#আমার_গল্পে_আমি_খলনায়িকা
পর্ব—১৩
—সেদিন হাসপাতালে অন্য কেউ জমজ সন্তান প্রসব করে।সেই জমজ সন্তানদের থেকে কোনো একজনকে তোমার শ্বাশুড়ীমায়ের কোলে তুলে দেওয়া হয়।
—কিন্তু আপনারা এটা কেনো করলেন,কি উদ্দেশ্য ছিলো আপনাদের বলুন,
—আমরা যা করেছি ওনার স্বামীর কথায়,উনিই ডাক্তারের হাতে মোটা অঙ্কের টাকা তুলে দিয়েছেলেন যাতে তার স্ত্রী জ্ঞান ফিরে মৃত সন্তান দেখতে না পায়।এরপর সেই মহিলার বাচ্চার তুলে দেওয়া হয়েছিলো তার কোলে,আর ঐ ভদ্রমহিলা যে জমজ সন্তান প্রসব করেছে এটা কেউ জানতেই পারলো না।
—উনি এখন কোথায় আছেন বা ওনার বাকি সেই সন্তান তাদের কোনো খোঁজখবর আছে কি আপনার কাছে?
—সেটা কিকরে থাকবে বলো,আমি যা জানি তাই বললাম তোমায়।আমি চাইলেই সবটা লুকিয়ে যেতে পারতাম কিন্তু কেনো বলছি জানো?সেইদিনের ঘটনার পর থেকে এক প্রকার অপরাধবোধ কুড়িয়ে কুড়িয়ে শেষ করে দিতে শুরু করে আমায়।আজ বিকেলেও যখন দেখা হয়েছিলো তোমাদের সাথে আমি প্রথম দেখাই তোমার শ্বাশুড়ীমাকে চিনতে পেরেছিলাম কিন্তু আমি তাৎক্ষণিকভাবে বেশ ঘাবড়ে যাই।কিন্তু তোমরা যখন আমার বাসা পর্যন্ত চলে আসলে আর কিছু লুকিয়ে কি লাভ বলো।নিজের ভারাক্রান্ত মনটাকে একটু হলেও শান্ত করতে পেরেছি আজকের ঘটনার জন্য।
ভদ্রমহিলার কথা শুনে আমার কাছে অনেকগুলো ব্যপার পরিষ্কার হতে লাগলো।তার মানে প্রত্যয় মায়ের সন্তানই হয়।আর এখন যে প্রত্যয় সেজে আছে সে প্রত্যয়েরই টুইন।হয়তো সে নিজের পরিবারের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে এসেছে।কারণ তার মায়ের সাথে যে অন্যায়টা করা হয়েছিলো সেটা সত্যি ক্ষমার যোগ্য নয়।সেই রাগবশত কল্লোলকেও হয়তো খু ন করে নিজের রিভেঞ্জ পূরণ করেছে।এবার আমাকে মা র তে চাইছে।কিন্তু ও আসল প্রত্যয়কে কেনো খু ন করলো এটাই মাথায় ঢুকছে না আমার।প্রত্যয় তো ওর নিজের ভাই।তাহলে কি কারণ হতে পারে?কোথাও এটা নয় তো ওর রাগ প্রত্যয়ের প্রতিও ছিলো,যেহেতু প্রত্যয় কল্লোলদের পরিবারেই বেড়ে উঠেছে তাই ও নিজের ভাইকেও শত্রুর তালিকায় ফেলে দিয়েছিলো।এই প্রশ্নের উত্তর তো একমাত্র প্রত্যয়ের টুইন দিতে পারবে।
ডিএনএ রিপোর্টটা ব্যাগে রাখতে রাখতে একটা কথাই ভাবছি আমি এখান থেকে বের হয়ে সাহিলের সাথে কখন কথা বলবো।এই ডিএনএ রিপোর্ট প্রত্যয়ের ভাইয়ের সাথে ম্যাচ করলো কিকরে এই প্রশ্নের উত্তর ওকে দিতে হবে।
মা নিজের জীবনের এই তিক্ত সত্যির সমুক্ষীন হয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।আমি তাকে কোনোমতে সামলে সাগরিকা চক্রবর্তীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলাম।এরপর একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়না দিলাম।গাড়িতে বসেই কিছু না ভেবে সাহিলের নম্বরে কল দেই।একটু পরে ও কল রিসিভ করে।আমি বেশ গম্ভীর স্বরে ওকে উদ্দেশ্য করে বললাম।
—তুই আমার সাথে এইভাবে চিট করতে পারলি,বল কেনো করলি এটা আমার সাথে?
—যাহ,বাবা।আমি কি করলাম আবার?কি হয়েছে একটু ক্লিয়ার করে বলবি?
—নাটক করছিস,এখন কিছু বুঝতে পারছিস না।
—না বুঝতে পারছি না।
—তুই আমায় ভুয়া ডিএনএ রিপোর্ট কেনো দিলি বল,তুই আমায় হেল্প করতে পারবি না বললেই হতো,কেনো একটা মিথ্যে রিপোর্ট বানিয়ে ধরিয়ে দিলি আমার হাতে,
—তোর কি আমাকে এতোটাই ফালতু মনে হয়?আমি ফলস রিপোর্ট কেনো দিতে যাবো তোকে,
—তাহলে,আজকেই আমি জানতে পেরেছি আমার হাসবেন্ড প্রত্যয় আমার শ্বাশুড়ী মায়ের ছেলেই নয়।এখন তুই বল ওদের দুজনের ডিএনএ রিপোর্ট মিললো কিকরে?
—সেটা আমি জানি না,হতে পারে তোর পাঠানো স্যাম্পলে কোনো গন্ডগোল ছিলো।আমি পারফেক্ট কাজই করেছি।ট্রাস্ট করতে পারিস।
স্যাম্পলের কথা শুনতেই আমার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো।সাহিলকে বললাম।
—সরি রে তোকে সন্দেহ করার জন্য।মনে হয় আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি।
—জানতাম তুই কোনো একটা গন্ডগোল করেছিস,গা ধা কোথাকার।আবার আমায় ব্লেইম দিচ্ছিস,
—আমি আগে বাসায় গিয়ে সিওর হয়ে নেই, তারপর কল করছি তোকে।বাই।
এখন আমার উদ্দেশ্য যতো তাড়াতাড়ি বাসায় পৌঁছানো।তারপর নিজের মনের খটকা দূর করা।বাসায় পৌঁছাতে অনেকটা সময় লেগে ছিলো।তখন রাত প্রায় দশটা।ভেতরে ঢুকেই আমি প্রথমে নিজের ঘরের দিকে ছুটে গেলাম।যে চিরুনিটা থেকে প্রত্যয়ের চুল কালেক্ট করেছিলাম সেটা হাতে নিয়ে আমার মনের সকল জিজ্ঞাসা মূহুর্তেই দূর হয়ে গেলো।নিজেকে দুনিয়ার সবথেকে বোকা মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে,ইচ্ছে করছে নিজেই নিজেকে এমন বোকামীর জন্য শাস্তি দেই।এটা তো কল্লোলের ব্যবহৄত চিরুণী আর এই চিরুণীতে যে চুলগুলো ছিলো সেগুলো কল্লোলেরই।প্রত্যয়ের চিরুণী পাশেই পড়ে আছে।তাড়াহুড়ো করে স্যাম্পল কালেক্ট করার সময়ে এই বিষয়টা মাথা থেকেই বেরিয়েই গিয়েছিলো।এবার বুঝতে পারছি এই কারণেই ডিএনএ রিপোর্ট ম্যাচ করেছে।কল্লোল তো মায়েরই সন্তান ওদের দুজনের ডিএনএ ম্যাচ করবে এটাই স্বাভাবিক।শুধু শুধু নিজের বন্ধুকে সন্দেহ করলাম।যাই হোক একটা কল করে ওকে পুরো বিষয়টা জানিয়ে দিলাম।
–
–
–
–
–
রাত সাড়ে দশটার দিকে রোদেলার ফোনকল এলো আমার কাছে।
—দোয়েল আপু আপনি কোথায়,এসেছেন বাসায়?
—হ্যাঁ আমি একটু আগেই এসেছি।তোমাকেই কল দিতাম,
—আপনার কাজ কি শেষ হয়েছে?
—হ্যাঁ।প্রত্যয় কোথায়?
—আমার কাছেই আছে।আপনি বললে ওকে ছেড়ে দেই।
—হ্যাঁ দাও,কিন্তু কি করেছো তুমি ওকে।ও সুস্থ আছে তো?
—সেটা বাসায় গেলেই দেখতে পারবেন।
—ঠিক আছে ওকে এবার পাঠিয়ে দিতে পারো।
কিছুসময়ে পরে প্রত্যয় বাসায় ফিরলো।মাকে ইতিমধ্যে ওষুধ খাইয়ে ওনার ঘরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসেছি।প্রত্যয়কে দেখে বুঝতে বাকি রইলো না আমার ও ড্রিঙ্ক করে এসেছে।ঘোর এখনো পুরোপুরি কাটেনি।প্রত্যয়কে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলাম,তারপর নিজেও শুয়ে পড়ি।এতোদিন যে চিন্তাগুলো ঘুমাতে দিতো না আমায় আজ সেগুলোর সমাধান পেয়ে গেলাম।প্রত্যয় আসলে কে,ও কল্লোলকে কেনো খু ন করেছে।এই দুটো বিষয় পরিষ্কার আমার কাছে।তবে এখনো অনেক কিছু জানার বাকি রয়েছে।আসল প্রত্যয়ের সাথে কি ঘটেছে আমি এখনো পুরোপুরি জানি না,রোদেলার মোবাইল ফোনে একটা ছবি দেখেছিলাম মাত্র।যদিও একটা ছবি দিয়ে সবকিছু প্রমাণ হয়ে যায় না।প্রত্যয়কে যদি সত্যিই খুন করা হয় তারপর ওর লাশের সাথে কি করা হয়েছে,আদৌ খুন হয়েছে কিনা আমি সন্দিহান।দুজনের শরীরে একই রক্ত বইছে তাই নিজের ভাইকে প্রাণে না মে রে বাঁচিয়ে রাখারও একটা সম্ভাবনা থেকে যায়।হয়তো ওকে না মেরেই শাস্তি দিচ্ছে।সবটাই আমার মনের ধারণা।এর আদৌ কোনো মূল্য আছে কিনা জানিনা।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজের মনের অজান্তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই।
–
–
–
–
–
–
পরেরদিন সকালবেলা।চোখদুটো মেলতেই দেখি প্রত্যয় আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
—ওভাবে কি দেখছো?
—তোমাকে….
—মানে?
—মানে কিছু না,কাল রাতে ফিরতে এতো দেরী হলো কেনো তোমাদের?
—ডাক্তার দেখাতে গিয়ে যদি রাত হয়ে যায়,তাহলে আমি কি করতে পারি বলো।তার আগে বলো তুমি কোথায় গিয়েছিলে কাল,ওভাবে ড্রিঙ্ক করে ফিরলে যে!
প্রত্যয় আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো।তারপর ঘরের বাইরে চলে যায়।একটু পরে আমিও বিছানা ছেড়ে উঠলাম।ফোনটা হাতে নিতেই দেখি রোদেলার প্রায় হাফ ডজন মিসড কল।ফোন সাইলেন্ট মোডে ছিলো বলে কিছুই টের পাইনি।আর সময় নষ্ট না করে রোদেলার নম্বরে কল দিলাম।
—দোয়েল আপু,আপনি কি বেঁচে আছেন,আমি তো ভেবেছিলাম…
—সরি গো,ফোনটা সাইলেন্ট ছিলো।কি কথা এখন বলো,ফোন দিয়েছিলে কেনো?
—আপনি যতোদ্রুত সম্ভব আমার সাথে দেখা করুন।
—কি হয়েছে বলবে তো?
—ফোনে বলার মতো কথা নয় এটা,আপনাকে আমার সাথে একটা জায়গায় যেতে হবে।হতে পারে আজ অবিশ্বাস্য কিছু ঘটবে যা এতোদিনে কল্পনাও করতে পারিনি আমরা।
—আচ্ছা আমি আসবো,কিন্তু তোমার কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলাম না আমি।
—আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই,আগে সেই জায়গাটায় গিয়ে দেখতে হবে আমার মনের ধারণাটা ঠিক নাকি ভুল।
—তুমি যে জায়গাটার কথা বলছি তার হদিস পেলে কোথা থেকে,
—প্রত্যয়ের থেকে,কালরাতে তো ও আমার সাথে ছিলো,তারপর চলে আসার অনেকটা সময় পরে আমি আমার বিছানাতে একটা…..আচ্ছা আপনি আসুন আগে তারপর বলছি।এগুলো ফোনে বলা ঠিক হবে না।
—কোথায় যেতে হবে সেটা তো বলো?
—এখন আমার বাসায় আসার দরকার নেই,আমি রেডি হয়ে মেইন রোডের দিকে আসছি।আপনাকে একটা অ্যাড্রেস পাঠাচ্ছি ওখানেই মিট করবো আমরা।
প্রত্যয় সকালের খাবার খেয়ে ওর কাজে বেরিয়ে গেলো।এরপর আমিও বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি।রোদেলার সাথে দেখা করে দুজনে একটা ট্যাক্সি বুক করে তারপর নিজেদের চূড়ান্ত গন্তব্যে রওয়না দিলাম।রোদেলাকে বেশ উদ্ধিগ্ন দেখাচ্ছে আজ,এরকম মনে হচ্ছে ও কোনো ক্লু পেয়েছে আর কোনো একটা প্রত্যাশা নিয়ে আছে।যাই হোক আমরা দুজন প্রায় দেড় ঘন্টা পরে নিজেদের গন্তব্যে উপস্থিত হলাম।আমি রোদেলাকে প্রশ্ন করি।
—রোদেলা এটা তুমি কোথায় নিয়ে এসেছো আমায়?
—এখানে আসেপাশে “আনন্দ আশ্রয়”নামে একটা হোটেল আছে আমাদের সেটার খোঁজ করতে হবে?
—হোটেল,কিন্তু হোটেলে কেনো?
—সেটাই তো দেখতে এসেছি।কী আছে হোটেলে।
অবশেষে আমরা কিছুক্ষণ খুঁজে আনন্দ আশ্রয়ের সন্ধান পেলাম।রোদেলা হোটেলের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে,তারা প্রথমে আপত্তি জানালেও আমার ফোনটা নিয়ে আমার বিয়ের সময়ের কিছু ছবি ডকুমেন্ট হিসেবে দেখায়।খানিক তর্কবিতর্ক হয় ওদের ভেতরে।আমি একটু দূরেই দাঁড়িয়ে রইলাম।কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না।একটু পরে হোটেল ম্যানেজার আমাকে আর রোদেলাকে নিয়ে একটা রুমের দিকে গেলেন।রুমটা বিল্ডিংএর একদম টপ ফ্লোরে।ম্যানেজার রুমের দরজাটা খুলতেই আমরা ভেতরে ঢুকলাম,এরপর যা দেখতে পাই সত্যিই তাজ্জব বনে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় রইলো না আমার।প্রত্যয় বিছানার ওপরে বসে আছে!শুধু তাই নয় ওকে দেখে বেশ অসুস্থ মনে হচ্ছে,আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।তার মানে প্রত্যয় বেঁচে আছে এখনো,ফেইক প্রত্যয় ওকে পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে পারি নি…
চলবে…….
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।