আমার আকাশে মেঘ জমেছে পর্ব ১০

আমার আকাশে মেঘ জমেছে
পর্ব:- ১০
.
ডা. সাবরিনা আক্তারের সামনে বসে আছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ে চাকুরীরত একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। নাম মিনহাজুর রহমান। সাথে রয়েছে তার সহধর্মিণী ও একমাত্র কন্যা মালিহা। সমস্যা উনাদের একমাত্র মেয়ের। মালিহা মানসিক সমস্যায় ভুগছে। মেয়েটা আঠারোর কোটা এখনো পেরোয়নি।
মিস্টার এন্ড মিসেস রহমান মেয়ের জন্য সোসাইটিতে মুখ দেখাতে পারছেন না। একমাত্র মেয়ের জন্য মানুষের কটু কথা শুনতে হয়। মালিহা প্রায় সময়ই একসাথে নিজের মধ্যে অনেকগুলো চরিত্র ধারণ করে। কখনো ওদের বাসার কাজের মেয়ে সেজে কাজ করে, কখনো নিজেকে তিন-চার বছরের বাচ্চা মেয়ে মনে করে, তো আবার কখনো একজন পুলিশ অফিসার। মিস্টার এন্ড মিসেস রহমান দুজনেই চাকরিজীবী। মালিহা আগে ওর নানার বাসায় থাকত। মিসেস রহমান এনজিও চালান। মেয়েদের নিরাপত্তা বিষয়ক সেমিনারগুলোতে উনাকে এটেন্ড করতে হয়। দেশে খুব কম থাকা হয়। কাজের জন্য এই দেশ সে দেশ ঘুরে বেড়াতে হয়।
.
-” আমি মালিহার সাথে কথা বলতে চাই, একা।”
ডা. সাবরিনা আক্তারের কথায় মিস্টার এন্ড মিসেস রহমান ঘাড় নাড়লেন। দুজনেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

-” মালিহা তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?”
মালিহা ডানে বামে মাথা নাড়াল।
-” ভেরি গুড। তুমি কি আমার পাশে এসে বসবে?”
_____________________________
অতিথির কেন যেন আজ সব ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। কোন কাজ সময় মতো করতে পারছে না। আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন ওর জন্য। তাও এরূপ গোলমাল মানা যায়?
-” মনি মা তুমি আমার কোন কথা শুনবা না তাইনা? তুমি আসমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছ কেন?”
-” তো কী করবো? রান্না কে করবে? এতো দিক সামলিয়ে রান্না করে খাবার আনা যায়? ”
-” কাজ সামলানোর জন্য আমি তো ছুটি নিয়েছি তাইনা?”
-” মহান কাজ করেছ। নাও এবার খাও।”
-” মনি মা..”
-” আচ্ছা আমি চুপ করলাম।”
_____________________________
মালিহার সাথে কথা বলার পরপরই ডা. সাবরিনা – রহমান দম্পতিকে চেম্বারে ডেকে পাঠিয়েছেন। দুজনেই এখন চুপচাপ সাবরিনা আক্তারের সামনে বসে আছেন। মালিহাকে এখন বাইরে রাখা হয়েছে। সে তার ছোট খালামনির সাথে বসে আছে।

-” মিস্টার এন্ড মিসেস রহমান আপনাদের সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”
-” জি ম্যাডাম বলুন। আমরা মেন্টালি প্রিপেয়ার্ড।”
-” মালিহার মূলত Dissociative Identity Disorder রয়েছে। মানসিক সমস্যাই বলা চলে।
DID হলো স্মৃতিশক্তির হঠাৎ উধাও হওয়া এবং পারসোনালিটি চেঞ্জ হয়ে অন্য সত্ত্বা ধারণ করা। এই সত্ত্বা সেকেন্ডে পরিবর্তন হতে পারে, হতে পারে ১ ঘন্টা লাগছে বা হতে পারে দুই-তিন দিন লাগলো। সাধারনত আসল যে মানুষ, তার কিছুই মনে থাকেনা যে সে অন্য সত্ত্বাতে গিয়ে কী কী করেছিল। অন্য সত্ত্বাতে যখনই সে রুপান্তরিত হতে থাকে তখনই তার স্মৃতিশক্তি চলে যায়, এবং সে চাইলেও মনে করতে পারেনা। আবার কিছু ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে আসল সত্ত্বা সবই বুঝতে পারে যে অন্য সত্ত্বাতে রুপান্তরিত হচ্ছে এবং এমন কিছু করছে যা তার করার কথা না, কিন্তু সে শরীরের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনা, সে বাধ্য হয় ওগুলা করতে।

অন্যান্য সত্ত্বা গুলা হয়ত কিছু কিছু বিষয়ে পারদর্শী হয়। ধরা যাক, রোগী খুবই ভীতু প্রকৃতির মানুষ, অন্য কারোর মুখের উপর কথা বলতে পারেনা। কিন্তু যদি সে তার অন্য সত্ত্বাতে পরিণত হয়, তবে হতে পারে সে অনেক রাগী হয়ে উঠবে। তার ভীতু অংশ টা আর কাজ করবে না। তখন হয়তো সে সাহসী হয়ে উঠলো।
হতে পারে তার আরেকটি সত্ত্বা খুবই ইমোশনাল টাইপ। যেকোনো কথা তার মনে লাগে, এবং সে ডিপ্রেশনে চলে যায়। হতে পারে এক সত্ত্বা প্রচুর ফানি , সারাক্ষন হাসতে ভালোবাসে, আবার কোনো এক সত্ত্বা হয়ত মানুষকে চোখে দেখতে পারেনা, সবসময় তাদের ক্ষতি করার পিছে থাকে। কোনো সত্ত্বা হয়ত অবুঝ শিশু, আবার কোনো সত্ত্বা হয়ত ৬০ বছরের এক দর্জাল মহিলা। কোনো সত্ত্বা হয়ত প্রচুর বুদ্ধিমান আবার কিছু সত্ত্বা অত্যন্ত বোকা।

নকল সত্ত্বাতে পরিণত হয়ে ওই মানুষটি অনেকদিন থাকতে পারে এবং তারপর আবার তার নিজের সত্ত্বাতে ফিরে আসে। হতে পারে তার কিছু মনে থাকবে না, হতে পারে সে এসব করতে বাধ্য ছিলো। গ্রামাঞ্চলে অনেকে এই রোগকে ভুতে ধরেছে হিসেবে বলে থাকে।
আচ্ছা মিসেস রহমান মালিহা তো ওর নানাবাড়িতে বড় হয়েছে তাইনা?”
মিসেস রহমানের চোখে পানি। যেই মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য এতো কিছু করছে অথচ এখন শুনছে সেই মেয়ে মানসিক রোগী। এসব মানা যায়? কলিজা চিড়ে যাচ্ছে উনার।
-” জি।”
-” মালিহা কী আপনাদের কখনো বলেছে ওর ওখানে থাকতে সমস্যা হচ্ছে কোন?”
-” আসলে খুব কম কথা হতো ওর সাথে। আমরা দুজনেই চাকরি করি।”
-” কমিউনিকেশন প্রব্লেম। আসল সমস্যা এখানেই। আপনারা ওর কথা শুনেন নি কখনো। কত বছর হলো আপনারা মালিহাকে নিজের সাথে রেখেছেন?”
-” দুই বছর। ম্যাডাম আসল সমস্যা কোথায়? আমার মেয়েটা সুস্থ তো?”
-” বাচ্চা মেয়েটাকে তো আপনারাই অসুস্থ করেছেন। আপনাদের সাথে থাকার আগে মালিহা প্রায় ছয় বছর যৌন হয়রানির স্বীকার হয়েছে। বাচ্চা মেয়েটাকে ওর আপন খালু বকে মেরে শারীরিক ভাবে নির্যাতন করত। আপনার মেজো বোনের পুরো পরিবার আপনার বাপের বাড়ি থাকে তাইনা?”
মিসেস রহমান থতমত চোখে তাকিয়ে আছেন। কই মালিহা তো কখনো তার কাছে এসব বলেনি। তিনি তো কয়েকদিন ধরেই ওর সাথে থাকার চেষ্টা করছে। তাহলে?
-” অবাক হচ্ছেন? আপনার মেয়ে কেন আপনাকে বলেনি? আসলে ওর যখন আপনাদের দরকার ছিল তখন আপনারা কেউ ওর পাশে ছিলেন না। নো বডি ওয়াজ দেয়ার ফর দ্যাট লিটিল গার্ল। ও নিজের সাথে লড়াই করেছে। আপনার বাপের বাড়িতে অনেক মানুষ ছিল। তবে ওর জন্য কেউ ছিল না। ইভেন নাও.. আপনারা একসাথে থাকছেন ঠিকই। তবে নামে মাত্র। কারণ এখনও মালিহা একা। এই একাকীত্ব ওকে মানসিক ভাবে দুর্বল করে তুলেছে। ওকে সময় দিন। আমিই কাউন্সিলিং করবো। এ রোগের কোনো ওষুধ নেই।
তবে সাইকোথেরাপি, হিপনোথেরাপি দ্বারা সকল সত্ত্বা গুলাকে একই সত্ত্বাতে পুঞ্জিভূত করা যায়। হিপনোসিসের সাহায্যে সচেতন ও অচেতন দুই মন থেকে সকল সত্ত্বাাগুলোকে টেনে বের করে সেগুলাকে আসল সত্ত্বাতে পুঞ্জিভূত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ওকে নিয়ে আরও দুই তিনবার আপনাদের আসতে হবে।”
-” ম্যাডাম, আমাদের মেয়েটা বাঁচবে তো?”
-” আপনারা যদি ওকে এখানে না নিয়ে আসতেন তাহলে ওর শেষ পরিণতি হয়ত মৃত্যু হতো। কিন্তু ও বাঁচবে এবং খুব জলদি সুস্থ হয়ে উঠবে।”
__________________________________
অতিথি ডা. সাবরিনা আক্তারের চেম্বারে আসলো বিকাল পাঁচটা নাগাদ। ডা. সাবরিনা আসরের নামাজ পড়ছিলেন। অতিথি যেয়ে চেয়ারে বসলো।
.
-” তুমি তো দেখছি টাইম টু টাইম চলো।”
ডা. সাবরিনার কথায় অতিথি হালকা হাসল। তবে সে হাসি প্রাণবন্ত নয়।
-” চা খাবে?”
-” দুধ ছাড়া।”
-” আচ্ছা।”
.
-” হুম তো গল্প বলা শুরু করো প্লিজ।”
চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে অতিথি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো।
-” বিয়ের প্রথম তিনমাস ছিল আমার ও প্রহরের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। প্রজাপতি বাহারি রঙে সেজেছিল আমাদের ছোট্ট সংসার। প্রহর তখনো জয়েন করেনি কোথাও। কাগজ পত্র নিয়ে কী যেন একটা ঝামেলা বেধেছিলি।
একদিন আমি আর প্রহর বারান্দায় বসেছিলাম। ডাক্তার হয়েও বেশি করে চিনি দেওয়া কফি খেত সে। আমার মানা শুনতোই না। সেদিনও আমাদের দুজনের হাতে কফি ছিল। গল্প করছিলাম দুজনে। হঠাৎ সে ঘর থেকে একটা কাগজ এনে আমার হাতে দেয়। গ্রামে জায়গা কিনেছিল। আমার আব্বার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য এতোটা ভেবেছে ও! খুশিতে চোখে পানি চলে এসেছিল আমার। আনন্দে জড়িয়ে ধরে ছিলাম। অনেক জোরে ধরেছিলাম। উনি চিল্লাচ্ছিলেন- আরে মরে যাব তো, দম বন্ধ হয়ে আসছে কিন্তু। আমি সেই চিল্লানো শুনতেই পাচ্ছিলাম না। উনার আওয়াজে মনি মা পর্যন্ত চলে এসেছিলেন আমাদের ঘরে।
পাগলি মেয়ে বলে মাথায়বাড়ি মেরে নিজের ঘরে চলে যান তিনি। আমি আবার প্রহর কে জড়িয়ে ধরি। সারা রাত ওভাবেই জড়িয়ে ধরে বসেছিলাম সেই অর্ধ খোলা বারান্দায়।
.
.
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here