আমার আকাশে মেঘ জমেছে শেষ পর্ব

আমার আকাশে মেঘ জমেছে
শেষ পর্ব
.
প্রহর প্রাথমিক অবস্থায় ছিল। মস্তিষ্কের এক ইঞ্চি জায়গা জুড়ে ছিল টিউমারটি। ডা. এনামুল হুদা স্যার আমাকে নিজে ফোন দিয়ে বলেছিলেন,
-” বুঝলেন ডা. অতিথি, আপনাকে এখন ডা. প্রহরের জন্য ফাইট করতে হবে। আই নো ইউ ক্যান ডু দ্যাট। দোন্ট টেক প্রেসার। এবরিথিং উইল বি অলরাইট। ”
-” স্যার আমি জানি প্রহরের কিছু হবে না। ওর কিছু হলে আমাদের মেডিকেল টেকনোলজি যে মিথ্যে হয়ে যাবে।”
-” আপনি কি উনাকে বাইরের কোন কান্ট্রিতে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন?”
-” নো স্যার। প্রহরের চিকিৎসা আমাদের দেশে হবে। দেশের মেডিকেল ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। আর আপনার মতো অভিজ্ঞ একজন মানুষ আমার দেশের মাটিতে রয়েছে। অযথা বিদেশে দৌঁড়াব কেন?”
-” আপনার মতো যদি সবাই বুঝত! কম খরচে দেশের মাটিতেই ভালো চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব। অথচ মানুষ কী করছে আজকাল।”
.
মনি মা ভেঙে পড়েছিলেন। কোথায় কী ভাবে, কেমন করে আগাবো বুঝতে পারছিলাম না। তবে দূর্যোগকালীন সময়ে মনের বল হারাইনি। আমিও কেঁদেছি।
রাতের বেলা ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি, যখন দেখেছি ছোট্ট পিহু তার বাবাকে হারানোর ভয় পাচ্ছে। আমার মনের ভিতর দিয়েও ঝড় বয়ে গেছে। কিন্তু আশা হারাইনি সেসময়।

প্রহরকে রেগুলার চেকাপে রাখা হচ্ছিল। ডা. এনামুল হুদা স্যার আমাকে একদিন ফোন দিয়ে ডেকে পাঠান। প্রহর সে সময় পুরোপুরি বেড রেস্টে।
ডা. এনামুল হুদা স্যারকে সেদিন আমি একরাশ সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
-” স্যার প্রহরের ট্রিটমেন্ট কীভাবে করবেন?”
-” ডা. প্রহর এখন প্রাথমিক অবস্থায় আছেন। আমরা উনাকে কিছুদিন অবসার্ভ করবো। নজরদারিতে রাখা যাকে বলে। আগে দেখবো টিউমার কী গতিতে বাড়ছে, শারীরিক কষ্ট দেখা দিচ্ছে বা বাড়ছে কীনা, টিউমার বাদ না দিলে কী কী ক্ষতির আশঙ্কা আছে, অপারেশন বা রেডিয়েশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মেনে নিতে ডা. প্রহর প্রস্তুত কীনা? আপাতত টিউমারের উপসর্গগুলো প্রশমনে আমি কিছু ঔষধ দিতে পারি। আপনি তো জানেনই টিউমারের কোন ঔষধ হয়না!”
-” এরপর?”
-” এরপর অপারেশনের কথা ভাববো। এই টিউমার বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অপারেশন করা যায়। ছোট ফুটো করে অপারেশন করা যায়, কখনও কম্পিউটারে টিউমারের জায়গা মেপে বাইরে থেকে রেডিয়েশন পাঠিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ছোট বিশেষ ধরনের টিউমারে গামা নাইফ দিয়ে অপারেশন করে খুব ভাল ফল পাওয়া যায়। বড় টিউমারেও অনেক সময় অপারেশন করে যতটা সম্ভব বাদ দিয়ে বাকিটুকুর জন্য গামা নাইফ ব্যবহার করা যেতে পারে। গামা নাইফ লক্ষ্যকেন্দ্রিক বলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব কম। যেহেতু ডা. প্রহরের ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। আমরা তাই উনাকে কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিব। মেডিকেল বোর্ড বসাতে হবে। চেষ্টা করবো যতটুকু সম্ভব টিউমার অপসারণ করার। যদি তারপর অবশিষ্ট থাকে তাহলে রেডিয়েশন পদ্ধতি তো আছেই। আপনি চিন্তা করেন না।”
প্রতিউত্তরে আমি শুধু মাথা ঝুঁকিয়ে বসে ছিলাম।
.
প্রহরের টিউমার বাড়ছিল খুব দ্রুত। ওর জন্য আমি গ্রামে নতুন ডাক্তার নিয়োগ দেই। ওকে ছেড়ে নিজের কাজ নিয়ে পড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ঢাকাতে বাড়ির সামনে যেই ক্লিনিকে রোগী দেখতাম সেখান থেকেও প্রায়ই ছুটি নিতে থাকি। প্রহর রাগ হয়ে যায় আমার উপর। খালি বলতো,
-” অতিথি নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করো না প্লিজ।”
নিজের ক্যারিয়ারের জন্য প্রিয় মানুষটাকে কষ্ট পেতে দিতে আমি কখনোই রাজি ছিলাম না। মনি মা অস্থির হয়ে পড়ে ছিলেন। বড় আপা নিজের শ্বশুর বাড়ি থেকে মনি মাকে দেখাশোনার জন্য একটা মেয়ে পাঠায়।
আমি যুদ্ধে নেমে পড়ি।
প্রহরকে সুস্থ করে তোলার যুদ্ধ।”
পরের ঘটনাগুলো ডা. সাবরিনা আক্তার নিজের চোখে দেখেছেন। প্রহরকে নিয়ে অতিথির দৌড়াদৌড়ি, নিজের কাজ ফেলে সর্বক্ষণ প্রহরের সেবা করা, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া.. সব।
এতো কিছুর পরও মেয়েটা মনোবল হারায়নি। মেয়েটার বয়স কম কিন্তু ধৈর্য্য, ভালোবাসা আর বুদ্ধির দিক দিয়ে সে সবাইকে পিছনে ফেলে দিতে পারে।
গত সাতদিন আগে প্রহরের টিউমার অপারেশন করা হয়েছে এবং এই হাসপাতালেই করা হয়েছে। প্রথম তিনদিন প্রহরকে আইসিইউ তে নিবিড় পরিচর্যায় রাখা হয়েছিল।
প্রহরকে কেবিনের বেডে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ্‌ রহমতে সুস্থ আছে।
.
ডা. সাবরিনা আক্তার মাথা তুলে অতিথির দিকে তাকালেন। ঠোঁটে হালকা হাসির ভাব ফুটে উঠল তার।
-” তুমি অনেক সাহসী অতিথি।”
-” উঁহু, আমি অনেক ভীতু ম্যাডাম। পরিস্থিতি আমাকে সাহসী করে তুলেছে।”
-” তাও, আমি জানি অনেক সাহস তোমার।”
-” অপারেশনের ফর্ম সাইনের আগ পর্যন্ত আমি খুব ভীতু ছিলাম ম্যাডাম। সম্মুখে শুধু নিজের সাহস দেখিয়েছি। আমি জানতাম এই অপারেশন সাকসেস না হলে প্রহরের মৃত্যু হতে পারে, ওর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যেতে পারে, ও ১৫-১৬ বছর পর কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। তবুও আমি ফর্মে সাইন করেছিলাম।
কেন জানেন?
মনে হচ্ছিল এই ফর্ম একটুকরো আশার আলো আমাদের পরিবারের জন্য। মনি মা তখন আমার পাশে ছিলেন; আমার কাঁধে ভরসার হাত রেখেছিলেন। প্রহরকে যখন ওটি তে ঢুকানো হয়েছিল, কোথায় থেকে যেন মনে অদম্য সাহস এসে জমা হয়েছিল। মনে হচ্ছিল এখন ভালো কিছুর সূচনা ঘটতে যাচ্ছে। নতুন দিনের অভিষেক হওয়ার সময় হয়ে এসেছে।”
আকাশে ঘন কালো মেঘ সেজেছে। যেকোনো মুহূর্তে শহরের বুকে বৃষ্টি নামবে। দ্রুম দ্রুম করে মেঘ ডাকছে। অতিথি নিজের হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকাল।
-” এখন আমাকে উঠতে হবে ম্যাডাম।”
-” এখনি উঠবে? ”
-” মনি মা কে ট্যাক্সি অথবা সিএনজি করে দিতে হবে। সেই সকাল থেকে প্রহরের কাছে বসে রয়েছে। মা’র এখন বাসায় যেয়ে আরাম করা দরকার। উনার নিজের শরীরও ভালো না। খুব পেরেশানি যাচ্ছে মনি মা’র উপর দিয়ে।”
তারপর থাইগ্লাসের জানালা দিয়ে বাইরের দিক তাকিয়ে ব্যস্ত গলায় বলে উঠল,
-” দেখেন আকাশে কত মেঘ জমেছে!”
অতিথি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। মনি মা’র কাছে যেতে হবে দ্রুত। দরজার দিকে পা বাড়াতেই শুনতে পেল,
-” অতিথি..”
ডা. সাবরিনার দিকে ঘুরে তাকিয়ে অতিথি কৌতুহলী চোখে প্রশ্ন করলো,
-” জি ম্যাডাম?”
-” আকাশে মেঘ জমেছে ঠিকই। তবে আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার মনের আকাশে চিন্তার মেঘ বিদ্যমান। মেঘগুলোকে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে দাও।”
অতিথি হালকা হেসে সামনের বেবি হেয়ারগুলো কানের পিছে আলতো করে গুজে জবাব দিল,
-” মেঘ হয়ে বৃষ্টি ঝরানোর মানুষটা এখন হাসপাতালের বিছানায় নিজের ঘর বেঁধেছে। আপতত বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার জন্য আমার আকাশে জমে থাকা মেঘ আরেকটু নাহয় অপেক্ষা করুক।
অপেক্ষা করতে ক্ষতি কী?”
.
সমাপ্ত….

( প্রিয় বন্ধুরা প্রতিদিন নিয়মিত ৫টি করে রোমান্টিক ধারাবাহিক গল্প আপলোড দেওয়া হবে। চমৎকার সব গল্প পড়তে নিয়মিত ভিজিট করুন গল্পের ঠিকানায়।ওয়েবসাইটটি নতুন তাই সবসময় ভালো গল্পগুলো আপলোড দেওয়ার চেষ্টা করবো)

5 COMMENTS

  1. Onek din por ekta positive golpo porlam.. positive, unbiased ar progressive viewpoint.. kono otirikto tene nie jaoa nei.. bhalo laglo..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here