আমার আকাশে তারা নেই ২ পর্ব -০৫

#আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি

৫.
“আম্মা তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। আমি এমন একটা সিদ্ধান্ত তোমার ভালোর জন্যই নিয়েছি‌। আমি তোমাকে সুখি দেখতে চাই। মরার আগে একজন ভালো পাত্রর হাতে তোমাকে তুলে দেওয়া বাবা হিসেবে আমার দায়িত্ব। সে দায়িত্ব থেকেই এই সিদ্ধান্ত আমার। তুমি সুখি হবে আম্মা। অনেক সুখি।”

বর্তমান
রাত নেমেছে প্রকৃতির নিয়মে। আঁধারে ছেয়ে গেছে চারদিক। ইচ্ছে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। রুপোলি চাঁদটি কালো আকাশের বুকে গর্বের সাথে ভেসে বেরাচ্ছে। তার আলোতে আলোকিত হচ্ছে ধরণী। হিমেল হাওয়ায় মাজা সমান চুলগুলো এলোমেলো হলো। বিয়ের আগে বাবার বলা কথাগুলো মনে পড়ছে বারবার। এই সুখের কথাই কি বাবা বলেছিল? হাতে থাকা মুঠোফোনটির দিকে ভেজা নয়নে তাকালো। অপেক্ষা করলো কারো কলের। বহু প্রতিক্ষিত একটি কল। কিন্তু এলোনা। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো হৃদয়। অক্ষিপট থেকে ঝড়তে লাগলো বিরহের নোনা জল। এত পাষাণ কেন হলো তার প্রেমিক পুরুষটি? সে কি জানে না তাকে ছাড়া ইচ্ছে একদম ভালো নেই? এই হৃদয় বিদারক কান্না কি সে শুনতে পাচ্ছে না? কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েলো মেয়েটি। আর যে সে এই দহন সহ্য করতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতেই চিৎকার করলো মেয়েটি।

“এতটা পাষান কেন হলেন ইহান? এভাবে কেন পোড়াচ্ছেন আমায়? এ দহনের থেকে মৃত্যুটাই যে শ্রেয়। আমি আর সত্যিই পারছি না ইহান। মুক্তিদেন আমায় এ যন্ত্রণা থেকে। একটু প্রশান্তি চাই আমার। কেবল একটু শান্তি।”

______________

“মেয়েটা আমার কেমন হয়ে গেছে নাহার। একদম নিশ্চুপ। মেয়েটা একটু শান্তির জন্য বাবার বাড়িতে এসেছে। তুমি আর ওর অশান্তির কারণ হইয়োনা নাহার। একটু শান্তি চায় আমার মেয়েটা।”

নাহার শুনলো। মলিন হলো তার মুখ। ভেতর থেকে মাতৃবোধ তাকে নাড়িয়ে তুলল। কোমল হলো কঠোর হৃদয়। অশ্রু জমলো চোখের কোণে। পেটে না ধরলেও নিজ হাতে মানুষ করেছে সে মেয়েটিকে। সেই একদম ছোট্ট থেকে। ভালোবাসা প্রকাশ না করলেও সে বড্ড ভালোবাসে বোকাসোকা চঞ্চল ইচ্ছেকে। মেয়েটার সুখের জন্যই তো ভালো পাত্রের হাতে তুলে দিয়েছিল ছোট হাতদুটো। কিন্তু নিয়তিকি মেয়েটাকে ভালো থাকতে দিল। অশ্রুসিক্ত নয়নে নাহার মেয়ের রুমের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,”হতভাগী রে তুই। সুখ যে তুই চেয়ে আনিসনি।”

______________

কঠোর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষটাও আজ বাচ্চাদের মতো আর্তনাদ করে কাঁদছে। দায়িত্বের কাছে আজ ভালোবাসা হার মেনেছে। এক সময়ের সবথেকে কাছে থাকা মানুষটা আজ বহুদূরে। যাকে আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এক বাবাকে আজ সেই বাবার প্রতিশ্রুতি ভেঙে তার রাজকন্যার বুকে খুব যত্নে ছুড়ি আঘাত হেনেছে সে। সে কি ক্ষমার যোগ্য?
রুমের প্রতিটা কোন থেকে ইচ্ছের গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে। এই রুমটাতেই তো ছুটে বেড়াতো মেয়েটা। নিজের চাঞ্চল্যতা দিয়ে মাতিয়ে রাখতো তাকে। হুটহাট বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভালোবাসার আবদার করতো। কতশত মিষ্টি মুহূর্ত কাটিয়েছে তারা এখানে। রুমটাও যেন ইচ্ছের অনুপস্থিতিতে হাহাকার করে উঠছে। ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে দেয়ালে টাঙ্গানো ইচ্ছে ছবির দিকে তাকিয়ে ইহান বলল,”আমাকে সবটা খুলে বলার সুযোগটাও তুমি দিলে না ইচ্ছে। তার পূর্বেই গুটিয়ে নিলে নিজেকে। ভালোবাসাটা কি এতটাই ঠুনকো?”

ইহানের অভিমান হলো সাথে তীব্র রাগ ভেসে উঠলো চোখেমুখে। মেয়েটার সাহস হয় কিভাবে বাড়ি থেকে তাকে না বলে চলে যাওয়ার? শুধু ফেরার অপেক্ষা। হাত পা বেঁধে ঘরে বসিয়ে রাখবে সে।
নিচ থেকে জোরালো শব্দ ভেসে আসছে। মায়ের গলা এটা। কিন্তু কি নিয়ে এভাবে চিৎকার করছে? ইহানের শরীর চাইলো না এ মুহূর্তে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। আর মোনটাতো মরে পরে আছে। যার সংস্পর্শে জীবিত হবে সেই মানুষটাই যে নেই।

রুশা মেয়েটা খারাপ না। দেখতে বেশ মিষ্টি। কথা বলে দারুণ। ব্যাবহার ও অমায়িক। এইতো শারমিন বেগম যখন রান্না করতে গেলেন তখন নিজ থেকে যেচে তাকে সাহায্য করতে চাইলো শারমিন বেগম না করলেও শুনেনি। চমৎকার ভাবে মা বলে ডাকে। যেন মনে হয় নিজের পেটের মেয়ে। ইরাটা কাছে থাকলে সেও এভাবেই ডাকতো। রুশা যখন তাকে মা বলে ডাকে তার বুক ঠান্ডা হয়ে যায় কিন্তু পরক্ষণে মনে হয় এই মেয়েটা বহুরূপী। যদি এত ভালোই হতো তবে ইচ্ছের মতো ফুটফুটে মেয়েটার সাজানো সংসার এভাবে গুড়িয়ে দিত পারতো না। রুশার জন্য জন্মানো অনুভূতি গুলো চাপা পড়ে যায়। ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো চিৎকার করে ওঠে সে।

“নিজের এই ভোলাভালা মুখ রূপ দেখিয়ে হাত করতে চাইছো আমায়? শোনো মেয়ে তোমাকে খুব ভালো করে চিনতে পেরেছি আমি। সুবিধাবাদী মেয়ে তুমি। ফুঁসলিয়ে আমার ছেলেকে হাত করেছ কিন্তু আমাকে পারবে না।”

“না মা। আপনি ভুল বুঝছেন। আমি….”

“থামো। থাকছো খাচ্ছো বেশ আছো। এতেই খুশি থাকো। আমার আশপাশে ঘেঁষার চেষ্টা ও করবে না।”

রুশা মাথা নিচু করে নিল। বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। ঠোঁট কামরে কান্না আটকে নিল। মাথা নিচু করে সকল কথা হজম টরে নিচ্ছে। কারণ করার কিছু নেই। ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে প্রত্যেকটা কথায়।
এরই মাঝে সেখানে ইহান উপস্থিত হলো। ক্লান্ত অসার শরীরটা কোন রকম টেনে‌নিয়ে এসে হাজির হয়েছে সে। একা মানুষটা এত‌ কিছু সামলাতে হাঁপিয়ে উঠেছে যেন। মায়ের উপর হঠাৎ করেই রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।

“কি সমস্যা মা তোমার? একটু শান্তিতে থাকতে দিবে প্লিজ? রুশাকে নিয়ে সমস্যা থাকলে বলো আমি ওদের নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। ওদের মুখে দুটো ভাত দেওয়ার যোগ্যতা টুকু‌ আমার আছে।”

এ পর্যায়ে রুশা এসে ইহানকে থামালো। এক প্রকার টেনে সরিয়ে নিল ওখান থেকে। শারমিন বেগম স্তব্দ হয়ে তখনো দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলের এই রূপ যে তার অচেনা। বরাবরই মায়ের সাথে কোমল স্বরে কথা বলে ইহান। মাকে সে বারবার খুব শ্রদ্ধা করে। আজ সেই ইহানের এই রূপটা মায়ের হৃদয়ে দাগ কেটে গেল। এত পরিবর্তন? শিরমিন বেগম সিঁড়ির গোড়ায় বসে অশ্রু ছেড়ে দিলেন চোখ থেকে। উপলব্ধি করলেন তার সাজানো গোছানো সংসারটা ভাঙতে শুরু করেছে। কার কুনজর পড়লো তার সুন্দর সংসারটার উপর?

_____________

নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কেবল বাবার খুশির জন্য বিয়েটার জন্য মত দিয়েছিল ইচ্ছে। সেদিনটা ছিল শুক্রবার। ঘরোয়া ভাবে আয়োজন করলেও লোক সংখ্যা কম ছিলনা মোটেই। রমরমা ভাব পুরো বাড়ি জুড়ে। ছোট বাচ্চারা ছুটে বেরাচ্ছে। মুরুব্বিগন খোশ গল্পে মেতে আছেন। নাহার আজ খুব ব্যাস্ত। এদিকে ওদিকে ছুটে কাজের তাগিদ দিচ্ছেন। পড়নের শাড়িটা ময়লা হয়ে আছে। এই শিতের সকালেও তার কপালে স্বল্প ঘামের অস্তিত্ব দেখা গেল।

“তোর না হওয়া বরের নামটা বলতো ইচ্ছে।” মেহেদীর কোন হাতে বলল তমা।

ইচ্ছে জবাব দিলো না সরাসরি। মজা করে বলল,” হাসান ভাইয়ের নামটা লিখে দে। জানিসই তো তাকে আমার কত পছন্দ। ভুলে যাসনা সে ও কিন্তু আমার না হওয়া বর।”

কথাটা বলে সুন্দর করে হাসলো ইচ্ছে। তমা চোখ গরম করে তাকালো ইচ্ছের দিকে। কিন্তু ইচ্ছেকে হাসতে দেখে বুঝলো তাকে জ্বালাতেই মেয়েটা এমন কথা বলেছে। মুহূর্তেই মুখ থেকে রাগী ভাব চলে যেয়ে ভীর করলো একরাশ লজ্জা।
পাশথেকে তিশা খিলখিল করে হেসে উঠলো। যোগ দিল ইচ্ছেও। তিশা হাসতে হাসতে বলল,
“তোর বিয়েটা কবে হচ্ছে তবে? তোর যা অবস্থা তাতে বেশিদিন বাকি বলেতো মনে হয়না। দেখা গেল বছর না ঘুরতেই দুই বাচ্চা সমেত এসে চমকে দিলি।”

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here