#আমার_আকাশ_জুড়ে_তুমি(৩)
#জেরিন_আক্তার_নিপা
রাগে আতিয়ার শরীর কাঁপছে। এর আগে কখনো কোনো ছেলে ওর মুখের উপর এভাবে না বলেনি। সে সব ছেলেদের ইচ্ছা মত নিজের ইশারায় নাচিয়েছে। কোনো ছেলে তার কথার অবাধ্য হতে পারেনি। এই ছেলেটার কিসের এতো অহংকার? সে হ্যান্ডসাম,গুড লুকিং,সিক্স প্যাক বডির অধিকারী এটুকুই তো? তার থেকে আতিয়া কম কিসে? মিস ওয়াল্ড কনটেস্টে নাম দিলে সে নিঃসন্দেহে প্রথম হয়ে যেত। হ্যাঁ, একটু খাটো তো কী হয়েছে? হাইহিল পরলে বোঝা যায় নাকি?
সা’দ চলে যাচ্ছে ম্যানেজার তার পেছন পেছন গিয়ে বললেন,
“-স্যার।
“-প্লিজ রফিক সাহেব এই নিয়ে আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না। আপনিই নিশ্চয়ই উনাকে আমার কথা বলেছেন।’
“- কথাটা তো শুনুন স্যার।’
“-কোনো কথা না। আমি কোনো মেয়ের সাথে নিজের রুম শেয়ার করতে পারব না। আর তাছাড়া আমি মেয়েটাকে চিনি না। আপনি উনাকে চলে যেতে বলেন।’
“-উনি সত্যিই খুব সমস্যায় পড়েছেন। দশটা থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। এখন তো বারোটা বাজে। এতো রাতে একা মেয়েমানুষ কোথায় যাবে বলেন তো? তার উপর উনি এই শহরে নতুন। কাউকে ভালো করে চিনেন না। কোনো আত্মীয়ও নেই এখানে। এর আগে আরো তিনটা হোটেল থেকে ঘুরে এসেছেন। কোথাও রুম খালি নেই। আপনি দয়া করে উনাকে ফিরিয়ে দিবেন না। আপনি তো এখানকারই ছেলে। আপনি তো জানেনই রাতের বেলায় রাস্তায় কত অমানুষ ঘুরে বেড়ায়। মেয়েটা যদি কোনো বাজে মানুষের হাতে পড়ে যায় তখন? নিজের শহরে অসহায় একটা মেয়েকে এভাবে একা ছেড়ে দিবেন স্যার?’
রফিকের কথায় সা’দ সত্যিই ভাবনায় পড়ে গেল। সত্যিই তো এতো রাতে একটা মেয়েকে এভাবে একা ছেড়ে দেওয়ার ঠিক হবে না।
“-ওকে। আপনি উনাকে আমার কাছে পাঠান। আমি কিছু কথা বলবো। ‘
“-আচ্ছা স্যার। থ্যাংক্স স্যার।’
“-হুম। ‘
রফিক আতিয়ার কাছে ছুটে গেল।
“-ম্যাম, স্যার রাজি হয়েছেন। আমি উনার সাথে কথা বলেছি। আপনি যান উনি আপনার সাথে কিছু কথা বলবে।’
“-ম্যানেজার সাহেব, আমি ঐ অসভ্য লোকটার সাথে রুম শেয়ার করতে চাই না। আমি যাচ্ছি উনাকে বলে দিন আমার রুম লাগবে না। একা এক রুমে উনি গলায় দড়ি দিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলে যাক।’
প্রচন্ড রাগের সাথে আতিয়া কথাটা বলল। রফিক আতিয়ার কথা কিছুই বুঝতে না পেরে বললেন,
“- আপনি এসব কি বলছেন ম্যাম? এতক্ষণ বসে থেকে এখন আপনি চলে যাবেন বলছেন? এতো রাতে কোথায় যাবেন আপনি? এখানকার কিছু চিনেন? ‘
লোকটার কথায় আতিয়ার রাগ কিছুটা কমলো। সত্যিই তো সে এখন কোথায় যাবে? রাত বারোটার পর রাস্তায়ও নিশ্চয়ই কোনো গাড়ি পাবে না।
“-ম্যাম আপনি ভাববেন না। উনি খুব ভালো লোক। স্যারকে আমি আগে থেকে চিনি। উনি মাঝে মধ্যেই এখানে আসেন। আর তাছাড়া উনি এই শহরের বিশিষ্ট শিল্পপতি সালাম চৌধুরীর নাতি সা’দ চৌধুরী। উনাকে এখানকার সবাই চিনেন। উনার থেকে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।’
আতিয়া সা’দের সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে। তার মনে মনে জেদ কাজ করছে। একটু আগে করা এই লোকটার কাজ তাকে খুব অপমানবোধ করাচ্ছে। লোকটা নিজেকে কি ভাবে? আতিয়া এর জন্য একে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে। তাকে অপমান করার যোগ্য জবাব দেবে সে। আতিয়াও বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। তারও কিছু কম নেই। বাড়ি, গাড়ি, টাকা-পয়সা, বিষয়সম্পত্তি কোনো কিছুর কমতি নেই। আতিয়া মনে মনে বলল,
“-আমাকে না বলা, না? তুমি নিজেকে নিয়ে খুব অহংকার করো তাই না? তোমার এই অহংকার যদি আমি মাটির সাথে মিশিয়ে না দেই তাহলে আমার নামও আতিয়া আশরাফ চৌধুরী না। আমি একদিন তোমাকে ‘না’ করবো। সেদিন তোমাকে না ফিরিয়ে দেবার জন্য আমার কাছে হাতজোড় করবে। আকুতি মিনতি করবে। আজ যেমন আমি করলাম। ‘
আতিয়ার অনেক জেদ। জেদের বশে ছোট থেকে সে এমন অনেক কাজ করেছে। বাবার সাথে জেদ করে অসংখ্য বার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। এবারও জেদ করেই বাড়ি ছেড়েছে।
সা’দ আতিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
“-এ শহরে নতুন?’
“-হ্যা।
“-রিলেটিভ কেউ নেই এখানে?’
“-থাকলে নিশ্চয়ই হোটেলে উঠতাম না। ‘
“-এখানে চেনাজানা কেউ নেই তাহলে আপনি এখানে কি করতে এসেছেন? ‘
“-কী করতে এসেছি আপনার কাছে কি তার জবাবদিহিতা করতে হবে?’
“-না। তা কেন করবেন? ‘
“-তাহলে এতকিছু জিজ্ঞেস করার মানে কি?’
“-কিছু না। জাস্ট জানতে চাইলাম। হতে পারে আপনি আগে থেকে সব প্ল্যান করে এসেছেন। আজ রাতে আমার সাথে থাকতে চাইবেন আর কাল সকালেই হয়তো এটা নিউজপেপারে,টিভিতে আসবে। ‘
“-হোয়াট? ‘
“-অস্বাভাবিক কিছু না। আমাকে ফাসানোর জন্য, আমার ফ্যামিলির বদনাম করার জন্য আগেও অনেকবার এমন হয়েছে। ‘
আতিয়া রাগে দু’হাত শক্ত করে মুঠো করে বলল,
“-আপনি নিজেকে কী ভাবেন মিস্টার? কোথাকার কোন সুপারস্টার আপনি? লোকে কেন আপনার বদনাম করতে যাবে? মানুষের কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? আর আপনি আমাকেই বা কোন কারণে সন্দেহ করছেন? ‘
“-আমি নিজেকে কী ভাবি তা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি কিন্তু নিজেকে একবারো সুপারস্টার দাবি করিনি। লোকে কেন আমার বদনাম করবে তা আপনার না জানলেও চলবে। আর আপনাকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আপনি বলছেন আপনি এখানে নতুন। কোনো রিলেটিভও নেই। তাহলে কেন শুধু শুধু এখানে এসেছেন? আচ্ছা ধরে নিলাম ঘুরতে এসেছেন। কিন্তু ঘুরতে এলে আগে থেকেই হোটেলে রুম বুক করে আসতেন। এখানে এসে যাতে সমস্যায় পড়তে না হয় তার সব ব্যবস্থা করে আসতেন। আর সবথেকে বড় কথা ঘুরতে এলে আপনি নিশ্চয়ই একা আসবেন না? সাথে কেউ না কেউ থাকবে।’
আতিয়া বুঝে গেল এর সাথে সে কথায় পেরে উঠবে না। এটা একটা সন্দেহপ্রবন লোক। একে মিষ্টি কথায় ভোলানো যাবে না। এর সাথে মিথ্যে বলতে হলেও খুব ভেবেচিন্তে বলতে হবে।
“-আমি আমার পারসোনাল কথা আপনার কাছে বলতে চাচ্ছি না। ‘
“-তাহলে ম্যাম আমিও যে আপনার সাথে আমার রুম শেয়ার করতে পারছি না। ‘
আতিয়া মনে মনে বলল,
-শুনেছিলাম সুন্দর ছেলে গুলো নাকি মাথামোটা হয়। কিন্তু না এ তো দেখছি সি আইডি অফিসারকেও হার মানাবে। মাথায় এতো বুদ্ধি নিয়ে এটা এখনো এতো হ্যান্ডসাম আছে কী করে? ‘
“-কী ভাবছেন মিস? আপনি কি আমার কাছে সত্যি বলবেন নাকি আমি রুমে যাব?’
আতিয়া ভাবছে কেমন মিথ্যা স্টোরি বানালে একে বিশ্বাস করানো যাবে। সাথে সাথে তার মাথা কাজ করে গেল।
“-আমি যাকে ভালোবাসতাম মানে আমার বয়ফ্রেন্ড তার সাথে এখানে এসেছি। আমরা দু’জন দু’জনকে অনেক ভালোবাসতাম। আমি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। আর তার বাবা ছিল অনেক ধনী। তিনি কিছুতেই আমাদের সম্পর্ক মেনে নিবেন না। আমার বয়ফ্রেন্ড এর বাবা তার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তার বিয়ে ঠিক করে ফেলল। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেই আমরা পালিয়ে যাব। ওর কথামত আমি আমার পরিবার ছেড়ে ওর হাত ধরে এপর্যন্ত চলে আসি কিন্তু…
এটুকু বলেই আতিয়া মিছেমিছি কান্নার অভিনয় করতে লাগলো। মেয়েদের চোখের পানি দেখলে যেকেউ তাদের বিশ্বাস করে নেয়।
“-কিন্তু ও আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। আসলে কোনো বড়লোকরাই একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে ভালোবাসতে পারে না। ধনীরা পারে শুধু নাটক করতে। ও আমার বিশ্বাস নিয়ে, আমার ভালোবাসা নিয়ে খেলা করেছে। আমাকে এখানে এনে আমার সাথে…
এটুকু বলে আতিয়া আবার চোখে হাত দিয়ে কাঁদতে লাগলো। হাতের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে সা’দের দিকে তাকাচ্ছে। মনে মনে বলছে,
-ব্যাটা আমার কথা বিশ্বাস করলো নাকি? মুখ দেখে তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। নাটকটা আরেকটু গভীরে নিয়ে যেতে হবে।’
“-ওর প্ল্যান ছিল ও আমাকে ওর বন্ধুদের হাতে তুলে দিবে। এখানে আসার পর আমি ওর প্ল্যান কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে ওর কাছ থেকে পালিয়ে আসি। আমি তো মন থেকে ওকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু ও তো আমাকে ভালোবাসেনি। ও শুধু আমাকে ভোগ করতে চেয়েছিল। আর সেজন্যই এতদূর নিয়ে এসেছে। সব বড়লোকরাই একরকম হয়। ওরা শুধু মেয়েদের অপমান করতে জানে।’
আতিয়া দু’হাতে মুখ ঢেকে নিল। সা’দ আতিয়ার কথাগুলো শুনে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। কারো বয়ফ্রেন্ড নিজের গার্লফ্রেন্ডের সাথে এমন কিছু করতে পারে এটা তার ভাবনার বাহিরে ছিল। মেয়েটা সত্যিই তাহলে খুব বিপদে পড়েছে। আতিয়া মনে মনে হাসছে,
-ওয়েল ডান আতিয়া। তুই তীরটা একদম ঠিক জায়গায় মেরেছিস। তোর নিশানা পুরোপুরি লেগে গেছে। উনি নিজে একটা ছেলে। নিজের জাতীরই একজন, একটা মেয়ের সাথে এতো জঘন্য একটা কাজ করেছে। তা ছেলে হয়ে উনি কখনো মেনে নিবেন না। আর না আমাকে এই অবস্থায় একা ছাড়বেন। এখন নিশ্চয়ই মনে মনে উনি আমার কথা ভেবে আফসোস করছেন। আর আমার বানানো বয়ফ্রেন্ডকে গালি দিচ্ছেন।
সাব্বাস আতিয়া। তুই কি করে এতটা ট্যালেন্টেড হলি? তোর ভেতর তো ট্যালেন্টে কুটকুট করছে। দুই মিনিটে এতো সুন্দর একটা স্টোরি বানিয়ে ফেললি! তুই তো রাইটার হতে পারবি।’
সা’দ বিরবির করে বলল,
“-ওই একটা ছেলের জন্য মেয়েটা এখন পুরো ছেলে জাতটাকেই খারাপ ভাবছে। পৃথিবীর সব ধনীদের ঘৃণা করছে। ভাবছে সব ধনী ছেলেরাই হয়তো মেয়েদের ভোগের পন্য ভাবে। কিন্তু এটা তো ঠিক না। তার এই ধারণাটা ভুল। সব ধনীরা এমন হয় না। তারা মেয়েদের সম্মান করতে জানে। ধনী ছেলেরাও গরীব মেয়েকে ভালোবাসতে পারে।’
সা’দ আতিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“-আপনি আমার সঙ্গে আসুন।’
আতিয়া মনে মনে ইয়াহু বলে তিন চারবার লাফিয়ে উঠলো। বিরবির করে বলল,
“-আমার বানানো স্টোরি তাহলে উনি বিশ্বাস করেছেন। আর করবে না-ই বা কেন?
ব্যাটার ভাবসাব আর ম্যানেজারের কথা শুনে তো মনে হলো ব্যাটা হেব্বি বড়লোক। আমি তো সেটারই চান্স নিয়েছি। পৃথিবীর সব বড়লোকদের খোঁচা দিয়ে কথা বলেছি। এখন উনি নিজেকে সাধু প্রমান করার জন্য আমার হেল্প করবেন।’
সা’দ আতিয়াকে রুমে নিয়ে গেল। আতিয়া সা’দের পেছন পেছন রুমে ঢুকে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বিছানায় বসে পড়লো।
#আমার_আকাশ_জুড়ে_তুমি(৪)
#জেরিন_আক্তার_নিপা
“-আহ! উফ আল্লাহ। কি দিনটাই না গেল আজ!’
সা’দের দিকে আড়চোখে চেয়ে মিনমিনিয়ে আতিয়া বলল,
“-ব্যাটা খচ্চর জায়গা না দিলে আজ রাত আমাকে রাস্তায় কাটাতে হতো। ইউ ছি!’
আতিয়া এমন ভাবে মুখ বাঁকাল যেন ড্রেনের পঁচা পানির গন্ধ এসে নাকে লেগেছে।
সা’দ এই প্রথম বার আতিয়াকে ভালো করে দেখল। মেয়েটা বেশি লম্বা হবে না। এই পাঁচ ফিট এক/দুই ইঞ্চি। কিন্তু ফর্সা অনেক। বিদেশীদের মত গায়ের চামড়া। পুতুল পুতুল ফেস। সাদা লং স্কার্টের সাথে হালকা গোলাপী টপ পরা। টপে বারবী ডলের ছবি আঁকা। চুলগুলো উঁচু করে ক্লিপ দিয়ে আটকানো। সা’দ ভাবল, এই মেয়ে একটা ছেলেকে বিশ্বাস করে ঠকেছে? সিরিয়াসলি!’
আতিয়ার ড্রেসআপ দেখে সা’দের মনে খটকা লাগছে। একটু আগের কথা মনে করলো সে।
“-মেয়েটা বলেছিল সে মধ্যবিত্ত ঘরের। একটা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ের ড্রেসআপ এমন হবে নাকি?’
সা’দের মনে পড়ে গেল। আগের বার দাদাজানের ইমেজ নষ্ট করার জন্য ইলেকশনের আগে কিভাবে নাহিলকে ফাসানো হয়েছিল। কিছুই ভুলেনি সা’দ।
“-না। এই সবকিছুই একটা ফাঁদ। আমার শত্রুরা এই ফাঁদটা খুব ভেবেচিন্তে পেতেছে। আমাকে সর্তক থাকতে হবে। মেয়েটাকে কেউ শিখিয়ে পড়িয়ে এখানে পাঠিয়েছে।’
আতিয়া লক্ষ করলো। অনেকক্ষণ ধরে লোকটা তাকে কিভাবে যেন দেখছে। কেমন সন্দেহের চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। নখ কামড়াতে কামড়াতে ভাবল আতিয়া।
“-এই গর্দভের আবার কি হলো? হ্যা,এভাবে আমার দিকে চোখ বড় বড় করে কী দেখছে? আমি কি দেখতে এতটাই খারাপ নাকি? না, না। সিচুয়েশান সুবিধার মনে হচ্ছে না। ব্যাটা নিশ্চয়ই আমকে সন্দেহ করছে।’
সা’দ গলা খাঁকারি দিল। বনিতা না করে সোজা জিজ্ঞেস করল।
“-আপনার বাবা কী করে বলেছিলেন যেন?’
আতিয়া মুখ থেকে হাত নামিয়ে স্পষ্ট গলায় উত্তর দিল।
“-বলিনি। আমার বাবা কী করেন তা আপনাকে এখনও বলিনি।’
“-ওহ। তা কী করেন উনি?’
আতিয়া মনে মনে বলছে,
-ব্যাটা ধুরন্ধর! শিয়ালের নানা শ্বশুর। দাঁড়া, দেখ তোকে কিভাবে গাধা বানাই।’
উত্তরের জন্য সা’দ আতিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে আছে।
যা কিছুই বলুক খুব ভেবেচিন্তে বলতে হবে। ধরা পড়ে গেলে চলবে না।
“-আমার বাবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুল টিচার। এখন আপাতত উনার একটা কোচিং সেন্টার আছে।’
“-ওকে। আপনারা কয় ভাইবোন? ‘
মনে মনে বিরক্ত হচ্ছে আতিয়া।
-শালা! এক রাতের জন্য তোর কাছে একটু থাকার জায়গা চেয়েছি। তোকে বিয়ে করতে চাইনি। তুইও আমাকে পাত্রী দেখছিস না। এতো প্রশ্ন কেন তাহলে? আমরা তো সারাজীবন একসাথে থাকব না। জাস্ট আজকের রাতটা। সকাল হলেই আমি আমার রাস্তায়। আর তুই তোর রাস্তায়। আমার বাপ, দাদা ষোল গোষ্ঠীর ইনফরমেশন দিয়ে তোর কাজ কি? তুই নিজের কাজে কাজ রাখ না।’
“-হ্যালো মিস!’
“-জি? হ্যা। আমরা পাঁচ বোন। সবার বড় আপুর বিয়ে হয়ে গেছে। দু’টা বাচ্চা আছে। টিনু,মুনু। দুলাভাই দুবাই থাকে। তার পরের আপুরও বিয়ে হয়েছে। ওর বাচ্চা কাচ্চা নেই। দুলাভাইয়ের চরিত্র ভালো না। মদ, গাঁজা খায়। তিন নম্বরে আমি। আমার ছোট জন কলেজে পড়ে। ফাস্ট ইয়ার। তার পরের জন। মানে পাঁচ নাম্বারজন ফাইভে পড়ে। আমাদের ভাই নেই। বাবা মায়ের তো একটা ছেলের খুব শখ ছিল। কিন্তু আল্লাহ উনাদের পাঁচ পাঁচটা মেয়ে দিয়ে দিলেন।’
সা’দের কান থেকে যেন ধোঁয়া বেরুচ্ছে। বাবারে বাবা! এই মেয়ে তার পুরো গোষ্ঠীর বর্ণনা কেন দিচ্ছে? সা’দ এসব জানতে চেয়েছে তার কাছে?
“-হয়েছে, হয়েছে। আপনার বাড়ি কোথায়?’
“-বাড়ি? আমার দাদার বাবার বাড়ি ছিল পাবনা। আমার দাদা উনার বাপের সাথে রাগ করে চলে আসেন রংপুর। আমার বাবা আবার আমার মা’কে পালিয়ে বিয়ে করেন। তাই দাদা বাবাকে বাড়ি থেকে বের দেন। তখন বাবা আবার কুমিল্লা গিয়ে উঠেন। মানে বলতে গেলে আমাদের বাড়ি…
“-চুপ করুন প্লিজ। অনেক রাত হয়েছে। আপনি এবার দয়া করে শুয়ে পড়ুন। ‘
হাসি চেপে রাখতে পারছে না আতিয়া। হায়! এসব কী বলল সে? জীবনে ঢাকার বাইরে কোথাও যায়নি। পাবনা, রংপুর, কুমিল্লা কতদূর সেটাও বলতে পারবে না। মুখে এসেছে আর সে বলে গেছে। লোকটাও ওর এসব কথা বিশ্বাস করে নিল!
সা’দ বাম কপালের শিরা ঢলতে ঢলতে ভাবছে,
-এই মেয়ের বয়ফ্রেন্ড ভাগবে না তো কি করবে? ছেলেটা ভেগে গিয়ে বেঁচে গেছে। আস্ত বাচাল মেয়ে একটা। এক কথা জিজ্ঞেস করলে পুরো গোষ্ঠীর হিস্টোরি খুলে বসে। এর বয়ফ্রেন্ড পালিয়ে গিয়ে জান বেঁচেছে। নয়তো বেচারা এর কথার নিচে চাপা পড়ে মারা যেত।’
আতিয়া খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“-আপনার আরও কিছু জানার আছে? ‘
-না বোন। মাফ কর আমাকে।’ সা’দ কথাটা বলতে যেয়েও পারলো না। গম্ভীর মুখে বলল,
“-না। আপনি শুয়ে পড়ুন।’
“-আচ্ছা।’
আতিয়া নিজের ব্যাগ নিয়ে বেডে উপুড় হয়ে বসে পড়লো। সা’দ ওর দিকে নজর দিচ্ছে না আর। সে এইটুকুতেই যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে আতিয়া। রাতের বেলা শাওয়ার নেয়নি। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে চেঞ্জ করে এসেছে। এক কাপড়ে আজ সারাটা দিন ছিল। গা চটচট করছিল এতক্ষণ। এখন একটু শান্তি লাগছে।
রুমে এসে সা’দকে না দেখে আতিয়া বলল,
“-গর্দভ মাথামোটা ব্যাটাটা কোথায় গেল আবার? যাক। যেখানে ইচ্ছে যাক। আমার কি? আমি চিল করি। কোনো প্যারা নাই জীবনে। আতিয়া যতদিন তোর মিথ্যে আছে ততদিন তুই আছিস। এবারের গল্প গুলো যা বানিয়েছিস না! পুরাই জোস। হামিদ চাচা শুনলে হাসতে হাসতে মরেই যাবে। ‘
এতক্ষণে হামিদ চাচার কথা মনে পড়লো আতিয়ার। সেই সকালে কথা হয়েছিল। তারপর থেকে আর কথা হয়নি। নিশ্চয়ই হামিদ চাচা অনেক চিন্তা করছে।
“-না। চাচার সাথে কথা বলতে হবে। পাপার খোঁজও নেয়া হয়নি। পাপা নিশ্চয়ই চার পাঁচ বার হার্টফেল করেছে।’
টাওয়েল রেখে নিজের ফোন হাতে নিল আতিয়া। কিছু ভেবে থেমে গেল।
“-না। আমার ফোন অন করা যাবে না। ফোন অন করলেই পাপা আমার খোঁজ পেয়ে যাবে। ওরা যেভাবেই হোক আমাকে খুঁজে বের করে ফেলবে।’ ভাবছে আতিয়া।
“- আর তাছাড়া আমি তো সিম খুলে ফেলে দিয়েছি। নতুন সিমও নেওয়া হয়নি। কিভাবে চাচাকে কল দিব?’
দরজায় শব্দ হলো। সা’দ রুমে এসেছে। আতিয়ার দিকে একপলক চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল সা’দ। বলল,
“-আপনি এখনও ঘুমান নি? ‘
“-না।’
অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিল আতিয়া। পরক্ষণেই তার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল।
“-এই ব্যাটার কাছে ফোন চাইলে ফোন দিবে কি? নাকি ভাব নিবে? শালার তো আবার ভাব কম না। রুম শেয়ার করার সময়ই কত ভাব দেখালো। শালা!’
আতিয়া চুপ করে আছে। সা’দ না চাইতেও বারবার আড়চোখে আতিয়াকে দেখছে। অত না ভেবে আতিয়া চেয়েই বসলো।
“-এইযে আপনার ফোনটা একটু দিবেন?’
কপালে ভাঁজ ফেলে সা’দ জিজ্ঞেস করলো,
“-কেন? ‘
আতিয়া বিরক্ত হলো। মনে মনে বলল,
-তোর ফোন পানিতে ধুয়ে, ওই পানি দিয়ে লেবুর শরবত বানিয়ে খাব শালা। ফোন দিয়ে মানুষে কি করে? খায়? নাকি মাথায় দেয়?’
সা’দ প্রশ্নবিদ্ধ চোখে আগের মতই উত্তরের আশায় আতিয়ার মুখের দিকে চেয়ে আছে।
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সা’দের চোখে চোখ রাখল আতিয়া। মনে মনেই বলল,
-বিদেশী ইঁদুর! তোমার পাল্লায় পড়ে সন্ধ্যা থেকে আমি যেই মিথ্যা কথা গুলো বলেছি, আমার মনে হয় না, আমার পুরো জীবনে আমি এতগুলো মিথ্যা বলেছি। আহ! আবার বানিয়ে বানিয়ে এতগুলো মিথ্যা বলতে হবে। তবে কাল সকাল পর্যন্তই।’
চোখ মিটমিট করে আতিয়া বলতে শুরু করল,
“-আপনাকে তো বলেছিই। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। আমার কাছে আর টাকা নেই। কোথাও থাকতে হবে আমাকে। এখন বাড়ি ফিরে গেলে বাবা আমাকে বাড়িতে উঠতে দিবে না। তাই আমি ভেবেছি কিছুদিন আমার চাচার বাড়িতে থাকব। উনারা আমাকে অনেক ভালোবাসেন। আমি সবকিছু বুঝিয়ে বললে চাচা বুঝবেন। তাই চাচার সাথেই একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম।’
“-ওহ।’
দুমিনিট চুপ থেকে কিছু ভেবে সা’দ বলল,
“-আপনার নিজের ফোন নেই? ‘
কথাটা শুনে হা করে তাকিয়ে রইল আতিয়া।
-আল্লাহ! এই ছেলে এতো সন্দেহ করে কেন? না, না। এর কি সন্দেহ করার রোগ আছে? সামান্য একটা বিষয় ইজি ভাবে নিতে পারে না। শুরু থেকেই আমার সবকিছুতে সন্দেহ প্রকাশ করছে। এর সমস্যাটা কি? এতো সুন্দর করে কাহিনী বানিয়ে বললাম, এখন ব্যাটা বলছে ” আপনার নিজের ফোন নেই?”।
মনে কথা মনেই চেপে রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে আতিয়া বলল,
“-আমার ফোন আমার বয়ফ্রেন্ড নিয়ে গেছে। আপনার ফোনে কি ব্যালেন্স নেই? আচ্ছা আপনি ফোনটা দিন। চাচার সাথে কথা বলে যত টাকা কাটবে, আমি আপনাকে সেই টাকা ফেরত দিব।’
মেয়েটার কথা শুনে না চাইতেও হেসে ফেলল সা’দ। সে নাকি টাকার হিসেব করছে! এই সামান্য টাকার হিসেব করার মত সময় ওর কাছে আছে নাকি? পকেট থেকে ফোন বের করে আতিয়ার দিকে এগিয়ে ধরলো।
“-নিন। যতক্ষণ ইচ্ছে কথা বলুন। টাকার চিন্তা করতে হবে না। ‘
আতিয়া যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছে এতটা খুশি হওয়ার ভাব করে বলল,
“-থ্যাংক্স।’ মনে মনে বলল,
-পঁচা পানিতে ডুবে মর তুই। বিদেশী ইঁদুর। ‘
ফোন কানে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল আতিয়া। বেডে বসে পড়ে দম নিলো সা’দ।
“-হাহ! মন বলে মেয়েটাকে বিশ্বাস কর। মাথা বলে বিশ্বাস করিস না। মেয়েটার হাবভাব ঠিক না লাগলেও, ওর কথাগুলো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়।’
আনমনে হাসলো সা’দ।
“-এই মেয়ের বয়স কত হবে? বিশ বা একুশ? এই বয়সে একটা ভুল মানুষের খপ্পরে পড়ে নিজের জীবনটা নষ্ট করতে যাচ্ছিল। বুদ্ধি আছে তাই মাঝ রাস্তায় বেঁচে গেছে নইলে…’
কেনই যেন আতিয়ার উপর রাগ হলো ওর।
কে বলেছিল একটা ছেলেকে বিশ্বাস করে বাড়িঘর, বাবা-মা ছেড়ে চলে আসতে? যদি ওর সাথে কিছু একটা হয়ে যেত?
“-আজকালকার মেয়েদের একটাই সমস্যা। বাবা, মা’র থেকে ওদের কাছে দু’দিনের প্রেম বড় হয়ে যায়। আরে তুই যদি তোর বাবা মা’রই হতে না পারিস, তাহলে একটা ছেলের হবি কী করে? বয়ফ্রেন্ড বলল আর সাথে সাথে বাড়ি ছাড়তে হলো! বাবা,মা,ভাই, বোনের কথা একবারও মাথায় আসলো না? সেলফিশ মেয়ে। ‘
সা’দের মনটা তিক্ত হয়ে উঠলো। হঠাৎ তার কেন এতো রাগ হচ্ছে বুঝতে পারছে না সে। ওই মেয়ের জীবন, যা ইচ্ছা তা করুক। তাতে ওর কি? এই কথাটাই মনকে কোনোভাবে বুঝাতে পারছে না। কেন এমন হচ্ছে?
চলবে…
চলবে….
সবার মন্তব্য আশা করছি