#আমি_ফাইসা_গেছি(৪০)
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
কুশান তোড়াকে নিয়ে শশুড় বাড়ি এসেছে।রাত তিনটা বাজে তবুও আজ আর এই দুইজন প্রেমিক যুগলের চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই।গভীর রাতের নিঃস্তব্ধতায় তারা আজ তাদের মনের ভাব আদান প্রদান করছে।কুশান তোড়াকে কোলের মধ্যে নিয়ে তার চুলগুলো আলতো করে বুলিয়ে দিচ্ছে আর বলছে,
জীবন টা বড়ই আজব।এই জীবনে কখন কি ঘটছে কেউ বলতে পারে না।একবার সুখের সময় আসছে তো আরেকবার দুঃখের সময়।মানুষের জীবনে আসলে পরিপূর্ণ ভাবে কখনোই সুখ ধরা দেয় না। সুখের পাশাপাশি দুঃখও বিরাজ করে।
“হুম,সুখ দুঃখের সমন্বয়েই মানুষের জীবন পরিচালিত হয়।কত বাধা বিপত্তি পেড়িয়ে আজ আমরা এ পর্যন্ত এসেছি।সত্যি আমার না এখনো কেনো জানি সব কিছু স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
কুশান এবার তোড়াকে আরো ভালোভাবে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।আর বললো,
তোমায় প্রথম যেদিন আমি সামনাসামনি দেখেছিলাম সেদিন থেকেই পুরোপুরি ভাবে আসক্ত হয়ে গিয়েছিলাম তোমাতে।আর মনে মনে সেদিনই ঠিক করেছিলাম এই মেয়েটাকেই আমার বউ হিসেবে লাগবে।তোমাকে কখনোই আমি আমার প্রেমিকার চোখে দেখতাম না।বিশ্বাস করো তোড়া,তুমি যখন শাড়ি পড়ে সাজগোছ করে আমার সাথে দেখা করতে এসেছো আমি কখনো খেয়াল করি নি, তোমার শরীরের মাঝে কয়টা ভাজ পড়েছে।শাড়ির ফাঁকে তোমার কতোটুকু পেট বেরিয়ে আছে, তোমাকে কতোটা লাস্যময়ী লাগছে!আমি তখন অন্যকিছু ভেবেছি।
তোড়া তখন বেশ কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,কি ভেবেছো?
” তোমার কথা পরিবারের লোকদের কাছে বলবো কিভাবে?কিভাবে নিজের মুখে বলবো আমি এই পরীটাকে বিয়ে করতে চাই।এই চিন্তায় আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম একদম।তোমার প্রতি আসক্তি যত বাড়তে লাগলো ততো আমাদের সম্পর্কের পরিনতি নিয়ে শঙ্কায় ছিলাম আমি।না জানি তোমায় বুঝি হারিয়েই ফেলি?
তোড়া কুশানের কথা শুনে মনে মনে হাসতে লাগলো,আর মিনমিনিয়ে বললো,তুমি যে কত বেশি বোকা আর হাদারাম ছিলে তা আমার থেকে কে বেশি জানতো?বিয়ে করার চিন্তা ছিলো নাকি তোমার মাথায়?
“এই তুমি কি কিছু বললা?
“” না তো।
“” না বলেছো।
তোড়া তখন বললো, আমাদের বিয়ে টা সত্যি এভাবে হয়ে যাবে আমি কল্পনাও করতে পারি নি।এটাই ভাবছিলাম।
কুশান তখন নিজের গাল তোড়ার গালে আলতো করে স্পর্শ করে বললো,
আসলেই, তোমাকে বউ করে কাছে পাওয়া এটা আমার সম্পূর্ণ কল্পনার বাহিরে ছিলো।আমি কখনো ভাবতেই পারি নি এইভাবে তোমাকে আমি সারাজীবনের জন্য এতো কাছে পাবো।কিন্তু তোমাকে নিজের করে পাওয়ার পরও আমার দুশ্চিন্তা একটুও কমে নি।একদিকে তুমি অন্যদিকে আমার ফ্যামিলির লোকজন।কি একটা পারিবারিক অশান্তির সৃষ্টি হয়েছিলো,আমার একেক টা দিন একেক টা বছরের মতো কেটে যেতে লাগলো।কি এক মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দিন গুলো পার করেছি তা নিজেও জানি না।
অনেক কষ্টে পরিবারের সবাইকে মানিয়ে নিলাম।সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে এগোতে লাগলো,আমার পরিবারের লোকজনও এখন খুশি,আর আমরা দুইজন আবার নতুন করে প্রেম শুরু করে দিলাম,আগের সবকিছু ভুলে যাওয়ার ট্রাই করলাম আমি,সবকিছু যেনো স্বর্গের সুখের মতো মনে হচ্ছিলো।মনে হচ্ছিলো আমি যেনো দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সুখি ব্যক্তি।
কিন্তু এই সুখ আমার আর বেশি দিন রইলো না।আমার জীবনে আবার নতুন আরেক ঝড়ের আগমন শুরু হলো।এই ঝড় বাকি সকল ঝড় থেকে সম্পূর্ণভাবেই আলাদা।এখন তো আমার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে,কি আমার পরিচয়?কে আমার আসল বাবা মা?আদৌ কি তারা বেঁচে আছে?
কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস দেখো,আমার এই অন্ধকার অশান্তিতে ভরা জীবনে এক ফালি চাঁদের আলোর মতো আমার সন্তান এসে উপস্থিত হলো।যার আগমনের কথা শুনে মুহুর্তের মধ্যে যেনো আমার সব দুঃখ কষ্ট একদম মন থেকে উধাও হয়ে গেলো।আমার তো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমি বাবা হচ্ছি?আমারও সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্চা হবে।সে সারাক্ষন শুধু আমায় আব্বু আব্বু বলে ডাকবে।আর আমিও সারাক্ষন শুধু তার সাথেই খেলবো।আমার তো ভাবতেই যেনো কেমন কেমন লাগছে?কবে যে আসবে সে দিন?আমার তো আর মোটেও দেরি সহ্য হচ্ছে না।
কুশান যখন দেখলো সে শুধু একাই কথা বলে যাচ্ছে তখন সে ডাক দিলো তোড়াকে।
“তোড়া?কি হলো তোমার?তুমি কিছু বলছো না কেনো?তোমার অনুভূতি টা তো শেয়ার করলে না?কেমন লাগছে তোমার মা হওয়ার কথা শুনে?”
এদিকে তোড়া কুশানের গল্প শুনতে শুনতে ওর কোলের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে।কুশান যখন দেখলো কোনো উত্তর আসছে না,তখন সে তোড়ার মুখ টা উপর করে ধরে দেখে তোড়া ঘুম পাড়তেছে।ঘুমন্ত তোড়াকে দেখে কুশান খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো।আর বললো,
আমার তো আনন্দে ঘুমই আসছে না চোখে।আর তুমি ঘুম পাড়তেছো?
আচ্ছা ঘুমাও।তোমার এখন রাত জাগা মোটেও ঠিক না।পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন এখন তোমার।তোমার কাছে এখন আমার আরেক টা জানপাখি আছে।
এই বলে কুশান তোড়ার মাথার নিচে একটা বালিশ দিয়ে দিলো।আর গায়ে একটা কাঁথা দিয়ে দিলো।তবে কুশানের এখনো চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই।এতো বড় একটা সুখবর পেয়েই হয় তো তার এমন অস্থির অস্থির লাগছে।যার কারণে চোখের ঘুম পর্যন্ত উধাও হয়ে গেছে তার।
ঘুমন্ত তোড়ার দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে রইলো কুশান।আর তার মুখ মন্ডল স্পর্শ করতে করতে বললো,
তুমি আমার কাছে একদম ফুলের মতো যাকে ভালোবেসে আমি সারাজীবন আগলে রাখতে চাই নিজের বুকপকেটে। আমার জন্য তুমি ব্যবহারিক কোনো আসবাবপত্র নও তোড়া, নও কোনো কামনা পূরণের সামগ্রী।তুমি হলে আমার সবচেয়ে প্রিয় যাকে আমি নিজের শেষনিঃশ্বাস অবধি আগলে রাখতে চাই ভালোবাসা দিয়ে।এই বলে কুশান নিজেও তোড়াকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
🖤
সেলিনা বেগমকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।অন্যদিকে সেলিনা বেগম কে খুনের চেষ্টা করায় জামিলা বেগমকে পুলিশের হাতে তুলে দিলো সেলিনার মেয়ে আর মেয়ের জামাই।পুরো এলাকা জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো।জামিলার যেহেতু নিজের বলতে শুধু মেয়ে জারাই আছে যার কারণে জামিলাকে উদ্ধার করার জন্য কেউ এগিয়ে আসলো না।এদিকে জারার কানে এখনো পৌঁছায় নি খবর টা।কারণ সে তো এখন তার শশুড় বাড়ি আছে।
রাতের বেলা জারা জামিলাকে কল দিয়েছিলো খোঁজখবর নেওয়ার জন্য।কিন্তু জামিলা কল রিসিভ করে নি।জারা ভাবলো হয়তো ব্যস্ত আছে তার মা সেজন্য কিছু মনে করে নি সে।নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে একা একা।
জারা রাতে একা একাই থাকে।কারণ শ্রাবণ প্রায় সময়ই বাহিরে রাত কাটায়।যেদিন বাসায় আসে সেদিন তার সাথে তেমন একটা কথাও বলে না।আবার একই রুমেই আলাদা ভাবে থাকে সে।কারণ শ্রাবণ মন থেকে মেনে নেয় নি জারাকে।সে এক প্রকার চাপে পরে বিয়ে টা করতে বাধ্য হয়েছিলো।যার কারণে ভীষণ ভাবে ক্ষুব্ধ সে জারার উপর।জারা যদি শ্রাবন কে জিজ্ঞেস করে কেনো সে রাতে বাহিরে থাকে তার জন্য শ্রাবণ অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে।জারা তার শাশুড়ী কে নালিশ দিলে তিনি উলটো তার উপরই রাগ দেখায়।লাবুনি বেগম বলেন,
নিজের স্বামীকে যদি বউ এর কন্ট্রোল করার ক্ষমতা না থাকে তাহলে দুনিয়ার আর কেউই সেই ছেলেকে ভালো করতে পারবে না।জারা এখন কাকে বলবে তার এই কষ্টের কথা?সেজন্য সে একা একা কাঁদে আর নিজের আগত সন্তানের কাছে নালিশ করে।এই সন্তানই এখন তার সুখ দুঃখের সাথী।
🖤
সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠার পরই কুশান আর তোড়ার কানে পৌঁছলো জামিলা বেগমের জেলে যাওয়ার কথাটা।তোড়া আর কুশানও ভীষণ অবাক হলো।কারণ সেলিনা বেগমের সাথে তো জামিলার বেশ ভালোই সম্পর্ক তারা দেখেছিলো।তাহলে কি এমন হয়েছিলো যে জামিলা বেগম সেলিনা কে মারার জন্য আঘাত করে।
কুশান আর দেরি না করে সাথে সাথে জারিফ চৌধুরীকে কল দেয়।আর তাকে জানিয়ে দেয় কথাটা।জারিফ চৌধুরী নিজেও ভীষণ আশ্চর্য হয়ে যায়।কারণ জামিলা তো কাল রাতে তাদের বাসাতেও এসেছিলো সেলিনার ব্যাপারে কথা বলার জন্য।তাহলে নিশ্চয় সেলিনা এমন কিছু বলেছে যার কারণে জামিলা রাগান্বিত হয়ে এই কাজটা করেছে।
জারিফ চৌধুরী কুশানকে আর এ ব্যাপারে কিছু বললো না।তিনি শুধু জামিলার জন্য আফসোস প্রকাশ করেই কল কেটে দিলেন।
জামিলার কথা শুনে সবাই ভীষণ আপসেট হয়ে গেলো।আর কুশান নিজেও ভীষণ টেনশন করতে লাগলো।এই রকম একটা ভালো মানুষের সাথে এটা কি হলো?কুশান ঠিক করলো সে জামিলার সাথে দেখা করতে যাবে।এজন্য কুশান তোড়াকে বললো,
আমি একটু থানায় যাচ্ছি তোড়া।জামিলা আন্টির তো নিজের বলতে কেউই নাই।আমার মনে হয় ওনার এই বিপদে আমাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
তোড়া সেই কথা শুনে বললো, একা একা যাবে তুমি?তার চেয়ে বরং সায়ক ভাইয়াকে সাথে করে নিয়ে যাও।উনি থাকলে ভালো হবে।
এদিকে জারিফ চৌধুরী ব্যাপার টা ক্লিয়ার হওয়ার জন্য শহিদুল সাহেব কে কল দিলো।আর জিজ্ঞেস করলো জামিলার কথা।কিন্তু শহিদুল সাহেব জামিলার জেলে যাওয়ার কথাটা এখনো শোনেন নি।তিনি তখন জারাকে গিয়ে বললেন,
জারা তোমার মায়ের খোঁজ জানো? খোঁজ নিয়েছিলে কি তিনি কোথায় আছেন এখন?
জারা তার শশুড়ের কথা শুনে ভীষণ আশ্চর্য হলো।তার শশুড় কেনো এভাবে জিজ্ঞেস করছে তাকে?
শহিদুল সাহেব তখন বললো,জারিফ চৌধুরী কল দিয়ে জানালো তোমার মা নাকি সেলিনা বেগমকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো।রাগ করে মাথায় কি দিয়ে যেনো আঘাত করে।যার কারণে সেলিনা বেগম হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে আর তোমার মাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
শহিদুল সাহেবের কথা শুনে জারা মুহুর্তের মধ্যে ভীষণ ভাবে শকড খেয়ে গেলো।তার শশুড় এসব কি বলছে?যে মামি তাদের আশ্রয় দিয়েছে সেই মামিকে কেনো মারতে যাবে তার মা।জারার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো তার মায়ের কথা শুনে।সে কোনো কিছু জিজ্ঞেস পর্যন্ত করতে পারলো না।সে শুধু ভাবতে লাগলো তার কপালে আর কত অশান্তি লেখা আছে?তার মা ছাড়া আর কে আছে তার?এখন কি হবে তার মায়ের?কে উদ্ধার করবে তার মাকে?
জারার মুখ চোখ দেখে শহিদুল সাহেব শান্ত্বনা দিয়ে বললো,
তুমি খবরদার কোনো চিন্তা করবা না মা।আমি দেখছি ব্যাপার টা।তুমি রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
জারা তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বললো বাবা,আমি মার সাথে দেখা করতে চাই একটু।প্লিজ বাবা আমাকে একটু নিয়ে চলেন।
শহিদুল সাহেব সেই কথা শুনে বললো, এখন তো দেখা করতে পারবে না।এখন গিয়েও কোনো লাভ হবে না।তারচেয়ে বরং আমি জারিফ কে সাথে করে নিয়ে গিয়ে আগে একটু খোঁজখবর নিয়ে আসি।কেনো তোমার মা এমন কাজ করলো।এই বলেই শহিদুল সাহেব বের হয়ে গেলেন বাসা থেকে।
একদিকে সায়ক আর কুশান চলে গেলো,অন্যদিকে জারিফ চৌধুরী আর শহিদুল সাহেব একসাথে চলে গেলেন থানায়।থানায় গিয়ে চারজনের একসাথে দেখা হয়ে গেলো।তারা যখন ওসির কাছ থেকে অভিযোগ পেপার টা নিলেন,চারজনের মুখই শুকিয়ে গেলো।কারণ ঘটনা সত্য।জামিলা সত্যি সত্যি সেলিনাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো।তাছাড়া পুলিশেরা নিজেরাও এই ঘটনার সাক্ষী।কারন তারা যখন জামিলাকে টানতে টানতে থানায় নিয়ে যাচ্ছিলেন তখনো জামিলা চিৎকার করে করে বলছিলো ওকে আমি আজ মেরেই ফেলবো।ওকে আমি নিজের হাতে খুন করবো।
জামিলার এমন অদ্ভুত আচরণের কথা শুনে জারিফ চৌধুরী থানার ওসিকে বললো, স্যার আমি কি একটু ওনার সাথে কথা বলতে পারি?
“হ্যাঁ পারেন।কিন্তু পাঁচ মিনিটের বেশি নয়।আর অবশ্যই একাই যাবেন।
” ঠিক আছে।এই বলে জারিফ চৌধুরীকে জামিলার সাথে দেখা করানোর একজন কন্সটেবল সাথে করে নিয়ে গেলো।
জামিলা জারিফ চৌধুরী কে দেখে এগিয়ে এলো।কিন্তু কোনো কথা বললো না।
জারিফ চৌধুরী তখন নিজেই বললো, জামিলা তুমি কেনো এরকম করলে?কেনো সেলিনাকে মারতে চেয়েছো?
জামিলা কোনো উত্তর দিলো না।সে আগের মতোই চুপচাপ করে রইলো।
জারিফ চৌধুরী তখন বললো, আমি জানি না তোমাদের মধ্যে আসলে কি হয়েছিলো?বা কেনো তুমি এরকম একটা কাজ করলে কিন্তু তুমি তো জানোই একমাত্র সেলিনাই জানে আমাদের কুশানের বাবা মা কে?এখন সেলিনার সাথে যদি খারাপ কিছু হয় তাহলে কিভাবে খুঁজে পাবো আমরা কুশানের বাবা মাকে?
জামিলা এতোক্ষনে কথা বলে উঠলো।সে বললো,
তার আর প্রয়োজন নেই জারিফ সাহেব।আপনাদের কুশান আপনাদের কাছেই থাক।আর এখন জেনেই বা কি করবেন?আপনারা তো কুশানের আসল মায়ের বুক অনেক আগেই খালি করেছেন,এখন তিনি তার হারানো বাচ্চা নিয়ে কি করবেন?
“এভাবে বলছো কেনো জামিলা?তুমি কি তাহলে জানতে পেরেছো কিছু?”
জামিলা তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
নভেম্বরের ১৫ তারিখে আমি জমজ বাচ্চার জন্ম দিয়েছিলাম।আমার একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হয়েছিলো।কিন্তু ছেলেটাকে আমি আর পাই নি সেদিন।শুধুমাত্র মেয়ে টাকে নিয়ে বাড়ি ফিরি।
জারিফ চৌধুরী সেই কথা শুনে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
কেনো পাও নি ছেলেটাকে?কি হয়েছিলো ওর?
জামিলা তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
কোনো একজন নির্দয়া অর্থলোভী মানুষ আমার সন্তানকে বিক্রি করেছে কোনো এক বড় লোক টাকাওয়ালা মানুষের কাছে।যাদের একবারের জন্য মনে হয় নি এই কাজটা করা ঠিক হচ্ছে না।কোনো এক দুঃখী মা কষ্ট করে ১০ মাস ১০ দিন এই বাচ্চাটাকে পেটে রেখেছিলো।তাদের একবারের জন্য মনে হয় নি এই বাচ্চাটাই হয় তো একদিন এই অভাগী মায়ের একমাত্র সম্বল হতে পারতো।
জারিফ চৌধুরী জামিলার কথা শুনে হা করে তাকিয়ে রইলো। কারণ তার আর বুঝতে বাকি রইলো না কিছু।তিনি আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করলেন না।
জামিলা এবার তার চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো, আপনিই বলেন,এখন আমি কোন মুখ নিয়ে সেই ছেলের দাবি করতে যাইবো?যে ছেলেকে আমি রক্ষা করতে পারি নি তাকে কিভাবে বললো বাবা,আমি তোর সেই মা হই।
জারিফ চৌধুরী তখন বললো,আপনি আগেই কুশান কে কিছু বলেন না।ও শুনলে ভীষণ কষ্ট পাবে।এমনিতেই ছেলেটা অনেক বেশি মানসিক যন্ত্রনার মধ্যে আছে।শুধু কুশান না,আপনার কাউকেই কিছু বলার দরকার নাই।।আমি আপনাকে জেল থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবো।যখন জেল থেকে ছাড়া পাবেন তখন আপনি আপনার ছেলেকে পেয়ে যাবেন।
জারিফ চৌধুরীর চোখের কোনায় জল দেখে জামিলা বললো, খুব সহজেই তো বলে দিলেন আমার ছেলেকে আমাকে দিয়ে দেবেন।কিন্তু আমি তো আপনার মনের খবর দেখতে পাচ্ছি জারিফ সাহেব।অনেক কষ্টে আর দুঃখে কথাটা বললেন আপনি।আমি এতো টা স্বার্থপর নই জারিফ সাহেব।ওই ছেলের অধিকার নিয়ে কখনোই আমি যাবো না আপনাদের কাছে।কারণ পুরো দুনিয়ার লোক কুশানকে আপনাদের ছেলে বলেই জানে। আপনারা যেহেতু ওকে ছোটো থেকে লালনপালন করেছেন সেহেতু ও এখন আপনাদেরই সন্তান।আর আমার মতো এমন অভাগা মায়ের পরিচয় দিয়ে কুশান কে ছোটো করবেন না প্লিজ।আর হ্যাঁ,আমাকে ছাড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই।বাকি টা জীবন আমি এখানেই কাটাতে চাই।
এদিকে কন্সটেবল টি এসে বললো, স্যার আপনার সময় অনেক আগে পার হয়ে গেছে।আপনি আসুন প্লিজ এখন।
জারিফ চৌধুরী সেই কথা শুনে চলে এলো সবার মাঝে।
জারিফ কে দেখামাত্র সবাই এগিয়ে এলো।আর জিজ্ঞেস করলো , জামিলা কি কিছু বললো?কেনো তিনি এমন করলেন?
জারিফ চৌধুরী বললো, না বলে নি কিছু।
কুশান তা শুনে বললো, তাহলে তুমি এতোক্ষণ ধরে কি কথা বললে আব্বু?
“কিছু না।”
এই বলে জারিফ সাহেব শহিদুল সাহেব কে বললো, জারার এখন কি অবস্থা?ও সুস্থ আছে তো?
“হ্যাঁ আছে,তবে মায়ের কথা শুনে ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছে।”
“ওর খোঁজখবর রাখিও বন্ধু।আর আমিও মাঝেমধ্যে গিয়ে দেখে আসবো জারাকে।”
কুশান তখন জারিফ চৌধুরী কে আবার জিজ্ঞেস করলো,আব্বু জামিলা আন্টিকে বের করার একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে।ভালো একজন এডভোকেটের সাথে কথা বলো তুমি।যে করেই হোক সেলিনা বেগমের এই ঘটনাকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে হবে।তাহলেই হয় তো বেঁচে যেতে পারেন উনি।
জারিফ চৌধুরী অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো কুশানের দিকে।কারণ কুশান তো এখনো জানে না জামিলাই তার নিজের আম্মু,তবুও ছেলেটার কত দরদ জামিলার জন্য?আর যখন শুনবে এই জামিলাই তার নিজের আম্মু তখন না জানি আরো কত পাগলামি করবে?না,একে কিছুতেই জানতে দেওয়া যাবে না এখন।যা করার তাকেই করতে হবে।
জারিফ চৌধুরী তখন কুশানকে বললো, বাবা তুই এ নিয়ে এতো বেশি চিন্তা করিস না।আমি তো আছি?আমরা জামিলাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য চেষ্টা করবো।তুই বরং তোড়ার কাছে যা।ওকে খবরদার কোনো টেনশনের মধ্যে রাখবি না।ওর ভালোভাবে খেয়াল রাখিস।যা এখন চলে যা তুই।এই বলে জারিফ চৌধুরী সায়ক কে বললো,
বাবা ওকে নিয়ে যাও তুমি।
কুশান তখন বললো আব্বু, আমি এক্ষুনি যাবো না বাসায়।আমি একটু সেলিনা বেগমকে দেখতে যেতে চাই।সেলিনা বেগমের অবস্থা তো খুবই শোচনীয়।
জারিফ চৌধুরী তখন অবাক হয়ে বললো, সেলিনা বেগমকে দেখতে যাবি?কেনো?
কুশান এবার আর কোনো উত্তর দিলো না।
জারিফ চৌধুরী তখন বললো, বাবা উনি তো এখন কথা বলতে পারবে না।ওনার কাছে গিয়ে কোনো লাভ নাই।
কুশান তখন জারিফ চৌধুরীর কথা শুনে বললো,
তাহলে আব্বু আমি কিভাবে জানতে পারবো আমার আসল বাবা মা কে?আর কিভাবেই বা চিনতে পারবো আমার পরিবারকে।এই সেলিনা বেগমের কিছু হলে তো আমি কোনোদিনই খুঁজে পাবো না তাদের।
জারিফ চৌধুরী কুশানের কথা শুনে আর একটা উত্তর ও দিলো না।তিনি বুঝতে পারলেন কুশান মুখে মুখে যতই তাদের আব্বু আম্মু ডাকুক না কেনো এখন সে সত্যি তার নিজের মা বাবার জন্যই ব্যাকুল।কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তো তাকে সত্য টা বলাও যাবে না।সেজন্য জারিফ চৌধুরী বললো,
বাবা তোর যেটা ভালো মনে হয় সেটাই কর।এই বলে জারিফ চৌধুরী শহিদুল সাহেব কে নিয়ে চলে গেলেন।
অন্য দিকে কুশান সায়ককে সাথে করে নিয়ে সেলিনা বেগমকে দেখতে গেলেন হাসপাতালে।
জারিফ চৌধুরী বাসায় গিয়েই আগে সোলেমান চৌধুরীর সাথে শেয়ার করলো জামিলার ব্যাপার টা।সোলেমান চৌধুরীও সেম কথাই বললো।যে এখনি কুশানকে জানানো যাবে না জামিলাই তার আসল আম্মু।যতদিন পর্যন্ত জামিলাকে তারা জেল থেকে মুক্তি করে না আনতে পারবে ততোদিন ব্যাপার টা গোপনই রাখতে হবে।তা না হলে কুশান শুধু শুধু টেনশন করবে।
সোলেমান চৌধুরী আর জারিফ চৌধুরী দুইজন মিলে ভালো একজন উকিল ধরলেন জামিলার কেসটা সলভ করার জন্য।যে করেই হোক তাদের জামিলাকে নির্দোষ প্রমাণ করতেই হবে।
এদিকে কুশানরা হাসপাতালে গিয়ে দেখে সেলিনা বেগম মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে।মাথায় আঘাত পাওয়ায় মাথার এক পাশের রক্ত জমাট বেঁধে আছে।বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে,যদিও বেঁচে থাকে তখন সে কাউকে চিনতে পারবে না।কারণ তখন তার ব্রেন কোনো কাজ করবে না।
চলবে,#আমি_ফাইসা_গেছি(৪১)
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
বিবাহ দুটি অচেনা মানুষকে একত্রিত করে।তাদের জীবনকে একসাথে এগিয়ে নিয়ে যায়। বিবাহের পর প্রতিটি দায়িত্ব স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে ভাগ করে নেওয়া উচিত এবং সন্তানকে বড় করার ক্ষেত্রেও এই একই নিয়মই খাটে। গর্ভাবস্থায় বাবা-মা উভয়েরই সমান দায়িত্ব থাকে।এসব কিছুই সম্ভব যদি স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে ভালো বোঝাপড়া থাকে।যখন একজন স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে যথেষ্ট মিল মহব্বত আর ভালোবাসা থাকবে তখনি এই বিবাহিত সম্পর্ক টাকে একদম স্বর্গসুখের মতো মনে হবে।আর এই বিবাহিত জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছে মা বাবা হবার অনুভূতি।একজন নারী যখন গর্ভবতী হয়ে যায় তখন তার জীবনে আসে ব্যাপক পরিবর্তন।এই পরিবর্তন শারীরিক, মানসিক সবক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।সেজন্য একজন স্বামী হিসেবে আপনাকে প্রথমেই স্ত্রীর এই পরিবর্তন গুলোর সাথে খাপ খাওয়ানোর মানসিকতা তৈরি করে নিতে হবে।
কুশান ডাক্তার ম্যাডামের কথা শুনে মাথা নাড়লো।সে বেশ মনোযোগ দিয়েই শুনতে লাগলো কথাগুলো।ডাক্তার ম্যাডাম তাকে তোড়ার ভালো করে দেখভালো করার জন্য নানারকম পরামর্শ দিতে লাগলো।তবে তোড়াকে অনেক আগেই চেকাপ করিয়েছেন ডাক্তার ম্যাডাম।তোড়া সম্পূর্ণভাবে সুস্থই আছে।আসলে তোড়ার হঠাৎ করে একটু ব্লেডিং হচ্ছিলো।যার কারণে কুশান একটু ভয়ের মধ্যে পড়ে যায়। সেজন্য সে তোড়াকে সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে আসে।তোড়ার অসুস্থতার কথা শুনে ইরা,মিরা,লিরা,সোনিয়া আর কামিনী সবাই এসেছে চেম্বারে।তোড়াকে চেকাপ করার পর ডাক্তার ম্যাডাম এখন কুশানকে চেম্বারে আলাদা ভাবে ডেকে এনে কিছু উপদেশ দিচ্ছেন।
ডাক্তার ম্যাডাম বললেন, স্বামী হিসেবে আপনার কিছু করণীয় আছে।
এক,আপনার স্ত্রী যে আপনার জীবনের অসাধারণ এক প্রাপ্তি তা তাকে অনুধাবন করান।কারণ এই সময়ে একজন গর্ভবতী মায়ের শারীরিক পরিবর্তন হয়, যেমন ধীরে ধীরে তোড়ার ওজন বাড়তে থাকবে।এতে আপনার স্ত্রী হয়তো নিজের শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগতে পারেন। এ সময় আপনি তার বেশি বেশি প্রশংসা করুন। এতে করে তার আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
দুই,স্ত্রীকে চমক দিন। এ সময় নারীর মানসিক অবস্থা যখন তখন পরিবর্তিত হয়। মন খারাপ লাগা, উত্তেজিত হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক এ সময়। শুধুমাত্র আপনার ভালোবাসাই স্ত্রীর এ ধরনের পরিবর্তন সামাল দিতে পারে। স্ত্রীর জন্য উপহার নিয়ে আসতে পারেন। এ উপহার হতে পারে ফুলের তোড়া, পছন্দের কোনো কিছু এমনকি আইসক্রিমও নিয়ে আসতে পারেন।অর্থাৎ আপনার স্ত্রী যে জিনিস টা পেলে এতোদিন খুশি হতো সেই জিনিস টা বেশি বেশি করে আনুন।
৩. তোড়াকে চেকাপ করার জন্য মাসে মাসে আসবেন চেম্বারে।আর সাথে অবশ্যই আপনি আসবেন। এতে করে তোড়া অনুভব করবে, আপনি তাকে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছেন।
৪.তোড়াকে রান্নাবান্নার কাজে অবশ্যই হেল্প করবেন।
শিশুকে গর্ভে বহন করা কিন্তু খুব সহজ কাজ নয়। সুতরাং, আপনাদের দুজনের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
কুশান তখন হাসতে হাসতে বললো, ম্যাডাম আমাকে রান্নার কাজে ওকে সাহায্য করতে হবে না।কারণ এখন ওকে কেউ রান্নাঘরের আশেপাশেই যেতে দিবে না।সবাই এতো বেশি খুশি হয়েছে যে তোড়ার মা হওয়ার কথা শুনে ওকে একদম মাথায় তুলে রেখেছে।পানি পর্যন্ত ঢেলে খেতে দিচ্ছে না ওকে।একদম পুরো বেড রেস্টে আছে সে।বেড রুমেই ওর জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া হয়।
“ওয়াও!কত লাকি এই মেয়েটা।সত্যি খুব ভালো লাগলো শুনে।আসলে খুব কম ফ্যামিলিতেই এরকম মেন্টালির লোকজন দেখা যায়।আপনার স্ত্রীর মেজাজের পরিবর্তন, মানসিক লড়াই, ব্যথা ইত্যাদি থাকবে এই সময়। এই পরিবর্তনগুলি যদিও স্বাভাবিক, তবুও আপনার স্ত্রী যখন এই পরিবর্তনগুলির মধ্যে দিয়ে যাবেন ঠিক তখনি যখন সে দেখবে আপনারা সবাই ওকে সমর্থন এবং উৎসাহ দিচ্ছেন,ও কিন্তু অনেক বেশি খুশি হবে।এতে করে আপনার বাচ্চাও ভালো থাকবে।
” জ্বি ম্যাডাম।”
“আরেকটা কথা কুশান সাহেব।এই নিয়ম টা অবশ্যই ভালোভাবে পালন করবেন।আজ তোড়ার হঠাৎ করে ব্লেডিং এই কারনেই হয়েছে।
কুশান তা শুনে বললো কি জন্য ম্যাডাম?
” স্বামী স্ত্রী মিলনের সময় অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।একটু অসাবধানতার কারণে কিন্তু কোনো অঘটন ঘটতে পারে।ওকে?
কুশান ডাক্তার ম্যাডামের কথা শুনে নিচ মুখ হয়ে বললো,জ্বি ম্যাডাম।
“আর কোনো প্রবলেম হলে বিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি চলে আসবেন হাসপাতালে।
কুশান তা শুনে বললো, ম্যাডাম আমি আর ওকে আনতে চাচ্ছি না হাসপাতালে।রাস্তাঘাটের ব্যাপার,বোঝেনই তো। আপনি যদি একটু কষ্ট করে মাসে মাসে আমাদের বাসায় গিয়ে ওর চেকাপ টা করে আসতেন তাহলে অনেক বেশি খুশি হইতাম আমি।
ডাক্তার ম্যাডাম কিছুক্ষন চুপ থাকার পর বললেন, আমি অনেক বিজি মানুষ তো।এভাবে বাসায় গিয়ে চেকাপ করার সময় নেই।কিন্তু এতো করে বলছেন যখন তখন অবশ্যই চেষ্টা করবো।তাছাড়া আপনাদের ফ্যামিলির প্রতিটা সদস্যকে ভীষণ ভালো লেগেছে আমার।বাড়ির বউ কে সবাই এতো বেশি ভালোবাসে সত্যি আমি দেখি নি এমন ফ্যামিলি।আর আপনার কথা কি বলবো?সত্যি আপনার স্ত্রী একজন ভাগ্যবতী নারী,যিনি আপনার মতো একজন হাজব্যান্ড পেয়েছেন।
কুশান তা শুনে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো,ভালো হাজব্যান্ড কিনা জানি না তবে সবসময় ওর মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করি।আর ম্যাডাম আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। খুব খুশি হলাম শুনে যে আপনি আমাদের বাসায় গিয়ে ওর চেকাপ করে আসবেন।আজ তাহলে আসি ম্যাডাম।এই বলে কুশান চেম্বার থেকে বের হয়ে গেলো।
কুশান চেম্বার থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে সবাই ওকে ঘিরে ধরলো।আর জানতে চাইলো কোনো প্রবলেম হয় নি তো?তোড়া আর তোড়ার বেবি ঠিক আছে তো?
কুশান সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো, তোমরা একটু শান্ত হয়ে যাও প্লিজ।তোড়া আর বেবি সম্পূর্ণভাবেই সুস্থ আছে।দুশ্চিন্তার কোনো কারণই নাই।ওকে একদম ফুল রেস্টে থাকতে বলেছেন ডাক্তার ম্যাডাম।
কামিনী সেই কথা শুনে বললো, আলহামদুলিল্লাহ। আমি তো ভীষণ চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছিলাম বাবা।
অন্যদিকে তোড়া মুখ চোখ অন্ধকার করে বসে আছে।সে কোনো কথা বলছে না।কুশান তখন তোড়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, কি ব্যাপার ম্যাডাম?আপনি কিছু জিজ্ঞেস করছেন না যে?
তোড়া সেই কথা শুনে বললো, ডাক্তার ম্যাডাম আমাকে আগেই বলে দিয়েছে সব।সেজন্য জানতে চাইছি না।তা তুমি আমার প্রশ্নের কিছু উত্তর দাও তো এখন?
“কি প্রশ্ন?”
“বাচ্চার মা তুমি না আমি?”
“” তুমি।”
বাচ্চা আমার পেটে না তোমার পেটে?
“তোমার পেটে।”
তাহলে ডাক্তার ম্যাডাম তোমাকে আলাদা ভাবে ডেকে নিয়ে গিয়ে কি কথা বললো? আমাকে থাকতে দিলো না কেনো?
কুশান তোড়ার এমন প্রশ্ন শুনে বললো,
কারন ডাক্তার ম্যাডাম আমাকে কিছু উপদেশ দিলো।যা শুধু আমার শোনা উচিত।তোমার শোনা যাবে না সেসব কথা।
তোড়া তখন বেশ উচ্চস্বরে বললো, কেনো শোনা যাবে না?আমি শুনলে কি হতো?
কুশান তোড়ার সাথে এতো বেশি তর্ক করতে গেলো না।কারণ ডাক্তার ম্যাডাম তো বলেই দিলো এখন নাকি সেকেন্ডে সেকেন্ডে তোড়ার মুড সুইং হবে,ওর মনে কখন কি আসবে সে নিজেও বুঝতে পারবে না।এসময় মোটেও ওর সাথে তর্ক করা যাবে না।সেজন্য কুশান তোড়াকে বললো,
বাসায় গিয়ে বলবো।এখন বাসায় যেতে হবে।
কামিনী তখন এগিয়ে এসে বললো, কি হয়েছে বাবা?
“না আম্মু কিছু হয় নি।”তোমরা গাড়িতে গিয়ে বসো।আমি তোড়াকে নিয়ে আসছি। এই বলে কুশান ধীরে ধীরে তোড়াকে ওঠালো।আর ওর হাত ধরে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো।
তোড়া আবার হঠাৎ করেই বললো, সরি।ভুল করে তখন ওসব জিজ্ঞেস করেছিলাম।তুমি কিছু মনে করো নি তো আবার?
কুশান তোড়ার কথা শুনে মনে মনে হাসতে লাগলো।বাট বাহিরে একটু রাগ রাগ ভাবই দেখালো।
তোড়া তখন বললো তুমি কিছু বলছো না কেনো?আমি কিন্তু খারাপ কিছু মনে করি নি।শুধু একটু সন্দেহ করছিলাম।যেহেতু ডাক্তার ম্যাডাম এখনো বিয়ে করে নি,তার উপর আবার যথেষ্ট সুন্দরীও আছে।সেজন্য ওনার সাথে তোমার একান্ত আলাপ আলোচনা আমার একদম সহ্য হচ্ছিলো না।
কুশান সেই কথা শুনে বললো, কি বললে?উনি অবিবাহিত?জানতাম না তো? আবার সুন্দরীও?খেয়াল করি নি তো?নেক্সট টাইম দেখা হলে তাহলে খেয়াল করবো।
তোড়া সেই কথা শুনে থেমে গেলো।আর এক পাও এগোলো না।
” কি হলো?থেমে গেলে কেনো?”
তোড়া তখন বললো, ছাড়ো আমাকে।আমি একা একা যেতে পারবো।এতোটাও অসুস্থ না আমি যে তোমার হাত ধরে ধরে যেতে হবে।
কুশান সেই কথা শুনে বললো তোড়া!জিদ করো না।তুমি যদি এরকম জিদ করো আমাদের বাচ্চাও কিন্তু ঠিক এমনই হবে।তুমি যদি ঝগড়া করো সেও সারাক্ষণ শুধু ঝগড়াই করবে।তুমি কি চাও আমাদের বাচ্চা এমন হোক?
তোড়া সেই কথা শুনে মাথা নাড়লো।
কুশান তখন বললো ডাক্তার ম্যাডাম এগুলোই বলছিলেন।তুমি আজ থেকে আমার সাথে সুন্দর করে কথা বলবে।তাহলে আমাদের বাচ্চাও আমাদের সাথে সুন্দর করে কথা বলবে।বুঝেছো?
তোড়া আবার মাথা নাড়লো।
কুশান তখন আবার তোড়াকে ধরে ধরে গাড়িতে নিয়ে বসালো।আর ড্রাইভার কে বললো একদম ধীরে ধীরে সাবধানে গাড়ি চালাবেন।ড্রাইভার কুশানের কথামতো একদম সাবধানে গাড়ি চালাতে লাগলেন।
🖤
সময় কারো জন্য থেমে থাকে না।সময় তার আপন গতিতেই চলতে থাকে। কুশানের চোখের সামনে ধীরে ধীরে তার সন্তান তোড়ার গর্ভে বেড়ে উঠতে লাগলো। তার সন্তানকে নিয়ে কত পরিকল্পনা কুশানের?তোড়া হঠাৎ একদিন জিজ্ঞেস করলো,
আচ্ছা তুমি ছেলে চাও নাকি মেয়ে?
কুশানের একটাই উত্তর ছিল যে সে সুস্থ সন্তান চায়।তার কাছে ছেলে-মেয়ে কোন বিষয় না।
কুশান তার সাধ্যমতো যতটুকু সম্ভব তোড়ার যত্ন নিতে লাগলো।কি করলে পেটের সন্তান সুস্থ থাকবে? কি করলে সন্তানের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের স্বাস্থ্যও ভালো হবে? ইত্যাদি বিষয়গুলো ইউটিউব, ওয়েবসাইড থেকে জেনে নিয়েছে সে।যদিও ডাক্তার ম্যাডাম তাকে উপদেশ দিচ্ছেনই তবুও সে আলাদা ভাবে নিজেও কিছু কিছু জিনিস শিখে নিচ্ছে।কারণ তার একটাই প্রত্যাশা তার তোড়া আর সন্তান যাতে সুস্থ থাকে সবসময়।কোনো কমতি সে রাখতে চায় না।
কুশান শুনেছে পেটের মধ্যে থাকলেও বাচ্চারা নাকি বাবা-মায়ের কথা শুনতে পায়। সেজন্য সে প্রতিদিন নিয়ম করে তার বাচ্চার সাথে কথা বলে, তাকে ইসলামিক কথাবার্তা শোনায়,তাকে কোরআন তেলোয়াত করেও শোনায়।এইভাবেই কাটছে কুশানের দিন।তাছাড়া এখন সে সম্পূর্ণভাবে ফ্রি আছে।কারণ তার ফাইনাল এক্সাম শেষ হয়ে গেছে।
দিনে দিনে বাচ্চা কতটুকু হচ্ছে? কত সপ্তাহে তার ওজন কতটুকু হয়? কত কি যে কুশানের জানার চেষ্টা, একদম ব্যকুলতা অবস্থা কুশানের।
কুশান তোড়ার এই এই নয় মাসের জার্নিতে খেয়াল করেছে গর্ভবতী মায়েরা বেশ কিছু প্রতিকুলোতার সঙ্গে লড়াই করে প্রতিটা ছেলেকে বাবা হওয়ার আনন্দ দেয়।এইভাবে ধীরে ধীরে কুশানের সন্তান বড় হচ্ছে।কুশান তোড়ার পেটের মধ্যে বাচ্চার নড়াচড়া অনুভব করতে লাগলো।সে তোড়ার পেটের উপর হাত দিয়ে, কান পেতে তার সন্তানের হৃদয় স্পন্দন অনুভব করেতে লাগলো।
গর্ভবতী মেয়েরা এসময়টাতে তাদের সকল আপনজন কে কাছে দেখলে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়।যার কারণে কুশান তোড়ার পুরো ফ্যামিলিকে তাদের বাসায় নিয়ে এসেছে।কুশানের এমন পাগলামি দেখে তোড়ার চাচী তো হাসতে হাসতে বলেই দিলো,
মনে হচ্ছে এই দুনিয়ায় কুশানই প্রথম বাবা হচ্ছে,আর কেউ মনে হয় বাবা হয় নি।এতো বেশি পাগলামি কেনো করছো বাবা?এবার একটু থামো।
কুশান তখন নিজেও হাসতে হাসতে বলে,চাচী আম্মা,আমার মনের অনুভূতি আপনি বুঝবেন না।আমি কি পরিমান খুশি হয়েছি যে এখন তোড়াকে আমি কোথায় রাখবো ভেবে পাচ্ছি না।ওর যাতে বিন্দু পরিমান ক্ষতি না হয় সেই ব্যবস্থায় করছি।
🖤
আজ অনেক দিন পর তোড়া আবার বাড়ির বাহির হচ্ছে।কারণ আজ তোড়ার আল্ট্রাসোনোগ্রাফী করা হবে।তোড়া তো উত্তেজিত হয়ে আছেই তার সাথে পুরো বাসার লোকজন আজ ভীষণ উত্তেজিত। কেউ বলছে ছেলে হবে কেউ বলছে মেয়ে।
তোড়া সবার এমন পাগলামি দেখে শুধু হাসছে।অন্যদিকে কুশান শুধু মনে মনে বলছে আল্লাহ!যাই দাও,শুধু সুস্থ সবল বাচ্চা দাও আমাকে।
তবে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করার পর ডাক্তার ম্যাডাম ঠিকঠাক বলতে পারলেন না সন্তান কি হবে! কারণ বাচ্চা নাকি পেটের ভিতর উলটে আছে।বাচ্চার পজিশন ভালো না।
সব পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে ডাক্তার ম্যাডাম সামনের সপ্তাহের ১০,১১,১২ তিনটা তারিখ দিলেন।আর বললেন,এর মধ্যে যেকোন একদিন বাচ্চা হবে।
শেষ মুহুর্তে তোড়ার নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছে।পা একদম ফুলে গেছে তার।কুশান ধরে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়।একা একা হাঁটতে পারে না।রাতে ঘুমাতে কষ্ট হয়।এপাশ ওপাশ হতে পারে না।কুশান ধরে ধরে এপাশ ওপাশ করে।তোড়ার সাথে সাথে কুশানকেও রাত জাগতে হয়।
তোড়ার ওজন একদম বেড়ে গেছে।চিকনি তোড়া ফুলে একদম গুলুমুলু হয়ে গেছে।তোড়া তো ওর এরকম গুলুমুলু চেহারা দেখে নিজেই ভয় পেয়ে যায়।সে মাঝেমধ্যে কুশানকে বলে এই আমি এমন হয়ে যাচ্ছি কেনো?আমার চেহারা এমন কেনো?এতো বাজে কেনো লাগছে আমাকে?
কুশান তখন বলে,এখনি তো সুন্দর লাগছে বেশি।আগে গায়ে তো কোনো মাংসই ছিলো না।এখন দেখো তো কত সুন্দর হয়েছো।এই বলে সে তোড়াকে আদর করে দেয় একটু।
তোড়া যদিও বুঝতে পারে এটা শুধুমাত্র শান্ত্বনা তবুও কুশানের মুখের প্রশংসা শুনতে সে বরাবরই ভালোবাসে।
ইদানিং তোড়ার অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস খেতে ইচ্ছে করে।হঠাৎ রাত তিনটায় উঠে সে বলতেছে, কুশান আমাকে একটু পানি আর মুড়ি ভিজিয়ে চিনি দিয়ে মাখিয়ে দেবে?
কুশান সেই কথা শুনে কিছুক্ষন হা হয়ে থাকে।এসব কি বলে সে?যে মানুষকে সে কখনোই এই খাবার খেতে দেখে নি আজ হঠাৎ করে এই খাবার তার মাথায় আসলো কি করে?
পরের দিন আবার বলতেছে কুশান কড়া করে তিন চার টা মরিচ দিয়ে একটু ভাত আর পানি মিক্সড করে মেখে নিয়ে আসবে?
কুশান তোড়ার এসব অদ্ভুত অদ্ভুত খাবার দেখে সত্যি না হেসে পারে না।কুশান তখন কামিনীর কাছে গিয়ে বললো ব্যাপার টা।কামিনী নিজেও হাসতে হাসতে শেষ হয়ে গেলো।আর বললো,
পেটে বাচ্চা থাকলে এমনি হয় বাবা।এতে ভয়ের কোনো কারণ নেই।আরো কত অদ্ভুত অদ্ভুত খাবার খেতে চায় মায়েরা।ইরা,মিরা,লিরা পেটে থাকতে তো আমি সবসময় একটা করে লেবুর পাতা কাছেই রাখতাম।আর পান্তা ভাত, খুদের ভাত,মুড়ি দিয়ে মাংসের ঝোল আরো কত কি খেতে চাইতাম।তোর বাবাও এরকম শুধু হাসতো।আর মাঝে মাঝে চিন্তার মধ্যে পড়ে যেতো।
কামিনীর কথা শুনে মুহুর্তের মধ্যে কুশানের মন টা খারাপ হয়ে গেলো।কারণ কামিনী শুধু ইরা,মিরা,লিরার নামই নিলো।তার নাম তো নিলো না।তার নিজের আম্মুও নিশ্চয় সে পেটে থাকা কালীন এরকম অদ্ভুত অদ্ভুত খাবার খাইতে চাইতো।কই আছে তার গর্ভধারিণী আম্মু?তাকে কি সে জীবনেও আর খুঁজে পাবে না?মুহুর্তের মধ্যে কুশানের চোখ টা জ্বলে টলমল হয়ে গেলো।
🖤
জারিফ চৌধুরী জামিলাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য অনেক চেষ্টা করছে।কিন্তু পারছে না।কারণ কেস টা অনেক জটিল হয়ে গেছে এখন। সেলিনা কাউকে চিনতে পারছে না আর সে কোনো কথা বলতেও পারে না।যার কারণে জামিলাকে জেল থেকে ছাড়ানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে জারিফ চৌধুরীর।তবে জারিফ চৌধুরী অনেক বেশি চেষ্টা করছে।তার ছেলের মনের এই কষ্ট টা তিনি যতদিন দূর করতে পারবেন না ততোদিন তিনি শান্তি পাবেন না।জারিফ চৌধুরী মাঝে মাঝে কুশানকে সাথে করে নিয়ে দেখা করে আসেন জামিলার সাথে।জামিলা কুশানের মুখ চোখ বুলিয়ে দোয়া করে দেয়,চুমু খায়।কুশান শুধু হা করে তাকিয়ে থাকে।কেনো জানি জামিলাকে দেখলেই তার অনেক বেশি মায়া কাজ করে।খুব ভালো লাগে তার জামিলার সাথে দেখা করতে আসলে।
অন্যদিকে জারার একটা ছেলে সন্তান হয়েছে।জারার দেখভালো জারিফ নিজেই করেছে।শ্রাবণের ছেলে হওয়ার পর থেকে সে অনেকটাই চেঞ্জ হইছে।সে এখন সারাক্ষণ ছেলে কে কোলে নিয়ে থাকে,তার সাথে কথা বলে,ছেলেকে চুমু খায়।বাহিরে আড্ডা দেওয়ার কথা তার মনেই থাকে না এখন।
একজন সন্তান আসলেই বাবা ও মার মনমানসিকতা সম্পূর্ণ চেঞ্জ করে দিতে পারে।স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যতো খারাপ সম্পর্কই থাক না কেনো যখন তাদের কোল আলো করে সন্তান আসে,সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সব অশান্তি, রাগ,অভিমান যেনো ভুলে যায় সবাই।
সন্তান হলো সৃষ্টিকর্তার অফুরন্ত নেয়ামত।সন্তান হাসলে পিতামাতা হাসে আর সন্তান কাঁদলে পিতামাতাও কাঁদে । সন্তানের মুখ দেখলে সকল পিতামাতার হৃদয়ে যেনো আনন্দের জোয়ার সৃষ্টি হয়। কারণ প্রতিটা সন্তানের মুখ পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও সুন্দর হয় । সন্তান যখন বাবা মা বলে ডাক দেয় তখন সেই বাবা মার বুকের মাঝখানে গিয়ে এক ধরনের শব্দ ধ্বনি বেজে উঠে।
চলবে,