আসক্তি ২ পর্ব ৩৩+৩৪

#আসক্তি২
পর্বঃ৩৩
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

শরৎের একটা মিষ্টি সকাল।রোদ টা যেন কাঁচের জানলাটার ছোট্ট ঐ ফোঁকর টা দিয়ে হুরমুরিয়ে ঢুকতে চাইছে ঘরে।রাস্তায় সবে মাত্র লোকেদের আনাগোনা।সকালের সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো তাদেরও জীবন যুদ্ধ।প্রতিটা সকালই কোন না কোন নতুনত্বের আহ্বান জানায়।জানায় নতুন করে জীবনকে সাজানোর উপায়।জীবনের মানে বোঝায় সুক্ষ ভাবে।রাতের পর সকাল হয়ে প্রমান করে জীবনে ঘনকালো অমানিশার পর অবশ্যই সুখের মশাল হাতে সকাল হাজির হয়।

পিটপিটিয়ে চোখ খোলে পাখি।সিথি বরাবর আছড়ে পরছে পরম ভালোবাসার মানুষ,প্রাণপ্রিয়ের উষ্ণ নিঃশ্বাস।জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে আসা আলোটা মন্দ লাগছে না। অনুভূতিরা জানান দেয়, পিঠে কারো পুরুষালী বাঁ হাতের শক্ত বাঁধন।সদ্য জাগ্রত ভোঁতা অনুভূতিগুলো গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে।উষ্ণ আবেশে বুকে মিইয়ে যায় ।পার হয় কিছুটা সুখের মূহূর্ত।মাথা তুলে তাকায়।
বক্ষের মালিকের দুঠোঁটের মাঝে পৌনে ইঞ্চির দূরত্ব। মুচকি হেসে আনমনে বলে,”তাই তো বলি আজ নিঃশ্বাসের ঘনত্ব এতো বেশি কেন!”

ভেবেই ঠোঁটের দূরত্বটা দু আঙ্গুলে ঘুচিয়ে দেয়।কিন্তু বিঁধিবাম, এ দূরত্ব যেন বাঁধা মানছে না।বার দুয়েক এমন করতেই নড়েচড়ে ওঠে শান।এবার দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরে বুকের উপর থাকা তার অর্ধাঙ্গিনীকে।পাখি আবারও উদ্যত হতেই কোথা থেকে একটা সাদা কিছু এসে দখল করে নেয় শানের নাকের ডগা।ভ্রুকুচকে কিছুক্ষণ চেয়ে বুঝতে পারে, কাশফুলের গুচ্ছ থেকে বিতারিত হওয়া কোন একটা উড়ন্ত ফুল।খুব সন্তোর্পনে আঙ্গুলে উঠিয়ে নেয় পাখি।হঠাৎ মনে পড়ে, “শরৎ এসে গেছ!”
মোহনীয় হাসিতে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয় অজানার উদ্দেশ্যে।

“খেলা শেষ হয়ে গেলে এবার ওঠো, আমার বুকটা ব্যথা হয়ে গেলো”
“আপনি জেগে আছেন!”,অবাক হয়ে বলে পাখি।
চট করে শান চোখ খুলে ছাদের দিকে চেয়ে বলে, “হুম জেগে আছি।এবার যদি বাঁচাতে চাও তো ওঠো আমি উঠব”
রেগে কটমটে দৃষ্টিতে তাকায় পাখি।
“কী?”
“খুব ভার লাগছে না?”
“তো লাগবে না! এতো বড় একটা মানুষ যদি এভাবে থাকে কার ভার লাগবে না?”
শানের কথায় আরো রেগে যায় পাখি।কপোট রাগ দেখিয়ে উঠে বসে পাশে।শান বুকটা চেপে ধরে উঠতে উঠতে বলে,”তাও আবার মেয়ে মানুষ”

পাখি কোন কথা না বলে উঠে চলে যেতেই শাড়ির আঁচলে টান পড়ে।আঁচলের শেষ মাথা দেখে বুঝতে পারে সেটা শানের হাতের মুঠোয়।
“ছাড়ুন বলছি”
পূর্বের ন্যায় বসে থাকে শান।
“কি হলো ছাড়তে বলছি না?”,চোখ রাঙ্গিয়ে বলে পাখি।
এবার আঁচল ধরে এক টানে কাছে নেয় পাখিকে।হকচকিয়ে ওঠে পাখি।শানের উপর গিয়ে পরে।
মাথাটা হালকা ঝুঁকে শান বলে,”মজা করলাম তো”
চোখের দৃষ্টি পরিবর্তন হয় পাখির।মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে তাকায়।কপালে গাঢ় চুমু এঁকে শান বলে,”বলছি তো মজা করেছি”

“হুমমম বুঝলাম”,উঠে শাড়িটা আবার সেট করতে করতে বলে পাখি।শান মাথা চুলকে সেদিকে চেয়ে মুচকি হেসে ওঠে।হঠাৎ কি হলো,পাখি চট করে বললো,”কাল রাতের কথা মনে আছে তো?”
ভাবুকের মতো শান পাল্টা প্রশ্ন করে,”কোন কথা?”
“মনে নাই।মায়ের সাথে দেখা করা….ঐ যে… যেভাবে আমি চাই সেভাবে কিন্তু”,কথায় কিছুটা মায়াবি কম্পন তুলে বলে পাখি।যাতে শানের মনের কথা জানতে পারে।
“ওকে, তবে আবারও বলছি আমার থেকে কোন ভালো ব্যবহার এক্সপেক্ট করো না।তখন কিন্তু তোমারও কোন রাখতে পারব না।মাথায় রেখো”,বলতে বলতে বিছানা থেকে নেমে স্লিপার জোড়া পায়ে দেয় শান।ফোনে দুইবার ট্যাপ করে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়। পাখি গলা উচিয়ে জোড়ে বলে,”সেটাই যথেষ্ট”

🌸🌸

মুখোমুখি বসে আছে আজ ষোল বছরের পুরোনো দুটি সত্ত্বা।কারো অন্তরে দাউদাউ করছে ঘৃনার আগুন, কারো অন্তরে সন্তানের জন্যে উতলে পড়া হাহাকার।ছেলের দিকে চেয়ে আছে শর্মিলা।চোখ দুটো আজ যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।বহুবছরের তৃষ্ণার্ত চোখ আজ শান্ত ;ছেলেকে এতোটা কাছ থেকে দেখতে পেয়ে। চোখের পলক ফেলতেও ভয় হচ্ছে তার, এই বুঝি সবটা স্বপ্নের মতো মিলিয়ে যায়!

শান শান্ত চাহনীতে নজর ফেলে পাখির দিকে।পাখি শুকনো ঢোক গিলে রাহেলার দিকে একবার তাকায়।চোখে মুখে অসহায়ত্ব বিরাজমান।চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে রাহেলা।তবুও কোথাও অন্তরের অন্তস্থল জানান দিচ্ছে আজ কিছু একটা ঘটতে চলেছে।খুব কি কঠিন কিছু?

গলায় খাঁকারি দিয়ে পাখি বলে ওঠে,”মা”
সচকিতে চোখ সরিয়ে নেয় শর্মিলা।চশমা টা খুলে শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে জবাব দেয়,”হ্যা বউ মা, বলো”
চোখে চশমা লাগিয়ে পাখির দিকে ফিরে বসেন তিনি।পাখি বুঝতে পারে না সবটা কীভাবে শুরু করবে সে।
হাত কচলাতে কচলাতে সবার দিকে একবার তাকায়।
উঠে দাঁড়ায় শান।পাখিও উঠে দাঁড়ায় সাথে সাথে।সামনে গিয়ে বলে,”কোথায় যান।আজ না এখানে থাকার কথা…”
“দেখা করতে বলেছো করেছি।এভাবে বসে থেকে থেকে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।শুক্রবারের দিন।নিজের বিকেল ঘুম নষ্ট করে বসে থাকতে পারব না আমি”,গড়গড় করে কথাগুলো বলে পা বাড়ায় শান।পাখি আবারও পথ আগলে দাঁড়ায়।
চাপাস্বরে বলে,”এমন কেন করছেন!একটু বসুন না প্লিজ”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শান বলে,”তাড়াতাড়ি”
পাখি আবার হাত টেনে বসিয়ে দেয় শানকে।

“আজ এতোগুলো বছর পর এসবের দরকার ছিলো না বউমা।আমাদের যে সময়গুলো চলে গেছে তা আর ফিরে আসার নয়।আমার নাড়িছেঁড়া ধনের কাছে এ বয়সে এসে নতুন করে অধিকার ফলাতে চাই না”
“এমন কেন বলছেন মা।আপনি তার মা।এখানে নতুন করে আরো কি কোন অধিকারবোধের প্রশ্ন থাকতে পারে”,শর্মিলার পাশে গিয়ে বসে বলে পাখি।

কথার মাঝেই ছ্যাঁত করে ওঠে শান, “আমি মানি না”
মূহূর্তেই চোখ বন্ধ করে ফেলে শর্মিলা।পাশে বসা রাহেলা হাত চেপে ধরে।চোখ খুলতেই দুফোটা জল গড়িয়ে পরে কোলের উপর।পাখি উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে শানের দিকে।
“বাদ দাও এসব মা।তোমায় বলেছিলাম এসবের কোন দরকার নাই।কোন কথাই শুনলে না আমার “,জড়িয়ে আসা কন্ঠে বলে শর্মিলা।
থমথমে মুখে অসহায় চাহনীতে চেয়ে থাকে পাখি।
“তো আপনি কি ভেবেছিলেন?আমার সামনে এসে বসবেন?কুমিরের কান্না কাঁদবেন আর আমি গলে জল হয়ে যাবো!নো ওয়ে”,রাগ রি রি করে ওঠে শানের শরীর।
পাখি দ্রুত উঠে গিয়ে শানের পাশে কাঁধে হাত রাখে।স্বাভাবিকভাবে বলে,”এভাবে মায়ের সাথে কথা বলতে নেই ডাক্তার সাহেব”

“মা!”,কটাক্ষ করে বলে শান।স্বপক্ষে আবার বলে,”কিসের মা?কার মা?আমার তো কোন মা নেই!সে তো ষোল বছর আগেই চলে গেছে নিজের খায়েশ পূরণ করতে! আর আমায় দিয়ে গেছে বেঁচে থেকেও নরক যন্ত্রনা”
শেষের কথাটায় বেশ শক্ত হয়ে আসে শানের চোখ মুখ।
শর্মিলা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,” আসি মা”
“মা যাবেন না “,অনুনয়ের স্বরে বলে পাখি শর্মিলার সামনে দাঁড়ায়।কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,”ছোটবেলায় বাবা মা দুজনকেই হারাই।লাখ লাখ টাকার সম্পদ থাকা স্বত্বেও বড় বাবার সংসারে কাজের মেয়ের মতো কাজ করেছি।বড় মায়ের কতো ঝাঁটার বাড়ি,খুন্তির আঁচ সহ্য করেছি।আপনাকে দেখার পর আমার মা মা অনুভূতিটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সবটা এভাবে শেষ হতে দেবেন না ”

বলতে বলতে কেঁদে ফেলে পাঁখি।প্রতিটা ফোটা অশ্রু যেন তীরের মতো বিঁধছে শানের কলিজায়।উঠে এসে পাখিকে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। শর্মিলার দিকে চোখ রেখে বলে,”ওকে ফাইন।আমি সবকিছু শুনতে রাজি আছি।তুমি আর পাঁচটা রমনীর মতো ছলনাময়ী নও,তাই নিজের এই মূল্যবান চোখের পানি বা অনুভূতি কোন ছলনাময়ীর সামনে খরচ করো না”

শানের কথা শেষ হতে না হতেই শর্মিলা একটা বিষ্ময়কর কাজ বসে।যেটার জন্য উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে যায়।কেউ ভাবতেও পারে নি এমন একটা কাজ সে করবে।
“আমি ছলনাময়ী তাই না? “,বুকের আঁচল উন্মুক্ত করে চিল্লিয়ে বলে শর্মিলা।
“এসব আমার ছলনার চিহ্ন বাবা,তাই না?”

শর্মিলার দিকে তাকিয়ে আতকে ওঠে পাখি।দুহাতে মুখ চেপে ধরে। রাহেলা কপালে হাত ঠেকিয়ে সোফায় বসে মেঝেতে একধ্যানে তাকিয়ে আছে।শান একবার সেদিকে তাকিয়েই মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে।নজর সরিয়ে ধীরেধীরে বসে পরে পিছনে থাকা সোফায়।

“সময়টা ঠিক এমনিই এক শুক্রবার;বিকেল বেলা।তোমায় দুনিয়া দেখানোর জন্যে জীবন বাজি রেখে প্রসব ব্যথা সহ্য করছি।জীবন যখন ওষ্ঠাগত আমার তখন তোমার কান্নার করুন স্বর কানে ভেসে আসলো।চোখদুটো আর খোলা রাখা সম্ভব হচ্ছিলো না।বুঝতে পারলাম আমার চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসলো।কতোক্ষন কেটে গেছে জানা নেই।যখন জ্ঞান ফিরলো কানে শুধু একটাই কথা ভেসে আসল,’এ সন্তান আমার না।এ সন্তান আমজাদ খানের।’
নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।কান্না করার মতো অবশিষ্ট শক্তিটুকুও আমার শরীর ছিলো না।তোমায় বুকে জড়িয়ে নীরব অশ্রু ঝড়িয়েছি।তোমার বাবার অভিযোগের পিছনের কারণ ছিলো তোমার সৌন্দর্য।তার ভাষ্যমতে ‘আমি কালো, আমার সন্তানও হবে কালো।সে কেন এতো সুন্দর হলো!”

হাজার বার তোমার বাবাকে বুঝিয়েছি তুমি আমাদেরি সন্তান। তবুও তিনি আমার সারা গায়ে কলঙ্ক লেপতে কুন্ঠিত হোন নি।তোমার বাবার সাথে বিবাহের পূর্বে আমজাদ খানের সাথে আমার পরিচয় ছিলো।খুব ভালোবাসতাম একে অপরকে।কিন্তু আমার বাবার কাছে হেরে যায় আমার মনের লুকানো অনুভূতি।বউ হয়ে আসি তোমার বাবার সংসারে।বিয়ের পর আমজাদের সাথে কোনরকম কোন সম্পর্ক আমার অবশিষ্ট ছিলো না।তবুও তোমার বাবা তার নাম নিয়ে সবসময় আমায় জড়াতেন।শেষ পর্যন্ত তোমায় অস্বীকার করে মিথ্যে বদনামকে বাস্তবে রূপদানের চেষ্টা করেন।

শুরু হয় আমার উপর অমানবিক নির্যাতন।রাত নেই দিন নেই সবসময় আমায় মারধোর করত।আমার সংসারের শান্তিটাই বিলীন হয়ে গেলো ধীরেধীরে।তবে সময়ের সাথে তোমার বেড়ে ওঠা হয়ে উঠল তোমার বাবার একাকিত্বের সঙ্গী।তোমাকে মেনে নিলেন তিনি।আমিও অতীতের সবকথা ভোলার চেষ্টা করলাম।হারানো সুখ টা ফিরে পেলাম নতুন করে।
কিন্তু কোথাও না কোথাও মনে একটা চাপা কষ্ট থেকে যেতো তোমায় নিয়ে।

নতুন ব্যবসা শুরু করলেন তোমার বাবা।কি ব্যবসা জানতে চাইলে সবসময় এড়িয়ে চলতেন।ব্যবসার সুবাদে মাঝে মাঝে কিছু লোকজন বাড়িতে আসত।
যাদের চাল চলন মোটেও পছন্দ হতো না আমার।এভাবে কিছু মেয়েরাও আসত।বেশভূষায় ভালোভাবেই বুঝে গেলাম এরা কোন ভালো মেয়ে নয়।প্রতিবাদ করলে তোমার বাবার অকথ্য গালাগাল শুনেছি।মার খেয়েছি।বার বার বলেছিলাম,’কি এমন ব্যবসা তোমার যে এরকম মেয়ে ছেলেরা বাসায় আসে?’
উত্তরে বলেছিলো, ‘আমার অনেক অনেক টাকা চাই শর্মিলা’
আস্তে আস্তে জানতে পারলাম তোমার বাবা নারী ব্যসায়ের সাথে জড়িত। নারী দেহ ছিলো তার একমাত্র নেশা,আর সেই নারীদের দিয়ে টাকা কামানোই ছিলো তার পেশা।

এসব শোনার পর তোমার বাবাকে প্রশ্ন করি, ‘এসব কি সত্যি’
তোমার বাবা সেদিন বলেছিলো,’সবই সত্যি, পোষালে থাকো নয়ত চলে যাও’
তোমার হাত ধরে চলে আসার উদ্যত হতেই বুঝতে পারলাম আমি দ্বিতীয় বারের মতো মা হতে চলেছি।বেরি পরে গেলো পায়ে।দুই দুইজন সন্তান নিয়ে ভাইয়ের কাঁধে কী করে বোঝা হবো?বাবা তো বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে পরোপারের টিকেট কেটেছেন। আর আমায় দিয়ে গেছেন বেঁচে থেকেও নরক যন্ত্রনার মতো কষ্ট।

ততোদিনে আমার কিছুই করার ছিলো না। সবটা মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া টু শব্দ করতে পারছিলাম না।তোমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে তোমার বাবা আরো বেশি নোংড়া আর হিংস্র হয়ে উঠল।নিজের ছেলেকে জিম্মি করে আমায় ভয় দেখাতেন।চোখের সামনে নিজের স্বামীর এমন নোংড়া লীলা দেখা সম্ভব ছিলো না আমার।এমনও দিন গেছে আমায় পাশের ঘরে তালাবদ্ধ রেখে তোমার বাবা আরেক ঘরে অন্য মেয়ের সাথে সময় কাটিয়েছে।এসব কিছু থেকে তোমাকে যতোটা পেরেছি দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। আমি কখনোই চাইনি তোমরা তোমাদের বাবার আসল রূপ দেখতে পাও।কারণ সেটা ছিলো খুব নোংড়া আর হিংস্র।সমাজের চোখে ততোদিনে তোমার বাবা খুব মহামানবে পরিনত হলেন।আর আমার কষ্টের একমাত্র সঙ্গী ছিলো তোমার রাহেলা চাচি

আস্তে আস্তে টিনা চলে আসলো পৃথিবীতে।তোমার বাবার লোভ আরো তড়তড় করে বেড়ে চলছিলো।তিনি সবসময় শুধু বলতেন তার অনেক টাকা লাগবে।আমি কিছুই বলতে পারতাম না;অসহায় বলে।তোমার বাবা আমার সেই অসহায়ত্বের সুযোগে দিনে দিনে লোকচোক্ষুর আড়ালে নোংড়া ব্যবসাকে আরো বড় করে তুললেন।গোপনেই প্রসার ঘটালেন ব্যবসার।সময়ের সাথে সাথে তার ব্যবহার আরো বেশি পশুর মতো হতে লাগলো।রাতে নেশা করে বাড়ি ফেরা।নেশাগ্রস্থ হয়ে আমার উপর শারীরিক অত্যাচার করা, সিগারেটের আগুনে গা পুরিয়ে দেয়া এসবে তিনি পৈশাচিক আনন্দ পেতেন।অথচ তোমাদের দুই ভাইবোনের সামনে ফেরেসতা সেজে থাকতেন।আর আমিও চাইনি তোমরা সবটা জানো।তাই ভোর হওয়ার সাথে সাথে সব ভুলে তোমাদের যত্নে মন দিতাম।

তুমি বড় হচ্ছিলে পাল্লা দিয়ে যেন বাড়ছিলো তোমার বাবার লোভের পরিধি।আমি আর চুপ থাকতে পারছিলাম না।প্রতিবাদ করা শুরু করলাম।মারমুখী হওয়া হাতদুটো আটকে দিতাম,বাড়িতে নোংড়া ব্যবসার প্রশ্রয় দিতাম না।তখন তোমার বাবা তোমার স্কুলের ফিস দেয়া বন্ধ করলেন,বন্ধ করলেন তোমাদের পিছনে এক টাকা খরচ করা।টিনার বাড়তি খাবার বন্ধ করলেন।প্রশ্ন করলে বলতো সন্তাদের পিছনে তিনি টাকা খরচ করবেন না।আমার হাতে লুকানো যা ছিলো তা দিয়ে টেনেটুনে সংসার সামলিয়েছি।সম্মুখে ছিলো তোমার মাধ্যমিক পরীক্ষা। ফর্ম ফিলাপের টাকা,তোমার প্রাইবেটের বেতন সবটা আমার গলায় কাঁটার মতো বিঁধে গেলো।কারণ আমার হাতের জমানো টা ততোদিনে ফুরিয়ে গেছে।কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না।উপায়ান্তর না পেয়ে আবারও হেরে গিয়ে সবটা নিয়তির উপর ছেড়ে দিলাম।

দেখতে দেখতে তোমার ফর্মফিলাপের তারিখ চলে এলো।আকুতি মিনতি করে টাকা নিয়ে তোমার হাতে দিয়েছিলাম ফরফিলাপের জন্যে।আর তোমরা ভাবতে তোমাদের বাবা তোমাদের কতোই না ভালোবাসত।

সেদিন ভর দুপুরে তোমার বাবা দুইজন মেয়ে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন।আমি অনেক অনুনয় করেছিলাম, বুঝিয়েছিলাম তোমার বাবাকে কিন্তু তিনি আমার কোন কথা শুনে নি।সহ্য করতে না পেরে ঐ নোংড়া মেয়ে দুটোকে ধাক্কা মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম।রাগে অপমানে তোমার বাবাকে তারা ব্যবসা থেকে বহিষ্কার করবে বলে জানায়।আর তোমার বাবা সেই রাগ আমার উপর তোলে।হাতের কাছের মোটা বাঁশ দিয়ে এলোপাথাড়ি মেরেছিলো আমায়।এরপর আমার আধমরা শরীরে, বুকে, পেটে , তলপেটে গলগল করে ঢেলে দেয় সদ্য কিনে আনা এসিড। সেদিন তোমার রাহেলা চাচিও বাড়িতে ছিলেন না।আমার টিনা খেলতে গেছিলো আর তুমি স্কুলে।”

কথাগুলো বলতেই চোখের পানিতে বুক ভেসে যাচ্ছিলো শর্মিলার।পাখি এসে তাকে ধরে শান্তনা দেবার বৃথা চেষ্টা করে। শান হাতকে মুষ্ঠিবদ্ধ করে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে মেঝের টাইলসের দিকে।

“আরো আছে বউ মা।”,নিজেকে ধাতস্ত করে শর্মিলা আবার বলতে শুরু করেন।
“দুহাতে মুখ ঢেকে কাতরিয়েছি সেদিন। আশপাশ কেউ আসে নি।আসবে কি করে দুপুরের খাবারের পর সবাই ভাতঘুমে ব্যস্ত।আর বাড়ির দরজা জানালা লাগিয়ে তিনি আমায় নির্যাতন করতেন।ঝলসে গায়ের মাংস খসে খসে পড়ে যাচ্ছিলো। গলার নিচ থেকে জ্বলে যাচ্ছিলো।কাটা মুরগীর মতো কষ্ট পাচ্ছিলাম। আর তোমার বাবা পৈশাচিক আনন্দ নিয়ে সেসব উপভোগ করছিলেন।প্রাণপনে আল্লাহ্’র কাছে চাচ্ছিলাম কেউ একজন আসুক।কেউ একজন আসুক আমার সন্তানদের জন্যে হলেও আমাকে বাঁচতেই হবে।ঐ সময় কলিং বেল বেজে ওঠে।বিরক্তি নিয়ে তোমার বাবা গেইট খুলতে যান। আমি গলা ফাটিয়ে কয়েকটা চিৎকার করে থেমে যাই।এরপর আর কি হয়েছে আমার মনে নেই।

যখন জ্ঞান ফেরে বুঝতে পারি আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি।বুক থেকে পা পর্যন্ত ছাউনির মতো ঢেকে দেয়া আমার শরীর।চোখ খুলে দেখি আমজাদ খান আমার পাশে বসে আছেন।হয়ত আমার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন।আমায় চোখ খুলতে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েন তিনি।তাকে দেখে স্বভাবতই অবাক হই।এরপর সব ঘটনা খুলে বলেন তিনি

আমার বাড়িতে আমার খোঁজ নিতে,একটি বার দেখা করতে এসেছিলেন তিনি।গেইটে পা রাখতেই তোমার বাবা তাকে আটকে দেয়।আমার চিৎকারে তোমার বাবাকে এড়িয়ে ভিতরে ঢুকে তিনি আমায় ঐ অবস্থায় দেখতে পান।এরপর দ্রুত নিয়ে আসেন হাসপাতালে।

কেটে যায় পুরো একুশটা দিন।এর মাঝে জানতে পারি তোমার বাবা আমার নামে মিথ্যে অপবাদ দিয়েছেন।রাহেলার সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারি তোমার মনে ততোদিনে আমার জন্যে ঘৃনার প্রবালদ্বীপ গড়ে ফেলেছেন তোমার বাবা।আমার কলিজার টুকরা টিনাকেও নাকি আমেরিকা নিয়ে গেছে তোমার কাকা।বেঁচে থাকার মতো কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।অন্যদিকে নিজের ঝলসানো শরীর।এমন সময় বিপদের সঙ্গী হিসেবে পাশে দাঁড়ায় আমজাদ। ওর পরিবারে আশ্রয় দেয়।সাদরে আমায় গ্রহন করে আমজাদের মা ও ছোট বোন।তোমাদের ছেড়ে থাকাটা খুব কষ্ট সাধ্য ছিলো আমার জন্যে।অনেকভাবে অনেকবার তোমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। প্রতিবারই তোমার বাবার কাছে ধরা পরে যাই।এরপর আমায় ডিভোর্স দেয় তোমার বাবা।আমজাদের কথামতো আইনের সহযোগীতাও নিয়েছিলাম। ততোদিনে তোমার বাবার হাত আইনের সর্বচ্চ চূড়া অবধি উঠে গেছিলো।আমার জন্যে আমজাদ তার চাকরি হারাতে বসেছিলো।আর তোমার বাবা তোমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আমায় হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে বাধ্য করেছিলো বাপ।অগত্য সে পথেও আর পা বাড়াই নি।ভাগ্যকে মেনে নিয়ে ছিলাম।

আমজাদের মা বোন থাকা স্বত্বেও সমাজ আমার প্রতি আঙ্গুল তুলেছিলো।কালিমা লেপে দেয় গায়ে।উপায়ন্তর না পেয়ে সর্বজনের সম্মতিতে দ্বিতীয় বারের মতো সংসার শুরু করি আমজাদের সাথে। মানুষ টা ফেরেসতার মতো ঝলসানো এই আমিকে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছে।”

দুহাতে মুখ ঢেকে হুহুস্বরে কেঁদে ওঠেন শর্মিলা।এতোসব শুনে পাখি নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না।শর্মিলাকে ধরে কেঁদে ওঠে।শান হতভম্বের মতো ঠাঁয় বসে আছে।শরীরের কোষ গুলো মৃত প্রায়।দুই কান দিয়ে গরম বাতাস যেন সাঁইসাঁই করে বের হচ্ছে।বাবার জন্যে জমানো এতোদিনের সমস্ত বিশ্বাস, ভালোবাসার দেয়ালটা যেন খসে খসে পড়ছে একে একে।নিজের চোখে মায়ের ঝলসানো বুক পেট দেখে কোন কিছুই অবিশ্বাস করার জো নেই।তারপরেও বিশ্বাসযোগ্য নয় এতো ঘৃন্য কাহিনী।

শর্মিলা মুখ মুছে বলে,”তুমি শহরে আসার পর তোমাকে একনজর দেখতে চোখ যেন মরে যাচ্ছিলো।আমজাদ বুঝতে পেরেছিলো দিনে দিনে আমি কতোটা মরে যাচ্ছি ।আমজাদের বোনের বিয়ে হয়ে যায়,মা চলে যায় এরপর আমার জন্যে ঢাকা শহরে তোমার পাশের এলাকায় বাড়ি কিনে নেয়।বাপ আমার, তোমার বাবা পৃথিবীর সবথেকে ঘৃন্য ব্যক্তি ছিলো।সে তার গন্তব্যে পৌঁছেছে।তবে আমার মনের ঘৃনার ঘা গুলো এখনো দগদগে।চাইলেও ভুলতে পারছি না তার দেয়া কষ্ট গুলো।আমার হারানো ষোল বছর!মৃত মেয়েটার মুখটাও দেখতে পারিনি তোমার বাবার জন্যে।

সে বার ইনায়াহ্’র দেখাশোনা করতে টিনাকে আমার কাছে এনেছিলাম তখন আমার শরীরের এই ঝলসানো দাগগুলো নজড় এড়ায় নি আমার মেয়ের।হাউমাউ করে কেঁদেছিলো।ভেবেছিলো নতুন সংসারে সুখী নেই আমি।আমি চাইলেই বরাবরের মতো তোমার বাবার রূপটাকে আড়াল করতে পারতাম।করিনি, কারণ তার পাপের জন্যে নির্দোষ আমজাদ কেন অপবাদ নেবে।সবটা বলেছি আমার মেয়েকে।আর ততোদিনে সবটা বোঝার মতো উপযুক্ত হয়েছিলো আমার টিনা।টিনার মাধ্যমে বার বার সবটা তোমায় জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ততোদিনে আমার জন্যে ঘৃনা ছাড়া কিচ্ছু ছিলো না তোমার মনে।

কিন্তু আমি তো মা।তোমার প্রতিটা নিঃশ্বাসের খবর নিতাম তোমার রাহেলা চাচির থেকে।তোমার কলেজের প্রিন্সিপাল আমজাদের ফ্রেন্ড তার থেকে।অপেক্ষা করেছিলাম একটা নতুন ভোরের কবে এসে আগের মতো জড়িয়ে ধরবে।কিছুদিন পর জানতে পারি নীরা নামের একটা অসহায় মেয়ের প্রেমে পড়েছো তুমি।খুশি হয়েছিলাম ভীষণ।কারন আমার বিশ্বাস ছিলো কেউ একজন তোমার জীবনে আসবে যে তোমার সমস্ত কষ্ট ঘুচিয়ে দেবে।মনঃস্থির করলাম দেখা করব নীরার সাথে।তার আগেই জানতে পারি নীরাকে তোমার বাবা নিজের বশে করে নিয়েছে।ভীষণ লোভী ছিলো নীরা। সম্পদের লোভ দেখিয়ে মেয়েটাকে বিয়ে করে।হাজার হাজার বার বাড়োন করেছি যেন তোমার সাথে এ অন্যায় না করে। কিন্তু তোমার বাবা আমার কোন কথা শোনে নি।খুব উপদ্রব হয়েছিলো তার।আর আল্লাহ্ উপদ্রবকারীকে পছন্দ করেন না।বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যেই মৃত্যুর কাছে হেরে যায়।”

কিংকর্তব্যবিমূঢ় শানের শরীর থেকে আত্মা যেন বেরিয়ে যাবার উপক্রম আজ।মন বলছে মায়ের সবকথা ঠিক। তবুও কোথাও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার বাবা এতো টা নোংড়া ছিলেন।
রাগটা ভেতর থেকে আসলেও মায়ের মুখটা দেখে মিলিয়ে যায় সে রাগ।ঢোক গিলে শান্তস্বরে বলে,”বাবা শহরের বাহিরে থাকত,নেশা করত।আপনার জন্যে কষ্ট পেতো।সবটা তো আপনার জন্যে ছিলো!”
“না।আমার জন্যে নয়।পাছে তার গোপন ব্যবসার খোঁজ তুমি জানতে পারো তাই তিনি শহরের বাহিরে থেকে কাজ চালাতেন।তার ব্যবসা পরবর্তীতে নারী পাচারের মতো জঘন্য ব্যবসায় রূপ নেয়।শহরের বাহিরে থেকে তিনি মেয়ে যোগার করে আনতেন আর মোটা অঙ্কে বিদেশে পাচার করতেন।বর্তমানে যে ব্যবসার একচ্ছত্র মালকিন এখন নীরা।তবুও যদি বিশ্বাস না হয় খোঁজ নিয়ে জেনে নিও।”,ঝনঝনে গলায় বলে শর্মিলা।
#আসক্তি২
পর্বঃ৩৪
লেখায় আফিয়া আজাদ নিঝুম

ড্রয়িংরুমে পিনপতন নীরবতা।কিছুক্ষন পূর্বেও কতো মুখোরিত ছিলো চারিপাশ।তারপর কান্নার শব্দ আর খানিক পর সবটা শান্ত।কেউ কোন কথা বলছে না, কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসাও করছে না।শুধু কানে ভাসছে বাহিরের জনজীবনের শাব্দিক রূপ।শর্মিলা সোফার হাতলে ডান কনুই ঠিকেয়ে কপালে হাত দিয়ে মেঝের দিকে চেয়ে আছে।যেন কতো বছরের দায়িত্ব তার মাথা থেকে নেমে গেলো
শান একটু ঝুঁকে দুহাতে ঘাড়টা চেপে মাথাটা জড়িয়ে দুই হাঁটুর দিকে নিয়ে বসে আছে।

পাখি সবদিকটা দেখে রাহেলাকে ইশারা করলেন।রাহেলা উঠে একগ্লাস পানি এনে শর্মিলার সামনে ধরলেন।শান্তস্বরে ডাকলেন,”ম্যাডাম”
শর্মিলা চকিতে কপাল থেকে হাত সরিয়ে রাহেলার দিকে তাকালেন।হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিয়ে সবটুকু পানিই নিমিশেই শেষ করলেন।দেখে যে কেউই বুঝতে পারবে এই পানির জন্যেই তিনি অপেক্ষা করছিলেন এতোক্ষন।

পাখি শানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে এতো বড় ধাক্কাটা তিনি কিভাবে নেবেন।আজ তার শানকে বড্ডো চূর্ণ মনে হচ্ছে। কেমন যেন কলিজা ফেটে যাচ্ছে শানকে দেখে।শানের দিকে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ শান নড়ে ওঠে।আস্তে করে মাথাটা তুলে সামনে তাকায়।সেদিকে তাকিয়ে বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে পাখির।চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারন করেছে,চোখের পাপড়ি গুলো ভারী লাগছে যেন কতো শত বছরের ক্লান্ত পথিক সে।চোখের নিচে ফুলে উঠেছে।সেদিকে করূন চোখে তাকায় পাখি। কান্না সংবরন করা দায় যে তার!

শান পুরোপুরিভাবে মাথাটা তুলে কয়েকবার মাথাটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে স্বাভাবিক করে নেয়।এরপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পাখির দিকে তাকায়।টুপ করে দুফোটা জল গড়িয়ে পরে পাখির গাল বেয়ে।শান পরপর কয়েকবার নাকে ছিচকে শব্দ করে উঠে দাঁড়ায়।পাখিও পরপর কতোগুলো শুকনো ঢোক গিলে উঠে দাঁড়ায়।রাহেলা বসে আছে শর্মিলার পাশে।শান খুব ধীরে এমন ভাবে পা ফেলে পাখির দিকে আসছে যেন সারা রাস্তায় কাঁটা বিছানো,এদিক সেদিক হলেই কাঁটা ফুটবে পায়ে।পাখি হাত কচলাতে কচলাতে শানের দিকে পা বারায়।পাখির সামনে এসে দাঁড়ায় শান।দুহাতে চোখের পানি মুছিয়ে দেয় পাখির।আবার চোখ থেকে খসে পরে কয়েকফোটা অশ্রু।এরপর নিজের দুহাত রাখে পাখির দুই গালে।অপলক কিছুক্ষন চেয়ে থাকে।পাখি শুধু শানের চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছে।শান কি করতে চলেছে সেটাই বুঝতে চাইছে সে।

“আমরা অনেক দূরে চলে যাবো।এই তিনকুলে তোমারও কেউ নাই।আমারও কেউ নাই।আমরা দুজনে মিলে অনেক সুখের সংসার শুরু করব। যাবে আমার সাথে?আমি যেখানেই নিয়ে যাই!”,খুব শান্তভাবে কথাগুলো বলছে শান।তবুও পাখির বড্ডো ভয় করছে।ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছে সে।গালে রাখা শানের হাতদুটো দু’হাতে ধরে নেয় পাখি।ছলছলে চোখে কিছু বলতে যাবে তার আগে শান বলে,”এই পৃথিবীটা খুব নিষ্ঠুর পাখি।মিথ্যের কাঁটায় পরিপূর্ণ।আমি চাইনা তুমি এখানে থেকে মিথ্যে শিখো।তুমি তো সত্য। তুমি তো আমার জীবনের চিরন্তন ধ্রুবতারা।”

শর্মিলা আর রাহেলা অবাক হয়ে দেখছে শান কি করতে চলছে।

“আমার জীবন টা কেন এমন হলো বলো তো?”,বলেই শান চোখ মুখ খিঁচে নেয়।কয়েকবার কান্না সংবরনের বৃথা চেষ্টা করে শান।তাতে খুব একটা লাভ হয় না।কান্নারা যেন আজ উগড়ে আসতে চাচ্ছে।বার বার জোড় করে ভিতরে পাঠাচ্ছে শান।কারণ সে চায় না পাখির সামনে কেঁদে ফেলুক।মেয়েটা বড্ডো কষ্ট পাবে।শানের ওরকম অবস্থা দেখে নিজেকে আটকাতে পারে না পাখি। ঠোঁট টিপে চোখের পানি ছেড়ে দেয় করূনভাবে।

শান আবার মুছে দিয়ে বলে,”পাগলি, কষ্ট তো আমার হচ্ছে তুমি কেন কাঁদছো?জান আমার কলিজাটা পুরে যাচ্ছে জান।কলিজাটা পুরে যাচ্ছে আমার।”
শেষের কথাটা বেশ চিৎকার করে বলে শান।আব্দুল্লাহ্ এতোক্ষন বাড়ির বাহিরে ইনায়াহ্’কে খেলার ছলে আগলে রেখেছিলো।শানের চিৎকারে দৌঁড়ে ভিতরে আসতে বাধ্য হয় সে।এসেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

শান দুচোখ বন্ধ করে কয়েক ফোটা জল ছেড়ে দেয়।কাঁপা কাঁপা হাতে পাখি সেটা মুছিয়ে দেয়।
“আআপনি শাশান্ত হহোন প্লিজ”,কান্না জড়িয়ে আসা কন্ঠে বলে পাখি।

হঠাৎ শান সবাইকে অবাক করে দিয়ে পাখিকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।

“আমার জীবন এতো মিথ্যেয় ঘেরা কেন পাখি?আমার জন্ম টা কেন হলো পাখি?আমার নিজের বাবা কেন আমায় মানলেন না?কেন বিগত ষোলটা বছর আমার অনুভূতি গুলো ডুকরে উঠলো?কেন বাবা নামোক পিশাচ লোকটা আমায় মিথ্যে বললো?কেন আমার মা আরো আগে সত্যিগুলো জানাল না?কেন এতো ভালোবাসার পরেও সে অভিনয় করলো?
জান আমার এতো কেন’র উত্তর আমি কোথায় পাবো?”

বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে শান।এভাবে কখনোই কেউ শানকে কাঁদতে দেখেনি।রাহেলা মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে।আব্দুল্লাহ্ এগিয়ে আসতে শর্মিলা হাত উচিয়ে তাকে আটকে দেয়।শানের করা প্রতিটা কেন’র উত্তর তার কাছে জানা।তবুও ছেলের চোখের একেক ফোটা পানি যেন বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধছে তাকে।
শানের কান্নায় পাখিও হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।শানকে শান্তনা দেবার মতো কোন ভাষা তার জানা নেই।শুধু এটুকু বুঝেছে এই মানুষটাকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখা তার কর্তব্য। তার উপর অর্পিত ফরজ দায়িত্ব।শানের পিঠে আলতো করে হাত বুলাতে শর্মিলা বাজখাঁই কন্ঠে বলে ওঠেন,”বউ মা কাঁদতে দাও ওকে।এতোদিনের জমানো কষ্ট গুলো উগড়াতে দাও।থামিয়ে দিও না”

শানের কান্নার শব্দে মুখোরিত চারিপাশ।দেয়ালের প্রতিটা ইট যেন ডুকরে ডুকরে কাঁদছে আজ।এ কোন নতুন সত্যের মুখোমুখি সে?যে সত্যকে সামনে আসতে ষোলটা বছর খোয়াতে হলো?এমন সত্য মিথ্যের আড়ালে চাপা থাকাই বোধহয় ভালো ছিলো।

পাখির কাঁধ ভিজে গেছে শানের চোখের মুখের পানিতে।সেদিকে একটুও খেয়াল নেই কারোরই।পাখির বুকের ভিতরে হওয়া চিনচিনে ব্যথাটা এবার প্রবল আকাড় ধারন করলো।মনে হচ্ছে যেন শানের কান্নাগুলো বিশাল বড় হাতুড়ির মতো পেটাচ্ছে তার বুকে।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে পাখির।নিজেকে ধাতস্থ করে শানের কানের কাছে মুখটা এনে বলে,”এভাবে কাঁদবেন না ডাক্তার সাহেব, আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে”

পাখির কথায় যেন কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায় শানের।কিছুক্ষন পরে চট করে পাখিকে ছেড়ে দেয় শান।অবাক হয় পাখি।দৌঁড়ে চলে যায় শান উপরতলার দিকে। ভয়ার্ত চোখে পাখি পিছন পিছন গেলে শর্মিলা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলেন,”ভয় পেও না বউ মা।আমার ছেলে তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে।আর যারা ভালোবাসতে জানে তারা কখনো আত্মহনন করতে পারে না”

শর্মিলার কথা শেষ হতে না হতেই শান একটা প্যাকেটে করে কিছু নিয়ে আসে।প্যাকেট টা হাতে নিয়ে খুব ধীরপায়ে শর্মিলার পায়ের কাছে এসে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে পরে।সবাই অবাক হয়ে চেয়ে দেখছে শানের কর্মকান্ড। ইনায়াহ্ আব্দুল্লাহর কোলে ঠোঁট টিপে কেঁদে চলেছে নিঃশব্দে।

কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকেট থেকে একটা স্বর্ণের চিকোন চুড়ি বের করে সামনে ধরে শান।
“এএটার ককথা মনে আছে আপনার?”

শর্মিলা মরিয়া হয়ে চুড়িটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে।চকচক করে ওঠে চোখদুটো।চোখে এক সমুদ্র অশ্রু নিয়ে মাথা উপর নিচ করে বলে,”হ্যাএএ”
“বাবা আমার হাত খরচের যে টাকা দিতো সেটা থেকে বাঁচিয়ে আপনার জন্যে রতন কাকার দোকান থেকে গড়িয়ে দিয়েছিলাম।অবশ্য কিছুদিন পর জানতে পারি জোড়ার একটা নাকি হারিয়ে ফেলেছেন”
তৎক্ষনাৎ শর্মিলা নিজের হাত দুটো শাড়ির আঁচল থেকে উন্মুক্ত করে শানকে দেখায়।বাঁ হাতে একটা চুড়ি ঠিক সেরকমই যেরকম শানের হাতে।মুচকি হেসে শান বলে,”হারিয়ে যাওয়ার পর শত খুঁজেও পান নি।আর আপনার চলে যাওয়ার পর আমরা যখন ঢাকা আসব তখন ব্যাগ গুছানোর সময় এটা পাই। এতোগুলো দিন এটা আমার কাছে ছিলো”

শর্মিলা ঠোঁট টিপে কান্না সামলিয়ে বলে,”আর আমি এই একটা চুড়িতে ষোলটা বছর কাটিয়ে এলাম বাপ”
শান চোখের কোণা দুটো দুই আঙ্গুলে চেপে নাকে ছিচকে শব্দ করে আবার লাল প্যাকেটটার ভিতরে হাত রাখে।হাতে করে নিয়ে আসে একটা কাঁজলের কৌটা।হাতের তালুতে নিয়ে শান শর্মিলার সামনে ধরে।
“রোজ রোজ আপনার চোখে কাঁজল দেখতাম।জানি না কেন কাঁজল পরতেন মোটা করে।তাই আপনার চলে আসার দিন রহিম কাকার দোকান থেকে এই কৌটাটা কিনে নিয়েছিলাম।বাড়ি এসে জানকে পারি আপনি নেই”

সে সময় কৌটার কাঁজল মানে অনেক বেশি কিছু।

শর্মিলা গন্ডো বেয়ে নেমে আসা চোখের ধারাটা দুহাতের তালুতে মুছে বলেন,”রোজ রাতে কাঁদতাম।রাজ জেগে থাকতাম। তোমার বাবা নেশা করে এসে একটু চুন থেকে পান খসলেই সারারাত আমায় দিয়ে বডি ম্যাসাজ করে নিতো,অন্ধকার রাতে উঠানে দাঁড় করিয়ে রাখত রাতে ঘুমাতে পারতাম না, দিনেও সেটার উসুল হতো না;তোমাদের যত্ন নিতে,সংসারের ঘানি টানতে। চোখের নিচে মোটা কালি পরেছিলো। তাই কাঁজলের আবরনে ঢেকে চলতাম”

শান একধ্যানে চেয়ে কথাগুলো শুনছিলো।কথা শেষে প্যাকেটটায় আবার হাত দেয়। এবার একটা পুরোনো দিনের খসখসে সুতি শাড়ি বের করে আনে।

পাখি ভ্রুকুচকে চেয়ে থাকে শাড়িটার দিকে।চেনা চেনা মনে হচ্ছে তার।

শাড়িটা শর্মিলার সামনে ধরে বলে,”আপনার কাপড়ের মাঝে এটা আমার পছন্দের ছিলো।যেটা আপনি প্রতি শুক্রবার করে পড়তেন”

এতোক্ষনে চিনতে পেরেছে পাখি।এটা তো সেই শাড়ি যেটা এ বাড়িতে আসার প্রথম দিন শান ওকে পরতে দিয়েছিলো।

শর্মিলা শাড়িটাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। নিঃশব্দে কেঁদে চেলেছে অনবরত।তাকে দেখে বুঝাই যাচ্ছে ভদ্র মহিলা গত ষোল বছরে কতোটা শক্ত হয়ে গিয়েছে।

“আজ তো শুক্রবার, একটি বারের জন্যে কাপড় টা পড়বেন?”,অনুনয়মাখা কন্ঠে বলে শান।
রাহেলা বিনা বাক্য ব্যয়ে শর্মিলার হাত টেনে নিয়ে যায় নিজের ঘরে।থতমত খেয়ে শর্মিলা রাহেলার দিকে চলে যায়।পাখি সেদিকে চেয়ে শানের পাশে এসে বসে।কাঁধে হাত রাখতেই চমকে পাশ ফেরে শান।হাত টা টেনে এনে হাতের উল্টোপিঠে চুমু এঁকে দেয়।পাখির চোখ মুছিয়ে বলে,”এভাবে কাঁদবে না।আমি নিজের টা সামলে নিতে পারব। তোমার টা পারব না”

আব্দুল্লাহ্’র কোল থেকে ইনায়াহ্ নেমে আসে শান পাখির কাছে।শান ঘুরে কোলে বসায় ওকে।দুই গালে চুমু খেয়ে বলে,”কাঁদে না মা। আমার মেয়ে কতো স্ট্রং তাই না”
বলতেই শানের গলা জড়িয়ে ধরে ইনায়াহ্।কেঁদে কেঁদে বলে,”তুমি কাঁদবে না সান সাইন।আমার খুব কষ্ট হয়”
শান চোখ বন্ধ করে ইনায়াহ্’র মাথা বুলিয়ে দেয়।

কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে শর্মিলা।পাখি সেদিকে তাকাতেই তার নজর অনুসরন করে শানও সেদিকে তাকায়।থমকে যায় চোখ দুটো।

চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের সে দিনগুলো।মা শাড়িটা পড়ে বাড়ির এটা ওটা করছে।আর শান বার বার বলছে,”এই শাড়িতে তোমায় অনেক সুন্দর লাগছে আম্মা।একদম ঐশ্বরিয়া রায়”
মাথায় গাট্টা মেরে কান চেপে শর্মিলা বললো,”খুব পেকে গেছিস না”
“আউচচ আম্মা ব্যথা লাগে”

“বাবু”

হঠাৎ নিজের পুরোনো নাম টা কানে ভেসে আসে শানের।ভাবনার জগত তাকে যেন ধাক্কা মেরে বের করে দিলো কেউ।সম্বিৎ ফিরে পা থেকে মাথা অবধি দেখে নিলো তার জীবনের প্রথম নারী ;তার মাকে।

অজান্তেই ঠোঁটের ডগায় ফুটে উঠলো,”আম্মা”
শর্মিলার উৎসুক চোখ মুখে ভারী বর্ষন নেমে এলো।যেন পানিতে থৈথৈ করে উঠলো চারিপাশে।মূহুর্তেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন শর্মিলা।সাথে সাথে ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়ে গেলো তার চারপাশের মিথ্যে শক্ত খোলসটা।বেরিয়ে এলো সিন্ধুকে তালাবদ্ধ সেই মাতৃসত্ত্বা।আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো নিজের ছেলেকে।আকাশ বাতাস আরেক দফা ভারী হয়ে উঠলো যেন।
মায়ের গায়ের গন্ধটা প্রাণ ভরে শুষে নিলো শান।ছোট বাচ্চাদের কাঁধে মাথা শুয়ে বলে,”তোমায় একদম ঐশ্বরিয়া রায়ের মতো লাগছে আম্মা”

শর্মিলা ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে।কারণ তিনি বুঝেছেন ঝড়টা দরজায় এসে গেছে।ছেলেকে এবার সামলানোর পালা।

“আম্মা,ও আম্মা।আম্মা গো….এমন কেন হলো আম্মা।আমরা তো সুখে ছিলাম আম্মা”

“আব্বা, আমরা সুখের অভিনয় করেছিলাম”

“আম্মা আমি প্রত্যেকটা রাত কেঁদেছি আম্মা।তুমি জানবে না আম্মা আমি আঁধারের রাতগুলো কিভাবে কাটিয়েছে।বাবা বাসায় ফিরত না।চাচিও চলে যেত সন্ধ্যায়।আমি ডুকরে ডুকরে কেঁদেছি আম্মা।আম্মা ষোলটা বছর কেন এমন করে তোমায় ছাড়া কেটে গেলো?আম্মা আরো আগে কি সবটা জানানো যেত না।বলো না আম্মা।আম্মা আমার কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে।
তোমার শাড়ি চুড়ি কাজল হাতে নিয়ে রাতের পর রাত ঘুমিয়েছি আম্মা।ভাবতাম ভোর হলে সবটা আগের মতো হবে, হয় নি আম্মা।ধীরে ধীরে বিগড়ে গেছিলো সবটা।আম্মা আমার পড়া মাথায় ঢুকত না।বোর্ড এক্সাম দিতে খুব কষ্ট হইছে আম্মা।সবাই কেন আমায় এভাবে ঠকালে আম্মা।সত্যিটা না জানলে জীবন কি চলত না আম্মা।শেষমেশ এই বয়সে এসে কেন জানলাম সবটা।মানুষটা মরার আগে কেন জানলাম না?”

শানের ঐ অবস্থা দেখে ভয়ে আতঙ্কে মেঝেতে পা দাপিয়ে কাঁদছে ইনায়াহ্।পাখি দৌঁড়ে গিয়ে বুকে পিষে নেয়।

শর্মিলা বুঝতে পেরেছেন এই মূহূর্তে তিনি কিছুতেই ছেলেকে শান্ত করতে পারবে না ।তাই কাঁদতে দিলেন প্রাণ ভরে।

“আম্মা মানুষটা সে বার প্রথম যখন হ্যাটাক করলো, তখনো মূমূর্ষ অবস্থায় বলেছিলো যাতে তোমার সাথে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করি।এতো নিখুঁত অভিনয় মানুষ কেমনে করে আম্মা?”

দীর্ঘসময় ধরে কাঁদছে শান।এবার শ্বাসের গতি ভারী হয়ে আসে শানে।নিমিশেই বন্ধ হয় শানের প্রলাপ। শর্মিলার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়।আতঙ্কিত চোখে মুখে পাখি, রাহেলা আর আব্দুল্লাহর দিকে তাকায়।
“মা কি হয়েছে,উনি চুপ কেন। মা?

“বাবু,এ বাবু।আব্দুল্লাহ্ ডাক্তারকে কল করো”

দিগ্বিদিক চিন্তা না করে আব্দুল্লাহ্ ডাক্তারের কাছে কল করে।সবাই মিলে ধরে পাশের সোফায় শুয়ে দেয় শানকে।পাখি বুঝতেছে না কি থেকে কি হয়ে গেলো।শানের হাত পা ঠান্ডায় জমে গিয়েছে যেন।দ্রুত উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় পাখি।একটা রসুন থেঁতলে বাটিতে সরিষার তেল ঢেলে চুলার আঁচে থেঁতলানো রসুন টা সমেত তেলটা গরম করে নেয়।এরপর দ্রুত ছুটে এসে শানের হাতে পায়ের তালুতে ম্যাসাজ করা শুরু করে।ওর দেখাদেখি রাহেলাও আরেক হাতে একই কাজ করে।শর্মিলা কি দেখে বিষম খাবে বুঝতে পারছে না।নিজের প্রতি ছেলের এতোদিনের জমানো কষ্টের প্রতিক্রিয়া দেখে নাকি ছেলের প্রতি পাখির অগাধ ভালোবাসা দেখে।

মূহূর্তেই ডাক্তার নাদিম চলে আসে বাড়িতে।শানকে দেখে খুব গম্ভীর মুখে তিনি বলেন, “কোন ব্যপারে খুব শক্ড তিনি।আর শক্ড থেকেই এই প্রতিক্রিয়া। দূঃচিন্তা করবেন না।তেমন মেজর কিছু না।…..এই ইঞ্জেকশন টা নিয়ে আসুন।সামনের দোকানেও পাবেন”
বলেই প্রেসক্রিপশন টা এগিয়ে দেয় আব্দুল্লাহ্’র দিকে।

আব্দুল্লাহ্ কোন সময় নষ্ট ছাড়া দ্রুত দৌঁড়ে চলে যায় গেইটের বাইরে।দুই কদম হাঁটলে সামনেই ফার্মাসি।প্রেসক্রিপশন এগিয়ে ইঞ্জেকশন টা নিয়ে আসে।হাফাতে হাফাতে ডাক্তারকে দেয়।

“আপনারা ঘাবড়াবেন না।আমি ঘুমের ইঞ্জেকশন টা দিলাম।এর মাঝে কেউ উনাকে ডাকবেন না।বা জাগানোর চেষ্টা করবেন না। উনার শরীরও অনেকটা দূর্বল।আর বাকিটা আমি শানের সাথে কথা বলে নেবো। “,শানের শরীরে ইঞ্জেকশন পুষ করতে করতে বলে ডাক্তার নাদিম।পাখি চোখ ঘুরিয়ে চোখমুখ খিঁচে ফেলে।

শর্মিলা সেদিকে দেখে আনমনে হেসে ওঠে।এই সময় কি হাসা উচিত?মনে তো হচ্ছে, না।তবে সে কেন হাসছে?ছেলের প্রতি কোন মেয়ের এমন ভালোবাসা দেখেই হয়ত অনুভূতিটা হাসি হয়ে বের হলো

আব্দুল্লাহ্’র সহযোগীতায় শানকে ঘরে নিয়ে আসে পাখি।

🌸🌸

সেই যে বিকেলে ঘুমিয়েছে শান এখন রাত হয়ে এলো তবুও উঠতে পারে নি।ডাক্তারের কথামতো কেউ তাকে ডাকে নি।বার কয়েক শর্মিলা এসে দেখে গেছে, মাথায় হাত বুলিয়েছে,কপালে অজস্র চুমুর যেন শেষ নেই।রাহেলা সেসব দেখে চক্ষুশীতল করে নেয়।এ দৃশ্য আজ কতোটা বছর দেখছে সে।

রাতের রান্নায় ব্যস্ত রাহেলা আর শর্মিলা।শান ঘুমাচ্ছে পাখি একা একা ঘরে হাফিয়ে উঠেছে।নিচে এসে একবার সুধালো,”মা আমি একটু হেল্প করি?”

“উহু, আজ আমি নিজে হাতে আমার ছেলের জন্যে রাঁধব।আর সাহায্য করবে রাহেলা”,কাঠখোট্টা ভাবে জবাব দিলো শর্মিলা।থমথমে মুখে ফস করে পাখি বলেও ফেলল,”ওহহহ বুঝেছি,অতীতে ফিরতে চান তো।মানে তখন তো আমি ছিলাম না তাই এখনও আমায় রাখতে চাচ্ছেন না”

শর্মিলা কাজ থামিয়ে পাখির সামনে এসে দাঁড়ায়।টেনে এনে বসায় কিচেন ডেস্কের উপর। ঝুঁকে গিয়ে বলে,”আমার অতীত, আমার অনেক বড় শিক্ষা।সে অতীতে তুমি নেই আমি এতেই খুশি।তখন থাকলে হয়ত সময়ের স্রোতে তোমাকেও হারাতাম।”

নিজের কাজে আবার মনোযোগ দিয়ে শর্মিলা বলে,”শোন মেয়ে,তোমার ওয়ান এন্ড অনলি কাজই হলো আমার ছেলেকে অনেকটা ভালোবাসা।তাকে আগলে রাখা।এখন ঘরে যাও। রাত যেহেতু হয়েছে বাবুর কখন ঘুম ভাঙ্গে বলা যায় না।চোখ খুলে যেন তোমাকেই দেখতে পায়”

পাখি মুচকি হেসে রাহেলার দিকে তাকায়।রাহেলা হেসে জবাব দেয়,”কি বলেছিলাম বউ মা, আমার ম্যাডামের মতো মানুষ হাজারেও পাবে না”
“হ্যাহহ, হইছে দজ্জাল শ্বাশুরি”,বলেই পাখি এক দন্ড সেখানে দাঁড়ালো না।
এদিকে শর্মিলা থ হয়ে পাখির যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে।

“রাহেলা এই মেয়ে মজা করতেও জানে?”
“কি বলেন ম্যাডাম,ও তো অলরাউন্ডার ”

বলেই শব্দ করে হেসে ওঠে দুজনেই।

🌸🌸

“দিদা তোমার ফোন বাজছে”,ফোন হাতে হাফাতে হাফাতে বলে ইনায়াহ্।
“কে ফোন করেছে? ”
“দাদুভাই ও বাড়ির থেকে ফোন করেছে”

শর্মিলা জিহ্ব কেটে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ফোনটা হাতে নিলেন।
“হ্যালো”
“ও বাড়ি গিয়ে ভুলে গেলে বুঝি”
“মাফ করবেন, বাবু অসুস্থ্য হওয়ায়…….”
“কি হয়েছে শানের?”
“এতোদিনের জমানো বিশ্বাস টা ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেছে, বাবু আমার নিতে পারে নি”,দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে শর্মিলা।
“সব মিটে গেছে তাহলে!এখন কি তবে ছেলের কাছেই থাকবে?”
“আমার ছেলেকে আমার থেকেও বেশি আগলে রাখার, যত্নে রাখার মানুষ পেয়েছে আমার বাবু।কিন্তু আমার বুড়া রিটায়ার্ড খান সাহেবের জন্যে এরকম কাউকে পাই নি এখনো।পাইলে তখন না হয়……”

শর্মিলার কথায় শব্দ করে হেসে ওঠে আমজাদ খান।এতোক্ষন ধরে বুকের কোথাও চিনচিনে ব্যথাটা একটু কমে গেলো মনে হয় শর্মিলার রসিকতায়।
রাত হওয়ায় খান সাহেব ধরেই নিয়েছিলেন শর্মিলা বোধহয় আর ফিরবে না তার কাছে।অনেক অভিমান জমা হয় মনে।অভিমানগুলোকে দূরে রেখে তাই কল করে শর্মিলাকে।

“এতো জোড়ে হাসবেন না খান সাহেব”
“আসছো কবে?”
“আগামিকালই”

🌸🌸

পাখি তখন থেকে ঘরে পায়চারী করছে আর মাথা উচিয়ে দেখছে শানের ঘুম ভাঙ্গে কিনা।একটু পর জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।দুপুরে গোসলের পর চুলগুলো বেঁধেছে; শুকানো হয়নি আর।তাই চুল ছেড়ে দাঁড়িয়ে দেখছে নিচের দিকে।

পিটপিট করে চোখ খোলে শানের।মাথাটা খুব ভার লাগছে।মাথার ভেতর কি যেন সব কিলবিল করছে।মাথা চেপে ধরে চারিদিকে তাকাতেই বুঝতে পারে রাত হয়েছে।জানলার দিকে চোখ পড়তেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।পিছনের সমস্ত কষ্ট,যন্ত্রনা সব যেন স্মৃতি থেকে মুছে গেছে একটা ঘুমের বিনিময়ে।খুব সাবধানে পা ফেলে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে পাখিকে।কাঁধের কাছে নাকটা রেখে জোড়ে শ্বাস নেয়।হকচকিয়ে ওঠে পাখি।

“কখন উঠলেন?”
“এইত”

পাখি আর কিছু বলতে পারে না। কারন ডাক্তার বলে গেছে তাকে যেন বেশি মানসিক চাপ দেয়া না হয়।কিন্তু পাখির মনে ভাবনার অন্ত নেই।
“তিনি কি আবার কষ্ট পাবেন?

“মা কোথায়?”
শানের কথায় চমকে ওঠে পাখি।সাবলিল ভাবে বলে “আচ্ছা মা নাকি আম্মা! কোনটা?”
“দুটোই।কারণ আমি দুটোই ডাকতাম”
“ছেলের জন্যে রান্না করছেন।আমায় তো রান্নাঘরে ঢুকতেই দিলো না।একদিনেই আমার সংসার দখল করে নিলো।”
“তুমি কি কান ভাঙ্গাচ্ছো আমার?”,সরুচোখে প্রশ্ন করে শান।

সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পাখি বলে,”বলে কিনা তোমার দায়িত্ব আমার ছেলেকে সামলানো।আরে বাবা তার ছেলে কি ছোট নাকি যে তাকে সামলাতে হবে!”

শান পাখির কথায় শব্দ করে হেসে আরো জোড়ে শক্ত করে চেপে ধরে।চোখ মুখ খিচে পাখি বলে,”আপনি একটা, আপনি একটা অসভ্য…..”

একটু পরে ওকে ছেড়ে দেয় শান।জানলার গ্রিল ধরে বলে,”আমি সন্তান হিসেবে অযোগ্য পাখি ”

চলবে…….
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here