আমার আকাশে মেঘ জমেছে
পর্ব:- ৫
.
আমার এই গভীর চিন্তা ও মনে চলমান গানকে উপেক্ষা করে প্রহর ভাই আমাকে রসায়ন পড়াতে থাকেন। ভাবটা যেন এমন, এক বসাতেই আমাকে তিনি রসায়নবিদ বানিয়ে দিবেন। আমি শুধু হা করে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ উনি চিল্লিয়ে বলে উঠেন,
-” নাকের কাছে মারলে ঘুষি, সেরে যাবে প্রেমের কাশি।”
-” মা.. মা.. নে?
-” ম্যাক্রো মিনারেলসমূহ। মুখস্থ করে আমাকে দাও।
নাকের= Na, K; কাছে = Ca; মারলে ঘুষি = Mg ; সেরে যাবে= S; প্রেমের= P ; কাশি= Cl.”
উনার মুখে মৌলের নাম শুনে আমার মনে হচ্ছিল আমি উনার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলি। ফিলিংসটাই শেষ করে দিয়েছিল।
.
সেদিন বাসায় এসে জানতে পারি প্রহর ভাই আমাকে আর পড়াবেন না। উচ্চতর ডিগ্রী নিতে দেশের বাইরে যাবেন। হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। এমনটা কেন হলো?
পরেরদিন প্রহর ভাইদের বাড়িতে প্রায় দৌড়েই গিয়েছিলাম। তবে প্রহর ভাইকে পাইনি। উনি নাকি আর গ্রামে আসবেন না। চাচিরা বিদায় দিতে যাবেন এয়ারপোর্টে।
.
এরপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। প্রহর ভাইয়ের ছোট ভাইবোন নিয়ে চাচি ঢাকা শহরে উনার বড় ছেলের কাছে চলে যাবেন বলে ঠিক করেন। গ্রামে কার আশায় থাকবেন? ছেলেমেয়ে গুলোকে মানুষ করতে পারলেই হলো। আমার মনের অবস্থা তখন বলার বাহিরে। চোখের নিচে কালি আর অমসৃণ ত্বক নিয়ে আমি কলেজে প্রথম বর্ষের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করি। প্রিপারেশন ছিল কোনরকম চালিয়ে দেওয়ার মতো।
একদিন হঠাৎ প্রহর ভাইয়ের আম্মা আসেন আমাদের বাড়িতে। আব্বা আম্মার সম্মতি নিয়ে আমার হাতে আংটি পরিয়ে যান। আব্বার সম্মতি দানের পিছনে প্রথম কারণ ছিল প্রহর ভাইয়ের নামের আগে ডাক্তার লাগানো সাইনবোর্ড। আর দ্বিতীয় কারণ, আব্বার গ্রামের হাসপাতালে একজন উচ্চ ডিগ্রীধারী ডাক্তার বসবে। আমার উপর আব্বা একেবারেই আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু আমার মনে তখন কেমন যেন ভয় কাজ করছিল। প্রহর ভাই জানে তো এসব। উনি যদি আমাকে ভুল বুঝেন? যদি মনে করেন আমি পরিকল্পনা করে চাচিকে দিয়ে এমন করিয়েছি?
দুশ্চিন্তায় দুই রাত আমি ঠিক মতো ঘুমাতে পারিনি।
.
আমার দুশ্চিন্তার সমাপ্তি ঘটে প্রহর ভাইয়ের ফোন পেয়ে। বাড়ির টিনএনটিতে ফোন দিয়েছিলেন উনি। কোন হাই হ্যালো কুশল বিনিময় না করেই ধারালো গলায় বলেছিলেন
-” ডাক্তারের বউ হতে চলেছ। পড়াশোনা ঠিক মতো করো। রেজাল্ট খারাপ হলে বিয়ে ক্যান্সেল। আর চেহারা নাকি খারাপ হয়ে গেছে? খাওনা ঠিক মতো? আমার কিন্তু সুন্দরী বউ চাই। যদি ফিরে চেহারার বারো অবস্থা দেখি তাহলে কিন্তু বিয়ে ক্যান্সেল।”
আমার কোন প্রতিউত্তর না শুনেই উনি ফোন রেখে দিয়েছিলেন। আনন্দে মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছিল না। পাক্কা দশ মিনিটের মতো রিসিভার কানে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
মনের মধ্যে তখন গান চলছিল,
“শোন গো দখিনা হাওয়া, প্রেম করেছি আমি।”
.
প্রহর ভাইয়ের সেই “বিয়ে ক্যান্সেল” নামক কথাটা আমার ক্ষেত্রে টনিকের মতো কাজ করলো। পড়তে লাগলাম ভালো মতো। রেজাল্ট খারাপ হলে বিয়ে ক্যান্সেল। ও মাই গড। নো ওয়ে।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলাম ঝোঁকের মাথায়। খাওয়া দাওয়া সব ছেড়ে বই নিয়ে বসে থাকলাম।
আব্বা কী যে খুশি ছিলেন! আমার জন্য পুকুরের তাজা মাছ, পাকা ফল, বিভিন্ন খাবারের আইটেম নিয়ে আসতে থাকেন উনি। ওতো সব খাবার আমার খাওয়ার সময় কই?
.
পরীক্ষা দিয়ে ভেবেছিলাম এবার শান্তি পাবো। কিন্তু তা আর হলো কই। আব্বার কোচিং এর জন্য আমাকে ঢাকায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রহর ভাইয়ের আম্মা গ্রামে এসে আব্বার সাথে কথা বলে আমাকে নিজের সাথে ঢাকায় নিয়ে আসলেন। ছেলের সংসারে থাকবেন না বলে চাচি গ্রামের সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে বাড়ি কিনেন ঢাকায়। দোতলা খোলামেলা বাড়িটিতে আমি গ্রাম গ্রাম গন্ধ পাচ্ছিলাম।
চাচি আমার উপর কড়া নজরদারি করছিলেন। একদিন হুট করেই উনি আমাকে জানান আমি তাকে চাচি ডাকতে পারব না। আমি তখন বোকার মতো জিজ্ঞেস করেছিলাম তাইলে কী বলে ডাকবো? উনি উত্তরে বলেছিলেন
-“মনি মা বলে ডাকবি।”
খুব মিষ্টি সম্পর্ক ছিল আমাদের মধ্যে। মনি মা আমাকে তুই সম্বোধনে ডাকতেন। প্রহর ভাই হিংসা করতো আমাদের নিয়ে।
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার দুই মাস আগে প্রহর ভাই আবার কড়া কণ্ঠে আমার সাথে কথা বলেন। এবারও তিনি একাই আমাকে কথা শুনান।
-” অতিথি, মেডিকেলে ভর্তি হওয়া সহজ নয়। তবে একেবারে কঠিন নয়। আমার মায়ের কথা মতো চলবা। উনি একজন সুপার ওমেন। শী ক্যান হেল্প ইউ কমপ্লিটলি। ডাক্তারের বউ হতে যাচ্ছ। বুঝে শুনে চলবা। মেডিকেলে চান্স না পেলে কিন্তু বিয়ে ক্যান্সেল।”
আবারও সেই এক যপ “বিয়ে ক্যান্সেল”। এই বিয়ে ক্যান্সেল নামক কথাটা শুনলেই আমার আত্মা উড়ে যেত। পড়াশোনায় মন দিলাম। টাইম টু টাইম সব কাজ করতে লাগলাম। মনি মা একদিন আমাকে বললেন
-” অতিথি এভাবে পড়লে অবশ্যই চান্স পাবি। তুই চান্স না পেলে কে পাবে?”
কনফিডেন্স হারিয়ে ফেললে মনি মার কথায় আবার তা ফিরে পেতাম।
.
সে বছর ঈদুল আযহা’র আগে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ডেট দেওয়া হয়। পড়াশোনার এতো প্রেশার যে কোন দিকে তাকানোর সময় পাচ্ছিলাম না। প্রহর ভাই আব্বা সবাই খালি চান্স চান্স করছিল।
পরীক্ষা সেন্টারে গিয়েছিলাম আব্বার সাথে। মনি মা বাসা থেকে বের হওয়ার আগে দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দেন। পরীক্ষা দিয়ে যখন ফিরি তখন মনে হচ্ছিল যুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছে। তবে যুদ্ধের ফলাফল এখনো বাকি।
মেরিট লিস্টে অনুযায়ী আমার সিরিয়াল আসে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজে। আব্বা, মনি মা সবাই খুশি ছিলেন। শুধু একজন নাখোশ ছিলেন.. প্রহর ভাই। উনার ধারণা ছিল, আমি আর একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেতাম। রাগে আমার শরীর কাঁপছিল। মেডিকেলে চান্স পেয়েছিলাম এই ঢের ছিল আমার জন্য।
আব্বা-আম্মা ঠিক করেন হজ্বে যাবেন। আমার ভবিষ্যতের জন্য দোয়া চাইবেন, শুকরিয়া আদায় করবেন মহান আল্লাহতালা’র নিকট।
সেই যে গেলেন আর প্রাণ নিয়ে ফিরলেন না। ফিরলেন তো লাশ হয়ে।
চলবে….