#আসক্তি২
পর্বঃ৩৯
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
সকাল বেলা বেশ হন্তদন্ত হয়ে শান রেডি হয় হসপিটালের উদ্দেশ্যে।যেন তড়িৎগতিতে সব করতে পারলে বেঁচে যায় সে।পাখি কতো বার জিজ্ঞেসাও করেছ আজ এতো তাড়াহুড়ো কেন, কিন্তু কোন জবাব মেলে নি।বরং বারংবার পাখিকে এভোয়েড করেছে শান।যেটা পাখির নজর এড়ায় নি।কেমন যেন মন টা খারাপ হয়ে আসে।
আজ শার্টের বোতাম নিজে নিজেই লাগাচ্ছে,এমনি সময় ভেজা চুলটাও পাখিকে দিয়ে মুছিয়ে নেয় আর আজ নিজেই করে নিচ্ছে,নিজে নিজেই চিরুনী চালিয়ে চুল টা সেট করে নেয়।পাখি বার বার হাত বাড়ালে সে কাজটা নিজেই করে নিচ্ছ শান।রেডি হলে পাখি ওয়ালেট আর চশমাটা হাতে নিতেই শান সেটা আগে আগে উঠিয়ে নেয়।এবার আর নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণে রখতে পারে না পাখি।
মুখ ফুটে বলেই ফেলে,”কি হয়েছে?কেন এমন টা করছেন?”
শান তবুও নিরুত্তর ছিলো।পাখিকে পাশ কাটিয়ে নিচে চলে আসতেই পাখিও দ্রুত পিছন পিছন নিচে নেমে আসে।ডায়নিং এ সাজানো নাস্তাগুলো এগিয়ে দিতেই খেয়াল হয় শান সোজা দরজার কাছ চলে গেছে।পাখি দৌঁড়ে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়ায়।দুই হাত দুইদিকে ছড়িয়ে বলে,”সমস্যা কি?কাল রাত থেকে এভোয়েড করছেন কিসের জন্যে?”
শান ওর দিকে একবার চোরা চোখে তাকিয়ে পকেট হাতরিয়ে ফোন বের করে পাখির সামনে ধরে।পাখি বোকার মতো ফোনের দিকে তাকায়;কিছু বুঝতে পারে না।
“কী?”
শান তবুও নিরুত্তর।বাম ভ্রু টা উচিয়ে মুখে বিরক্তির ছাপ এনে পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই পাখি পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।পিঠের উপর মাথাটা ঠেকিয়ে চুপচাপ থাকে।
শান নিজের বুকের উপর রাখা পাখির হাতে মুঠি দুটো আলতো হাতে ছাড়াতেই পাখি বলে ওঠে,”কি হয়েছে?আমি কি কোন ভুল করেছি ডাক্তার সাহেব?এমন শাস্তি দিচ্ছেন!”
শান কন্ঠে গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলে,”না”
“তাহলে?”, খুব শান্তকন্ঠে ফিরতি প্রশ্ন করে পাখি।
কিন্তু তার কোন জবাব পায় না সে।শান ঝনঝনে গলায় বলে,” কাজ আছে, ছাড়ো।দেরি হয়ে যাচ্ছে”
বলেই পাখির হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যায় শান।আর তার যাওয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে পাখি।কয়েকফোটা জল গাল গড়িয়ে পরে যায়।হুশ ফিরে চোখের পানিটা মুছে নিজেকে সান্তনা দেয়, “হয়ত দরকারি কোন কাজ আছে ”
“তাই বলে এভাবে চলে গেলো?কিছু খেয়েও গেলো না?এমন তো কখনো করে না”, হাজার টা চিন্তায় বুক ভারী হয়ে আসে পাখির।শানের এই সামান্য ব্যবহারই তার সহ্য হচ্ছে না ।
” ভাবি”
পিছন থেকে রনির ডাকে সম্বিৎ ফেরে পাখির।ভালো করে চোখের পানিটা মুছে ঠোঁট এলিয়ে রনিকে বলে,”খেতে আসেন ভাইয়া ”
পাখির কথামতো রনি খেতে আসে।রনিকে ডায়নিং এ বসিয়ে পাখি ইনায়াহ্’র ঘরে চলে যায়।কিছু অঙ্ক করতে দিয়েছে সে।
“অঙ্ক শেষ মা?”, বলতে বলতে ইনায়াহ্’র ঘরে ঢোকে পাখি।
সহাস্যে ইনায়াহ্ জবাব দেয়, ” শেষষষ”
“ওকে এবার চলো নাস্তা খেয়ে তোমায় স্কুলে দিয়ে আসি, কেমন!”
“আচ্ছা”
বলেই ইনায়াহ্ পাখির হাত ধরে নিচে চলে আসে।
🌸🌸
ইনায়াহ্’কে স্কুলে দিয়ে আসার অনেকক্ষন হয়েছে।বাড়িতে এসে বুঝতে পারে রনি বাড়িতে নেই।আজ থাকারও কথা নয় রাখির সাথে ঘুরতে গেছ সে।এর মাঝে কতোবার ফোনটা চেক করেছে অথচ শানের কোন মেসেজ বা কল পায় নি সে।ভিতরে যেন কষ্টেরা দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে।
“সবাই ঠিকই বলে,বিয়ের পর নাকি ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়।তাই তো, না হলে এভাবে হঠাৎ ইগ্নোর করার মানে কী””
“বউ মা, কি রান্না করবা আজ”,
রাহেলার কথায় ভাবনার সুতো ছেড়ে পাখির।চোখের জমানো জল টা লুকিয়ে বলে,” যা ইচ্ছে রাঁধো চাচি।”
রাহেলা বুঝতে পারে পাখির মন ভালো নেই।দরজার চৌকাঠ ছেড়ে বিছনায় পাখির পাশে এসে বসে।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”কি হয়েছে মা?”
মাথায় রাখা হাতটার দিকে একবার তাকিয়ে ছলছলে চোখে রাহেলার দিকে তাকায় পাখি।পরম মমতায় রাত থেকে জমানো কষ্টগুলো গড়গড় করে বেরিয়ে আসতে চাইছে।চোখ নামিয়ে কোলের উপর রাখা বালিশের কভার ট খুঁটে চলেছে পাখি।নিঃশব্দে দুই ফোটা জল গড়িয়ে পরতেই পাখি সন্তোর্পনে মুছে নেয়।রাহেলা মুখ টা উচু করে বলে,”বলবে না কি হয়েছে?”
“চাচি উনি আমার সাথে কাল রাত থেকে কথা বলেন না।কি কারণে বলেন না তাও বলে না। আরে বাবা আমায় না বললে বুঝব কি করে আমার দোষটা কোথায়।আমার একটুও ভালো লাগছে না তার এমন ব্যবহার”, বলতে বলতে কেঁদে ফেলে পাখি
রাহেলা নিঃশব্দে হেসে বলে,” এতো সামান্য কারণে এতো কষ্ট পেও না বউ মা।শানবাবা তোমায় কতোটা ভালোবাসে তা তুমি আন্দাজও করতে পারবে না”
“ওসব কিছু না চাচি।বিয়ের পর ফুরিয়ে যাচ্ছে সব”,ঠোঁট উল্টিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলে পাখি।
🌸🌸
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায় তবুও শানের একটা কল বা মেসেজ পায় না পাখি।এমনি সময় প্রতিটা মূহূর্তে খোঁজ নেয় অথচ আজ!
রাহেলা সারাদিনে চেষ্টা করেও পাখিকে খাওয়াতে পারে নি।ঘরের দরজা লাগিয়ে গুমোট হয়ে ছিলো সারাদিন।অবাক হয় পাখি কারণ, ইনায়াহ্ও আজ একটি বারও ডাকতে এলো না।
“সবাই কেমন যেন পর পর হয়ে যাচ্ছে দিন দিন”
ভাবতেই কান্না চলে আসে পাখির।
ইদানিং খুব সামান্য কষ্টেই চোখে জল আসছে পাখির।শানের সামান্য নীরবতাও তার সহ্য হচ্ছে না।নিজেকে অসহায় লাগছে তার।নিচে ড্রয়িং রুমে শর্মিলার কন্ঠ শুনে কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করে কি বলছে! কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না পাখি।তাই অগত্যা নিচে নামতে বাধ্য হয়।সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই দেখে খান সাহেবও এসেছে আজ।মূহূর্তেই নিজের সব কষ্ট লুকিয়ে পা চালিয়ব দ্রুত নেমে আসে।
সালাম জানিয়ে বসতে দেয় তাকে।পাখি হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে ঢুকলে শর্মিলা বলে,”এতো ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই বউ মা।আমরা বাড়িরই লোক।আমাদের সাথে অতিথির মতো আচরন করো না।আমার খারাপ লাগে”
শর্মিলার কথাটায় কিছু একটা যেন ছিলো। যেটা পাখির মন খারাপের মূহূর্তটাকে আরো বিষিয়ে তোলার জন্যে যথেষ্ট।
শর্মিলার কথা শেষ হতেই শান আব্দুল্লাহ্ সহ হাতে বড় বড় দুটো বাজারের ব্যাগ সমেত বাড়িতে ঢোকে।পাখির দিকে না তাকিয়েই পাশ কেটে শর্মিলার কাছে গিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয়।লিস্ট মোতাবেক সব বাজার আছে কিনা সব দেখতে বলে।
“আম্মা,দেখো তো সব টা ঠিক আছে”
কিছুক্ষন পর শর্মিলা দেখেশুনে বলে,”হ্যা বাবু সব ঠিক আছে”
শর্মিলার সাথে কথা বলে শান আবারও পাখিকে পাশ কাটিয়ে খান সাহেবের কাছে এসে বসে।কুশল বিনিময় করে ক্ষীণ সিস বাজিয়ে উপরে নিজের ঘরে চলে যায়।শানের যাওয়া দিকে অপলক চেয়ে থাকে পাখি।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
“মা “,ক্ষীনস্বরে ডাকে পাখি।শর্মিলা জবাব না দিয়ে মাথা উচু করে পাখির দিকে তাকায়।
” আমি কিছু করব?”
“এভাবে বললে, কেউই তোমাকে কাজ করতে দিবে না মা।বাড়ির বউ রা এভাবে কাজের অনুমতি নেয় না।নিজে থেকে এসে করে”, স্বাভাবিক ভাবেই কথাগুলো বলে শর্মিলা।
অথচ কথাগুলোর ঝাঁঝে পাখির ভিতর পুড়ে যাচ্ছে যেন।নিজেকে সমান্য একটু ধাতস্ত করে বলে,” সেদিন কাজ করতে চাইলাম দিলেন না তো, তাই আজ…..”
“রাহেলা ও কি এভাবেই মুখে মুখে তর্ক করে?”
পাখির কথার মাঝেই শর্মিলা পাখিকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে।রাহেলা কিছু না বলে মাথা নিচু করে কাজ করে।
সবার আজকের ব্যবহার পাখিকে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীতে সে কতোটা অসহায়।এতোদিন পর আবারও নিজেকে এতিম লাগছে।
জলভরা চোখ নিয়ে দ্রুত রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে পাখি।ইনায়াহ্’র দিকে তাকাতেই ইনায়াহ্ মলিন মুখে ওর দিকে চেয়ে খান সাহেবের সাথে খেলায় মত্ত হয়।
“তোমার জন্যেই তো এ বাড়ির সাথে, এ বাড়ির মানুষদের সাথে আত্মার বাঁধনে বাঁধা পরলাম। আর সেই তুমিও আজ!”… আপনমনে কথাগুলো আওরিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে চলে যায় পাখি।ঘরে ঢুকেই বিছানায় নজর ফেলে বুঝতে পারে শান বাম পায়ের উপর ডান পা দিয়ে শুয়ে শুয়ে ফোনে কি যেন টাইপ করছে আর মিটমিট করে হাসছে।
পাখি অপলক চোখে সেদিকে চেয়ে থাকে।শান একবার তাকিয়ে মুখের হাসিটা বিলীন করে আবারও ফোনে ব্যস্ত হয়।
” কি এমন হলো হঠাৎ?সবাই এতো পরিবর্তন হলো কেন?কি করেছি আমি?”,ভেবেই চোখের পানিটা মুছে নেয়।
ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে বলে,”এভাবে মানব না আমি।আমাকে এভোয়েড করার কারন বলতেই হবে আজ”
শানের দিকে পা বাড়াতেই শান ফোন টা কানে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
পাখির পা থেমে যায় । আর এক মূহূর্ত দেরি না করে দৌঁড়ে ঢুকে পরে ওয়াশরুমে।শাওয়ার ছেড়ে নিচে বসে পরে।দুই হাতে হাঁটু জড়িয়ে শব্দ করে কেঁদে ফেলে।পানির শব্দের কাছে কান্নার শব্দটা খুবই ক্ষীণ শোনা যায়।তবুও শানের বুঝতে অসুবিধা হয় না পাখি কাঁদছে।
ওয়াশরুমের দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ভাবে,”খুব বেশি হচ্ছে নাতো”
পুরো এক ঘন্টা পর দরজা খুলে বাহিরে চলে আসে পাখি।শান তখনও শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছে।পাখি ভেজা শরীরে পা টিপে কাবার্ডের কাছে এসে ড্রেস বের করে নেয়।
তৎক্ষনাৎ মনে পড়ে দুদিন আগেও শান তার জামা কাপড় কাবার্ড থেকে বের করে দিতো।সেই জামা ওয়াশরুমের ভিতরে দিতে কতো খুঁনসুটি।যতোক্ষন না শানকে ভিতরে ঢুকতে দিতো ততোক্ষন জামা হাতে পেত না পাখি।
ভাবতে ভাবতে কাবার্ডের দরজা ঠাস করে লাগিয়ে আবারও ওয়াশরুমে চলে যায়।
পাখির ফোলা ফোলা লাল চোখ দুটো নজর এড়ায় না শানের।সেদিকে তাকিয়ে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় তার।বিড়বিড় করে বলে,”কেন যে এই রনির কথা শুনতে গেলাম!এভাবে কষ্ট পেতে হতো না আমার বউটাকে”
শানের ভাবনার মাঝেই পাখি শুকনা কাপড় পরে বের হয়ে আসে।ভিজা কাপড় গুলো বেলকোনিতে মেলে দিতেই বুঝতে পারে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
পাখি ঘরে ঢুকতেই শানের চোখে চোখ পড়ে যায়।শান নজর সরিয়ে বলে,”এতোক্ষন গোসল করলে কি জ্বর বাঁধানোর জন্যে?”
পাখি কোন উত্তর না দিয়ে বিছানার একপাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে।
এমনি সময় শান কখনোই তাকে এভাবে শুয়ে থাকে দিতো না।কখনো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে থাকত,কখনো কাঁধে মুখে গুঁজে দিতো নয়ত কখনো বুকে নিয়ে শুয়ে থাকত। আর আজ!
ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যায় পাখি।
ঘুম ভেঙ্গে যায় পেটের ক্ষিদেয়।আর যেন সহ্যই হচ্ছে না তার। সারাদিনে একটা দানাও পেটে পরে নি পাখির।চোখ পিটপিট করে খুলে দেখে পুরো ঘর আবছা ড্রিম লাইটের আলোতে ছেঁয়ে গেছে।ঘড়ির দিকে চোখ ফেলে দেখে ১১.৩০ বাজে।
“এতোক্ষণ ঘুমাইলাম!”
ভাবতে ভাবতেই বিছানা ছাড়ে পাখি। ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেখে শানের ফোনটা বালিশের কাছে অথচ শান নেই।চারদিকে চোখ বুলিয়ে ফোনটা দ্রুত হাতে নেয়।
“তখন উনি কেন হাসছিলো ওভাবে”
ফোনের প্যাটার্ন পাখির নামের প্রথম অক্ষর।সেটা পাখি জানে।সে অনুযায়ী লক খুলতে গিয়ে অবাক হয় পাখি। কারণ প্যাটার্ণ ভুল দেখাচ্ছে।ভিতরে কষ্টের পাহাড় গড়ে ওঠে মূহূর্তেই।সে দৃশ্য শান দরজার আড়াল থেকে দেখে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না।
বিছনায় ফোনটা ছুড়ে ধীরপায়ে নিচে নেমে আসে।এতোক্ষণে কারোরই জেগে থাকার কথা নয়।তবুও কেন যেন মনে হচ্ছে ঘরে ঘরে সবাই জেগে আছে।পাখি ড্রয়িং রুমের লাইট জ্বালাতেই অবাক হয়ে যায়।থ হয়ে চেয়ে থাকে চারিদিকে।রঙ্গ বেরঙ্গে লাইটে সাজানো পুরো ঘর।ড্রয়িংরুমের মাঝ বরাবর সুন্দর করে গাঁদা ফুলের পাপড়িতে লেখা,”শুভ জন্মদিন মনি”
হঠাৎ মনে পড়ে, “আজ তো ২৩ শে ডিসেম্বর”
আপনা-আপনি মুখে হাত চলে যায় পাখির।পা টিপে ফুলের মাঝখানে রাখা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতেই মাথার উপর রাখা ঝাড়বাতিটা শব্দ করে দুলে ওঠে।মাথা তুলে তাকায় পাখি।হাজারও ফুলের পাপড়ি ঝপঝপ করে গড়িয়ে পরে পাখির গায়ের উপর।ফুলের সুবাসে ছেঁয়ে যায় পুরো ঘর।মূহূর্তেই দেয়ালে টাঙ্গানো ঘড়িটায় ঢংঢং শব্দ করে ওঠে।
“২৪ তারিখ পরলো তবে”
“হ্যাপি বার্থ ডে মনি”, বলতে বলতে এগিয়ে আসে বাড়ির প্রতিটা সদস্য। পিছন ফিরে ঠোঁট টিপে কান্না সংবরন করার চেষ্টা করে পাখি।শর্মিলা সামনে এসেই বুকে জড়িয়ে নেয়।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,” শুভ জন্মদিন বউ মা।”
রাহেলা এসে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে, “আমাদের সকলের মধ্যমনি”
পাখি হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারে না।শর্মিলার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।অভিমানী স্বরে বলে,”ভেবেছিলাম আমায় বুঝি পর করে দিলে”
শর্মিলা হেসে বলে,”তোমায় পর করার সাধ্য কার আছে মা?এতো বড় কঠিন মানুষ বোধহয় পৃথিবীতে নেই।”
এরপর একে একে সবাই পাখিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়।রাখি আর রেহানা হককেও সবার মাঝে খুঁজে পায় পাখি।সবাই সবার মতো নানান উপহার দিচ্ছে পাখিকে।ইনায়হ্ ঘুমু ঘুমু চোখ দুটো টেনে টেনে তুলছে।সেদিকে চেয়ে হেসে ফেলে পাখি।কোলে নিয়ে গালে চুমু দিয়ে বলে,”এতো রাত জাগতে হবে না মা। তুমি ঘুমাও”
ইনায়াহ্ নাকোচ করে বলে,”না আমি তোমায় উইশ করব তো মুন সাইন”
“আচ্ছা”,
ইনায়াহ্’র কথায় হেসে ফেলে সবাই।
সবাই আছে কিন্তু কাঙ্খিত সেই মানুষটাই নেই যাকে খুঁজে চলেছে পাখির চোখ।আশপাশে চোখ বুলাতেই শর্মিলা কানে কানে বলে,” আমার ছেলেকে খুঁজছো বুঝি?”
থতমত খেয়ে পাখি বলে লজ্জায় মাথা নিচু করে।
শর্মিলা স্বগতোক্তি করে বলে,”আছে।আগে আমাদের সাথে সময় কাটাও তারপর না হয় আমার ছেলেকে খুঁজে নিও”
লজ্জায় কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে পাখির।
কেক কেটে সবার সাথে হালকা কিছু খেয়ে নেয় পাখি।অনুষ্ঠান শেষে রনি চলে যায় রাখি আর রেহানাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে।শর্মিলা চলে যায় ও বাড়িতে।রাহেলা ইনায়াহ্’কে শুয়ে দিতে চলে যায়।এতো সময়ের মাঝে একবারও শানকে খুঁজে পায় নি পাখি।সারাদিনের অভিমান খুব গাঢ় হতে থাকে।
এতো আয়োজনের মাঝেও খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে পাখির।সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। দরজায় পা রেখে সামান্য ভিড়িয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই গলার কাছে ওড়নায় টান পড়ে।আবছা আলোয় হকচকিয়ে ওঠে পাখি।শুকনো ঢোক গিলে বলে, “কে?”
একটা মৃদু হাসির শব্দ কানে ভেসে আসে পাখির।সে শব্দটা পাখির চেনা।মানুষটাকে ঠাওর করতে পেরে অভমানে চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে ।ওড়না টা রাগে হেচকা টান দিয়ে দুই কদম এগিয়ে যেতেই চুলে টান পরে।
“ঢং ছাড়েন।আমার ব্যথা লাগছে”,দাঁত কিড়মিড় করে কথাটা বলে পাখি।
তৎক্ষনাৎ পাখিকে একদম নিজের মুখোমুখি নিয়ে আসে শান।চোয়াল শক্ত করে চোখ বন্ধ করে নেয় পাখি।চুল চেপে ধরা শানের হাতটা চেপে ধরে পাখি।
কপালে গাঢ় উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে চোখ মেলে তাকায় পাখি।চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে তার।দুইহাত বুকে ঠেলে দিতেই শান আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয়।কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলে,” হ্যাপি বার্থ ডে জানপাখি”
“বা* পাখি”, বলে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দেয় ।
শান শব্দ করে হেসে পিছনে গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়।পাখি মাত্র এক ইঞ্চির দূরত্বে শানকে বুঝত পেরে আরেকটু সরতেই গলায় কোন কিছুর অস্তিত্ব টের পায়। ততোক্ষণে শানের হাত গলার পিছনে চলে যায়।গলায় হাত দিয়ে বুঝতে পারে মোটা একটা চেইন পরিয়ে দেয় শান।স্তম্ভিত হয়ে যায় পাখি।শান গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দেয়।পাখি আবারও হাতদিয়ে চেইন টা স্পর্শ করে দেখে স্বর্নের মোটা একটা চেইন।
শান ওকে টেনে এনে বিছানায় বসিয়ে একটা লাল বক্স থেকে মোটা দুটো হাতের চুড়ি বের করে মুচকি হেসে হাতে পরিয়ে দেয়।এরপর পিছনে গিয়ে চুল সরিয়ে কানের দুল দুটো খুলে নতুন গড়িয়ে আনা ঝুমকো জোড়া পরিয়ে দেয়।পাখি অবাক চোখে শানকে দেখে বার বার।এবার শান সামনে এসে বসে বলে,” শুভ জন্মদিন জান”
“লাগবে না এসবের।জুতো মেরে গুরুদান”
“ভালোবাসি তো”
“সারাদিন বিনা কারণে চোখের জল ঝড়িয়ে এতোসব আমার চাই না ডাক্তার সাহেব”, ছলছলে চোখে করূন কন্ঠে বলে ওঠে পাখি।
শান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,” তোমায় একটু সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।বিলিভ মি, তোমায় ইগ্নোর করার বুদ্ধি রনির।কিন্তু ভাবতে পারি নি তোমার এতোটা কষ্ট হবে”
পাখি কিছু না বলে সারাদিনের জমানো অভিমানটা উগড়ে দেয়। শ্রাব্য অশ্রাব্য শ’খানিক গালি দেয় শানকে।শান মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সেসব শুনে বলে,”বাহ্ তোমার মুখে এই গালি গুলো এতো মিষ্টি লাগছে কেন জান!”
পাখির রাগ আরও বেড়ে যায়।দাঁত কিড়মিড় করে শানের দিকে এগিয়ে গলায় কামড় বসিয়ে দেয়।
দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথ সহ্য করে শান।
হঠাৎ হুশ ফিরতেই পাখি সরে আসে। চেয়ে দেখে সামনের আট টা দাঁতের প্রতিচ্ছবি যেন জ্বলজ্বল করছে।অপরাধ বোধ জেগে ওঠে মনের মাঝে। হাত বাড়িয়ে জায়গা টা ছুঁতেই শান মুচকি হেসে বলে,”রাগ কমেছে?”
পাখি বিছানা ছেড়ে উঠে গহনা গুলো খুলতে খুলতে বলে,”আর কোনদিন এমন করলে আমি দূরে চলে যাবো”
“যেতে দিলে তো।”, পাখির হাত থামিয়ে দিয়ে বলে শান
পূনরায় বলে,” খুলো না। থাকুক একটু।দেখি ”
পাখির হাত থেমে যায় মূহূর্তেই।
“যেদিন হারিয়ে যাব সেদিন এভোয়েড করার কাউকেই পাবেন না ”
“কথাটা যা বলেছো আর কোন দিন বলো না। আমি বাঁচব না জান”
#আসক্তি২
পর্বঃ৪০
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
বিকেল বেলা রাহেলা সহ চায়ের আড্ডায় মগ্ন পাখি।ইনায়াহ্ পাশে বসে কিছু একটা আঁকছে।গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুক দিতেই শান হুরমুর করে বাড়িতে ঢোকে।চমকে যায় সবাই।পাখি দ্রুত কাপটা টেবিলের উপর রেখে এগিয়ে দাঁড়ায় শানের সামনে।
“কি হয়েছে আপনার?এমন দেখাচ্ছে কেন?”
শান কোন কথার জবাব না দিয়ে ঠোঁটে স্মিত হাসি বজায় রেখে পাখির দিকে চেয় থাকে।পাখি দুই বাহু ঝাঁকিয়ে বলে,”আরে বলুন না!এমন করে আছেন কেন?”
চট করে শান পাখির কোমড় জড়িয়ে কোলে তুলে নেয়।হাসতে হাসতে বলে, “পাখি আমার জন্যে আজ অনেক খুশির দিন।আমি আজ অনেক অনেক খুশি”
পাখি হকচকিয়ে ওঠে।আড়চোখে পাশে থাকা রাহেলা আর ইনায়াহ্’কে দেখে নিয়ে চাপাস্বরে শানকে কপোট রাগ দেখায়।
“কি করছেন টা কি? ছাড়ুন…. ”
পাখির কথা শেষ হতে না হতেই শান রাহেলার দিকে তাকিয়ে দেখে হা হয়ে তাকিয়ে আছে।রাহেলা মিটমিটিয়ে হেসে নজর সরিয়ে নেয়।উৎকণ্ঠিত হয়ে বলে,”তা কি এমন খুশি শানবাবা।আমাদের বুঝি বলা যায় না!”
শান বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরে চোখ মুখ কুচকে ফেলে।পাখিকে নামিয়ে দিয়ে থতমত খেয়ে বলে,”এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আসো ”
বলেই ইনায়াহ্’র পাশে গিয়ে বসে।
রাহেলা একটু ঝুঁকে স্বাভাবিকভাবেই বলে,”কি হয়েছে বাবা?এতো খুশি কেন আজ?”
পাখিকে পানির গ্লাস আনতে দেখে শান হাতার বোতাম গুলো খুলতে খুলতে বলে,”আমাদের হসপিটালের যিনি ওনার তিনি আগামি মাসে শিকাগো চলে যাচ্ছেন।মূলত তার ফুল ফ্যামিলি ওখানে চলে যাচ্ছে।আর এখানে যেহেতু কয়েকটা ব্যবসা তার। তার মাঝে হসপিটালটা অন্যতম, সেটার এম ডি হিসেবে আমায় সিলেক্ট করেছেন।”
“সত্যি বলছো!”,
শানের কথায় খুশিতে চকচক করে ওঠে রাহেলার চোখ মুখ।
পাখি ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি এলিয়ে শানের দিকে তাকায়।
“একদম সত্যি চাচি।তবে দায়িত্ব পাইলেই তো আর হয় না।সেটা সুষ্ঠুভাবে পালনও করতে হয়।পদের পাশাপাশি দায়িত্বটাও অনেক বেড়ে গেলো এবার”,বলতে বলতে পিছনে সোফায় গা এলিয়ে দেয় শান।
পাখি উঠে গিয়ে পিছনে দাঁড়ায়। দুই হাতে খুব আলতো করে মাথাটা টিপে দেয়।এতে শানের কোন প্রতিক্রিয়া না থাকায় পাখি নিজের কাজ ভালো ভাবে চালিয়ে যায়।
“চা করে দিবো;আদা দিয়ে?”,প্রশ্ন করে পাখি।
শান দুই চোখের কোণা দুটো দু আঙ্গুলে চেপে বলে, “না থাক, এখন না।পরে..”
রাহেলা ওদের দুজনকে একবার দেখে নিয়ে বলে, “দায়িত্ব ভাগ করে নেয়ার মতো মানুষ আছে তো বাবা”
শান কিছু না বলে মুচকি হেসে রাহেলার দিকে তাকায়।
“চলো আজ ঘুড়তে যাবো।আজ আর হসপিটালে যাচ্ছি না”,বলেই পাখির দিকে তাকায়।
ইনায়াহ্ খুশি হয়ে বলে ওঠে,”জানো মুন সাইন আগে আমরা কতো ঘুড়তে যেতাম।এখন আর সান সাইন নিয়ে যায় না আমাদের”
বলেই মুখে স্পষ্ট অভিমানের ছাপ ফুটিয়ে তোলে।শান একগাল হেসে ইনায়াহ্’কে জড়িয়ে নিয়ে দুই গালে শব্দ করে চুমু খেয়ে বলে,”আজ যাবো মাম্মাম।”
পাখির দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার মুন সাইনকে ঘুড়ানো হয় নি ”
পাখি ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি রেখে বলে,”চাচি তুমিও চলো না!সবাই যাই মজা হবে অনেক”
“না মা, তোমরা যাও। আমি বরং বাড়ির কাজগুলো এগিয়ে নেই”,ঠোঁট প্রসস্ত করে হেসে জবাব দেয় রাহেলা।
শান সাথে সাথে বাঁধা দিয়ে বলে,”আজ কিছু রেঁধো না চাচি।আমরা বাহিরে থেকে খাবার নিয়ে আসবো ”
আবার শান প্রশ্ন করে, “চাচি রনি কোথায়?”
“ভাইয়া তো রাখির সাথে ঘুরতে গেছে”,বলেই হেসে দেয় পাখি
“এতো ঘোরাঘুরির কি আছে বুঝি না, কদিন বাদেই তো বিয়ে”
“ওরা রোম্যান্টিক। আপনার মতো না”,কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে পাখি।
শান সরুচোখে সেদিকে তাকাতেই পাখি ফট করে উঠে দাঁড়ায়।ইনায়াহ্’কে তাগাদা দিয়ে বলে,”মা চলো আমরা রেডি হই”
🌸🌸
পার্কে এসে দেখা মেলে ইনায়াহ্’র কয়েকজন বন্ধুর।সাথে তাদের ফ্যামিলি।আর সে এসেই তাদের সাথে মিশে গেছে একদম।শান পাখির হাত টেনে পাশের নির্জন একটা বেঞ্চে বসে। পাখির হাতদুটো হাতের মুঠোয় ভরে গভীর চুমু দেয়।পাখি পরম ভরসায় মাথা এলিয়ে দেয় শানের কাঁধে।
শান সামনের পুকুরের পরিষ্কার পানিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শান্ত স্বরে বলে,”তুমি আমার জন্যে অনেক লাকি”
“কী রকম!”
শান একহাতে পাখিকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,”এই যে আম্মাকে পেলাম।আমার বাবার পাপের শহর গুড়িয়ে দিতে পারলাম।হসপিটালের এমডি’র পদ পেলাম।এসব কি চাখটিখানি কথা!”
পাখি সামান্য হেসে বলে,”এসবই আপনার প্রাপ্য”
“উুহু,তোমার মাঝে কিছু তো একটা আছে।যা সকল মন্দকে পরাস্ত করতে পারে”
“তাহলে আমার সাথে হওয়া মন্দ গুলো কেন পরাস্ত করতে পারি নি ডাক্তার সাহেব”,কাঁধ থেকে মাথাটা উঠিয়ে হতাশ কন্ঠে বলে পাখি।
শান ভ্রু কুচকে পাখির দিকে ফেরে।ভীত সন্ত্রস্ত কন্ঠে বলে,”তোমার কি মন খারাপ? ”
“নাহ,সেরকম নয়।তবে এটা প্রশ্ন আমার।আমার সাথে হওয়া মন্দগুলো কেন ঠেকাতে পারলাম না।সামনে যদি আরো কোন মন্দ থাকে সেগুলোই বা ঠেকাব কিভাব! “,শানের চোখে চোখ রেখে গড়গড় করে কথাগুলো বলে পাখি।
শান পাখির দুই গালে হাত রেখে মুখটা আঁজলা ভরে ধরে বলে,”তুমি সব মন্দকে হারিয়ে এতোদূর এসেছো।যদি তাই না হতো তাহলে তোমার বড় বাবার পরিবারের মতো ডেঞ্জারাস পরিবারে এতোগুলো বছর টিকতে পারতে না পাখি।”
“আব্বু, আম্মুর সাথে হওয়া মন্দ টা তো আটকাতে পারি নি “,
পাখি জানে এই কথাটা পুরোটাই তার নিছক আবেগ মাত্র।কারণ কেউ কখনোই কারো মৃত্যুকে আটকাতে পারে না।
শান চশমার গ্লাস ভেদ করে পাখিকে দেখে নিয়ে বলে,”তাহলে তোমায় পাইতাম কি করে!”
পাখি আর কিছু বলতে পারে না।প্রশান্তির হাসি ঠোঁটে এলিয়ে শানের বাম হাতটা জড়িয়ে কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয়।
আদুরে স্বরে বলে,”যতোক্ষণ আপনি থাকেন আমার কোন ভয় থাকে না।আপনি না থাকলে কেমন যেন খালি খালি লাগে।এখন তো আরো ব্যস্ত হয়ে পরবেন”
শান অভয় দিয়ে বলে,”আমি যদি কখনো পাশে নাও থাকি আমার ভালোবাসা সবসময় তোমার সাথে থাকবে পাখি।পরিস্থিতি যাইই আসুক আমি তো তোমায় ছাড়ছি না”
শেষ কথাটা বেশ জোড় দিয়ে বলে শান।
“আচ্ছা যদি কোনদিন আমার সাথে খুব খুব খুব মন্দ কিছু হয় তখনো কি আমায় এভাবেই ভালোবাসবেন?”,জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে শানের দিকে চেয়ে বলে পাখি।
শান ধমকে বলে,”এসব কি ধরনের কথা বার্তা পাখি? কি মন্দ কিছু হবে।আজগুবি এসব চিন্তা করে করেই শরীরের বারোটা বাজাইছো, না?”
“বলুন না প্লিইইজ”,নাকে কান্নার স্বরে পাখি জানতে চায়।
শান বুঝতে পারে এ প্রশ্নের পাখি নিয়ে তবেই খান্ত হবে।
“তোমার শেষ শ্বাসের শেষ বিন্দু পর্যন্ত তোমার সাথে থাকব আমি।কারণ তুমি আমার প্রেম না ভালোবাসাও না তুমি আমার আসক্তি।যাকে এক মূহূর্তও ছেড়ে থাকা যায় না, উহু কিছুতেই না”
পাখি চুপচাপ বসে থাকে।দুজনের দৃষ্টি এখন পুকুরের লাল শাপলা গুলোর দিকে।
হঠাৎ বাম দিক থেকে আসা বাচ্চার কান্নার আওয়াজে দুজনেই সেদিকে তাকায়।ফুটফুটে একটা সদ্য হাঁটতে পারা বাচ্চা নজরে আসে।কান্না করে চোখ ফুলিয়েছে যে।পাখি একবার শানকে দেখে বাচ্চাটার দিকে তাকায়।আশপাশ চোখ বুলিয়ে দেখে কেউ নেই।পাখি দ্রুত উঠে বাচ্চাটাকে কোলে নেয়।কোলে নিয়ে কিছুক্ষন দোলাতেই একদম চুপ হয়ে যায় বাচ্চাটা।ঠোঁট উল্টিয়ে পাখির দিকে তাকায়।
“তোমার মা কই”,বেশ আদুরে কন্ঠে বলে পাখি।
বাচ্চাটার বয়স খুব বেশি হলে তিন বছর হবে।বয়স বুঝতে পেরেই পাখি এটা সেটা জানতে চাইছে।এদিক সেদিক ঘুরে বাচ্চাটা তার মাকে খোঁজার চেষ্টা করছে।ইতোমধ্যে শান চলে আসে।বাচ্চার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গালে আলতো ছুঁতেই রাগের বলিরেখা স্পষ্ট ফুটে ওঠে বাচ্চাটার চোখে মুখে।শান পাখি দুজনেই অবাক হয়ে যায় তার প্রতিক্রিয়া দেখে।পাখির কোল থেকে হাত বাড়িয়ে শানকে মার দিতে চায় বাচ্চাটা।পাখি এগিয়ে যেতেই শান দূরে সরে যায়।এভাবে দুই একবার করতেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে বাচ্চাটা।ওদের দুজনের খুঁনসুটি বেশ উপভোগ করছে সে।
“ওর মা কই?”,আশপাশ তাকিয়ে বিড়বিড় করে শান।
পাখি বাচ্চাটার গালে আদোর করে বলে,”বুঝতে পারছি না।কিন্তু খুব কিউট না?”
“হুমমম”,মুচকি হেসে বলে শান।
একজন ভদ্র মহিলা সাথে একটি বাচ্চা সমেত এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।তার পিছনে একজন ভদ্র লোককে দেখতে পায় শান।
ওদিকে ইশারা করে বলে,”এরাই নাকি?”
পাখি শানের নিশানা অনুসরন করে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,”ঠিক বলতে পারছি না।আসুক দেখি কি বলে!”,
এর মাঝেই ঐ ভদ্র মহিলা এদিকে দৌঁড়ে ছুটে আসে।পাখির কোল থেকে বাচ্চাটাকে দ্রুত নিয়ে আদোর করে দেয়।বাচ্চাও যেন মায়ের বুকে ফিরে শান্তি খুঁজতেই ঘাড়ে মাথা এলিয়ে দেয়।দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় ইনিই মা।মায়েরা তো এমনিই হয়।
সারা মুখে চুমু খেয়ে ভদ্র মহিলা শান পাখির দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকায়।মুখটা মলিন করে পাখি শানের দিকে তাকাতেই শান ভদ্র মহিলাকে আশ্বস্ত করে বলে,”ভয় পাবেন না।বাচ্চাটা আমাদের পাশে এসে কান্না করছিলো……”
“ঠিকাছে “,শানের কথায় তড়িঘড়ি করে জবাব দেয় ভদ্র মহিলা।তার ভাব দেখে বুঝাই যাচ্ছে তিনি এখনো শান পাখিকে বিশ্বাস করতে পারেন নাই।
পিছনে আরেকটি বাচ্চা সমেত ভদ্রলোক এগিয়ে এসে শানের সাথে হাস্যোজ্বল মুখে মুসাফায়ের উদ্দেশ্যে হাত এগিয়ে দেয়।
“হ্যালো ডক্টর শান”
“হ্যালো,মিস্টার রাজীব “,ঠোঁটে সৌজন্যতার হাসি ফুটিয়ে বলে শান।
“আমার মিসেস।আর বাচ্চাও আমার”,বাচ্চা সহ মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলে রাজীব।
শান একগাল হেসে রাজীবের মিসেসের দিকে তাকায়।
“আসলে সদ্য হাঁটা শিখেছে তো বুঝতেই পারি নি কখন এদিকটায় এসেছে।বড্ডো ভয় পেয়ে গেছিলাম”,ভীত কন্ঠে বলে রাজীব।
“মিসেস রাজীব,নেক্সট টাইম একটু দেখে রাখবেন যাতে নিজের দায়িত্বহীনতার দায়ভার অন্যের উপর বর্তাতে না হয়, কেমন!,”
ভদ্র মহিলা চুপসে গিয়ে বাচ্চাকে আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয়।পাখির দিকে একবার তাকিয়ে অন্যত্র চলে যায়।
রাজীব কিছু বলতে উদ্যত হতেই শান পাখির হাত টেনে নিয়ে চলে যায়।
এরপর আরো কিছুক্ষন ইনায়াহ্’কে নিয়ে খেলাধুলা করে শান বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করে।পথে সকলের জন্যে রাতের খাবার কিনতে ভুল হয় না।
কিছুক্ষন পর বাড়িতে পৌঁছে যায় তারা।বেশ ফুরফুরে লাগছে আজ পাখির।কেমন যেন ডানা ঝাপটানো পাখির মতো লাগছে।
রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে দেখে শান ফোনে কিছু একটা করছে।পাখি তোয়ালেতে মুখটা মুছে ভেজা তোয়ালে শানের ফোনের উপর ছুড়ে মারে।
“কি হলো এইটা?”,অবাক হয়ে প্রশ্ন করে শান।
পাখি ড্রেসিং টেবিলের টুলটা টেনে বসতে বসতে বলে,”কি আর হবে!দৈনিক যা হয় তার একটু উল্টো আর কি!”
শান দ্রুত পায়ে বিছানা ছাড়তেই পাখি ফট করে উঠে দাঁড়ায়।চিরুনীটা সামনে তরবারির ন্যায় ধরে বলে,”একদম না বলছি। একদম না।কেমন লাগে হুমমম?যখন প্রতিদিন আমার দিকে ছোড়া হয়!”
শান মিছে রাগ দেখিয়ে বলে,”দাঁড়াও তোমার কেমন লাগাচ্ছি”
“একটা মার আজ গায়ে পড়লে কিন্তু আমিও আজ মারব”,
“কি বললে, স্বামীর গায়ে হাত তুলবা “,বলতে বলতে এগিয়ে আসে শান।
দুইহাত মুঠোয় ভরে পিছনে মুছড়ে ধরে। সামান্য ব্যথায় চোখ মুখ কুচকে ফেলে পাখি।
“আর বলব না, প্রমিজ প্রমিজ”
শান মিটমিট করে হাসে আর পাখির দিকে চেয়ে থাকে।পাখি আবারও বলে,”আর দুষ্টুমি করব না সত্যি”
শান একগাল হেসে হাত ছেড়ে বুকে জড়িয়ে নেয়।
“খুব ব্যথা পাইছো?”
“হুমমম, একটু ”
“আচ্ছা সরি”
শানের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে পাখি বলে, “তখনকার বাচ্চাটার কথা মনে আছে আপনার?”
“হুমমম আছে তো”
“কি কিউট না, গোলুমোলু টাইপ”
শান শব্দহীন হেসে দেয় কিছু বলে না।
পাখি মাথাটা তুলে শানের থুতনিতে কপাল ঠেকিয়ে বলে,”ইশ!আমাদের যে কবে হবে, ওমন গোলুমোলু টাইপ একটা।ওহ না না, দুইটা;টুইন হবে।ডাক্তার সাহেব আমার না টুইন বেবি খুব পছন্দ।আপনার মতো দুইটা চাই আমার।”
গড়গড় করে বলে চলেছে পাখি।বলার পরেও শানের কোন প্রতিউত্তর না পেয়ে পায়ের পাতায় ভর করে একটু উচু হয়ে বলে,”কি হয়েছে কথা বলছেন না যে!”
শান থমথমে মুখে পাখির দিকে চেয়ে থাকে।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাখিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে চলে যেতেই সবটা খেয়াল হয় পাখির। কোন কথা ছাড়াই শক্ত করে জড়িয়ে রাখে শানকে।কারো মুখে কোন কথা নেই কিছুক্ষণ।নীরবতা ভেঙ্গে পাখি ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, “আমি ভুলে গেয়েছিলাম ”
“প্রত্যেকটা মেয়েই মা নামোক ছোট্ট শব্দের গভীর অনুভূতি নিয়ে জন্ম নেয়।তোমারও তার ব্যতিক্রম নয়।আমি জানি তুমিও মা হতে চাও। কিন্তু আমি অপারগ।এইসব কারণেই কিন্তু তোমার থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি।তোমার এই একটা জিনিসের অভাব আমি কোনদিনও পূরণ করতে পারব না পাখি।সরি “,এক দমে কথা গুলো বলে শান পাখিকে সরিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে।
পাখির ভিতর ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করে। কিন্তু সে ইচ্ছে করে চায় নি ওভাবে বলতে।শানের যে এমন একটা দূর্বলতা আছে তা পাখির মাথাতেই ছিলো না।মনের ভুলে কথা গুলো বলেছে।
“আমি সত্যিই ইচ্ছে করে বলিনি ডাক্তার সাহেব।আমার মনেই ছিলো না সবকিছু”,বলতে বলতে শানের পাশে গিয়ে বসে।বিছানায় রাখা শানের হাতটা নিজের গালে ঠিকিয়ে নেয়।শান শান্ত চাহনীতে পাখির দিকে তাকায়।খুব অসহায় চোখে পাখি ক্ষমা চেয়ে বলে,”বিশ্বাস করুন”
ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি রেখে শান বলে,”আমি জানি তুমি ইচ্ছে করে বলো নি।তোমার মনেও মা হওয়ার তীব্র আকাঙ্খা আছে।আর সেই আকাঙ্খা থেকেই কথাটা বলেছো…..”
“আমি….”
“আমায় বলতে দাও।আমি কিছু মনে করি নি পাখি।বার বার সরি বলতে হবে না। হুমমম!”
পাখি আরেকটু এগিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে শানের।মাথায় হাত বুলিয়ে শান বলে,”আমরা কোনদিনও বাবা মা হতে পারব না জান।এই সত্যিটা মেনে নাও”
“এই জিনিসটা আর কখনো পূনরাবৃত্তি হবে না। কথা দিলাম”
চলবে…..
[