আবারও তা মেঝেতে নুইয়ে পরে। ছেলেটি নিশ্চিত হয়ে সাথে সাথে সিয়ারাকে কোলে তুলে নেয়। সবার উদ্দেশ্যে বলে,

‘সিয়া সত্যি সেন্সলেস হয়ে গেছে। ওকে গ্রীন রুমে নিয়ে যাচ্ছি আমি। স্যার, ডক্টরকে কল করুন।’

ছেলেটি উদ্ভ্রান্তের মতো গ্রীন রুমের দিকে ছুটে চলে যায় সিয়ারকে নিয়ে। সবাই বেশ বড়ো সড়ো একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে কিছুক্ষণ আগের এই ঘটনার জন্য। কিন্তু মধ্যবয়স্ক লোকটির ঝাঁঝালো কণ্ঠের নির্দেশ শুনে সবাই হুঁশ ফিরে পেলো।

‘যাও যে যার কাজে যাও! আমি ডক্টরকে ফোন করছি। অন্য সিনের নেক্সট শট নেবো আমি আর তিরিশ মিনিট পর, সেট রেডি করো। গো, ফাস্ট!’

সবাই যে যার নিজের কাজে চলে যায় ধমক খেয়ে। আসলে, মধ্যবয়স্ক লোকটি হলেন বাংলা ছোট পর্দা অর্থাৎ সিরিয়ালের পরিচালক বা ডিরেক্টর সুরেশ চক্রবর্তী। এখানে ওনার পরিচালনায় তৈরী করা একটি সিরিয়ালের শুটিংই চলছিলো আর সেই শুটিং চলাকালীন সিয়ারা অর্থাৎ এই সিরিয়ালের নায়িকা জ্ঞান হারায়। সিয়ারার জ্ঞান হারানোর কথা শুনে এই ধারাবাহিক বা সিরিয়ালের প্রযোজক সুধাংশু গাঙ্গুলি সেটে চলে আসেন। ওনাকে জানানো হয় সিয়ারা গ্রীন রুমে আছে তাই উনি সেদিকে প্রস্থান করেন। গ্রীন রুমে উপস্থিত হতেই দেখেন সিয়ারা চুপচাপ শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে আর ওর পাশেই ওনার ছেলে বসে আছে। বেচারা নিজের ড্রেস ছাড়েনি এখনও পর্যন্ত, শুটিংয়ের ড্রেসেই বসে আছে।

‘দেবু! সিয়া মা কেমন আছে এখন?’

নিজের বাবার গলার স্বর পেতেই দেবাংশু সেদিকে তাকায়। চিন্তিত কণ্ঠে বলে ওঠে,

‘তুমি কখন এলে? তোমার তো শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।’

‘তাই বলে এতোটাও শরীর খারাপ না যে সিয়া মা অসুস্থ জেনেও আমি আসতে পারবো না। তুমি যাও গিয়ে চেঞ্জ করে নাও আমি বসছি ওর কাছে।’

বাবার কথা শুনে দেবাংশু চলে যায়। সুধাংশুবাবু সিয়ারার কাছে বসেন। ওনার চোখে মুখে চিন্তার ছাঁপ। দেবাংশুর কথা মনে করে উনি মনে মনে ভাবলেন,

‘আমি তো এইখানে আসার জন্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলাম। তোকে যে আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা জানানোর ছিলো। রাস্তায় তোর অসুস্থ হওয়ার কথাটা আমাকে আরো বেশি চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। বুঝতে পারছি না এই অবস্থায় তোকে কীভাবে বলবো কথাটা।’

‘আঙ্কেল আপনি? আপনি কখন এলেন।’

সুধাংশুবাবু দেখলেন সিয়ারা উঠে বসেছে নিজে নিজেই। উনি কিছু বলবেন তাঁর আগেই সিয়ারা আবার জিজ্ঞেস করলো,

‘আপনার এখানে আসার কি দরকার ছিলো? আপনার তো শরীর ভালো না, এমন কিছু হয়নি আমার যে আপনাকে এভাবে শরীর খারাপ নিয়ে আসতে হবে।’

‘এক্সাক্টলি! এই কথাটাই আমি পাপাকে বললাম বাট আমার কথার কোনো দামই দিলো না। বায় দ্য ওয়ে, তোর কি হয়েছিল?’

দেবাংশু ওয়াশরুম থেকে বেরোতে বেরোতে কথাগুলো বলে। শেষের প্রশ্নটা সিয়ারকে বেশ বিচলিত করে দিলো।

‘জানি না কি হলো।’

দেবাংশু হালকা হাসলো উত্তরটা শুনে। ডক্টর ওকে জানিয়েছেন, সিয়ারা ট্রমার কারণে অজ্ঞান হয়ে গেছিলো। সে বেশ আন্দাজ করতে পারছে সিয়ারা ঠিক কি জন্যে অজ্ঞান হয়েছে। কারণ সিয়ারা তাঁর কাছে খোলা বইয়ের মতো। আজকে শুটিং সিন যে হুবুহু সিয়ারার জীবনকাহিনীর সাথে মিলে গেছে তা সে আজ সকালে স্ক্রিপ্ট পরেই বুঝতে পেরেছিল। স্ক্রিপ্টের বদল যে যেভাবে সিয়ারকে এফেক্ট করবে সেটা হয়তো সে আন্দাজ করতে পেরেছিল কিন্তু সিয়ারা প্রতিবাদ না জানানোয় সে’ও কিছু বলে না।

‘আজ আমার অতীতটা এভাবে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠবে ভাবতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম আমি মুভি অন করে গেছি কিন্তু বরের বেশে দেবাংশুকে দেখার পর এভাবে যে “ওর” মুখটা আমার চোখের সামনে জ্বলজল করে উঠবে ভাবিনি। কিন্তু আঙ্কেলকে এত চিন্তিত লাগছে কেন? তাহলে কি….??

‘স্যার! বাইরে আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছেন, একজন প্রোডিউসার।’

এই কথাটা শুনে সুধাংশুবাবুর মুখটা আরো বেশি ফ্যাকাশে হয়ে গেলো যা সিয়ারার চোখ এড়ালো না। উনি হ্যাঁবোধক মাথা নাড়িয়ে দেবাংশু আর সিয়ারাকে বললেন,

‘দেবু তুই আয় আমার সাথে। সিয়ারা মা তুমি রেস্ট নাও আমরা আসছি। নতুন একটা প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলবো, এসে তোমাকে জানাবো।’

সুধাংশুবাবু আর দেবাংশু চলে যান। কিন্তু সুধাংশুবাবুর কথা সিয়ারার জন্য বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। সোফা থেকে নেমে ধীর পায়ে দরজার কাছে এগোলে হঠাৎ করেই সিয়ারার চোখ গুলো বড়ো বড়ো হয়ে যায়। পিছিয়ে যায় সে আর কিছুক্ষণের জন্য নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। বড়ো একটা নিশ্বাস নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলে বের হয় গ্রীন রুম থেকে।

[#

‘কথা দিলাম’ 🌸❤️
||পর্ব ১||
কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

{

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here