আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে পর্ব-৪৩

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(43)

বৃষ্টির মাঝে গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা সাদা পাঞ্জাবীতে আদাভান শুয়ে আছে। এটা রোজকারের অভ্যেসে পরিণত হয়েছে গত তিনটে মাসে। সময়ের সাথে বদলেছে ঋতু, বদলেছে আবহাওয়া। কিন্তু আদাভান আজও বদলায়নি। আজও অরুনিকাকে বুকে নিয়ে না ঘুমালে তার ঘুম আসেনা। তাইতো রোজ রোজ ছুটে আসে অরুনিকার কাছে একটু নিদ্রার খোঁজে। ছুটে আসে খুঁজতে একটু প্রশান্তি।

বৃষ্টির তেজ কিছুটা কমে গেছে। দুইহাত মাথার পিছনে দিয়ে মাটির উপর শুয়ে আছে আদাভান। দৃষ্টি আকাশের দিকে। শূন্যে দৃষ্টি মেলে বেশ কিছুক্ষন ভাবনার পর দুই চোখ বুজলো আদাভান। বুকের উপর ভারি কিছু অনুভব করেই মুচকি হাসলো।

“এসেছো প্রাণপাখি! এতো অপেক্ষা কেনো করাও আমাকে বলতো। এতো নিষ্ঠুর কবে থেকে হলে তুমি? আমাদের সন্তানকেও একটু দেখতে দিলেনা আমায়, নিজের সাথেই নিয়ে চলে গেলে। খুব ভালোলাগে আমাকে কষ্ট দিতে তাইনা? প্রাণপাখি! আমি ঘুমাতে পারিনা। শূন্যতায় খা খা করছে বুকটা আমার। এতো স্বার্থপর কেনো তুমি প্রাণপাখি? নিজে তো দিব্বি ঘুমিয়ে আছো নিশ্চিন্তে। একটুও কি মনে পড়েনা আমার কথা? মনে পড়েনা তুমিহীনা আমি শুন্য। তোমার স্মৃতিগুলো আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশকে কিভাবে ভুলবো আমি প্রাণপাখি? আমি যে চরম অভাগা। পারলাম না তোমাকে আমার কাছে রাখতে। পারলামনা একজনম তোমার হাতে হাত রেখে হাঁটতে। আচ্ছা, আমি কি খুব বেশি কিছু চেয়ে ফেলেছিলাম জীবনের কাছ থেকে? আমাদেরও তো একটা সুখের সংসার হতে পারতো।”

“এই প্রাণপাখি! প্রতিদিনের মত আজও চুপ করেই থাকবে? কতোগুলো দিন তোমার কণ্ঠস্বর শুনিনা, দেখিনা তোমার দুষ্টুমিভরা চেহারা। কেনো চলে গেলে প্রাণপাখি আমাকে একা করে? সাথে কি নেওয়া যেতনা আমায়? আমাকে বেঁচে থাকার জন্য কিছু তো দিয়ে যেতে পারতে? তোমরা দুজনেই স্বার্থপরের মতো একা ছেড়ে দিয়েছ আমাকে। আমি যে শেষ হয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। সেদিন তো ডক্টরের কাছে আমি তোমাকে ভিক্ষা চেয়েছিলাম। তবে কেনো দিলোনা বলোনা? কেনো সৃষ্টিকর্তা কেড়ে নিলো সব আমার থেকে। এই এই দেখো অনেক অভিমান জমে আছে। এসোনা, ভেঙ্গে ফেলো সব অভিমানের বেড়াজাল।”

হসপিটালে,

“আমি মনে হয় আর ফিরবনা আদাভান। আমাদের সন্তানকে আমাদের দুজনের ভালোবাসা দেবেন।”

“চুপ করো প্রাণপাখি। আমাকে এভাবে আঘাত কোরোনা প্লিজ। কষ্ট হচ্ছে যে খুব। সাবধানে ফিরে এসো আমাদের সন্তানকে নিয়ে।”

“আমার হাতে সময় অনেক কম আদাভান। আমাকে বলতে দিন প্লিজ।”

ছলছলে চোঁখে স্ট্রেচারে করে ওটির উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া অরুনিকার দিকে তাকিয়ে আছে আদাভান। পথিমধ্যে বহু কষ্টে ডক্টরকে থামিয়ে আদাভানের হাত আঁকড়ে ধরে অরুনিকা।

“শুনুন, ভালো কোনো মেয়েকে বিয়ে করে নেবেন। তবে তাকে শুধু প্রাণপাখি ডাকবেন না। ওই নামটার উপর শুধু আমার অধিকার। এটা আর কাওকে দিতে পারবনা আমি। খেয়াল রাখবেন নিজের। ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি তোমাকে আদাভান।”

বহু বছর পর কাঙ্খিত শব্দগুচ্ছ শুনে শব্দ করে কেঁদে উঠলো আদাভান।

“আদাভান! আর কখনো হয়তো বলতে পারবোনা তাই আজই বলে দিলাম। আমি তোমাকে অনেক অনেক অনেক বেশিই ভালোবাসি।”

আদাভান কিছু বলে ওঠার আগেই অরুনিকার অবস্থা আরও খারাপ হতে দেখে ওটির ভেতরে নিয়ে নেওয়া হয়। হসপিটালের করিডোরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে আদাভান। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। অতিরিক্ত কান্নার ফলে হাঁপিয়ে উঠে হেঁচকি তুলছে। অরুনিকার বলা কথাগুলো মনে করে আরোও দুর্বল হয়ে পড়ে। পিঠে কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাহসান সাহেবকে দেখে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। আদাভানকে উঠিয়ে বুকে টেনে নেন তিনি।

দুই ঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে। ওটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার মাঝে হটাত করে একজন নার্স বেরিয়ে আসতে সেদিকে দৌড়ে গেলো আদাভান।

“পেশেন্টের গার্ডিয়ান কে আছেন?”

“আমি ওর হাসবেন্ড।”

“দেখুন পেটেন্টের অবস্থা অনেক ক্রিটিকাল। মা আর বাচ্চা দুজনের মধ্যে একজনকে বাঁচাতে হবে। প্লিজ আপনার সিদ্ধান্ত জানান।”

একমুহুর্তও সময় ব্যয় না করে আদাভান বললো,

“আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিন প্লিজ। আর কিছুই চাইনা আমার। আমার অরুকে চাই শুধু আমার। যে কোনো মূল্যে আমার চাই অরুনিকাকে।”

“আপনারা উপরওয়ালাকে ডাকুন। আমরা আমাদের বেষ্টটা দিয়ে চেষ্টা করবো। বাকিটা ওনার হাতে।”

একঘন্টা পর ওটির লাইট অফ হতেই বেরিয়ে আসেন ডক্টর। মলিন মুখে একবার সবার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নেন।

“উই আর এক্সট্রিমলি সরি। আমরা পেশেন্টকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছি। বাট শি ইজ নো মোর।”

কথায় আছে অতি শোকে মানুষ পাথরে পরিণত হয়। আদাভানের অবস্থাও ঠিক তেমনই। বাড়ির সবার কান্না কাটিতে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকায় আদাভান। সাদা কাপড়ে মোড়ানো নিস্তেজ বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে থাকে। সারামুখে চুমু খেয়ে বুকের মাঝে আগলে নেয়।

“এই প্রাণপাখি দেখো আমাদের মেয়ে হয়েছে। আমাদের একটা ফুটফুটে মেয়ে হবে বলেছিলে না তুমি? দেখো তোমার কথা আল্লাহ শুনেছেন। এই প্রাণপাখি, দুজনে এমন চোখ বন্ধ করে রেখেছ কেনো? আমার উপর কি খুব অভিমান হয়েছে? এই এই চোখ খোলানা প্লিজ। আমি সব অভিমান ভাঙিয়ে দেবো। আম্মু বাবুকে একটু কোলে নাওতো। আমি আমার অরুপাখিকে কোলে করে নিয়ে যাবো বাড়ীতে আজ।”

আদাভানের পাগলামিতে মুখ চেপে কান্না করেন আনিকা আহসান। রুবিনা বেগম কান্নাকাটি করে ভেঙ্গে পড়েছেন। তাহসান সাহেবেরও আজ কাহিল দশা। অরুনিকার মৃত্যু সংবাদে মিনি স্ট্রোক করেছেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডমিট করা হয়েছে তাকে, এখনো জ্ঞ্যান ফেরেনি। আনিকা আহসান বাকি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনরকমে নিজেকে সামলে রেখেছেন। ভেতরে ভেতরে তিনিও শেষ হয়ে যাচ্ছেন ছেলেমেয়ের এই করুন পরিণতিতে।

ইতিমধ্যে আশেপাশের অনেক লোক এসে জড়ো হয়েছে আদাভানদের উঠানে। উঠানের মাঝবরাবর একহাতে অরুনিকাকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে বসে আছে আদাভান। কেউ ধারে কাছে ঘেসলেই সাপের মতো ফুঁসে উঠছে। আদাভানের অবস্থা দেখে উপস্থিত সবার চলে জল। আনিকা আহসান সদ্য গোসল দেওয়া কাফনে মোড়ানো বাচ্চাকে আদাভানের কাছে আনতেই রাগী দৃষ্টিতে তাকায় আদাভান।

“ওকে নিয়ে যাও এখান থেকে। একদম আমার কাছে আনবেনা। ওর জন্য আমার প্রাণপাখি আমার সাথে কথা বলছেনা। সব ওর জন্য হয়েছে। কে বলেছিল ওকে আসতে? আমার আর আমার প্রাণপাখির মধ্যে অভিমানের সৃষ্টি করেছে ও। নিয়ে যাও ওকে। আমি ওর মুখ দেখতে চাইনা। আমার প্রাণপাখি যতক্ষণ না আমার সাথে কথা বলবে আমি ওকে কোলে নেবনা, দেখবোনা।”

ছেলের পাগলামিতে ডুকরে কেঁদে ওঠেন আনিকা আহসান। স্বামী হারিয়ে একমাত্র ছেলেকে নিয়েই তার জীবন। সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছেন সবসময় আদাভানকে ভালো রাখতে। অথচ আজ ভাগ্যের লীলাখেলার কাছে এসে অপারগ। চাইলেও পারছেন না ছেলেকে স্বাভাবিক করতে।

হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করে এই বাড়ীতে আনা হয়েছে তাহসান সাহেবকে। আদাভানের পাশে বসে নরম সুরে বলেন,

“বাবা, আমার মেয়েটা যে কষ্ট পাচ্ছে। এভাবে আর বেশিক্ষণ ওকে রাখা যাবেনা। গোশুল দিতে হবে, দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে।”

“বাবা, অরুকে আমি কোথাও নিয়ে যেতে দেবোনা। আমার অরু আমার কাছেই থাকবে। এইযে দেখুন ওই সামনের কাঠগোলাপ গাছটা আমার অরুর পছন্দের অনেক। ওকে ওখানে দাফনের ব্যবস্থা করুন প্লীজ।”

কান্নাভেজা কণ্ঠে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানান তাহসান সাহেব। যথারীতি গোসুল দেওয়া হয়। দাফনের সব কাজ আদাভান নিজের হাতেই করে। তারপর অতি যত্নে শুইয়ে দেয় অরুনিকাকে। পাশের ছোট্টো কবরে তাহসান সাহেব শুইয়ে দেন প্রাণপ্রিয় মেয়ের শেষ অংশকেও। এক এক করে চাপা দেওয়া মাটির নিচে ঢেকে যায় দুটো দেহ।

🍂বর্তমান🍁

“সেদিনের স্বপ্নের মানে আমি আগে কেনো বুঝলাম না প্রাণপাখি? তুমি অন্ধকারে হারিয়ে গেছো ওই কবরের নিচে, আমাকে ডাকছো অথচ আমি পৌঁছাতে পারছিনা তোমার কাছে। আল্লাহ তো আগে থেকেই আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলো তুমি আমাকে বিদায় জানাচ্ছ। শুধু আমি বুঝতে দেরি করে ফেলেছি। এই প্রাণপাখি, বুকটা খালি লাগছে আমি ঘুমাবো আসো আমার বুকে।”

শীতল অনুভবে ছেয়ে গেল আদাভানের সর্বাঙ্গ। অরুনিকার কবরের পাশে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়লো আদাভান। পরম শান্তির এক ঘুম, যা শুধু প্রিয়তমার সংস্পর্শেই আসে।

হাজারটা সুখের স্মৃতি একটা কষ্ট মুছতে না পারলেও একটা কষ্ট হাজারও সুখের স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য যথেষ্ট। এটাই নিষ্ঠুর পৃথিবীর নিয়ম।

“চেনা মানুষের ভিড়েও হারিয়ে ফেলি নিজেকে,
হাজারো বেরঙিন ব্যথা কাঁদে এই বুকে,
এলোমেলো ঝড়ে মন ভেঙ্গে পড়ে,
হারিয়ে ফেলি পরিচয় তোমার স্মৃতিচরে।”

চলবে?
#Fiza Siddique

জানি অনেকে রেগে আছেন আমার উপর। আর আজকের পর্ব পড়ে আরও রেগে যাবেন হয়তো। আসলে পড়াশোনার চাপ অনেক। লেখালেখির সময় করে উঠতে পারছিনা। আজকে পর্বটা হয়তোর একটু অগোছালো হয়েছে, মাঝে বেশ গ্যাপ গেছে তাই হয়তো। এবার থেকে রেগুলার গল্প পাবেন, খুব বড়ো সমস্যা ছাড়া। আজকে সাইলেন্ট রাইডার্সদের মন্তব্যও দেখতে চাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here