আমার আকাশে মেঘ জমেছে পর্ব ১১

আমার আকাশে মেঘ জমেছে
পর্ব:- ১১
.
আপনি আপনি নামক সম্বোধনের সম্পর্কটা খুব দ্রুত তুমিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। মনের অজান্তেই প্রহর ও মনি মা’র উপর ভরসা করতে শুরু করি। ওরা আমাকে একটা ছোট বাচ্চার মতো ট্রিট করছিল। মনি মা আমাদের সাথে থাকত নয়মাস। আর বাকী তিনমাস আমার বড় ভাসুরের কাছে। বড় ভাসুর এসে মনি মা কে জোর করে নিয়ে যেত। বাঁধা দেইনি কখনো। উনারও তো মা।
আমাদের বিয়ের তখন দশমাস চলছে। প্রহর চাকরিতে জয়েন করেছে পাঁচ- ছয়মাস হবে। মনি মা তখন বড় ভাইয়ের বাসায়। আমি মেডিকেল ক্লাস করেই চলে আসতাম। একাকী লাগত খুব। প্রহর আসতো সেই রাত দুটো তিনটে নাগাদ। সময় দিতে পারছিল না আমাকে। আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিলাম। বিয়ের পরের সেই তিনমাস ফিরে পেতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু তা ছিল অসম্ভব।

মেডিকাল ক্যাম্পাসে আমার অনেক বড় ফ্রেন্ড সার্কেল ছিল। বিয়ের পর আমি নিজের চারপাশের অদৃশ্য দেয়াল ভাঙতে পেরেছিলাম… মনি মা’র জন্য।
মনি মা বলতেন,
-” অতিথি তুই জীবনের এখনো কিছুই দেখিস নি। তোর এই বয়সটা সংসারের জাঁতাকলে পিষার বয়স নয়। বন্ধু বান্ধব বানাবি। ঘুরবি, খাবি।”
প্রহরের সময় না দেওয়া আমাকে ভাবিয়ে তুলল। মনে হচ্ছিল প্রহরকে পেয়েও যেন আমি পাইনি। পড়াশোনার অবস্থা বেগতিক। রেজাল্ট ভালো আসছিল না। সেই নিয়েও প্রহর চিল্লাত।
আমি উড়নচণ্ডী হয়ে উঠি। বন্ধুদের সাথে রাতের চাকচিক্যময় ঢাকা শহরের নতুন খোলা নাইট ক্লাবগুলো তখন আমার বেয়ারা জীবনের প্রথম ধাপ। বাসা থেকে বের হতাম সন্ধ্যা নাগাদ। ফিরতাম প্রহর আসার আগেই।
আমার সুন্দর সাজানো পৃথিবীটা যে ধীরে ধীরে নিকষ কালো আঁধারে প্রবেশ করছিল, আমি তা টের পাচ্ছিলাম।
সেদিন ছিল বৈশাখের তৃতীয় দিন। বাসায় ফিরতে আমার রাত দশটা বেজে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম আজও প্রহর দেরি করেই ফিরবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। প্রহর অনেক আগেই বাসায় চলে এসেছিল। আমার পরনে তখন পাতলা জমিনের ফিনিফিনে নীল শাড়ি ও স্লীভলেস ব্লাউজ। সেই প্রথম বেয়ার নামক জিনিসটি আমি টেস্ট করেছিলাম। সাথে নীল ককটেল টাইপ কিছু খেয়েছিলাম। মাথা ঝিমঝিম করছিল।
সেই প্রথম প্রহর আমার গায়ে হাত তুলে। দুই গালে সজোরে দুটো থাপ্পড় মেরেছিল। আমি রুখে দাঁড়াই। অন্তরে চেপে রাখা অগ্নিকুণ্ড লাভার রূপ নেয়। ব্যাগে কয়েকটা কাপড় ভরে বের হয়ে আসি বাসা থেকে। প্রহর আমাকে আটকায় নি।
.
রামপুরায় আমার এক বান্ধবী থাকতো। “তমা”। সিএনজি ভাড়া করে আমি ওর বাসায় যেয়ে উঠেছিলাম। তখন ছিল সিটিসেল আর নোকেয়ার যুগ। আমার কাছে ফোন ছিল না। ভুলে বাসায় রেখেই চলে এসেছিলাম। মাঝে তিনদিন সরকারি ছুটি ছিল। মেডিকেল কলেজ ছাড়া প্রহরের আমাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমার মনে তখন মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছিল। আমি জানতাম আমাকে ছাড়া প্রহর ভালো থাকবে না। আমি প্রহরের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এই ভেবে শান্তি পাচ্ছিলাম,
আমাকে কষ্ট দিয়ে প্রহর সুখে নেই।
.
পরেরদিন সকালে যখন ঘুম থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়াই, নিজেকে চিনতে পারছিলাম না। মুখে মেকাপ, কাজল লেপ্টে যাওয়া খোলা চুলের রমণীটি আমি ছিলাম না……. অন্য কেউ ছিল।
একে একে রাতের কথাগুলো মনে পড়তে থাকে।
দ্রুত তমার ফোন নিয়ে প্রহরের কাছে ফোন দেই। কিন্তু শতবার ফোন দিয়েও প্রহর আমার ফোন রিসিভ করেনি। আমার আবার রাগ উঠে। বিছানায় ছুড়ে ফেলি সেলফোন।
“আহ!” বলে চিল্লিয়ে উঠে নিজের চুল টেনে ধরি।
প্রহর আমাকে থাপ্পড় মারার পরও আমি ওকে ফোন দিচ্ছি এটাই তো বড় কথা। ফোন দিচ্ছি তো সরি বলার জন্যই। তাও ফোন ধরছে না।
এত অহং ওর?

তমা আমাদের বিশাল ফ্রেন্ড সার্কেলের অংশ হলেও কখনো আমাদের সাথে ঘুরতে বের হয়নি। ওর বাসায় আমার ভালো রেপুটেশন ছিল।
ও আমাকে ধরে বিছানায় হেলান দিয়ে বসায়। আমাকে বুঝায় আমি ভুল করেছি।
আমি ওর উপর চিল্লিয়ে বলেছিলাম,
-” থাকতে দিতে না চাইলে বলে দে। ঢাকা শহরে আমার যাওয়ার জায়গার অভাব নেই।”
-” তুই ভুল বুঝছিস। আমি তো জাস্ট.. ”
-” আমি কি চলে যাব? ”
-” আচ্ছা আই এম সরি।”
.
দুইদিন পর আমার মন নরম হয়ে আসে। তমার আম্মু খুব ভালো মানুষ ছিলেন। উনার বুঝানোর ধরণ ছিল অসাধারণ। উনিও একজন স্বনামধন্য ডাক্তারের বউ। আমার অবস্থা আন্টি খুব ভালো মতোই বুঝেছিলেন এবং আমাকে বুঝিয়েও ছিলেন।
বাড়ি ফিরে এসে দেখি বাড়ি যেভাবে রেখে গেছিলাম সেভাবেই আছে।
প্রহর আমাদের বেডরুমে শুয়ে ছিল। সেই রাতের পোশাক পরেই রয়েছে। ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম আমি। বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ আওয়াজ হচ্ছিল।
দৌড়ে ওর কাছে গিয়েছিলাম। পা ধরে মাফ চেয়েছিলাম।
আমি যে ভুল করেছি তা শুধরানোর মতো নয়। কেঁদে কেটে এক করে ফেলেছিলাম। আমার শতবার মাফ চাওয়া দেখে প্রহর প্রতি উত্তরে হেসেছিল।
আমি যাওয়ার পর প্রহর খায়নি ঠিক মতো। বাড়িতে রান্না হয়নি। পানি আর বিস্কুট খেয়ে ছিল ও। আমার উপর রাগ করে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিল।
আমরা দুজনেই খুব জেদি। পার্থক্য হলো আমার জেদ খুব তাড়াতাড়ি গলে পানি হয়ে যায়। আর প্রহরের? তা আর নাই বা বললাম।
ওই ঘটনার পর প্রহর আমাকে সময় দিতে চেষ্টা করতো খুব। কিন্তু পারতো না। আমি বুঝতে পারছিলাম ওর সমস্যা। তাই, নিজেই নিজেকে পড়াশোনা ও ঘরের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখতে লাগলাম।
.
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here