আসক্তি ২ পর্ব ৩৫+৩৬

#আসক্তি২
পর্বঃ৩৫
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

সকালে মায়ের সাথে কথা বলে শান ঘরে এসে হাতের কাজগুলো শেষ করে নেয়।ল্যাপটপের খুঁটখাট ক্ষীণ শব্দটা ফাঁকা ঘরে বেশ আওয়াজ তুলছে।পাখি গোসল সেড়ে বের হয়।শানের দিকে একবার তাকিয়ে তোয়ালেতে মাথা টা মুছে নেয়।সব কাজে আজ খুব তাড়া পাখির।কারণ আজ শনিবার।স্কুল খোলা সাথে স্কুলে এক্সামেরও সময় ঘনিয়ে এসেছে।পাখির দিকে একবার তাকাতেই শান বুঝতে পারে বীষণ তাড়ার মাঝে আছে।কোলের উপর থেকে ল্যাপটপ সড়িয়ে বিছানায় রাখল।ধীরপায়ে হেয়ার ড্রায়ার হাতে নিয়ে পাখির চুল গুলো শুকাতে সাহায্য করে।

পিছন ফিরে মুচকি হেসে ওঠে পাখি।কিন্তু ব্যপার টা মন্দ লাগছে না। বরং খুবই ভালো লাগছে।হঠাৎ ডেকে ওঠে শান
“পাখি”
“হুমমম”
“জবটা ছেড়ে দাও”

অবাক হয়ে পাখি শানের দিকে ফেরে।চোখেমুখে অনেক প্রশ্ন জমলো যেন।শান বুঝতে পেরে স্বাভাবিক ভাবে আবারও পাখিকে ঘুরিয়ে দেয়।চুলে বিলি কেটে বলে,”আমি চাই তুমি মাস্টার্সে এডমিশন হও।আপাতত জব ছাড়ো।জব আর পড়াশুনা আবার সংসার সামলানো কোন অংশেই যুদ্ধের থেকে কম কিছু না।আগে পড়াশুনাটা শেষ করো।তারপর যদি ইচ্ছে হয় জব করবে, তাহলে করবে । না ইচ্ছে হলে করো না।আমার তরফ থেকে কোন প্রেসার থাকবে না।তোমার সব ডিসিশনেই আমায় পাশে পাবে”

মূহূর্তেই পাখির মুখটা কালো হয়ে যায়।কারণ সে আর চায় না পড়াশুনা করতে।সে চায় সংসার আর চাকরি টা করতে।

“আমি আর পড়ব না ডাক্তার সাহেব।আমার পড়তে ভালো লাগে না আর।কতো পড়ে আর!
আমি জবটা কন্টিনিউ করতে চাই”,অনুরোধের সুরে বলে পাখি।
শান ওকে টেনে এনে বিছানায় বাসায়।মুখোমুখি নিজেও বসে।
“লিসেন পাখি।আমার এমন কোন অভাব ধরে নি যে জবটা তোমার লাগবেই লাগবে।তাই আমি বলি আগে যোগ্যতা অর্জন করো তারপর তোমার চয়েজ তুমি কি করবে।তবে যাই করো তোমায় জব করতে দেবো না।আমি দেখেছি কয়েক রাতে তোমার মাথা যন্ত্রনা করছিলো”

পাখি আর কিছু বলতে পারে না।সত্যি কিছুদিন থেকে রাত হলে প্রচুর মাথা যন্ত্রনা করে পাখির।যদিও শানকে মুখ ফুটে কিছু বলে না।তবুও শান বুঝে যায়।

“আচ্ছা করবো না।তাহলে ম্যামকে জানিয়ে দেই”
“আমি জানিয়েছি গত পরশু”
“কিহহহহ”

🌸🌸

রান্নাঘরে সকাল থেকে এটা ওটা রাঁধছেন শর্মিলা।এতোদিন পর ছেলেকে কাছে পেয়ে দিশেহারা তিনি।কোনটা কখন রাঁধবেন সব যেন তার নখদর্পণে।

“মা, আজকেই চলে যাবেন?”

হঠাৎ পাখির কথায় মাথা তুলে তাকায় শর্মিলা।আবার কাজে মনোযোগ দিয়ে বলে, “হ্যা মা আজই যাবো।”
“আমাদের সাথে থাকুন না মা”,বেশ দরদমাখা স্বরে অনুরোধ করে পাখি।
“উুহু, ও বাড়িতে একজন বয়স্ক লোক।তাকে রেখে এভাবে থাকা উচিত হবে না”,দরজা দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে কথাটা বলে শান।পাখি কিছুক্ষন নজর ঘুরিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো
“সত্যিই তো তিনি তো ভুল কিছু বলেন নি।”

শানের কথায় শর্মিলা ভিতরে ভিতরে একটু খুশি হোন।শান মায়ের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়।
“কি রান্না করছো আম্মা?”,
“তোর পছন্দের তরকারি কুচো চিংড়ি মাছ দিয়ে লাউ ভাজি।”
“আহহহ,ভাবতেই জিহ্বে পানি চলে এসছে”
সবাই নিঃশব্দে হেসে ফেলে।কোথা থেকে ইনায়াহ্ এসে পাখির কাছে দাঁড়ায়

“একটা কথা বলবে, মা?”
“কি কথা বল না”,আশ্বস্ত করে শর্মিলা।
“আমি তোমার সন্তান হওয়ার মতো কোন যোগ্যতা রাখি না তাই না?”
খুন্তি ছেড়ে দেয় শর্মিলা।সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পরে।পাশ ফেরে শানের দিকে চেয়ে বলে,”এসব আবার কি ভাবো বাবু?”
“মনে হচ্ছে ”
“সেরকম টা নয়।এখানে তোমার কোন দোষ নেই।নিয়তি আমাদের আলাদা করেছিলো আর আজ নিয়তিই এক করেছে।এসব ভেবে মন ছোট করিস না।”,ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে শর্মিলা।
শান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সবজির জালি থেকে দুটো পাকা টমেটো হাতে নিয়ে পাখির দিকে তাকিয়ে শর্মিলাকে বলে,”আম্মা ধুয়ে দেও।জানো তো এ বাড়িতে কেউ আমার হাতের কাজ করে দেয় না”

সরুচোখে পাখি শানের দিকে তাকায়।বেশ অবাক হয় পাখি।শর্মিলা টমেটোগুলো ধুয়ে শানের হাতে দিতে দিতে বলে,”ওসব তুই না বললেও আমি জানি বউ মা তোর কতো খেয়াল রাখে”
পাখি এবার বাম ভ্রু টা উচিয়ে বুকের কাছে দুহাত গুঁজে শানের দিকে তাকায়। শান উপায়ন্তর না পেয়ে পাখিকে পাশ কাটিয়ে চলে আসে ড্রয়িং রুমে।পাখি বিড়বিড় করে বলে,”দাঁড়াও মজা দেখাই”

“মা, ও মা “,মুখ ভরে শর্মিলাকে ডাকে পাখি।পাখির ডাকে কান খাড়া করে দেয় শান।কারণ ডাকেই বুঝা যাচ্ছে ঘাপলা আছে।
“হ্যাহ, বলো”
“বলছি যে মা,আমি ইনায়াহ্ সহ আপনার সাথে যাই?মানে ওখানে কয়েকটা দিন থাকি?”
শর্মিলা সন্দিহান চোখে পাখির আগা-গোড়া দেখে নেয়।পাখি সেদিকে তোয়াক্কা না করে ন্যাকামির স্বরে আবার বলে,”আপনাদের মা ছেলের পূনর্মিলন দেখে মাকে আজ খুব মনে পড়ছে।ওখানে আপনার সাথে কয়েকদিন থাকি”

শর্মিলা আর কিছু বলতে পারে না।অনুভব করতে পারেন তার ছেলে যেভাবে বড় হয়েছে এই মেয়েটাও তো সেরকম কষ্ট করেই বড় হয়েছে।
“কিন্তু বাবু কি যেতে দেবে?”
“কেন দেবে না মা,আপনি বললে ঠিকই দেবে।আর আমরা কাল বা পরশু না হয় চলে আসব”,বলেই আড়চোখে শর্মিলার দিকে তাকায় পাখি। বোঝার চেষ্টা করে ট্রিকস টা কতোটা কাজে লাগলো।

“আচ্ছা আমি কথা বলে দেখি কি বলে ও”,বলে ড্রয়িংরুমে শানের কাছে আসে শর্মিলা।

“অসম্ভব”
চমকে ওঠে শান।চিল্লিয়ে বলে কথাটা। একবার রান্নাঘরের দিকে নজর ফেলে বুঝতে পারে পাখি চোখ ছোট ছোট করে মুচকি হাসছে। শানের মুখের অবস্থাটা দেখার মতো।
নজর সরিয়ে বলে, “আম্মা ওর কোথাও যাওয়া হবে না।সসামনে ওকে মাস্টার্সে ভর্তি হতে হবে।পপড়াশুনার চাপ”,থতমত হয়ে বলে শান
“মেয়েটা দুটোদিন থাকতে চাইছে আমার সাথে। যাক না।”
“না আম্মা।তুমি বুঝতেছ না”,চোখ মুখ কুচকে বলে শান।

পাখি দ্রুত এগিয়ে এসে শর্মিলার পাশে বসে বলে,”আমি যাবো মা।মনটা কেমন করছে আমার।কয়দিন থাকলে ভালো লাগবে”
শানের দিকে তাকাতেই শান যেন চোখ দিয়ে গিলে ফেলবে ওকে।কটমটে দৃষ্টিতে চেয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,”যাওয়া হবে না বলেছি তো ”
শর্মিলা বাঁকা হেসে বলে,”আচ্ছা তুইও চল তবে”
“যাবো না আমি, ওরে নিয়ে যাও”,ঠান্ডা কন্ঠে বলে শান উপরে চলে যায়।পাখি হেসে ফেলে শব্দ করে।শান সিঁড়ি থেকে দেখে আবার উঠে যায়

🌸🌸

সকাল বেলা রাফি ইনায়াহ্’কে স্কুলে দিয়ে আসে।রাখিকে বলে দেয় জব ছাড়ার কথা।একটু মন খারাপ করলেও পরোক্ষণে শানের সিদ্ধান্তে একমত হয় রাখিও।
শর্মিলা পাখিকে সাথে করে চলে যায় ও বাড়ি।শান মুখ গোমড়া করে হসপিটালে যায়।

এ বাড়িতে আসার ঘন্টা খানিক হয়েছে এর মাঝে একটি বারও শান কল করে নি।পাখি কল করলেও রিসিভ করে নি।কেমন যেন চাপা অভিমান জমা হয় মনে।মনকে বোঝায় আর কল দেবে না সে শানের কাছে।পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছে সে।তবুও মন ভালো লাগছে না তার।শানকে একটু মজা বুঝাতে নিজেই সে মজা হারে হারে টের পাচ্ছে যেন।

উপরের বেলকোনি ওয়ালা ছোট ঘরটায় পাখির থাকার বন্দোবস্ত করেন শর্মিলা।কতোবার নিজের সাথে রাখতে চেয়েছিলো শর্মিলা। কিন্তু পাখি থাকে নি।কারণ তার বিশ্বাস শান তাকে সারাদিন ভুলে থাকলেও ঘরে ফিরে অবশ্যই তাকে কল করবে।আর রাতে শ্বাশুরির ঘরে থাকাটা কেমন সমীচীন লাগল না তার।তাই এই ঘরেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।

“উনি কি করছে এখন?একটি বারও কি কল টা রিসিভ করা যায় না?এতো রাগ? দুপুরে খেয়েছে কিনা তাও তো জানতে পারছি না”

“বউ মা খেতে আসো”
শর্মিলার ডাকে ভাবনার সুতো ছেড়ে পাখির।মুখটা পাংশুটে করে আপন মনে বলে, “খেতেই তো ইচ্ছে করছে না”

“ভাবি, বড় মা খেতে ডাকছে।খাবেন না?”,বলতে বলতে ঘরে ঢোকে রানু।
মুখে মিছে হাসি টেনে পাখি বলে,”হ্যা খাবো।কিন্তু আমার তো এখন ইচ্ছে করছে না।”
“বড় মা আপনাকে টেনে নিয়ে যেতে বলেছে। চলুন।নয়ত আমাকেই বকবে”,হরবরিয়ে কথাগুলো বললো রানু।
“আচ্ছা, চলো”,বলে অভিমানে বিছানার উপর ফোনটা ছুড়ে ফেলে চলে যায় পাখি।

ডায়নিং টেবিলে হরেকরকমের খাবারের আয়োজন করেছে সবাই।পাখির চোখ কপালে উঠে যায়।খান সাহেব একে একে সার্ভ করছে দেখে পাখির ঠোঁটে আপনাআপনি হাসি ফুটে ওঠে।শর্মিলা চেয়ার টেনে বসতে বসতে পাখিকে ইশারা করে বসতে।চোখের ইশারায় খান সাহেবকে দেখিয়ে বলে,”এতোসব কিছু উনিই যোগাড় করেছে।আমাকে কিছুই করতে দেয় নি”
পাখি অবাক হয়ে তাকায় খান সাহেবের দিকে।মুচকি একটা হাসি উপহার দিয়ে বলে,”এ বাড়িতে যদিও এটা দ্বিতীয় বার আসা তবুও এটাই প্রথম।আর একমাত্র ছেলের বউকে ভালো মন্দ খাওয়াবো না তা কি হয়”

খান সাহেবের কথায় সবাই হেসে ওঠে।প্লেটে খাবার নিয়ে একের পর এক নাড়াচাড়া করছে পাখি।
“বউ মা, রান্না ভালো হয় নি”
চমকে পাখি মাথা তুলে তাকায়।জোড় করে হাসি টেনে বলে,”সেরকমটা নয় মা”
“তাহলে?”
“কিছু না মা”,বলে জোড় করে খাবারে মনোযোগ দেয় পাখি।
শর্মিলা বেশ বুঝতে পেরেছে শানের সাথে এখনো কথা হয় নি পাখির যার জন্যেই মন খারাপ।মুচকি হেসে খেতে খেতে বলে,”দেখি তো ছেলেটা কি করছে”

খাওয়ার ফাঁকে ফোন দেয় শানের কাছে।মাথা তুলে অধীর আগ্রহে শর্মিলার দিকে তাকিয়ে থাকে পাখি।

কিছুক্ষন কথা বলার পর শর্মিলা ফোন রেখে দেয়।পাংশুটে মুখে পাখি ভাবতে থাকে,”আমি এতোগুলো ফোন দিলাম…..!”
“বাবুর নাকি খাওয়ার মতো সময় হয় নি। একটু পরেই খেয়ে নিবে”,
পাখির এতোসব খাবার একদমই আর ভালো লাগছিলো না।কোনমতে কিছু মুখে দিয়ে দ্রুতই উঠে যায় উপরে।হতভম্ব হয়ে সেদিকে চেয়ে থাকে খান সাহেব।

শর্মিলা হেসে বলে,”ওদের দুজনের মাঝে একটু মনোমালিন্য হয়েছে।চাপ নিয়েন না।আমার বিশ্বাস বাবু আসবে এ বাড়িতে”
“আচ্ছা আচ্ছা “,বলেই আবারও খাওয়ায় মন দেয় খান সাহেব।

🌸🌸

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় তবুও শানের কোন খবর মেলে না। এদিকে ঠিকই মায়ের সাথে সারাক্ষন কথা বলেই চলেছে।পাখি বেশ বুঝতে পেরেছে এভাবে আসাটা উচিত হয় নি তার।নিজে নিজেই বিড়বিড় করে, “মাত্র কয়েকটা ঘন্টা তাকে ছেড়ে এসেছি তাতেই এতো অস্থির লাগছে কেন।মনে হচ্ছে কতো বছর তার সাথে দেখা হয় না,কথা হয় না।আমার কি এভাবে আসাটা ভুল হলো?”

শানের চিন্তায় চিন্তায় কেটে যায় পুরো সন্ধ্যা।দুপুরের পর ইনায়াহ্’ও এ বাড়ি চলে আসে।বার বার চেষ্টা করছে সবার মাঝে, সবার সাথে হাসিখুশি থাকতে কিন্তু পারে নি।শানের কথা মনে পড়েছে খুব।মনটা বিষিয়ে উঠেছে যেন।সকলের জোড়াজুড়িতে রাতের খাবারটা কোনমতে খেয়ে নিয়েছে পাখি।এরপর গোমড়া মুখে ঘরে চলে আসে।

বার বার ঘুমানোর চেষ্টা করেও কোন লাভ হচ্ছে না আজ।শানের চিন্তা আর শানের মুখটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না সে।কল করে শানের কাছে।দুই বার রিং হয়ে কেটে যায়।তৃতীয় বার কল করতেই রিসিভ করে শান।পাখির মুখের সমস্ত বুলি যেন ফুরিয়ে গেছে।
“হ্যা কিছু বলবা? “,কাটকাট কন্ঠে প্রশ্ন করে শান।
পাখি কিছু বলতে পারে না।বালিশে মুখ গুঁজে চুপ করে থাকে।
“তোমার নিঃশ্বাসের শব্দ শোনাতে কল করেছো বুঝি?”,পাখির জবাব না পেয়ে আবার বলে শান।

পাখি মাথা তুলে বিছানার উপর বসে পরে। ঠোঁট উল্টে বলে,”সারাদিন কল ধরলেন না যে? ”
“এমনিই, আমার ইচ্ছে”
পাখি আর কোন কথা খুঁজে পায় না।কেমন যেন গায়ে পড়া লাগছে তার নিজেকে।খট করে ফোন টা কেটে বালিশের কাছে রেখে দেয় সাইলেন্ট করে।

শান বাড়ি ফিরেছে অনেকক্ষন হলো।পুরো ঘরে পাখির শরীরে গন্ধ এখনো রয়ে গেছে।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওয়াশরমে চলে যায়।ফ্রেশ হয়ে ফ্রিজ খুলে খাবার গরম করে নেয়।একা একা খেতে মোটেই ইচ্ছে করছে না তার।ফোনের গ্যালারিতে নিজেদের নানা খুঁনসুটির ছবি বের করে দেখতে শুরু করে শান।খাওয়া শেষে পুরো বাড়িটা ভালো করে দেখে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম এসে জড়ো হয় চোখের পাতায়।

মাত্র কয়েক মিনিট পরেই সে ঘুম উবে যায় কর্পুরের মতো।পাশ ফিরে পাখির শোবার জায়গার দিকে তাকায় নিষ্পলক।কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগে তার।

🌸🌸

মন খারাপের কাছে ব্যর্থ হয়ে পাখি বেলকোনিতে এসে দাঁড়ায়।ছোট ছোট ফুলের টব সেখানে টাঙ্গানো।চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে পাতাগুলো।এমনি সময় এ সামান্য সৌন্দর্যটুকুই পাখির মন ভালো করার জন্যে যথেষ্ঠ ছিলো কিন্তু আজ হচ্ছে না।

সময় তখন ১ বেজে ২০ মিনিট।বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড় হয়।চাঁদের আলোয় চারপাশ পরিষ্কার বোঝা গেলেও গাড়ির মানুষ টা কে বুঝতে পারছে না পাখি। কারণ এ বাড়ির গেইটের সাথে বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটার ছায়া ঢেকে দিয়েছে মানুষটার পুরো শরীর।ভ্রুকুচকে সেদিকে তাকিয়ে থাকে পাখি।

লোকটা ফোন বের করে কাউকে কল করছে যেন।একবার কেটে যেতেই আবার কল করে। তাতেও কেটে যায়। এবার বিরক্ত হয়ে গাড়ির শেডে একটা কিল বসায়।চাঁদের আলোয় মুখের বাম পাশ বুঝতে পারে পাখি। এবার ভাবনার উদায় হয় দৌঁড়ে ঘরে গিয়ে দেখে অনেকগুলো মিসড্ কল।লক খুলে চোখ ছানাবড়া তার।
“এতোবার উনি কল করেছে”
তড়িঘড়ি করে ব্যাক করতেই চাপাস্বরে ধমকিয়ে ওঠে শান।

“কতোক্ষন ধরে কল করছি আমি।গাধি কোথাকার।ফোন কোথায় তোমার?”
পাখি কিছু বলতে পারে না।মুখে অজানা ভালো লাগায় হাসি ফুটে ওঠে।ফোন কানে নিয়েই বেলকোনিতে চলে আসে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে।

এদিকে শান হ্যালো হ্যালো করে বিরক্ত হয়ে কেটে দিয়ে আবার কল দেয়।সবটাই উপর থেকে পরোখ করে পাখি।এবার কল রিসিভ না করেই খুব সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। সদর দরজা খুলতেই ভিতর থেকে কেউ শব্দ করে
“উহুম উহুম”
চমকে তাকায় পাখি।কাচুমাচু করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।

“এতো রাতে কোথায় যাচ্ছো বউ মা?আর তুমি তো এ জায়গার কিছু চেনো না তাহলে?”
শর্মিলা সবটাই দেখেছে তার ঘরের জানালা দিয়ে।

খান সাহেব বেশ রাত অবধি জেগে জেগে বই পড়েন।আজও তার ব্যতিক্রম নয়।জানলা দিয়ে তিনি বেশ বুঝতে পারলেন গেইটের সামনে কেউ গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে।শর্মিলাকে ডেকে বলেন,”দেখো তো চেনা যায়?”
“আরে এটা তো বাবু।এতো রাতে এখানে কেন”,ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বলে শর্মিলা।গা ঝাঁকিয়ে হেসে খান সাহেব বলেন, “যাও বউ মা গেলে, দরজা লাগিয়ে এসো”

“কি হলো বউ মা কিছু বলছ না যে”,বলে মিটিমিটি হেসে ওঠে শর্মিলা।
আমতাআমতা করে পাখি বলে,”মা উনি এসেছে”
এবার আর হাসি আটকে রাখতে পারে না শর্মিলা।হেসে কুটিকুটি হয়ে কাছে এসে বলে,”এরকম আর কখনো করবে না।আমার ছেলেকে ছেড়ে কোনদিন কোথাও যাবে না।”
মাথায় গাট্টা মেরে বলে,”নিজেও থাকতে পারো না আর আমার ছেলেটাও তো পারে না দেখছি।যাও আমি কাল বা পরশু ইনায়াহ্’কে নিয়ে যাবো”

পাখি মাথা তুলে লজ্জা পেয়ে বলে, “আসি মা”
“পাগলি ”

🌸🌸

গাড়িতে বসে আছে পাখি।শান কোন কথা ছাড়াই ড্রাইভ করে চলছে।বাড়ি পৌঁছিয়েও একটা কথা বলে নি সে।পাখি পা টিপে টিপে ঘরে ঢোকে।ঘড়ের অবস্থা দেখে আপনাআপনি হা হয়ে যায় পাখির মুখ। সারাঘরের সব জিনিস লণ্ডভণ্ড।সিগরেটের শেষ মাথা,সাথে সিগারেটের ছাঁই তো ফ্রি। কাবার্ডের একটা কাপড়ও ঠিক জায়গায় নেই।

খানিক পরেই শান ঘরে ঢোকে।
“এসব কি?”,অাহতস্বরে প্রশ্ন করে পাখি।
শান কোন উত্তর না দিয়ে পাখিতে টেনে আনে বিছানায়।জোড় করতেই পাখি হকচকিয়ে ওঠে।
“কি হচ্ছে কি? আগে বলুন এসবের মানে কি? ”
শান তাতেও কিছু না বলে পাখিকে বুকের সাথে চেপে ধরে শুয়ে থাকে।ঘনঘন শ্বাস ফেলে কাঁধে। পাখি ছোট্ট ছানার ন্যায় চুপচাপ শুয়ে থাকে।নীরবতা ভেঙ্গে শান কাঁধে চুমু দিয়ে বলে, “ফের যদি কোন আমায় ছেড়ে থাকার কথা ভাবো এর থেকেও ভয়ানক ঝড় তুলব বাড়িতে”

শানের কন্ঠের প্রগাঢ় কথা যেন অন্তরকে ভরিয়ে তোলে।মিষ্টি হেসে বলে,”যাবো না”
“ঘুমাও এবার। আর আমাকেও ঘুমাতে দাও”
#আসক্তি২
পর্বঃ৩৬
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

ইদানিং শানকে বিছানা ছাড়াতে বেশ বেগ পেতে হয় পাখির।মোটামোটি অলসই বলা চলে।শানকে টেনেটুনে তুলে পাখি ফ্রেশ হতে চলে যায়।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে শান কোলবালিশ জড়িয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে।আবারো ডাকতে গিয়ে থেমে যায় পাখি।ধীরপায়ে এগিয়ে আসে। পাশে বসে ডান হাতে কপালে নেমে আসা অবাধ্য চুলগুলো তুলে ধরে।চশমা ছাড়া কেমন যেন অন্যরকম লাগে শানকে।মুচকি হেসে কপালে চুমু দিয়ে উঠে আসে পাখি।দ্রুত নেমে আসে নিচে।কারণ শান একবার উঠে গেলে কিছু না কিছু তার খেতেই হবে।রাহেলার দরজায় ডাকতে গিয়ে মনে পড়ে কাল কি এক দরকারে গ্রামের বাড়ি গেছে সে।ও বাড়ি থাকতে পাখিকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে রাহেলা।

বিরসবদনে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।গরম পানি চুলায় দিয়ে পাখি টুকটাক জিনিসগুলো হাতের কাছে নিয়ে আসে।কফি টা করে নিয়ে ব্রেড গুলো সাজিয়ে নেয়। এরপর কফিটা নিয়ে চলে যায় শানের ঘরে।তখনো শান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।হালকা করে দু একবার ডাকতেই চোখ খোলে শান।

কফির দিকে ইশারা করে বলে,”ঠান্ডা হলে নতুন করে করে দিতে পারব না।অনেক কাজ আছে”

শান কোন জবাব না নিয়েই ওয়াশরুমে চলে যায়।পাখি ততোক্ষনে নিচে চলে আসে।সকালের নাস্তার সমস্ত বন্দোবস্ত করে নেয় সে।বড় বাবার সংসারে কাজ করতে করতে কাজের গতি স্বভাবতই একটু বেশি বৈকি!

ঘেমে নেয়ে একাকার হয় পাখি।ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিতেই শান বলে ওঠে,”গোসল টা সেড়ে নাও।ঘাম গুলা শুকালে ঠান্ডা লাগবে নয়ত”

ব্রেডের কোনাটা মুখে নিয়ে বলে,”একা একা আমার খেতে ভালো লাগছে না। কেউ যদি কোম্পানী দিতো তাহলে পুরোটা খেতে পারতাম”

পাখি মুচকি হেসে শানের পাশের দাঁড়ায়। গাল টেনে দেয় শানের।হা হয়ে গালে হাত দেয় শান।
“তুমি, তুমি আমার গাল টানলে?”
“তো”
“আমি তোমার থেকে আট বছরের বড় পাখি।আর তুমি আমায়…..”,বলতে বলতেই শান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।পাখি শানের গাতিবিধি বুঝতে পেরে এক দৌঁড়ে সিঁড়িতে উঠে যায়।শান কোমড়ে দু হাত দিয়ে উপরে পাখির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে।
“নামো আরেকবার, দেখো কি করি ”
“কিচ্ছু করতে পারবেন না”,বলেই বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে পাখি।

শান বসে বসে ফোন স্ক্রল করছে।অপেক্ষা,পাখির আগমনের।কিছুক্ষন পর মাথায় তোয়ালে পেচিয়ে পাখি নিচে নেমে আসে।এরপর দুজনের খুঁনসুটির মধ্য দিয়ে সকালের নাস্তা সেড়ে নেয়।

শানের ফোনে কল আসায় রিসিভ করে কানে ধরে।
“হ্যা রাহাত, কিছু পেলে?”
……
ওপাড়ের ব্যক্তি কি বলছে কিছুই বুঝতে পারছে না পাখি।তবে শানের মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।
“ওকে তুমি ডকুমেন্ট গুলো আমায় ইমেইল করো। ওকে থ্যাংকস ভাই।খুব বড় উপকার হলো”

বলেই থমথমে মুখে ফোনটা কেটে দেয় শান।পাশ থেকে শানের কাঁধে হাত রেখে পাখি প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে?এতো টেন্সড লাগছে যে!”
পাখির কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শানের ফোনের আলো জ্বলে ওঠে।তড়িঘড়ি করে শান ফোন স্কল করে।চক্ষু যেন চড়কগাছ তার।
ফোন এগিয়ে পাখিকে দেখায়।পাখি আতকে ওঠে।
“এতো জঘন্য!”

🌸🌸

হসপিটাল যাওয়ার সময় হয়েছে শানের।পাখি হাতে হাতে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে।পাখির মাঝে তাড়াহুড়ো দেখে শান শব্দ করে হেসে ওঠে।অবাক হয়ে শানের দিকে তাকায় পাখি।
“হাসছেন কেন?”,প্রশ্ন করেই ফ্যালফ্যাল করে শানের দিকে চেয়ে থাকে।
শান পাখির ডান হাত টেনে সামনে সোজা করে দাঁড় করায়।
“এদিকে আসো”
“কী?”
“আমি হসপিটাল যাচ্ছি, তুমি না”
“হ্যা, তো?”
“এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই।একটু আকটু দেরি হলে ওখানে আমায় কেউ মেরে ফেলবে না”

বলেই স্বশব্দে হেসে ওঠে শান।মুখটা পাংশুটে করে পাখি জবাব দেয়,”ওকে গেলাম তবে।ভালো মতো হেল্প করছি গায়ে লাগছে না”
“শোন না”,কন্ঠের স্বর খাঁদে নামিয়ে বলে শান।
পাখি কিছু না বলে বুকের কাছে দুহাত গুঁজে দাঁড়ায়।

“কথা হচ্ছে,আমি যাচ্ছি।আম্মা ফোন করেছিলো। ও বাড়ির সবাই নাকি রাহেলা চাচির বাড়ি গেছে।তার মা মারা গেছে সেখানে।তো তুমি সাবধানে বাড়িতে থাকবা।ফোন সারাক্ষন কাছে কাছে রাখবা।আমি কিন্তু ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করব।আর কোন সমস্যা মনে হলে আমায় কল করবে।”,বলেই পাখির দিকে এগিয়ে আসে শান।কপালে চুমু এঁকে দেয়।
পাখি সরুচোখে চেয়ে বলে,”আর কিছু নাই?”

“আরো তো অনেক কিছুর ইচ্ছে হচ্ছে। বাট তোলা থাক ”
“অসভ্য লোক”,বলে চলে আসে পাখি।
“আর শোন তো,আমি সন্ধ্যার পরপরই বাড়ি ফিরব।আজ আমরা রাতে ঘুরতে বের হবো”
খুশি হয় পাখি।
গলা জড়িয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,”সত্যি!”
“একদম”

🌸🌸

“লাখ লাখ টাকার সম্পদ, আপনি বুঝতে পারছেন?”
“সরি,রায়ান ভাই যেহেতু ওয়ারিশ এখনো জীবিত আর সব সম্পত্তি তার নামেই লিখিত সেহেতু আমি কেন কোন উকিলই কিচ্ছু করতে পারবে না।আপনি বরং খোঁজ নিয়ে দেখুন আমার কথা বিশ্বাস না হলে”,ব্যর্থ কন্ঠে জবাব জানায় মাহমুদ।

মাহমুদের কথায় রাগে ক্ষোভে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে রায়ানের।পারে তো উক্ত স্থানেই গেড়ে দেয় তাকে।মুষ্ঠিবদ্ধ হাত টা টেবিলে জোড়ে আঘাত করে। ডান পায়ে লাত্থি দিয়ে সামনের ফাঁকা চেয়ার টা গুড়িয়ে দেয়।রেগে উকিলের দিকে ঝুঁকে বলে, “শর্টকাট ওয়ে বলুন মিঞা।এতো পেচা পেচির সময় নাই।”

“আহহ্ রায়ান শান্ত হ”

এতোক্ষন বৈঠকে বসে পুরো বৈঠক মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো আয়ান।একই জঠরের হলেও দুই ভাই দুই প্রকৃতির।এ যেন উত্তরমেরু আর দক্ষিণমেরু। কারোর সাথে কারোর স্বভাবের মিল নেই তবে উদ্দেশ্য একই।

রায়ান উগ্র প্রকৃতির। যেকোন কাজ তার তৎক্ষনাৎ হওয়া চাই।ধৈর্যশক্তি শূন্যের কোঠায় বলা চলে।চট করে উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে কার্য হাসিল করতে পছন্দ করে।
অন্যদিকে আয়ান ধীরস্থীর, শান্ত স্বভাবের।সে নিজের বুদ্ধি বিবেক খাটিয়ে কাজ করতে পছন্দ করে।উপস্থিত বুদ্ধির সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ সময় ভুল প্রমাণিত হয় কিনা!

রায়ানকে শান্ত হতে বলে উঠে গিয়ে রায়ানের পিঠ চাপড়ায়।
“ভাই আমার, বড় হইলি তবুও মাথা খাটাতে শিখলি না।রিল্যাক্স ব্রো”

বলেই উকিলকে উদ্দেশ্য করে মুচকি হেসে বলে,”আপনি এখন আসুন।পরে প্রয়োজন পরলে আমরা ডেকে নিবো। কেমন!”

আয়ানের ব্যবহার মাহমুদের বরাবরই খুব ভালো লাগে।ফিরতি একটা হাসি উপহার দিয়ে হাত এগিয়ে দেয় মুসাফাহ্’র উদ্দেশ্য।আয়ান হেসে হাত বাড়িয়ে দেয়।এরপর মাহমুদের চলে যাওয়া নিশ্চিত হতেই আয়ান আবার এসে রায়ানের পাশে বসে।

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রায়ান বলে,”এটা কোন কথা ভাই।এতোদিন জেনে আসলাম কাকা জ্যাঠাদের ছেলে না থাকলে সম্পত্তির বেশীরভাগ অংশ ভাতিজারা পায়।আর আমরা? আমরা কি এভাবেই বসে বসে আঙ্গুল চুষব?”
“সবই ঠিক আছে। কিন্তু চাচাজান তো মেয়ের নামে সব দিয়েছে।এ ক্ষেত্রে ওয়ারিশ একমাত্র সেই’ই।ডোন্ট ওরি….একটা না একটা কিছু মাথায় অবশ্যই আসবে।রিল্যাক্স”,আশ্বস্ত করে বলে আয়ান।ইতোমধ্যে ছক কষা শেষ কিভাবে কি করবে।এখন শুধু এগোনোর পালা।

🌸🌸

বিকেল পরে যায়। শান প্রতিটা ঘন্টায় কয়েকবার করে ফোন করে খোঁজ নিয়েছে পাখির।বলতে গেলে কাজ থেকে একটু ফুসরত পেলেই পাখিকে কল করে। একা একা সেসব ভেবেই হেসে ওঠে পাখি।

বিকেল বেলা হাতে কোন কাজ নেই বললেই চলে।রাতে যেহেতু বাহিরে যাওয়ার পরিকল্পনা সেহেতু রান্নার বন্দোবস্ত আজ আপাতত আর নেই।ফ্রিজ খুলে আইসক্রিমের বক্স টা হাতে নিতেই অমায়িক হাসি ফোটে পাখির মুখে।

সেদিন মদ খেয়ে মাতলামো করেছিলো পাখি।শান অনেকগুলো চকোলেট আর আইসক্রিম এনেছিলো।যদিও সেগুলো খাওয়ার সুযোগ হয় নি।আজ সুযোগ টা কাজে লাগাতে মূহূর্তও দেরি করতে ইচ্ছে করছে না পাখির।দ্রুতই বাটিতে করে নিয়ে বসে পরে টিভির সামনে।চামুচে করে মুখে দিয়েই চোখ বন্ধ করে পাখি।তার পছন্দের খাবারের মাঝে আইসক্রিম সর্বপ্রথম আর তা যদি হয় প্রিয় মানুষের দেয়া তাহলে তো কথাই নেই।

কয়েক চামুচ মুখে দিতেই শান আবার কল করে। তবে এবার ভিডিও কল।ভ্রুকুচকে ফোনের দিকে তাকায় পাখি।শানের ছবিটা জ্বলজ্বল করছে।আইসক্রিমের বাটিটা বাম হাতে নিয়ে কল রিসিভ করে পাখি।কেমন যেন লজ্জা লাগছে।শান রিসিভ করে ফোনটা সামনে রেখে দেয়।পেশেন্টের সাথে কথা বলছে। এক ফাঁকে পাখির দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে প্রেসক্রিপশন লিখছে।পাখিও চুপচাপ খাচ্ছে আর দেখছে সেসব।
প্রেসক্রিপশন টা পেশেন্টের হাতে ধরিয়ে দেয়।এরপর নেমে আসা চমশমাটা আঙ্গুলে ঠেলে উপরে উঠিয়ে বলে,”কি খাচ্ছো তুমি?”
“এই যে আইসক্রিম”,বাটিটা উচিয়ে জবাব দেয় পাখি।

শান এবার দুইহাত টেবিলে রেখে পাখির দিকে সরুচোখে তাকিয়ে বলে,”সকাল সকাল গোসল করছো তার জন্যে তোমার সর্দি সর্দি ভাব বুঝতে পেরেছি এখন আবার এই বিকেল বেলা আইসক্রিম খাচ্ছো।ঠান্ডা লেগে গেলে?”
“আপনি আছেন কি করতে?”,আইসক্রিম টা মুখে দিতে দিতে বলে পাখি।
“আবাদি ডক্টর, তাই না!”
“হ্যা, তাই তো”
“মারব টেনে এক চর।রাখো বলছি”,কপোট রাগ দেখিয়ে বলে শান।
ঠোঁট উল্টিয়ে পাখি বাটিটা পাশে রেখে দেয়।এরপর অভিমান করে ফোনটা খট করে কেটে দেয়।

কয়েক মূহূর্ত পর আবার কল করে শান।কেটে দেয় পাখি।এভাবে তৃতীয় বারের বেলা পাখি ফোনের দিকে চেয়ে থাকে।আনমনে বলে,”এবার দিলে রিসিভ করব”
কিন্তু বিঁধিবাম, কল আসে ঠিক কিন্তু সম্পূর্ণ কল আসার আগেই কেটে দেয় শান।কারণ ফোনের ওপাশে শান আবার পেশেন্টদের ভীড়ে হারিয়ে যায়।

পাখি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বাড়ির লাইট গুলো একে একে জ্বালিয়ে দেয়।তখন ইতোমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

হঠাৎ ঘনকালো মেঘে ছেঁয়ে যায় আকাশ।ধীরেধীরে আকাশ গুড়ুম গুড়ুম করে ওঠে।বোঝাই যাচ্ছে আকাশের শামিয়ানা ভেঙ্গে আজ বৃষ্টিরা দলবেঁধে নেমে পড়বে ধরনীতে।

খুব একটা ভীতু মেয়ে নয় পাখি।তবুও থেকে থেকে কেমন যেন গা শিউড়ে উঠছে।শানকে একবার কল করে কিন্তু কল উঠায় নি শান।মনে মনে নিজেকে বোঝায়, “হয়ত ব্যস্ত”
বাতাসের বেগ বেড়ে যায় দ্বিগুন।উপরতলা থেকে কিসের যেন ধপাস করে শব্দ হলো।চমকে ওঠে পাখি।মাথা তুলে উপরের দিকে তাকায়।কলিজা যেন শুকিয়ে আসে তার।এদিকে একটু একটু বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে।পাখি সব জানালা গুলো বন্ধ করে দিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে সদর দরজার দিকে চেয়ে আছে।কখন শান আসবে।

কিছুক্ষন পর বাতাস টা আরেকটু বেগে ছোটে।আবারও শব্দ হয়।মূহূর্তেই ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায়।সোফার কভার খামচে ধরে পাখি।কেমন যেন ভয়ানক লাগছে সবটা;ভুতুড়ে ভুতুড়ে।হাতরিয়ে ফোনটা খুঁজে ফ্লাশ জ্বালিয়ে পা উচিয়ে দু হাঁটু জড়িয়ে বসে থাকে পাখি।নজর সদর দরজার দিকে।এবার শব্দটা ভীষণ জোড়েই শোনা যায় সাথে বাজ পড়ার বিকট শব্দ।দুহাতে কান চেপে ধরে পাখি।

পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলে ফোনটা হাতে শক্ত করে চেপে উপরে দিকে যাওয়ার জন্যে মনঃস্থির করে সে।সিঁড়িতে পা রাখতেই কেমন যেন কলিজা কেঁপে ওঠে।তবুও ভয়ে ভয়ে সবগুলো সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে উঠে সব ঘরের জানালা দরজায় নজর বুলিয়ে নেয়।

“সবই তো বন্ধ। তাহলে……!”

ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করতেই মনে পড়ে পাখির,”আজ বিকেলে কাপড় উঠিয়ে নেয়ার সময় তো ছাদের দরজা লাগাই নি”

খুব দ্রুত পা চালিয়ে চলে যায় ছাদের দরজার কাছে।দরজা খোলা, আর সেটাই বাতাসের বেগে ধাক্কা লেগে শব্দ হচ্ছিলো।নিজের মাথায় নিজেই গাট্টা মেরে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দেয় পাখি।মূহূর্তেই সব ভয় যেন কেটে যায় মন থেকে।

এবার নিচ থেকে ঝনঝন শব্দ হতেই আবারও কেঁপে ওঠে পাখি।শানের আগমন মনে করে নিচে সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখে ফোনের ফ্লাশ জ্বালানো কাউকে।ফ্লাশ টা এদিক সেদিক নড়ছে।পাখি প্রথমে ভেবেছিলো শান। কিন্তু পরোক্ষনে মনে হয়,”তিনি হলে তো এভাবে ফ্লাশ এদিক সেদিক করবে না!আমায় ডাকছেও না কেন?”

ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসে পাখির।মনে সাহস যুগিয়ে তড়িৎগতিতে নেচে নেমে আসে ।

“কে, কে ওখানে”,কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করে পাখি।ফ্লাশ লাইট সমেত আগন্তুক লোকটি দাঁড়িয়ে পরে। কাঁধ থেকে যেন বড় একটা ব্যাগ মেঝেতে সরাত করে পরে যায়।হার্ট বিট বেড়ে যায় পাখির।

“ব্যাগ সমেত কে হতে পারে”,নিজমনে আওরিয়ে আবার প্রশ্ন করে সে।
“কি হলো কথা কেন বলছেন না?”
“তুমি কে?”

গা হিম হয়ে আসে এবার। বাহিরে বৃষ্টির বেগ আবারও বেড়ে গেছে।সাঁইসাঁই করে বৃষ্টি পড়ছে বিরতিহীন ভাবে।
পুরুষালী গাঢ় মোটা কন্ঠস্বর টা অচেনা।কিছুতেই এটা ইতোপূর্বে কোনদিনও শোনে নি পাখি।তড়িৎগতিতে ডায়ালে শানের নম্বর টা ডায়াল করে।

কাপাকাপা হাতে ফোনটা কানে নিতেই লোকটা আবার বলে ওঠে,”কে তুমি?কি হলো কথা কেন বলছো না?”

“হ্যালো,হ্যালো, হ্যালো পাখি ”
“ববাড়িতে ততাড়াতাড়ি আসুন।কে যেন…… ”

‘”হেই তুমি কাকে ফোন করছো?আর কে তুমি?কথা কেন বলছো না?”
পাখির কথা শেষ না হতেই বলে ওঠে আগন্তুক লোকটা।পাখি খট করে ফোন কেটে দেয়।ফোনের ফ্লাশ সামনে এগিয়ে মানুষটাকে দেখতে চায় পাখি।কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বলে,”একদম এগোবেন না বলে দিচ্ছি।”
বলতে বলতে ডায়নিং এর কাছে চলে আসে পাখি।
ছুড়িটা হাতে নিয়ে বল,”কাছে আসলে এটা ছুড়ে মারব। খুন হয়ে যাবেন একদম। বের হোন, বের হোন বাড়ির থেকে।বের হোন বলছি”

“আরে আজিব তো।কে তুমি? আর ছুড়ি রাখো বলছি, রাখো”,কপোট রাগ দেখিয়ে বলে লোকটা।

পাখি ভয়ে কেঁদে ফেলে নিঃশব্দে।তবুও নিজের সাহসীকতা বজায় রেখে পাখি বলে, “আমি কে মানে?আমি এ বাড়ির বউ”

“বউ!”,বিড়বিড় করে বলে লোকটা।যেটা পাখির কানে এসে পৌঁছায়।
ছুড়িটা শক্ত করে ধরে বলে,”হ্যা বউ। এবার বের হোন বলছি।একা একটা বাড়িতে কি করে ঢুকলেন আপনি? দারোয়ান কিভাবে ঢুকতে দিলো আপনাকে?আজ আসুক উনি বাড়িতে”
শেষের কথাগুলো ক্ষীনস্বরে বলে পাখি।

আগন্তুক লোকটা এগিয়ে আসতেই পাখি কোন কথা ছাড়াই হুট করে একটা কাজ করে বসে। ছুড়িটা ছুড়ে মারে অন্ধকারে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে।
“আউচচচ”,চাপা আর্তনাদ হতেই লোকটার হাতের ফোনটা মেঝেতে পরে যায় স্বশব্দে।বিদ্যুৎ চলে আসে তখনি।নিজের সামনে এমন সুদর্শন একজন পুরুষকে দেখে অবাক হয়ে যায় পাখি।ডান হাতের দিকে খেয়াল পরতেই দেখে সাদা টি-শার্টের হাতাটা রক্তে লাল হয়ে গেছে।

লোকটা পাখির দিকে চেয়ে চোখ মুখ কুচকে মাথা নিচু করে আর্তনাদ করে। মূহূর্তেই পাখির খেয়াল হতেই চেঁচিয়ে বলে,”বলেছিলাম না আগাবেন না”

লোকটা উঠে দাঁড়াতেই পাখি ভয়ে দুই পা পিছিয়ে যায়।আর তখনই হন্তদন্ত হয়ে দরজায় পা রাখে শান।অবাক হয়ে পাখির দিকে তাকাতেই দেহে প্রাণ ফিরে পায় যেন।হাতের বাঁ পাশে দেখে কেউ একজন ডান হাতের বাহু চেপে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে।পাখি লোকটাকে একবার দেখে নিয়ে সুযোগ বুঝে দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে শানকে।বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলে।এতোক্ষনের চাপা ভয়, কান্না এবার আর বাঁধ মানছে না যেন।

লোকটা পাখির দৌঁড়ানিতে অবাক হয়ে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।শান পাখির মাথায় হাত দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে।জড়িয়ে রেখে মাথা তুলে তাকায়…

চলবে…….

[বিঃদ্রঃযাদের কাছে পাখির আহ্লাদ গুলো ন্যাকামি বা ঢং মনে হবে তারা নিজেকে একবার প্রশ্ন করবেন তখন, যখন নিজের বরের কাছে আদুরে হোন।নিজের বরের কাছে যখন আহ্লাদি হোন তখন নিজেকে প্রশ্ন করবেন আমিও কি ন্যাকামি করছি না?

আসলে কি জানেন, প্রতিটা মানুষই ভালোবাসার মানুষদের কাছে আদুরে, আহ্লাদি হতে চায়।বাচ্চামি স্বভাবটা বেরিয়ে আসে]
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here