আমার_পূর্ণতা #রেদশী_ইসলাম পর্বঃ ২৩

#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ ২৩

আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এ দিনটায় সাধারণত তাফসির একটু বেশিই ঘুরাঘুরি করে। কখনো বা সাথে শাহিন থাকে আবার কখনো বা থাকে না। তবে বেশিরভাগ সময়ই সে একায় থাকে। শাহিন অলস প্রকৃতির। সে আরামপ্রিয় মানুষ। যেখানে রাত সেখানে কাইত টাইপ। তবে তাফসিরের ধাতে আবার এসব নেই। সে ফিট থাকতে পছন্দ করে। হার্ড ওয়ার্ক করে। সপ্তাহের দু’টি ছুটির দিন যখন শাহিন ঘুমিয়ে কাটায় তখন তাফসির সকাল সকাল উঠে দৌড়ে বেরায় টরেন্টোর কোনো জগিং পার্ক বা স্বচ্ছ রাস্তার অলিতে-গলিতে। আজ এমনই জগিং করতে এসেছে সে একটা পার্কে। পার্কের শেষ প্রান্তে একটা বিশাল নীল পানির নদী। পার্কের ভেতর সরু আঁকাবাকা চিকন রাস্তা। রাস্তার দু’ধারে ওক,পাইন,বার্চ, লাল পাতার কুসুম গাছ সহ আরোও অনেক নাম না জানা গাছ। যার অধিকাংশ পাতায় রাস্তায় অবহেলিত হয়ে গড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ দৌঁড়ানোর পর একটা সময় ক্লান্ত হয়ে সে ধপ করে বসে পড়লো একটা খয়েরি রঙের কাঠের বেঞ্চিতে। এমন বেঞ্চ এখানে আরও অনেক আছে। চার পা হাঁটলেই এমন একেকটি বেঞ্চ পাওয়া যায়।
তাফসিরের ঘামে ভেজা এ্যাশ কালারের টিশার্টটি লেপ্টে আছে তার গায়ে। গলায় ঝুলানো ওয়ারলেস এক্সপেন্সিভ কালো হেডফোন। যেটি সে গত ভ্যাকেশনে ইতালি থেকে কিনেছিলো। এটি বেশ পছন্দ তাফসিরের। গেলো ও বহুদিন। এখনো নষ্ট হয় নি। পরনে কালো ট্রাউজার এবং পায়ে কালো স্নিকার্স। তাফসির সেই ঘর্মাক্ত অবস্থায় বেঞ্চে হেলান দিয়ে চোখ বুঝলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো কিছু সুন্দর মুহুর্ত। প্রতিদিন সকালে জগিং শেষে বাড়িতে ফিরে প্রাচুর্যকে কলেজে পৌছে দেওয়া। তার সাথে ঝগড়া করা। প্রাচুর্যের রাগী মুখটাকে দেখার জন্য বিভিন্ন ভাবে রাগিয়ে দেওয়া। প্রতিদিন রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রাচুর্যের ঘরে ঢুকে অনেকক্ষণ যাবত তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা। মাঝে মাঝে উষ্ণ পরশ দেওয়া।
কিন্তু কুম্ভকর্ণ মেয়েটি তো বুঝতেই পারে না। আবার বিয়ের ডেট ঠিক করার দিন রাতে ছাঁদে প্রাচুর্যকে প্রথম জড়িয়ে ধরা। আর সব শেষে ওইদিন রাতের ওইসব দৃশ্য সব কেমন জীবিত এখনো। আর কি কোনো স্মৃতি আছে? না আর তো কোনো স্মৃতি মনে পরছে না তার। এতো কম স্মৃতি? আরও কিছু স্মৃতি হলে কি সমস্যা হতো? তাহলে তো তাফসির অনায়াসেই সেইগুলো ভেবে ভেবে কানাডার দিন গুলো পার করতে পারতো। নাহ আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। বুকের ভেতর হালকা চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে তার। এই অনুভুতি গুলো সম্পূর্ণ নতুন তার কাছে। সে আরও চাই। অনেক অনেক স্মৃতি চাই প্রাচুর্যের সাথে। যাতে গল্প করতে করতে গোটা দিন শেষ হলেও স্মৃতি না শেষ হয়।

হঠাৎ পাশে কারও উপস্থিতি অনুভব করে আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো তাফসির। তাকে তাকাতে দেখে পাশে বসা নারীটি উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো—

” থ্যাংক গড তুমি চোখ খুলে তাকিয়েছো তাফসির। আমি তো ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে পরলে নাকি ”

সোনালি রেশমি চুলের স্লিভলেস ট্যাংক টপ এবং শর্ট লেগিংস পরা মেয়েটিকে দেখে বিশেষ ভালো লাগলো না তাফসিরের।চোখ ফিরিয়ে নিলো সামনে। যদিও কানাডায় এমন অহরহ নারী দেখা যায় বরং এর থেকে শর্ট ড্রেস পরেও তারা অনায়াসেই ঘুরে বেড়ায়। তবে তাদের দিকে বেশিক্ষণ দৃষ্টি স্থির রাখতে পারে না তাফসির। অস্বস্তি হয় তার। তাফসির সামনের লাল পাতার গাছটির দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো—

” তুমি এখানে কি করছো ক্যামিলি? ”

” ওমা আমাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না বুঝি যে আমি হাঁটতে এসেছি? অবশ্য ভালো করে তো দেখলেই না। ”

” তুমি তো সচারাচর এদিকে আসো না। আজকে আসলে যে? ”

” আজকে মনে হলো এদিকে একটু আসা উচিৎ। অনেকদিন আসা হয় না। তাই এলাম। ”

তাফসির আর খুঁজে পেলো না যে এরপর কি বলা উচিৎ। তাই মাঝের সময় টুকু নিরবতায় থাকলো। নিরবতা ভঙ্গ করে ক্যামিলি নামের কানাডিয়ান মেয়েটি বলে উঠলো—

” শুনলাম বাংলাদেশে গিয়েছিলে। তা কেমন ঘুরলে দেশে?”

” বেশ ভালোই। তারপর বলো তোমার কি অবস্থা? দিনকাল কেমন যাচ্ছে? ”

” আমার দিনকাল তো ভালোই যাচ্ছে। চলো না ব্রেকফাস্ট করে আসি একসাথে। ”

” সরি ক্যামিলি আজ বোধহয় সম্ভব নয়। শাহিন অপেক্ষা করছে বাড়িতে। অন্য কোনোদিন হবে। ”

তাফসিরের কথায় ক্যামিলি মন খারাপ করে বললো—

” ওও মাই ব্যাড লাক। ওকে নেক্সট টাইম। ”

তাফসির বসা থেকে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললো—

” আচ্ছা থাকো তাহলে। কালকে অফিসে দেখা হবে। বাই ”

এই কথা বলে তাফসির আর কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা বাড়ির পথ ধরলো।

ক্যামিলি তার অফিসের কলিগ। বাংলাদেশে যাওয়ার পর এই মেয়েই তাকে আই লাভ ইউ লিখেছিলো যেটা কিনা প্রাচুর্য দেখেছিলো। কিন্তু সেদিন সে ক্যামিলি কে রিজেক্ট করলেও ক্যামিলি পেছন ছাড়ে নি তার। যদিও বাংলাদেশে থাকা কালীন আর বিরক্ত করে নি তবে কানাডায় আসার পর আবার প্রপোজ করেছিলো। তখন তাফসির বলেছিলো সে বিবাহিত। তারপর থেকে আর কিছু বলে নি। স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলেছে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তাফসির এড়িয়ে চলেছে ক্যামিলিকে। মেয়েটা কে বেশি সুবিধার বলে মনে হয় না তাফসিরের কাছে। ক্যামিলিকে নিয়ে সে অনেক কথায় শুনেছে। ইভেন সে এটা ও শুনেছে বছর দুয়েক আগে ক্যামিলি স্টিফেন নামের এক ছেলের সাথে লিভ-ইন রিলেশনে ছিলো। যদিও এটা এদের কাছে কমন কিন্তু তার কাছে তো আর না। বিদেশের মাটিতে পা দিলেই যে নিজের ধর্ম,সংস্কৃতি সব ভুলে যেতে হবে তার তো কোনো কথা নেই।
.
.
.
.
তখন সন্ধ্যা ৭ টা। রাস্তার দু’ধারে লালচে সোডিয়াম লাইটের আলোয় চারপাশ আলোকিত। ফুটপাত ধরে আইসক্রিম খেতে খেতে হাঁটছে প্রাচুর্য আর রিয়া। গন্তব্য বাড়ি। অলরেডি মিসেস শাহানা দু তিন বার ফোন দিয়ে ফেলেছে রিয়ার নম্বরে। কিন্তু তখন তারা দু বোন স্ট্রিট ফুড খেতে ব্যস্ত তাই ফোন ধরার অতো সময় কোই। তাই এখন ফ্রি হয়ে রিয়া ফোন বের করে কল লাগালো মিসেস শাহানার ফোনে। মিসেস শাহানা ফোন রিসিভ করে গড়গড় করে বললেন—

” রিয়া কোথায় তোরা? তাড়াতাড়ি বাড়িতে আয়। দশ মিনিটে। ”

মিসেস শাহানার কথায় রিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো—

” কি হয়েছে ছোট মা? এতা তাড়াহুড়ো করছো কেনো? কোনো সমস্যা? ”

” এতো কথা বলার সময় নেই। যা বলেছি তাড়াতাড়ি কর। দশ মিনিটেই যেনো বাড়িতে দেখি। “__বলে সাথে সাথে ফোন কেটে দিলেন মিসেস শাহানা।

রিয়ার চোখেমুখে ভাজ দেখে প্রাচুর্য রিয়াকে জিজ্ঞেস করলো—

” কি হয়েছে আপু? মা কি বললো তোমাকে? ”

” বললো দশ মিনিটে বাড়িতে যেতে। কথা শুনে মনে হলো ইমার্জেন্সি কিছু। চল তো তাড়াতাড়ি যায়। ”

” হ্যাঁ চলো। সিরিয়াস কিছু নাহলে তো আর এতো জরুরি তলব করবে না। ”

তারা দু’জন রিকশা নিয়ে চৌধুরী বাড়ির গেটের সামনে আসলো। রিয়া রিকশা মিটিয়ে তাদের বাড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো একটা গাড়ি পার্ক করা। রিয়া হাতের কনুই দিয়ে প্রাচুর্যকে গুতা মেরে বললো—

” এই প্রাচুর্য বাড়িতে কে এসেছে বল তো? এটা তো আমাদের বাড়ির গাড়ি না। ”

” আমি কিভাবে জানবো আপু? তুমিও যেখানে আমিও সেখানে। ভেতরে গেলেই না বুঝবে? ”

” হ্যাঁ তাই তো। চল তো গিয়ে দেখি। ”

রিয়া আর প্রাচুর্য সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলো ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে অচেনা এক মহিলা ও পুরুষ। রিয়া মাথায় চাপ দিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো যে আগে কোথাও দেখেছে কিনা এই মধ্যবয়সী মহিলা ও পুরুষকে। কিন্তু না মনে পরলো না তার। এর মধ্যেই মিসেস মুমতাহিনার চোখ পরলো রিয়ার দিকে। তিনি হেসে সামনে বসে থাকা দম্পতিকে বললেন—

” ওই তো এসে গেছে আমার মেয়ে রিয়া। রিয়া মা এদিকে আয় তো। এখানে এসে বোস। ”

মিসেস মুমতাহিনার কথায় ড্রয়িংরুমে অবস্থিত সকলের একঝাঁক চোখের দৃষ্টি এসে পরলো তার দিকে। তাতে রিয়া অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে পরলো। কিন্তু তবুও কিছু করার নেই।মা যখন ডেকেছে তখন হাজার অস্বস্তি হলেও তার যেতে হবে। নাহলে ব্যাপারটা বেয়াদবি হয়ে যাবে। তাই রিয়া ধীর পায়ে এগিয়ে যেয়ে সোফায় মিসেস মুমতাহিনার পাশে বসলো। ক্ষীণ স্বরে সামনে বসা দম্পতিকে সালাম দিলো।
সামনে বসা দম্পতি তার সালাম নিলো। সাথে সাথে মহিলাটি হেঁসে বললো—

” মাশাল্লাহ মা তোমাকে তো খুব মিষ্টি দেখতে। ভাগ্যিস দেখতে এসেছিলাম নাহলে তো জানতাম না তুমি এতো সুন্দর। ”

মহিলাটির কথায় রিয়া থম মেরে গেলো। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে কাহিনী কি। কিন্তু সে যা ভাবছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে তো সর্বনাশ।

প্রাচুর্য এসে মিসেস শাহানার পেছনে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলো—

” এরা কে মা? ”

” রিয়াকে দেখতে এসেছে। তোর মেজো বাবার বন্ধু আর তার বউ। ওনার ছেলে নাকি ভালো চাকরি করে। তাফসিরের মতোই ইন্জিনিয়ার। তোর মেজো বাবার কাছে সম্মন্ধ দিয়েছিলো। তোর মেজো বাবা রাজি হয়েছে। আমাদের তো কিছু বলে নি। হুট করে হাজির হয়েছে এখন। ”

মিসেস শাহানার কথায় প্রাচুর্য কিছু বললো না। কেনো জানি ঠিক ইন্টারেস্ট পাচ্ছে না এখানে থাকতে। তাই সাত পাঁচ না ভেবে ঘরে চলে গেলো সে। তার এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে তাফসিরের সাথে। গতো তিনদিন ঠিক মতো কথা হয় নি তাদের। ঠিক মতো কি? কথায় তো হয় নি। শুধু একবার ফোন দিয়ে বলেছিলো কি করছিস,খেয়েছিস কিনা,বিজি আছি পরে কথা হবে এইটুকু। একে কি আর কথা বলা বলে? সে দেখেছে মানুষ তার গার্লফ্রেন্ড বা বউয়ের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে। কিন্তু তার বেলায় কি হলো? তার স্বামীর পাঁচ মিনিট ও কথা বলার সময় থাকে না। আর যখন সময় হয় তখন তো বাংলাদেশে মাঝ রাত। ঘুমিয়ে পরে প্রাচুর্য। তাই কথা ও হয় না তেমন।

প্রাচুর্য চার্জ থেকে ফোন খুলে রিং দিলো তাফসিরের নাম্বারে। একবার,দু’বার, তিনবার তারপরেই খট করে কেটে গেলো কল। তাতে প্রাচুর্যের মনে একরাশ কালো মেঘ জমা হলো। পরমুহূর্তেই ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো ভিডিও কল। তাফসির ভিডিও কল দিচ্ছে। মনের কালো মেঘ সরে যেয়ে প্রাচুর্যের মনে ধরা দিলো দিনের মতো ঝলমলে সূর্যের আলো। প্রাচুর্য সময় নষ্ট করলো না। চটপট ফোন রিসিভ করলো। তাতে ভেসে উঠলো তাফসিরের মুচকি হাসি মিশ্রিত মুখ। প্রাচুর্য ঝকঝকে দাত বের করে চমৎকার হাসলো। অতি উৎসাহ মিশ্রিত কন্ঠে বললো—

” কি করছেন তাফসির ভাই? ”

প্রাচুর্যের ওই ঝলমলে হাস্যরত মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো তাফসির অনায়াসেই কাটিয়ে দিতে পারবে বহু যুগ। তাফসির ঠোঁটের কোণের হাসি চওড়া হলো। অতি আবেগ মিশ্রিত কন্ঠে বললো—

” এইতো বউয়ের ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম। ”

লাল আভায় ছেঁয়ে গেলো প্রাচুর্যের মুখ। তা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো ফোনের ওপাশে থাকা অতি সুদর্শন যুবকটি। ঠোঁটে মুচকি হাসি বজায় রেখে তাফসির বললো—

” এতোক্ষণ কোথায় ছিলেন ম্যাডাম? আরেকটু আগে ফোন দিলে তো পারতেন। ”

” বাসায় ছিলাম না তো। জানেন রিয়া আপুকে দেখতে এসেছে? ”

” বাহ বেশ ভালো তো। ওর পর্ব শেষ হলেই আপনি পার্মানেন্টলি আমার ঘরে। কিন্ত কি করে ছেলে? ”

” মা বললো ইন্জিনিয়ার। এখনো ভালো ভাবে জানি না। মেজো বাবা রাতে হয়তো আপনাকে ফোন দিতে পারে। তখন ভালো করে জেনে নিবেন। কিন্তু একটা কথা কি জানেন? আমার মনে হয় না আপু রাজি হবে। আমি না একটা জিনিস টের পেয়েছি। বলতে পারেন শুনেছিও। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে আমার মনে হয় বাড়িতে একটা ঝামেলা হলেও হতে পারে। ”

#চলবে

[গল্পটা বেশি বড় হবে না। আর কয়েক পর্ব পরেই সমাপ্তি]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here