#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(5)
কাব্যের মেসেজে ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে অরুনিকার। মনে মনে আদাভানকে আরও একটু জ্বালানোর প্ল্যান করে নে সে। কাব্য আজ অরুনিকাকে নিতে আসবে, এটা শুনে ক্রুর হাসে অরুণিকা। ফোনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে একবার তাকায় আলেয়া আর আদিত্যর দিকে। দুজনে এখনও একইভাবে ঝগড়া করে যাচ্ছে। বিরক্তির চরমে পৌঁছে কিছু বলতে নিলেই সামনের দিকে তাকিয়ে থমকে যায় অরুনিকা। বুকের বাম পাশে অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করে। নিশ্বাস নিতেও কেমন যেনো কষ্ট অনুভব হয়। যেনো এখনই দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে সে।
কলেজের মেইন গেটের কাছে একটা গাড়ি এসে থামতেই একটা মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে আদাভানকে। আদাভানও তাকে জড়িয়ে ধরেছে। মেয়েটার পরনে শর্ট টপ সাথে ব্ল্যাক জিন্স, দেখে বেশ মডার্ন বলেই মনে হচ্ছে। অরুনিকা এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক ফেলতেও যেনো ভুলে গেছে। পলক ফেললেই যেনো কিছু মিস হয়ে যাবে, কিছু হারিয়ে যাবে তার কাছ থেকে। এতক্ষনে মেয়েটা আদাভানের গলা জড়িয়ে ধরে কিছু একটা বলছে। আদাভানও পরম যত্নে দুই হাতের আজলায় তার মুখটা নিয়ে হেসে হেসেই কিছু বোঝাচ্ছে। হয়তো প্রেমিকার রাগ ভাঙ্গাচ্ছে। এসব ভাবনার মাঝেই চোখ থেকে একফোঁটা পানি টুপ করে গিয়ে পড়লো অরুনিকার হাতে থাকা পানির গ্লাসে। গ্লাসের পানির সাথে চোখের পানি মিশে একাকার হয়ে গেলো। কেউ ধরতেই পারবেনা এই পানিতে আছে কারোর বেদনার একফোঁটা চোঁখের পানি।
সবার চোখের আড়ালেই অরুণিকা খুব সন্তর্পনে মুছে ফেললো নিজের বিষাদের চিহ্ন। নিজের দুর্বলতা কারোর সামনে প্রকাশ করতে সে বরাবরই অনিচ্ছুক। মুখে তাচ্ছিল্যমাখা এক হাসি দিয়ে কাউকে কল করে কাউকে কিছু এগিয়ে গেলো কলেজ গেটের দিকে। এতক্ষনে আদিত্য আর আলেয়ার হুস ফেরে। নিজেদের ঝগড়া, মা*রামা*রি বাকি রেখে হাবলার মতো তাকিয়ে থাকে অরুনিকার দিকে। অরুনিকার ক্লাস না করেই বেরিয়ে যায় কলেজ থেকে। আজ কিছুই তার ভালো লাগছেনা। আদাভানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একপলক ফিরেও তাকায়নি সেদিকে। ভীষণ অভিমান জন্মেছে আদভানের প্রতি তার। একবারও পিছনে না ফিরেই রিক্সায় চড়ে বেরিয়ে যায় সে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে নিজেকে দেখে যাচ্ছে অরুনিকা। নিজের মনের মধ্যে এক অদৃশ্য যুদ্ধ চলছে তার। একপক্ষে রয়েছে অতীতের বদলা আর অপরপক্ষে রয়েছে নিজের ভালোবাসা। একসময় কান্নাতে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে অরুনিকা। তার সাথে এমনটা না হলে কি খুব ক্ষতি হতো? খুব ক্ষতি হতো আদাভান নামক নরপিশাচের প্রেমে না পড়লে? আসলেই কি এটা প্রেম নাকি ভালোবাসা? প্রেমে তো মানুষ বারবার পড়ে, কিন্তু ভালোবাসা! সেতো একবারই হয়। আদাভানকে ভালবাসার আগে কেনো সত্যিটা তার চোখের সামনে এলোনা? কেনো ভালোবাসা এতো যন্ত্রণাময়? ভেতরটা যে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে তার। কিভাবে সহ্য করবে এতকিছু অরুনিকা! কিন্তু ওকে যে শক্ত থাকতে হবে। নিজের জন্য না হলেও তার বড়ো আপার জন্য তাকে শক্ত হতে হবেই। নিজের দুর্বলতা কারোর সামনে দেখানো যাবেনা। আয়নার সামনে উঠে দাড়িয়ে পাগলের মতো দুই হাত দিয়ে চোখ মুছে বিড়বিড় করে বলে,
“বর্ষা আপা আমি তোমার সাথে হওয়া অন্যায়ের বদলা নেবোই। ওই আদাভান আহসানকে আমি নিঃশেষ করে দেবো। যার জন্য আমি আমার বড়ো আপাকে হারিয়েছি হারানোর যন্ত্রণা তাকেও পেতে হবে। প্রতি মুহূর্তে সে হারাবে, সব হারাবে। হারাতে হারাতে নিঃশেষ করে দেবো আমি তাকে। আর কোনো নারীর জীবন নিয়ে খেলতে আমি দেবোনা আপনাকে মি. আদাভান আহসান। নারীকে আপনি খুব দূর্বল মনে করেন তাইনা? সেই নারী প্রজাতিই আপনাকে ধুলোর সাথে মিশিয়ে দেবে। এটা আমার ওয়াদা।” বলেই পাগলের মতো আয়নার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে অরুণিকা। পরক্ষনেই দুই হাতে মুখ চাপা দিয়ে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে।
কেনো আমাকে এত অবহেলা করছো মিস. পমপম। তুমি জানোনা আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তোমার পছন্দের সবকিছুই আমার ভালোবাসার অংশ হয়ে গেছে তুমি কি সেটা জানো? তুমি পমপম ভীষণ পছন্দ করো, এই যে দেখো পুরো আলমারির অর্ধেক আমি পমপম ওয়ালা ড্রেসে ভরিয়ে রেখেছি। যতবার নিজের জন্য শপিংয়ে গেছি তোমার জন্য শাড়ী, ড্রেস, ওড়না কিনেছি। সবগুলোই তোমার পছন্দের। আচ্ছা আমার ভালোবাসার গভীরতা তুমি কী একটুও অনুভব করতে পারোনা? আমার চোখে তোমার জন্য ফুটে ওঠা গভীর ভালোবাসা তোমার চোখে পড়েনা? এত অভিমান কেনো জমাচ্ছ মিস. পমপম? পারবে তো এই অভিমান ভাঙাতে? নাকি ! বলেই এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদাভান।
এখন প্রায় সময় অরুণিকা কাব্যের বাইকে করে আসে। খুব একটা কারোর সাথে কথাও বলেনা। আর আদাভানের সাথে তো ভুল করেও দেখা হয়না তার। আদাভান যে দেখা করতে চায়না এমনটা নয়। বারবার চেষ্টা করেও অরুনিকাকে এক পলক দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। ভেতরে ভেতরে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে যে এক প্রেমিক পুরুষ সেদিকে কোনো খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনা অরুনিকা। কলেজ স্টুডেন্টদের রোজ ক্লাসে প্রেজেন্ট থাকার কথা জোর করে বলতেও পারেনা সে। অভিমানের পাল্লাটা ক্রমে ভারী হতেই থাকে।
এদিকে নূরের বাড়ী থেকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ার এক পর্যায়ে এক সুদর্শন ছেলের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়। পাত্র ভালো জব করে, সেটেল্ড। ব্যাস মেয়ের সুখের জন্য আর কি চাই। এসব ভেবেই নূরের মতামতের অপেক্ষা না করেই তারা বিয়ের ডেট ফিক্স করে ফেলে। নূরকে যে এক পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিলো এটা আদিত্যকে বলেছিলো সে। কিন্তু সবকিছুই যে এত তাড়াতাড়ি ঘটে যাবে কেউ ভাবতেও পারেনি। আদিত্যর ব্যাপারে বলতে গিয়েও অজানা এক কারণে নূরের মুখ থেকে একটা কোথাও বেরোলোনা সেই মুহূর্তে। নূরের বাবা, মা চুপ থাকা সম্মতির লক্ষণ ভেবে খুশী হয়ে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে যান বিয়ের আয়োজন করতে। ওনাদের রুম থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে নূর। কাঁপা কাঁপা হাতে বেড থেকে ফোন নিয়ে আদিত্যকে কল করে।
“কি ব্যাপার আজ দেখি আমাকে খুব মিস করছিলি তুই? এইতো একটু আগেই কথা হলো আবারো মণে পড়ে গেলো বুঝি?” বেশ ঠাট্টার সাথে কথাটা বললেও নূরের ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলনা আদিত্য।
“এই নূর? কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ লাগছে? অনেক কষ্ট হচ্ছে? এই নুরপাখিটা কী হয়েছে তোর আমাকে বলনা! তুই করিসনা প্লীজ। কি হয়েছে বল। আমি সব ঠিক করে দেবো।”
“তুই আর কিছুই ঠিক করতে পারবিনা আদিত্য। সব শেষ হয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহে আমার বিয়ে। আমার বিয়েতে আসিস প্লীজ। শেষ বারের মতো সেদিন তোকে দেখবো। মন ভরে দেখবো। তোকে ছোঁয়ার অধিকার হারালেও তোকে মন ভরে দেখবো সেদিন।” অতিরিক্ত কান্নার ফলে আর কিছুই বলতে পারলোনা নূর।
নূরের কথায় পুরোপুরি থম মেরে গেছে আদিত্য। এখন তার কি করা উচিত সে নিজেও বুঝতে পারছেনা। তবে আর যাই হোক তার নুরপাখিকে সে হারাতে পারবেনা। কিছুতেই নাহ।
“তুই এতকিছু ভাবিসনা নূর। তুই আমার নূরপাখি। তোকে আমার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবেনা। কাল তুই কলেজে আয়, যা করার আমিই করব। তুই শুধু কাঁদবি না। একদমই কাঁদবিনা।”
নিজের বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে অরুণিকা। তার চোখে আজ ঘুম নেই। চোখ দুটোও যে বেইমানি করছে আজ তার সাথে। অন্য কারোর বিরহে চোখের জল পড়ছে তার, এটা ভাবলেই রাগ চরমে পৌঁছে যাচ্ছে অরুনিকার। এমন বেইমান জিনিষ নিজের শরীরে রাখতেই ইচ্ছে করছেনা তার। মিঃ আদাভান আমি শুধু আপনাকে ঘৃণা করি। এতটা ঘৃণা করি যে নিজের হাতে খু*ন করতেও দুই বার ভাববো না। আপনি আমার আপুর খু*নী, আমার কিশোর জীবনের খু*নী, আমার আম্মু আব্বুর স্বপ্নের খু*নী, আমার ভালোবাসার খু*নী। এত এত খু*ন করেও বেঁচে আছেন কিভাবে? নিজেকে খু*ন করতে ইচ্ছে করেনা আপনার? বলেই পাশে থাকা ফ্লাওয়ার ভাসটা ছুঁড়ে ফেলে নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। কয়েক টুকরোতে সেটা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। সেদিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“ঠিক এভাবেই খন্ড বিখণ্ড করবো আপনাকে। এত টুকরো করবো যে কেউ জোড়া লাগাতে পারবেনা।
চলবে?
#Fiza siddique