আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে পর্ব-৪২

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(42)

“আমি আপনার যোগ্য না আদাভান।”

অরুনিকার মুখে অসময়ে এমন কথা শুনে হতবাক হয়ে যায় আদাভান। ভ্রুদ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে কথাটা বোধগম্য করার চেষ্টা করে।

“আপনি কেন আমাকে ভালবাসলেন আদাভানে। আপনার দেওয়া গভীর ভালবাসার বদলে দুঃখ, কষ্ট ছাড়া কিছুই যে দিতে পারিনি আমি। প্রতিমুহূর্তে আমাকে সাজাতে চাওয়া আপনাকেই আমি বারবার বিপদে ফেলেছি, সহজ সরল চলার পথে বিছিয়ে দিয়েছি অজস্র কাঁটা। নিজের হাতে করা এই ভুলগুলো কিভাবে মেনে নেব আমি? কিভাবে ভুলে যাবো আপনার জীবন সংশয়ের জন্য একমাএ দায়ী ছিলাম আমি। আমার রক্ষকের ভক্ষক হয়ে উঠেছিলাম আমি। কিভাবে মেনে নেবো আপনার নিঃস্বার্থ ভালবাসার বাগানে একটু একটু করে বিষ ঢেলে গেছি আমি। উঠে পড়ে লেগেছিলাম ছারখার করে দিতে আপনাকে। আপনার কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচতাম বলতে পারেন? আমি যে প্রতি মুহূর্তে ধুঁকে ধুঁকে করছি। আমার করা ভুল, না না ভুল পাপ। আমার করা পাপগুলো আমাকে ঘুমাতে দেয়না। মনে করিয়ে দেয় আপনার সাথে করা অন্নয়গুলো। বর্ষা আপুর মৃত্যুর প্রতিশোধের নেশায় দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কি পরিমান আঘাত হেনেছি আপনার এই কোমল হৃদয়ে। বুকের বাম পাশের এই ভালোবাসার বক্সে নাজানি কতো আঘাত দিয়েছি। আপনার তখন অনেক কষ্ট হয়েছে তাইনা? মনে হয়েছে নিজের হাতেই আমি বারবার ছু*রি চালাচ্ছি এই বুকে। আমার পরম শান্তির এই বুকে মাথা রাখলেই তারা গেয়ে ওঠে অভিমানী গান, শুনিয়ে বেড়ায় দুঃখের কথা। বুঝিয়ে দেয় আমার বেইমানি।”

“হুশ। এই সময় এত কান্না করতে নেই প্রাণপাখি। তুমি জানোনা কতশত তপস্যার ফল তুমি। জানোনা কতোরাত তাহাজ্জতের আমানত তুমি। অদাভানের জীবনের আর এক নাম তার প্রাণপাখি। একটুতে রেগে যাওয়া, হুটহাট অ্যাটাক করা, অভিমানে গেল ফুলিয়ে রাখা এই স্ট্রং পার্সোনালিটির মেয়ের প্রেমে তো পড়েছিলাম বহুযুগ আগে। না ছিলো মায়াবী চেহারা, না ছিলো যৌবনের সৌন্দর্য্য। ছিলো শুধু একরাশ মুগ্ধতা। তার উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়ায় পাগল করে দিয়েছিল এক কিশোরকে। নেশার চেয়েও বেশি নেশালো হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই উষ্ণ ছোঁয়া। আচ্ছা, চুমুর সাথে কি আফিম মিশিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলে আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে? বলোনা প্রাণপাখি এই শিরায় শিরায় কিভাবে গেঁথে দিলে তোমার নাম?”

আদাভানের কথায় কান্না ভুলে খানিকটা লজ্জমিশ্রিত চেহারা নিয়ে তাকালো অরুনিকা। প্রেগনেন্সির জন্য বেশ মোটাসোটা হয়ে যাওয়ায় লজ্জায় রাঙ্গা অরুনিকাকে দেখতে আরোও আকর্ষণীয় লাগছে। সেই লজ্জার রেশ আরোও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে হালকা হেঁসে অরুনিকার পরনের শার্টের উপরের বোতামটা খুলে দিলো। লাজুকলতা অরুনিকা বিস্ময়ে চোখ বড়ো বড়ো করে আদাভানের দিকে তাকাতেই আরোও বেশি লজ্জায় পড়ে গেলো। দুজনের চোখাচোখি হতেই চোখ টিপ দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো আদাভানে। লজ্জায় পরনের ধিলে ঢালা শার্ট হাতের মাঝে নিয়ে ক্রমশ মুচড়াচ্ছে অরুনিকা।

“ককি করছেন?”

“বলবো?”

লজ্জায় রাঙা মুখে মাথাটা নীচু করে সম্মতি দিতেই আদাভানে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বলতেই একহাতে শার্টের উপরের খোলা অংশ ধরে অপর হাতে নিজের মুখ ঢাকার বৃথা চেষ্টা চালায় অরুনিকা।

“দেখার কি আরোওওও কিছু বাকি আছে প্রাণপাখি? আমার সব কাজের প্রমাণ কিন্তু এইযে আমার লিটিল প্রিন্সেস।”

“উফ্! থামুন প্লিজ।”

“শুরুটা আর করলাম কই। শুরুটা তো করি, তারপর নাহয় থামবো।”

অধরে অধরে স্পর্শে, আদুরে আলিঙ্গনে ভরিয়ে তুললো আদাভান। কেটে গেলো ছোট্টো ছোট্টো ভালোবাসার অজস্র মুহূর্ত। জমে গেলো ডায়রির পাতায় ভালবাসাময় নতুন এক অধ্যায়।

নিকশ কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন এক ঘরে আদাভান দাড়িয়ে আছে। সামান্যতম আলোর ছিটেফোঁটাও নেই সেখানে। চারিদিকে যেদিকে তাকানো যায় শুধুই কালো। হটাৎ বাচ্চার কান্নার আওয়াজে চমকে ওঠে আদাভান। কোমল এক শিশুকণ্ঠ যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়েও কোনোকিছুর নাগাল না পেয়ে জোরে আরোও বেশি ভয় পেয়ে যায়।

“আদাভান, আমি যেতে চাইনা। আমাকে বাঁচান প্লিজ। ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। এই দেখুন আমাদের সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা করুন। বাঁচান আমাদের।”

কথাটা শুনেই চমকে ওঠে। দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। এই নিকশ কলো আঁধার পেরিয়ে কিভাবে পৌঁছাবে তার প্রাণপাখির কাছে? কিভাবে বাঁচাবে তাদের অংশকে? এসব ভেবে কোনো কূলকিনারা পায়না। নিজেকে কেমন যেনো অন্ধ অন্ধ বোধ হচ্ছে আদাভানের।
“অরু কোথায় তুমি?”

“আমি এইতো আদাভান, আপনার সামনে। না না আপনার পিছনে। কিজানি কোথায় আছি। সবই তো অন্ধকার।”

অরুনিকাকে হারানোর ভয়ে জোরে চিৎকার করে উঠতেই ঘুম ভেংগে যায় আদাভানের। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে পাশে তাকাতেই ঘুমন্ত অরুনিকাকে দেখে সস্তির শ্বাস ফেলে। অরুনিকার দুইহাত একসাথে করে এনে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকে। কান্নার মাঝে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে রুক্ষ ঠোঁট ছোঁয়ায় অরুনিকার কপালে। অস্বস্তিতে আর ঘুম আসবেনা বুঝে উঠে গিয়ে দাঁড়ায় ব্যালকনিতে। ঘামে ভিজে লেপ্টে যাওয়া শার্টের দিকে একবার তাকিয়ে চলে যায় শাওয়ার নিতে।

কফি হাতে ব্যালকনির রেলিং ঘেঁসে দাড়িয়ে বিষণ্ণ মনে একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আদাভান। হাজারো না বলা অভিযোগ ছুঁড়ে দিচ্ছে পরম ভারসাময় স্থানে। চোখের কোনে জমে থাকা অশ্রু জানান দিচ্ছে তার কষ্টের কথা। মাঝরাতে দেখা সেই স্বপ্নের পর আর এক মুহুর্ত ঘুমাতে পারেনি সে। দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারছেনা কিছু।

শরীরটা বেশ খারাপ লাগায় অরুনিকাকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছে আজ আদাভান। বাম হাতে অরুনিকার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে একহাতে ড্রাইভ করছে। মাঝে মাঝে জানালার খোলা বাতাসে উড়তে থাকা প্রিয়তমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।

“আপনি এখানে আমাকে দেখে হাসছেন কেনো শুনি? এই এই একদম আমাকে দেখতে খারাপ হয়ে গেছে বলে অন্য মেয়ের দিকে তাকাবেন না। আপনার চোখ তুলে নেবো তাহলে।”

“আমি কি দেখছিলাম জানো? তোমার শাড়ি। মনে আছে কলেজে তোমার ওই ওড়নায় পমপম লাগানো থাকতো বলে মিস পমপম বলে ডাকতাম। হা হা। দেখো তুমি আজও সেই পমপম লাগানো শাড়ী পরেছো।”

“এটা তো আপনিই দিয়েছিলেন। মনে নেই বিয়ের পর আমাকে কত্তোগুলো পমপম লাগানো শাড়ী গিফট করেছিলেন।”

দুজনের কথোপকথনের মাঝে হটাত করে গাড়ির সামনে কাউকে আসতে দেখে বেশ জোরে ব্রেক কষে আদাভান। রাগে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে গাড়ি থেকে বেরোতেই সামনের মানুষটিকে দেখে চমকে ওঠে। অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,

“কাব্য!”

ততক্ষনে কয়েকজন পুলিশ এসে দুইহাত চেপে ধরে কাব্যের। পরণের জেলের পোশাক, বড়ো বড়ো গোঁফ দাড়ি, চেহারা শুকিয়ে গেছে, উজ্জ্বল মুখশ্রীতে কালো ছোপ ছোপ দাগ স্পষ্ট।

“অরু, এই অরু। কথা বলনা আমার সাথে। অরু তুই শুধু আমার। তোকে পেতে গিয়ে আমি কোনোকিছুর পরোয়া করিনি অরু। সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে আমি শুধু তোকেই ভালোবাসি অরু। অরু আমাকে মাফ করে দে অরু। আমাকে ফিরিয়ে এনে অরু তোর জীবনে। বিশ্বাস কর, অনেক সুখে রাখবো। এই এই ছেলেটার থেকে অনেক ভালো রাখবো। আমার কাছে ফিরে আয় অরু। আমি সেই তোর কাব্য ভাইয়া। দেখ, চিনতে পারছিসনা? আমার সাথে কথা বলনা অরু প্লিজ। তোর কণ্ঠস্বর শোনার জন্য আমি মরে যাচ্ছি।”

“ইন্সপেক্টর আপনি নিয়ে যান ওনাকে। একজন আসামি, খুনিকে এভাবে রাস্তায় ছেড়ে দেয় নাকি? আর কখনো যেনো বাইরে না বেরোতে পারে সেই ব্যাবস্থা করুন। আমার আপুর, খালামনির মৃত্যুর প্রতিশোধ নিজের হাতে নিতে পারলে সবচেয়ে খুশি হতাম আমি। কিন্তু আফসোস তাহলে আমার এই লোকটার মধ্যে কোনো তফাৎ থাকতোনা। নিয়ে যান প্লিজ ওনাকে। ঘেন্না করে আমার অনেক দেখলে।”

পেরিয়েছে আরোও একটা মাস। অরুনিকা হাঁটাচলা করতে পারেনা একদমই। খাওয়া দাওয়ায় সবটাই অরুচি। পানি ছাড়া আর কিছুই যেনো পেতে সয়না। কিন্তু বিগত দুইদিনে অরুনিকাকে দেখে বেশ অবাক হচ্ছেন আনিকা আহসান। প্রেগনেন্সির প্রথম থেকে শুরু করে যে মেয়েকে জর করে কিছু খাওয়ানো যেতনা সে নিজে থেকে ফ্রিজ খালি করছে। চকলেট থেকে শুরু করে আঁচার কিছুই বাদ দিচ্ছেনা। বিষয়টা যদিও চিন্তার না হলেও বেশ চিন্তা বাসা বাঁধছে আনিকা আহসানের মনে। কেমন যেনো অজানা এক আশঙ্কা ঝেঁকে ধরছে তাকে। ভাবনার মাঝে অরুনিকার আর্তনাদে ভয়ে শীতের মাঝেও ঘাম ছুটতে থাকে। শীতল স্রোত বয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে। একমুহুর্ত অপচয় না করে দৌড়ে যান অরুনিকার রুমের দিকে।

রুমের সামনে গিয়ে আঁতকে ওঠেন আনিকা আহসান। বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে থাকেন সামনের দিকে। পা দুটো যেনো বরফের মতো জমে গেছে, এক পা এগোনোর শক্তিটুকু সঞ্চয় করে উঠতে পারছেন না। কিচেনে থাকা আদাভানকে ডাকার মতো সাহস বা শক্তি কোনোটুকুই যেনো অবশিষ্ট নেই। শুকনো কাঠ হয়ে যাওয়া গলায় কান্নাগুলো দোলা পাকিয়ে শ্বাসরোধের চেষ্টায় উন্মত্ত। শরীরের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে আদাভানকে ডাক দেন। আনিকা আহসানের ডাকে চমকে উঠে হাতে থাকা সদ্য বানানো কফির মগটা পড়ে যায় আদাভানের পায়ের উপর। হালকা শব্দে আঃ বলে উচ্চারণ করার আগেই শুনতে পায় আনিকা আহসানের কান্নার শব্দ। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে বুকটা। চিনচিন ব্যাথায় এক হাত বুকে চেপে রূমে যেতেই থমকে যায়।

লাল রঞ্জিত ফ্লোরের মাঝে আনিকা আহসানের কোলে নিভু নিভু বোজা চোঁখে উপরের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে অরুনিকা। এক হাত পেটের মাঝে রেখে রক্তে রাঙ্গা ফ্লোরের মাঝে কাতরাচ্ছে সে। দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নেয় আদাভান অরুনিকা। কোনো কথা না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ির পিছনে শুইয়ে দেয় আদাভান। আনিকা আহসানও দ্রুত পায়ে এসে অরুনিকার মাথা তুলে নেন নিজের কোলে। ঝড়ের বেগে ড্রাইভ করে দোষ মিনিটে হসপিটালে পৌঁছে পাগলের মতো এদিক ওদিক ছুটতে থাকে আদাভান। অবশেষে সব ফর্মালিটি পুরন করে অরুনিকাকে নেওয়া হয় ওটির উদ্দেশ্যে।

চলবে?
#Fiza Siddique

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here