আসক্তি ২ পর্ব ৩৭+৩৮

#আসক্তি২
পর্বঃ৩৭
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে চোখ গরম করে আগন্তুক লোকটির দিকে তাকাতেই থমকে যায় শান।আপনাআপনি মুখ হা হয়ে আসে।বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু। ডান বাহুতে নজর ফেলে চোখ মুখ কুচকে নেয় শান।হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
“রনি!”,অবাক বিষ্ময়ে প্রশ্ন করে শান।কান্না থামিয়ে থতমত খেয়ে যায় পাখি।পিটপিট করে শানের আড়াল থেকে মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করে।

“ভাইয়া কিছু একটা করো, খুব জ্বলছে”,ব্যথায় দাঁতে দাঁত পিষে বলে রনি।শান তড়িঘড়ি করে পাখিকে সরিয়ে ছুটে যায় রনির কাছে।
আনমনে বিড়বিড় করে পাখি,”তারমানে ইনি রনি!”

শান টি-শার্টের হাত উচিয়ে দেখে চামড়া থেকে অনেকটাই ছিলে গেছে।মনে মনে আল্লাহ্’কে ধন্যবাদ দেয় শান;বেশি কিছু হয় নি ভেবে।
রনি একবার পাখির দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আগা-গোড়া দেখে নিয়ে হাত টা চেপে ধরে।

পাখি অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে শুধু।হঠাৎ শানের ডাকে সম্বিৎ ফেরে।
“পাখি, দ্রুত ফার্স্টএইড বক্সটা নিয়ে আসো কুইক”
পাখি রনির দিকে একবার দেখে নিয়ে উপর ঘরে চলে যায় ফার্স্টএইড বক্স আনতে।

“তুই এভাবে?এই সময়?আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না রনি”,হরবরিয়ে একসাথে কতোগুলো প্রশ্ন করে শান।
“আগে কিছু একটা করো ভাইয়া খুব জ্বলছে আমার।সবটা পরে বলছি “,অনুনয়ের স্বরে বলে রনি।
ইতোমধ্যে পাখি চলে আসে হাতে বক্সটা সমেত।এগিয়ে দেয় শানের দিকে।শান হাত বাড়িয়ে সেটা নিতেই পাখির মলিন মুখটার দিকে একবার তাকায়।পাখি অপরাধীর মতো নজর সরিয়ে নেয়।

“দেখি, হাত দে।”,বলেই রনির হাত টা টেনে নেয় শান।স্বগতোক্তি করে বলে,”তোর তো পুরো শরীর ভেজা কিভাবে কি করব আমি! ”
শানের কথা শেষ হতেই রনি উপরের টি-শার্ট খুলতে উদ্যত হয়।পাখি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

“পাখি একটা শুকনা তোয়ালে নিয়ে আসো”
শানের একেকটা কথায় অবাক হয় রনি।হাজার প্রশ্ন এসে মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে।কিন্তু কিছু করার নেই।আগে নিজেকে কোনমতে এই যন্ত্রনা থেকে উদ্ধার করতে হবে তারপর সমস্ত প্রশ্ন।

পাখি একটা শুকনা তোয়ালে এগিয়ে দিতেই বাঁ হাতে সেটা একপ্রকার টেনে নেয় রনি।পুরো গা কোনমতে মুছে হাতটা এগিয়ে বলে,”তাড়াতাড়ি ভাইয়া”

কিছুক্ষনের মাঝে শান ক্ষত হওয়া জায়গাটা পরিষ্কার করে মেডিসিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়।

“এবার বল, সুদূর আমেরিকা থেকে আমায় কিছু না জানিয়ে এভাবে আসার কারণ কি?”,থমথমে মুখে প্রশ্ন করে শান।
ব্যথায় টনটন করা হাতটা সোফার হাতলে রেখে রনি শানের দিকে চেয়ে থাকে।পিছনে দাঁড়ানো পাখিকে দেখে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,”আগে এটা বলো, এই ডাকাত মেয়েটা কে?”
“রনি”,কপোট রাগ দেখায় শান।
“তুমি জানো না ভাইয়া, এই মেয়ে কতোটা সিরিয়াস।ভাবা যায়!”
“আমি তো দেখছি পুরো দোষ তোর”

হা হয়ে রনি শানের দিকে তাকায়।
“আমার দোষ মানে!আমি কি করলাম?আর ঐ মেয়েটা কে যে এভাবে বলছো “,কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে রনি।
“এভাবে না জানিয়ে আসাটা উচিত হয় নি।ছুড়িটা যদি ঠিক ভাবে লাগতো বুঝতে পারছিস কি অবস্থা হতো?আর ওর এমন আচরন স্বাভাবিক নয় কি?”
“তুমি আমার পুরো কথা না শুনেই বললে সবটা আমার দোষ?”
“আপাতদৃষ্টিতে তাই তো মনে হচ্ছে।আচ্ছা বল শুনি”
“আমি আসলাম তোমায় সারপ্রাইজ দিবো বলে।জানি এই সময় তুমি বাড়িতেই থাকো।এক্সামের কারণে গত মাস থেকে তোমার সাথে ভালো করে কথা হয় না, দেখাও হয় না।তাই এভাবে আসা।এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এখানে।আকাশ খারাপ ছিলো কিন্তু গেইটে পা রাখতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। পরে দারোয়ানের ওখানে অপেক্ষা করি।ওখান থেকে দেখি পুরো বাড়ি অন্ধকার।বৃষ্টি একটু থামলে বাড়িতে ঢুকি।দরজা এমনি ভেড়ানো ছিলো।তখন ও সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিলো ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে ।আমার সাথে তর্কাতর্কি করে হঠাৎ অন্ধকারে ছুড়িটা ছোড়ে।আহহহ ভাইয়া হাত গেলো”,বলে ব্যথায় ককিয়ে ওঠে রনি

শান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে দাঁড়ানো পাখির দিকে দেখে নেয়।ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে আছে সে।
“আরো কি বলে জানো?ও নাকি এ বাড়ির বউ”,পূনরায় বলে রনি।
“হুম ভুল তো কিছু বলে নি”
“আর ইউ কিডিং ব্রো?বউ আর তোমার?হ্যাহহহ”,শানের কথাকে উড়িয়ে দেয় রনি।
“ও হচ্ছে পাখি। আমার ওয়াইফ”
“ভাইয়া মজা করো না তো।এখন ভালো লাগছে না মজা ।তুমি বিয়ে করবে এটা বিশ্বাস করতে পারব না আমি”,চাপা রাগ করে বলে রনি।
শান হাসতে হাসতে জবাব দেয়,”হুমম এটাই ফ্যাক্ট”

বলে উঠে গিয়ে পাখির সামনে দাঁড়ায়।চোখের কোণে চিকচিক করা জলের কণাটা মুছিয়ে দেয়।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তোমায় বলেছিলাম না রনির কথা?কাকার ছেলে?”
মাথা উপর নিচ করে রনির দিকে চেয়ে হ্যা বোধক উত্তর জানায় পাখি।
“এই সেই রনি।কি হতো বলোতো ছুড়িটা যদি হাত ছুঁয়ে পাশ কেটে চলে না যেত?”

পাখি মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,”আমি বুঝতে পারি নি,সরি।খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম”
বলতে বলতে ঠোঁট কাপিয়ে কেঁদে ফেলে পাখি।শান আলতো হাতে মাথাটা বুকের সাথে ধরে।

রনি দ্রুত উঠে শানের হাত টা টেনে এপাশে করে বলে,”লাইক সিরিয়াসলি! তুমি সত্যিই বিয়ে করেছো?”
“তো বলছি কি এতোক্ষন ধরে!”
অবাকের চরম সীমায় অবস্থান করছে রনির মগজ।ভাবতেও পারছে না শান বিয়ে করবে।এটাই তো স্বাভাবিক।
“যা ফ্রেশ হয়ে নে।সবটা বলছি “,বলে রনিকে তাড়া দেয় শান।রনির কাঁধের ব্যাগটা মেঝে থেকে উঠিয়ে ওকে রুমে নিয়ে যায়।

পাখি এতোক্ষনে হাফ ছেড়ে বাঁচে।বুক হাত দিয়ে বিট বোঝার চেষ্টা করে।নিজের প্রতি নিজেরই কেমন যেন খারাপ লাগা কাজ করছে।নিজের করা ভুলের জন্যে বুক কেঁপে ওঠে পাখির।
“একটুর জন্যে কি হয়ে যেত”

🌸🌸

পাখি তড়িঘড়ি করে রাতের রান্নাটা সেড়ে নেয়।ফ্রিজ থেকে বাকি তরকারিগুলো গরম করে ডায়নিং এ সাজায়।ততোক্ষনে শান রনিকে সহ নিচে নেমে আসে।
ডায়নিং এর চেয়ার টেনে বসতে বসতে শান বলে,”এবার সত্যি করে বল হঠাৎ কেন আসলি?”
“কি বলছো ভাইয়া? দেশে আসব তার কারণ লাগে?”,অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে রনি।
“আমায় নিজেকে চেনাতে আসিস না।তুই যে কারণ ছাড়া আসিস নি তা আমি জানি।এবার সত্যি সত্যি বল”
“আসলে ভাইয়া, একজনের সাথে মিট করতেই আরকি……”,মিনমিন করে বলে রনি পাখির দিকে তাকায়।
লজ্জাবোধ আর সংকোচে চোখ নিচু করে নেয় পাখি।শানের চেয়ারের কোনা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।

“এক সেকেন্ড….তোমায় কোথাও দেখেছি আমি”,পাখিকে উদ্দেশ্য করে বলে রনি।
পাখি বিব্রত হয়ে কন্ঠের স্বর খাঁদে ফেলে বলে,”আমাকে?”
“হুমম হুমম তোমাকে”
ভ্রুকুচকে শান একবার রনির দিকে আরেকবার পাখির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, “ওকে কোথায় দেখবি তুই?”
“দেখেছি তো অবশ্যই ভাইয়া। তবে মনে করতে পারছি না”,ভাবুকের মতো বলে রনি।
“হইছে আর ভাবতে হবে না। খা….তা বললি না কার সাথে মিট করতে দেশে আসলি?”,খাবারের লোকমা টা মুখে দিতে দিতে বলে শান।
রনি নজর এদিক সেদিক করে বলে,”ততেমন কেউ না। এই আরকি ফেসবুক ফ্রেন্ড”
শান মুচকি মুচকি হেসে বলে,”শেষমেশ ফেসবুক ফ্রেন্ডের টানে দেশে আসলি তবে”

থতমত খেয়ে রনি চুপ করে ভাত গুলো নাড়াচাড়া করে।

শান ওদিকে একবার তাকিয়ে বলে,”গার্লফ্রেন্ড ইস্যু”
“তেমনটাই….বাদ দাও না এসব।বলো আগে এই মিরাকল ঘটলো কি করে?আই মিন বিয়ে তাও এই ডাকাত….”

বলতে বলতে শানের দিকে তাকাতেই থেমে যায় রনি।এরপর শুরু থেকে শেষ অবধি সবটা রনিকে বলে শান।শুনে হেচকি ওঠে রনির। পাখি পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। পানিটা খেয়ে নিজেতে ফিরে আসে রনি।

🌸🌸

সকাল বেলা পাখির কাছে হন্তদন্ত হয়ে ছুট আসে রাখি।তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় পার করছে পাখি।রাখিকে হাফাতে দেখে বলে,”কি রে এভাবে হাফাচ্ছিস কিসের জন্যে।”
বলে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এগিয়ে দেয়।রাখি পানিটা খেয়ে পাখিকে ড্রয়িংরুম টেনে আনে।

“কি হইছে কি, বলবি তো?”
“আরে ঐ আমেরিকা প্রবাসী ছেলেটা বলেছিলাম না তোরে?”
“হ্যা, মনে আছে। কি যেন নাম বলেছিলি ইবনে ইবনে ”
“আরে ইবনে জুহায়ের। ওর সাথে গত একমাস থেকে শুধু ঝগড়া লাগে।সময় দেয় না। আমারও ভালো লাগছিলো না ওতো ঝগড়া ঝাটি পরে ব্রেক আপ করি।কাল রাতে বিডি সিম থেকে মেসেজ করে বলছে সে নাকি দেশে এসেছে আর আমায় বিয়ে করে তবেই ফিরবে।কি করি, কি করি আমার মাথায় কুলাচ্ছে না”
“তবে সমস্যা কি? আমি যতোদূর জানি তুইও তো ভালোবাসিস। তাহলে?”
“মা বিদেশে থাকা পছন্দ করেন না।ওর কথা মাকে বলাতে ডিরেক্ট না করেছে।আমি কি করব রে কোন উপায় দে…..”

“তুমি?এখানে?”

রাখির কথা শেষ হতেই উপর থেকে রনি চিল্লিয়ে ওঠে।পাখি রাখি দুজনেই মাথা তুলে তাকায়।রাখি হতভম্ব হয়ে বলে,”তুমি এখানে কেন?”

রনি কিছু না বলে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে আসে।পাখির মাথায় কিছুই ঢুকছে না এখন।ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
রনি নেমে এসে রাখির সামনে দাঁড়ায়। দাঁত কিড়মিড় করে বলে,”তুমি এখানে কেন? যাক এসে পড়েছ ভালোই হইছে।।আমায় আর কষ্ট করে খুঁজতে হলো না!….এবার বলো তোমার এই সব নাটকের কারণ কি?”
রাখি পিটপিট করে চোখ তুলে তাকায় রনির দিকে।ভাবতেও পারছে না তাদের প্রথম দেখাটা এভাবে হয়ে যাবে।

“কি হলো, আন্সার মি”,রেগে গিয়ে বলে রনি।
পাখি এতোক্ষন চুপ থেকে সবটা বোঝার চেষ্টা করে। এরপর রাখির হাত চেপে বলে,”ও আমার ফ্রেন্ড হয়।আপনি ওকে চেনেন?”
রাখির দিকে তাকিয়ে বলে,”রাখি তুই ওকে চিনিস?
“এইটা রনি “,রিনরিনে কন্ঠে বলে রাখি।
“হ্যা তা তো জানি ”
“এই সেই ইবনে জুহায়ের রনি”
অবাক হয়ে চেয়ে থাকে পাখি।
রনি কিছু বলতে যাবে তার আগেই শান বলে ওঠে,”এতো চিৎকার কিসের? ”
সবাই উপরের দিকে তাকায়।রনি দুই সিঁড়ি উঠে বলে,”ভাইয়া এই সেই মেয়ে। যার জন্যে দেশে আসা”
কটমটে চোখে পাখির দিকে তাকিয়ে বলে,”আর যার জন্যে তোমার ডাকাত বউয়ের ছুড়ির আঘাত সহ্য করা”

রনির কথায় চমকে যায় রাখি।হন্তদন্ত হয়ে বলে,”কিসের ছুড়ির আঘাত দেখি তো”
রনি হাতাটা উচিয়ে অসহায়ের মতো ব্যান্ডেজের দিকে ইশারা করে।রাখি হাতটা দেখে ভয়ার্ত গলায় বলে,”এতোখানি ব্যান্ডেজ?কি করে হলো?”
এরপর রনি কাল রাতের সব ঘটনা রাখিকে খুলে বলে।চাপা রাগতস্বরে বলে,”সবটা হইছে তোমার জন্য”
“আমি আসতে বলেছি তোমারে?”,পা উচিয়ে রাগি চোখে বলে রাখি।
“তা বলতে যাবা কেন? তুমি তো নতুন পাইছো না? ”
“বাজে কথা বলবা না একদম।মেরে বালিচাপা দিবো।ফালতু ছেলে”

“তোমরা থামো এবার?কি শুরু করলে দুজনে?”,হেসে দিয়ে বলে শান।
রনিকে প্রশ্ন করে,” এসবের মানে কি?”
“ভাইয়া ওর সাথে গত একবছর ধরে রিলেশনে আছি।গত মাস থেকে এক্সামের চাপে ব্যস্ত ছিলাম সসময় দিতে পারি নি বলে, বলে কিনা ব্রেকআপ!কিন্তু ও তো জানে না ওর কার পাল্লায় পরেছে”,রাখির দিকে রাগিচোখে তাকিয়ে বলে রনি।

“মিথ্যা কথা ভাইয়া।ও নিউ রিলেশনে জড়াইছে।আর সবথেকে বড় কথা খালি ঝগড়া করে আমার সাথে।তার থেকেও বড় কথা মা কিছুতেই মানছে না যে প্রবাসী কারোর সাথে আমার বিয়ের হোক”,মলিন মুখে বলে রাখি।
শান পাখির দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ঘরিয়ে রাখির দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি কি চাও সেটা বলো?এটা নিশ্চই তোমার মা জানে না যে, রনি আমার ছোট ভাই।”
“আমি কিছু জানি না ভাইয়া, মা যা বলবে তাই….”

রাখির কথায় তেড়ে আসে রনি।
“প্রেম করার সময় মনে ছিলো না, মা মানবে কিনা!”,ভেংচি কেটে কটাক্ষ করে বলে রনি।
“আহ রনি, কি বাচ্চাদের মতো করছিস?আমি কথা বলছি তো”
“তুমি কি করো করো, আমার ওকে চাই।চাই তো চাইই ব্যাস।দরকার পরলে,দরকার পরলে উঠায়ে নিয়ে যাবো”
ভরা মজলিশে এমন কথা রাখিকে বিপাকে ফেলে দেয়। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।মুচকি হাসিতে একনজর তাকায় রনির দিকে।

“আচ্ছা আমি কথা বলছি তোমার মায়ের সাথে”

বলেই শান উপরে উঠে চলে যায়।যাওয়ার আগে পাখিকে একবার রুমে ডেকে যায়।পাখি, রনি আর রাখির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে শানের পিছন পিছন চলে যায় শানের ঘরে।
“ভাবি তোমায় রাখির ফোনে দেখেছি”,সিঁড়ির দিকে চেয়ে গলা উচিয়ে বলে রি।

🌸🌸

“কাগজ টা দেখে নাও ভালো করে, ডকুমেন্ট গুলো কালেক্ট করেছি। আমার মনে হয় যা করার এখনি করা উচিত। কি বলো তুমি?”পাখির দিকে কাগজপাতি এগিয়ে বলে শান।
শানের কথার কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না পাখি।তবুও কাগজ গুলো হাতে নিয়ে একের পর এক উল্টিয়ে দেখা শুরু করে।কিছুক্ষন পর কাগজ গুলো বন্ধ করে কয়েক মূহূর্তের জন্যে চোখের পাতা বন্ধ করে নেয়।চোখ খুলে বলে,”ছিহ একটা মানুষ কতোটা নীচ হতে পারে ভাবা যায় না।আমি এসবের কি বুঝব বলেন?আপনার যা ভালো মনে হবে করবেন”

শান মুচকি হেসে পাখির দু বাহুতে হাত রাখে। টেনে এনে বিছানায় বসিয়ে গালে হাত রেখে বলে,”তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী। মানে বুঝো? মানে তুমি ডক্টর ফয়সাল আহমেদ শানের অর্ধেক অঙ্গ।আমার লাইফের যা কিছু সুন্দর সবই তোমার আগমনে।আর সেই তুমিটাকে ছাড়া কি করে কোন সিদ্ধান্ত নেই বলো তো!”
ছলছলে চোখে পাখি শানের দিকে তাকায়।

“হুমম বলো এবার, কি করব?নাকি আরো কিছুদিন উড়তে দিবো?তবে পাপের সাম্রাজ্য বেশি বড় হতে দিবো না আমি”,বলতে বলতেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে শানের।
“আপনার মন যা বলে তাই করুন।আমি জানি, আপনি বিচক্ষণ। তবে আমি সবসময়ই আপনার পাশে আছি”,শানের হাতটা দুইহাতে ধরে বলে পাখি।

পাখির দুই হাতের উল্টোপিঠে চুমু দিয়ে এগিয়ে যেতেই পাখি পিছিয়ে যায়।
“কি করছেন? ”
“কি করছি মানে?রাতে তো ভয়ে একদম সিধিয়ে ছিলে। বুকের উপর শুয়ে কখন ঘুমাইছো টেরই পাই নি।পরে দেখি ঘুমে বিভোর”
“হ্যা, তো?”
“তো মানে…. বুঝোই তো ”
“উহু একদম না। আপনাকে দেখলে কেউ বলতে পারবে না আপনি এতোটা দুষ্টু আর অসভ্য”

শব্দ করে হেসে শান জবাব দেয়,”বউয়ের কাছে বাপ্পারাজ হয়ে লাভ নাই।হতে হয় ইমরান হাসমি”
“এই না না, একদম না বলছি”,বলতে বলতেই মিলিয়ে যায় পাখির স্বর।

🌸🌸
রাখি থম মেরে তখন থেকে বসে আছে সোফায়।মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছে না যেন।রনি কতোবার কতো প্রশ্ন করেছে সে একটারও জবাব দেয় নি।রাখি বেশ ভালোভাবেই বুঝেছে তার মা এ সম্পর্ক কোনভাবেই মেনে নিবে না।আর সে তার মাকে ফেলে কোনভাবেই পালিয়ে যেতে পারবে না।

“এরকম কেন করতেছো রাখি?কেন বোঝার ট্রাই করছো না আই’ম ইন লাভ উইথ ইউ। ড্যাম ইট”,মুখটা থমথমে করে করূনস্বরে বলে রনি।হুট করে রাখির সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে হাতদুটো ধরে নেয়।
“কিছু তো বলো রাখি।দেখো শুধুমাত্র তোমার জন্যে আমি এতোদূরে এতোবছর পর চলে এসেছি ভাইয়ার কাছে।এভাবে রিফিউজ করো না আমায়।আই কান্ট বেবি, আই কান্ট লিভ উইথআউট ইউ।প্লিজ ট্রাই টু ফিল মাই ফিলিংস।ইট’স রিয়েলি হার্ট’স”,বলতে বলতে পাখির হাতদুটোয় নিজের কপাল ঠেকায় রনি।

কাঁপা কাঁপা হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে রাখি বলে,”ভাইয়া যদি মাকে রাজি করাতে পারে……”
“আমি এককালীন দেশে চলে আসব রাখি “,রাখির কথাকে সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই হরবরিয়ে বলে রনি।কেমন যেন মায়াবি একটা মুখ। এতো অনুনয় করছে রাখিকে।রনিকে উঠিয়ে পাশে বসায় রাখি।
স্মিত হেসে বলে,”আমি আবারও মাকে বোঝাব ”
“সত্যি?”
“একদম”
#আসক্তি২
পর্বঃ৩৮
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

নীরা,শহরে বহুল আলোচিত সমালোচিত একটি নাম।একদল মানুষের কাছে যে আইডল। আরেকদল মানুষের কাছে সে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ডাক্তারি পেশার পাশাপাশি প্রয়াত স্বামীর ব্যবসা, সাথে নিজের অনলাইন অফলাইন বিউটি প্রোডাক্টের ব্যবসা সে একা হাতে সামলাচ্ছে।নারীবাদীদের কাছে এ এক বিরাট মিশাল।ডাক্তারি পাশ দিয়ে পেশায় নিযুক্ত হওয়ার খুব বেশিদিন হয় নি। এরই মাঝে বেশ প্রশংসিত সে।তার একমাত্র কারণ সে হতদরিদ্রদের বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা প্রদান করে।

অনলাইন মার্কেটিং এ ও বেশ সরব নীরা।বিভিন্ন বিউটি প্রোডাক্টের ব্যবসা তার।রাজধানীর কয়েকটা বড় বড় মানসম্মত এলাকায় তার বিউটি
পার্লারও রয়েছে।এতোসব একা একা করা মোটেই চাখটিখানি কথা নয়।যা সে গত দুই বছরের ধরে সুনামের সাথে করে আসছে।অথচ কেউ জানে না তার এতোসব লোক দেখানো নামে মাত্র ব্যবসার পিছনে কতোটা ঘৃন্য কর্মকান্ড লুকায়িত আছে।
তার বিলাসবহুল জীবন যদিও সবার দৃষ্টিতে এসেছিলো তবে তার স্থায়িত্ব বেশীদিন থাকে নি।কারণ টাকার জোড়ে সে সব বদনাম ঢেকে ফেলেছে।

🌸🌸

গ্রাম থেকে ফিরেছে শর্মিলা, রাহেলা, আব্দুল্লাহ্ আর ইনায়াহ্।আরো কিছুদিন থাকার ইচ্ছে ছিলো শর্মিলার।কিন্তু শানের কথার কাছে সে পারে নি।অগত্যা চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। সদর দরজায় পা রাখতেই রনি শব্দ করে বলে ওঠে,
“বড় মা!”

আজ এতো বছর পর শর্মিলাকে এভাবে দেখে রনি নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারে নি।সে ভাবতেও পারছে না এভাবে শর্মিলার সাথে তার দেখা হবে।দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে।ছোটবেলায় নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন রনিকে।বিদেশ থেকে ফিরলেই বায়না করত শর্মিলার কাছে সে খাবে,ঘুমাবে, গোসল করবে।এক কথায় দেশে ফিরলে রনির সবটা আবদার জুড়ে ছিলো শর্মিলা।সেই মানুষ টা যখন চলে যায় তখন সে কিছুতেই এই অপবাদ টা মানতে পারে নি।অথচ না মেনেও কোন উপায় ছিলো না।এরপর হাতে গোনা কয়েকবার শুধু দেশে এসেছিলো রনি।তারপর আর এদেশের মাটিতে পা রাখে নি রনি।

মুখোমুখি বসে আছে বাড়ির সবাই।মূলত একটা আলোচনায় বসা।অপেক্ষা শুধু শানের।কারণ সে এখানে ডেকেছে। পাখি একটু হলেও আঁচ করতে পেরেছে, কি কারণে আজ বৈঠক।সবার জন্যে নাস্তা পানির ব্যবস্থা করে শানকে ডাকতে চলে যায় উপরে।

“কি ব্যপার, সবাইকে নিচে বসিয়ে এখানে কি করছেন আপনি?”,ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করে পাখি।
শান ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে পাখির দিকে তাকায়।নেমে আসা চশমা টা উপরে ঠেলিয়ে ফিরতি প্রশ্ন করে,”সবাই এসেছে?”
“হুমম, সবাই ”
“কিন্তু আসল মানুষরাই তো এলো না পাখি।”
“আসবে হয়ত।ফোন দিলাম রাখির কাছে ওর মা নাকি আসতে চাইছে না”
বিজ্ঞের ন্যায় শান জবাব দেয়,”আমি ডেকেছি আর আসবে না।দেখো ঠিকিই চলে আসবে”

নিচ থেকে ডাক পরে যায়।পাখি আর এক মূহূর্ত দেরি না করে ল্যাপটপটা সরিয়ে শানের হাত টেনে নিয়ে যায়।

মূলত আজ রাখি আর রনির বিয়ের ব্যপারেই আলোচনা করতে সকলকে উপস্থিত থাকতে বলেছে শান।কারন পরিবারের সবার উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহনকে বেশি প্রাধান্য দেয় সে।

শুরু থেকেই থম মেরে বসে আছে রেহানা হক।রনি রাখির দিকে তাকিয়ে আছে এক ধ্যানে।যেন নজর সরালেই মেয়েটা হাত ফসকে চলে যাবে।রাখি সেদিকে একবার দেখে লজ্জামিশ্রিত একটা হাসি উপহার দেয়।রনি বুকের বাঁ পাশ টা চেপে ধরে মরার ভান করে শানের কানে চাপাস্বরে বলে,”ভাই আমার অবস্থা খুব খারাপ।ব্যপারটা বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে যাও। প্লিজ ভাইয়া প্লিজ”

শান কপোট রাগ নিয়ে রনির দিকে তাকাতেই রনির মুখোভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে যায়।শটান হয়ে বসে থাকে।

এক পর্যায়ে শান, রাখি আর রনির ব্যপার টা সর্বসম্মুখে বলে। আর সবশেষে প্রস্তাব রাখে রেহানা হকের কাছে।তিনি স্বভাবসুলভ হাসিটা উপহার দিয়ে বলেন “এটা সম্ভব না ডক্টর শান।আমার একটা মাত্র মেয়ে।ওর বাবা গত হওয়ার পর খুব কষ্টে এতো সবটা আগলে ওকে নিয়ে জীবন পার করছি।আর সেই মেয়েকে সুদূর আমেরিকা আমি পাঠাতে পারব না।মাফ করবেন আপনার এই কথাটা আমি রাখতে পারব না।

গড়গড় করে কথাগুলো বলে দেয় রেহানা।রাখি ছলছলে চোখে সেদিকে তাকাতেই দুফোটা জল টুপ করে গড়িয়ে পরে হাতের উপর।রনি সেদিকে তাকিয়ে বলে,”দরকার পরলে আমি দেশে চিরস্থায়ী চলে আসব আন্টি”

সবাই থমথমে মুখে রনির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।শান কটমটে চোখে তাকাতেই রনি মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,”হ্যা, চলে আসব”

“আমি আপনার অবস্থাটা বুঝতে পেরেছি মিসেস হক।কিন্তু মেয়ে তো বিয়ে দিতেই হবে, তাই না।রনি আমার কাকাত ভাই বলে বলছি না ওদের দুজনের মাঝে বন্ডিং অনেক ভালো।সব থেকে বড় কথা ওরা একে অন্যকে খুব ভালোবাসে”,শান খুব স্বাভাবিক এবং শান্ত করে কথাগুলো বলে রেহানার দিকে তাকায়।

তার মাঝে কোন প্রকার কোন পরিবর্তন খুঁজে পায় না শান।
আবারও বলে,”আচ্ছা, ওর গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট।বিদেশ হওয়ায় আপনার যদি আপত্তি থাকে তবে সে দেশে এসে ভালো কোন জবে জয়েন করবে।”
রনি মাঝখান থেকে বলে ওঠে,”হ্যা আমিতো এটাই করব”

শান আবার ওর দিকে তাকায়।
এবার রেহানা হকের মাঝে কিছুটা পরিবর্তন দেখা দিলো।
চিন্তিত চেহারায় তিনি প্রশ্ন করেন,”ওর বাবা মায়ের কি মত?”
শান ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত করে বলে,”আমার সিদ্ধান্তই তাদের সিদ্ধান্ত।এখন আপনি বলেন, আপনি কি চান?”

শর্মিলা অনেক বুঝালো রাহেলাও কম না।রাখি আর পাখি দুজনেই গুজুরগুজুর করছে।পাখির কোলে বসা ইনায়াহ্ সবার মুখের দিকে দেখছে।রনি সবার দিকে একনজর চেয়ে মিনমিন করে বলে,”সংসদের বিল কখন পাশ হবে ভাইয়া? উফ এরা এতো ড্রামাটিক!”
“তুই একটু বেশিই বকবক করছিস না রনি?”,রনির দিকে ফিরে শটান হয়ে বসে বলে শান।
স্বগতোক্তি করে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,”তোর বিয়ের কথা আলোচনা হচ্ছে কোথায় একটু লজ্জা পাবি তা না ধেইধেই করে মাঝখানে হাত ঢুকাচ্ছিস বার বার”
সামনের দাঁত কপাটি কেলিয়ে রনি বলে,”কি যে বলো ভাইয়া। লজ্জা আর আমি!”

“ঠিকাছে ডক্টর শান আয়োজন করুন”

রেহানার কথায় শান হাফ ছেড়ে বাঁচে।নিজের উপর আসা দায়িত্ব থেকে অব্যাহত পায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”তাহলে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা যাক?”

মুচকি হেসে রেহানা জবাব দেয়,”ঠিকাছে”

চকচক করে ওঠে রনির চোখদুটো।পারে তো এখনি উরাধুরা নাচতে মন চাচ্ছে তার।ওর এমন উশখুশ করা দেখে শান সহ সবাই হেসে ওঠে।লজ্জায় মিইয়ে যায় রাখি।

🌸🌸

শান ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে সেট করে নিচ্ছে।
এমন সময় পাখি এসে বলে,”আপনার না আজ অফ ডে, কোথায় যাচ্ছেন তাহলে?”

আয়না দিয়ে ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে,”ইম্পোর্ট্যান্ট কাজ আছে একটা ”
বলতে বলতে শান কাবার্ডের কাছে এসে ড্রেস বের করে নেয়।শার্ট গায়ে খোলা বোতামে দাঁড়িয়ে থাকে।পাখি তখন এক দৃষ্টে চেয়ে আছে শানের দিকে।

“আমায় দেখা হলে এবার বোতাম গুলো লাগিয়ে দিতে পারবেন ম্যাম?”
শানের কথায় হকচকিয়ে ওঠে পাখি।সহাস্যে এগিয়ে যায় শানের দিকে।শানের মুখোমুখি দাঁড়াতেই ডানহাতে কোমড় জড়িয়ে শান কানে কানে বলে,”আপনার স্পর্শ আমার শার্টটাও পেতে চায়”

লজ্জামাখা হাসিতে পাখি বলে,”ঢং ”
“ট্রাস্ট মি”
“হইছে আর লাগবে না।”

বোতাম লাগানো হয়ে গেলে পাখি সরে আসতেই আবারও নিজের বুকের কাছে নিয়ে আসে শান।
চুলের খোপাটা খুলে দিয়ে পাখির দিকে তাকায়।ফট করে বাম গালে চুমু দেয় । আবারও পাখির মুখোমুখি দাঁড়ায়। ভ্রুকুচকে শানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওঠে পাখি।
আবারও ফট করে ডান গালে চুমু দিতেই পাখি ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়,”এতো রোম্যান্স কেন আজ?”
শান কোন জবাব না দিয়ে বলে,
“একটা জরুরী কাজে যাচ্ছি জান”
“কি কাজ?”,চিন্তিতো ভঙ্গিতে বলে পাখি।
শান ওর দুই কাঁধে হাত রেখে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,”আমার বাবার তৈরীকৃত পাপের সাম্রাজ্য বিনষ্ট করতে। যার একচ্ছত্র নারী,নীরার আওতাধীন।”

কথাটা শোনার সাথে সাথেই পাখির চোখে মুখে দূঃচিন্তারা একসাথে উড়ে আসে।কেমন মলিন দেখায় মুখটা।পাখিকে অস্বাভাবিক দেখে শান প্রশ্ন করে, “কি হলো?”
“আপনার কিছু হবে না তো! “,হতাশ কন্ঠে বলে পাখি।
শান ঠোঁটের হাসিকে প্রশমিত করে চিরুনি টা পাখির হাতে ধরিয়ে দেয়।এরপর মাথাটা এগিয়ে দেয়।
“কিচ্ছু হবে না ইন শা আল্লাহ্।কারণ আমি অপরাধ করতে নয় অপরাধের ঘাঁটি ভাঙ্গতে যাচ্ছি ”

মাথা আছড়ানো হয়ে গেলে চিরুনিটা পাখির হাত থেকে নিয়ে টেবিলের উপর রাখে।হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে বলে,”এতো চিন্তা করো না।সব প্রমান আমার কাছে আছে।আর পরশের ফ্রেন্ড আছে গোয়েন্দা বিভাগের অধীনে। উনি আশ্বস্ত করেছে আমায়।”
শানের বলা কথা গুলো পাখির মনে একটুও দাগ কাটতে পারলো না।
হঠাৎ করে বলেই ফেলল,”আমিও যাবো”
শান ঠোঁট কিঞ্চিত প্রসারিত করে ভ্রুতে ভাঁজ ফেলে বলে,”তুমি গিয়ে কি করবা?”
“জানি না। তবে ঐ থার্ডক্লাস মেয়েটাকে দেখার ইচ্ছে আমার”,বলতে বলতে চোখে মুখে রাগ ফুটে ওঠে পাখির।

“ও অনেক সুন্দর।বুঝলে!”,বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় শান।

এই একটা কথায় থমকে যায় পাখি।গলা দিয়ে যেন আর কোন কথাই বের হচ্ছে না।টলমলে চোখ জোড়ার নজর এদিক সেদিক করে চোখে জমানো পানিটা ভিতরে পাঠানোর চেষ্টা করছে।হঠাৎ করে শান এসে দুই বাহু ধরে ফেলে।
“তুমি ওর থেকেও সুন্দর।আমার জীবনের যা কিছু সুন্দর সব তোমার বদৌলতে “,বলেই পাখির কপালে ঠোঁট ঠেকিয়ে চুপ করে থাকে।
পাখি রাগে অভিমানে নিজেকে ছাড়ানোর হাজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে।
দাঁতে দাঁত পিষে বলে,”এখনো তাকে ভালোবাসেন তাই না?”
গা ঝাঁকিয়ে শব্দ করে হেসে দেয় শান।সে হাসি পাখির সারা শরীরে যেন হিংসার আগুন ধরিয়ে দেয়।

রেগে উঠে এসে টেবিলের উপর থেকে ওয়ালেট টা নিয়ে শানের হাতে ধরিয়ে দেয়,ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে চশমা টা হাতে ধরিয়ে দেয়।শান মুচকি মুচকি হেসে পাখির দিকে দেখছে।
“এসব একবারেই হাতে দিচ্ছো কেন? “,হেসে হেসে বলে শান।
টলটলে চোখে শানের দিকে না তাকিয়ে পাখি জবাব দেয়,”যাতে এসবের উছিলায় বার বার আমায় ডাকতে না পারেন”
পা বাড়িয়ে চলে আসতেই আবার বলে ওঠে,”আর হ্যা নীরা যখন নিঃশ্ব হয়ে যাবে তখন না হয় এ বাড়িতে এনে সারাদিন ওকে মুখের সামনে বসিয়ে রাখবেন।আর ঢকঢক করে ওর সৌন্দর্য গিলবেন”

পাখির কথায় শানের হাসি যেন থামছেই না আর। স্বশব্দে হেসে ওঠে।পাখির হাত টেনে আয়নার সামনে দাঁড় করায়।কিছুতেই দাঁড়াতে নারাজ পাখি।শান পিছন থেকে পেটের উপর হাতের শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে নেয়।কাঁধের চুল সরিয়ে গাঢ় চুম্বন এঁকে দেয়।তবুও পাখি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় মত্ত।পাখির এমন আচরনে শানের স্পর্শের গতি আরো বেড়ে যায়।শ্বাস ভারী হয়ে আসতেই পাখি থেমে যায়।খুব শান্ত চোখে আয়না ভেদ করে শানকে দেখে।স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,”এখনো ভালোবাসেন? অবশ্য প্রথম প্রেম বলে কথা”
পাখির কথার কোন জবাবই শান দেয় না।খানিক পরেই শান কাঁধের উপর থুতনিটা রেখে সহাস্যে জবাব দেয়,”আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।ওটা মজা করেছি।আর মজাটা না করলে বুঝতাম কি করে আমার বউ আমায় নিয়ে কতোটা পজেসিভ!”

🌸🌸

পার্লার বেশ রমরমা চলছে নীরার।লেডিস জেন্টস উভয়ের বিভিন্ন ব্রাঞ্চ খুলেছে আনাচে কানাচে।এক নামে সবাই চেনে “পারফেক্ট লুক বিউটি পার্লার”(ফেইক নাম)

ঢাকার মেইন অফিসেই আজ পুলিশের তদন্ত করার কথা।নীরা তখন চেম্বারে ব্যস্ত সময় পার করছে।হঠাৎ দায়িত্বরত কর্মীর ফোনে নীরা অবাক হয়ে যায়।কল রিসিভ করে কানে নিতেই পায়ের তলার মাটি যেন সরে যাওয়ার উপক্রম তার।খুব দ্রুত চেম্বার অফ করে মেইন অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
এক গাদা পুলিশ দেখে ভড়কে যায় নীরা।খুব চাতুরতার সাথে নিজের অনুভূতিটা লুকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি উপহার দেয়।সম্ভাষণ জানিয়ে ভিতরে নিয়ে বসায়।তাদের আগমনের কারণ জানতে চায়।
গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার সোহেল ঘুরে ঘুরে সব প্রোডাক্ট গুলো দেখছে।মুচকি হেসে বলে, “তা ম্যাম, কতোদিনের বিজনেস?”
“এএই তো দুই কিংবা আড়াই বছর হবে।অফিসার বসুন না প্লিজ”
“দুই কিংবা আড়াই বছরে এতো এতো নাম কামালেন, কিছু তো রহস্য আছেই ম্যাম। তাই না?থ্যাংকস, আমি বসতে আসি নি”

চুপসে যায় নীরার মুখ।আহত দৃষ্টিতে কর্মীদের দিকে তাকাতেই সবাই চোখ নামিয়ে নেয়।ইতোপূর্বে যতোজন অফিসারই এসেছিলেন তার আগে কোন না কোন ভাবে নীরা খোঁজ পেয়েছিলো। তখন সাবধানতা অবলম্বন করা সুবিধা হতো।আজ সোহেল কিছু না বলেই স্বশরীরে উপস্থিত হয়।
এই মূহূর্তে নীরার কি করা উচিত। কিছুই বুঝতে পারছে না সে।মাথা নুয়ে একাধারে ভেবেই চলছে সবটা।

“ফরিদ কাকা, তালা লাগাও”
হঠাৎ সোহেলের গলায় তালা লাগানোর কথা শুনেই চট করে মাথা ওঠায় নীরা।অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে বলে,”হোয়াট?এসবের মানে কী? কোন আইনী নোটিশ নেই কিচ্ছু নেই তালা লাগবেন মানে?আমার অপরাধ?

সোহেল নীরার সামনে এসে দাঁড়ায় ছোট ছোট চোখ করে বলে,”সত্যিই কি ইতোপূর্বে আইনী নোটিশ পান নি ম্যাডাম?”
থতমত খেয়ে যায় নীরা।সে তো নোটিশ পেয়েছিলো কিন্তু টাকার জোড়ে সেগুলো তো ধামাচাপাও দিয়েছে।তাহলে আজ এমন হবার কারণ!

ছোট ছোট কদমে একটা রুমের সামনে দাঁড়ায় সোহেল।গলা শুকিয়ে আসে নীরার।কি ভেবে যেন দরজায় সজোড়ে একটা লাত্থি দেয় সোহেল।কিন্তু দরজা না লাগানোর ফলে এমনিই খুলে যায়।
“আরে আরে, দরজাও ভিতর থেকে লাগানো নয়?স্ট্রেইঞ্জ!নাকি সুযোগ পান নি কোন টা?”
নীরাকে উদ্দেশ্য করে বলতে বলতে ঘরটার ভিতরে ঢোকে সোহেল।অপ্রীতিকর অবস্থায় তিনজন ছেলেমেয়েকে দেখে সোহেল।চোখ মুখ কুচকে বেরিয়ে আসে।
রাগতস্বরে বলে,”কি ভেবেছিলেন পার্লারের ব্যবসার আড়ালে নোংড়া অবৈধ ব্যবসা চালাবেন আর কেউ টেরও পাবে না, তাই না?”

নীরা জোড় করে হাসি এলিয়ে কম্পিত কন্ঠে বলে,”ভুল ভাবছেন অফিসার।ওখানে বডি ম্যাসাজ করা হয়।আআসলে এই কাজটা নতুন চালু করেছি। এএখনো উদ্বোধন করি নি।তাই আরকি…….”
“বডি ম্যাসাজ সেন্টারে সে* কর্মকান্ড পরিচালিত হয় তাই না ডক্টর নীরা?”,রাগে চিল্লিয়ে বলে সোহেল।ভয়ে কোণঠাসা হয় নীরা।কিছুই বলার জো থাকে না আর।

সোহেল আরেকজন জুনিয়র অফিসারকে একটা কাগজের কপি বের করতে বলেন।এরপর নীরার সামনে তা রাখতে বলেন।প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটা কাগজ পড়ে প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত নীরার।এদিকে সোহেল প্রত্যেকটা তাকের প্রোডাক্ট গুলো অন্যান্য সহকর্মী সহ দেখছে।কয়েকটা প্রোডাক্ট দেখেই চোখে মুখে তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটে তুলে বলে,”এতোদিন জেনে এসেছি ডাক্তাররা সততাবান মানুষ হোন।কিন্তু আপনাদের মতো ডাক্তাররা তো মানুষের জীবন নিয়ে খেলেন!”
রাগে চোয়াল শক্ত করে সোহেল আবারও বলে,”প্রত্যেকটা প্রোডাক্ট মেয়াদ উত্তীর্ণ।সবগুলোর মেয়াদই শেষ হয়ে গেছে।আর সেগুলো দিয়ে আপনি এখনো সার্ভিস দিয়েই চলেছেন?শেইম অন ইউ ডক্টর নীরা”

সোহেল পাশা থাকা জুনিয়র অফিসার আবিদকে ইশারা করে বলে,”এরেস্ট”
“হোয়াট দ্যা হেল ইজ দিজ গোয়িং….এভাবে কি করে কাউকে….”,বলতে বলতেই দুজন মহিলা পুলিশ এসে নীরার হাতে হাতকড়া পড়িয়ে দেয়।
“আরে, আরে আমার কথাটা তো শুনুন অফিসার”

নীরার কথা যেন কারোরই কানে যাচ্ছে না।
সোহেল আবার বলে,”ফরিদ কাকা পারফেক্ট লুক বিউটি পার্লারের সকল ব্রাঞ্চে তালা লাগানোর ব্যবস্থা করুন।আর সমস্ত প্রোডাক্ট নষ্ট করে দিন”

🌸🌸

মূহূর্তেই খবর ছড়িয়ে পরে চারিদিকে।সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ঘৃনা জানায় নীরাকে সাথে তার অবৈধ ব্যবসাকে।
থানায় নিয়ে আসা হলে প্রথম যে মানুষটার মুখোমুখি হয় নীরা সেটা আর কেউ নয় শান।অট্টোহাসিতে ফেটে পরে শান।রক্তচোক্ষু নিয়ে নীরা সেদিকে তাকাতেই শানের হাসির গতি বেড়ে যায়।

“ডক্টর শান, থ্যাংক ইউ সো মাচ। আপনার সহযোগীতা ছাড়া আমরা এতোদূর যেতে পারতাম না”,কৃতজ্ঞ চিত্তে বলে হাত বাড়িয়ে দেয় সোহেল।
সহাস্যে শান হাত বাড়িয়ে বলে,”এভাবে ছোট করবেন না।আসলে কিছু কাজের বিনিময়ে ধন্যবাদটা পাইলে ভালো লাগে না ”

হেসে উঠে সোহেল কফির অফার করে একজনকে পাঠায় কফি আনতে।
মুখ ঘুরিয়ে বলে,”আসলে কি বলুন তো আমাদের সমাজে ডক্টর নীরাদের মতো রাঘববোয়ালরা প্রমানের অভাবে বছরের বছর আইনের ধরাছোঁয়ার বাহিরে থেকে যায়।অনেক সময় প্রমান থাকলেও কিছুই করার থাকে না। উল্টো প্রমানকেই ভুঁয়া প্রমানিত করে ”
বলেই গা ঝাঁকিয়ে হেসে ওঠে দুজনেই।

নীরা কটমটে চোখে সেসব দেখছে আর রাগে ফুঁসছে।শান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
“এই অবস্থা আরো কয়েকবছর আগে হতো যদি জানতাম আমার জন্মদাতা কতোটা নিকৃষ্ট ছিলো।যদি জানতাম তোমরা দুজনেই কতো নোংড়া তাহলে এতোদিনে আমার হাতেই হয়ত বাবার খুনের দায়ে হাতকড়াটা পড়ত”,রাগে তর্জনী আঙ্গুল উচিয়ে বলে শান।কপালের রগগুলো দপদপ করে ভেসে উঠছে।

শানের কথার প্রতিউত্তর করার মতো কোন কথাই আজ নীরার কাছে নাই।

“কাম ডাউন, শান”,বলতে বলতে পরশ ঢুকে পরে অফিস কক্ষে।শান সেদিকে চেয়ে নিজের রাগকে সংবরন করে।পরশ কিছু কাগজ এগিয়ে দেয় সোহেলের কাছে।

“স্যার এসব একটু দেখে নিন।প্রয়াত আহমেদ ওরফে আমাদের ডক্টর নীরার লেইট হাজব্যান্ডের ইনকাম সোর্সের সকল ডকুমেন্ট ”
হাত বাড়িয়ে সে সব নেয় সোহেল।পুরো মুখটায় ঘৃনা ভরে শানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”আপনার বাবা এতোটা নোংড়া ছিলেন! নারী পাচার, খাদ্যে ভেজালের মতো নানা দূ্র্নীতির কাজে জড়িত ছিলেন”

সোহেলের কথায় মুখটা পাংশুটে হয়ে যায় শানের।কথায় আছে বাবা মায়ের কর্মের ফল সন্তানদের ভোগ করতে হয়। তাই তো বাবার মৃত্যুর পর আজ তার কর্মের জন্যে কিঞ্চিত হলেও অপমানিত হতে হচ্ছে শানকে।
পরশ সবটা বুঝতে পেরে পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বলে,”উনাকে শানের বাবা হিসেবে না সম্বোধন করে ডক্টর নীরার লেইট হাজব্যান্ড বলাই ভালো স্যার।তখন সোনায় সোহাগা আরকি!”

“তা যা বলেছেন পরশ”,বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ওঠে সোহেল।
আড়মোড়া ভেঙ্গে স্বগতোক্তি করে সোহেল বলে,” আবিদ ডক্টর নীরাকে কোর্টে না নেয়া পর্যন্ত সেলেই রাখো”

চলবে…….

ধন্যবাদ 💜]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here