ইচ্ছেমতি পর্ব -০৫

#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_৫
#শামছুন্নাহার

ফরিনা বেগমের মুখে মিহির চলে যাওয়ার কথা শুনে ওয়াসিফ কি চমকে গেলো?না,একদমই না। বরং মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো ওয়াসিফ। হাত দুটো ওপরে উঠিয়ে শরীর টানা দিয়ে বললো-“তুমি ভুল জানো আম্মু মিহি আজকে যাবে না। কারন মৃদুল ভাই আজকে ওবাড়িতে যাচ্ছে না।”
ছেলের কথায় ফরিনা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন-“আমি একবারও বলছি যে মৃদুল আজকে যাবে?”
ওয়াসিফ কিছু বলার আগেই তিনি ফের শুধালেন
— “মিহি আজকে চলে যাবে। মৃদুল,নতুন বউ আগামী শুক্রবার যাবে। আরো চারদিন পর বুঝলি?”
—“আম্মু তুমি ওরে আটকাবে না? আম্মু ছেলের কথা চিন্তা করে অন্তত ছেলের বউকে আটকাও। প্লিজ মা এমন করিও না। তুমি জোড় করলেই ও থাকবে প্লি…জ!”

হঠাৎ ওয়াসিফের এমন আহ্লাদী কন্ঠে প্রিয়তমা থাকার অনুরোধে ফরিনা বেগম না হেসে পারলেন না। মুখে হাসি রেখেই ওয়াসিফের শেষ করা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন -“পারবো না সর! আমি ঈশা নয় যে ঘুষ দিলেই পটে যাবো।”
বলেই তিনি বের হয়ে গেলেন। পিছনে ওয়াসিফের বারবার বলা -“আম্মু” ডাক শুনেও শুনলো না।

মিহির চলে যাওয়া ব্যাপারটা ওয়াসিফের ভালো লাগছে না,একদমই না। কি করবোএখন? “ভালবাসি”কথাটাও বলা বাকি! আম্মু কি এবার সাহায্য করবে না? তাহলে আটকানোর উপায়? এই মূহুর্তে বিষয়টা সহজভাবে নিতে পারছে না ওয়াসিফ। যে করেই হোক মিহিকে আটকাতে হবে,অন্তত শুক্রবার অব্দি থাকুক। শনিবারে তো ঢাকা চলেই যাবে তারা। তারপর? ঢাকায় কিভাবে দেখবে ওকে? দেখা যাবে তখন। কিন্তু এখন কি করে আটকানো যায়? ঈশা? ইয়েস ঈশাকে দিয়ে কাজ টা করাতে হবে,আমার লক্ষী বোন। ঈশার কথা মাথায় আসতেই আর কিছু না ভেবে দৌড়ে ছুটলো ঈশার রুমে।

ঈশার রুমে আসতেই দেখলো দরজা খোলা কিন্তু দরজা ভেড়ানো। দু’বার নক করে যখন কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না আস্তে করে দরজাটা একটু ফাক করলো ওয়াসিফ। রুমের দরজা- জানালা এখনো খুলেনি ঈশা। অন্ধকার হলেও থাইগ্লাস দিয়ে বাহিরের আলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওয়াসিফ রুমে প্রবেশ করল।ঈশার রুমের বারান্দার দরজা খোলা। সেখান থেকে পড়ার আওয়াজ আসছে। এমনভাবে পড়ছে যেন কেউ কারো কানের কাছে ফিসফিস করে কথা বলছে। ঈশা পড়ছে? তাহলে শুয়ে আছে কে? ওয়াসিফ ভাবলো। এমন সময় ওপাশ ফিরে থাকা মিহি এপাশ ফিরতেই থমকে গেলো ওয়াসিফ। মিহির অবাধ্য চুলগুলো মুখে এসে পরেছে। এই প্রথম মিহিকে এভাবে দেখছে সে,খোলা চুলে। মিহি সবসময় ঘুমটা দিয়ে থাকে তাই না দেখার কারন এটা। ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখে মিহিকে বাচ্চা লাগছে, ভীষন মায়াবী,আহা! ওয়াসিফের ইচ্ছে হল মিহির অবাধ্য চুলগুলো সরিয়ে ওর কপালে ভরসার একটা স্পর্শ একে দিতে। কিন্তু তা কি আধো সম্ভব?

ইচ্ছে করছে এখানে দাড়িয়ে থেকে ওর ঘুমন্ত নিষ্পাপ চেয়ারায় তাকিয়ে থাকতে। মিহি আবার নড়তেই ওয়াসিফের ধ্যান ভাঙ্গলো। মিহি উঠে যাবে বলে ঈশার মতো পা টিপে টিপে বারান্দায় পা রাখে ওয়াসিফ। ভাইকে দেখে ঈশা বই বন্ধ করে দিল। চেয়ারের পাশে থাকা টুল টা এগিয়ে দিয়ে বসতে ইশারা করে। ওয়াসিফ চুপচাপ বসে পড়ে। ঈশা স্মিত হেসে বলে-” এত সকালে তুমি এখানে? কিছু বলবে?”
ওয়াসিফ একবার রুমে তাকিয়ে মিহিকে দেখে নিল।কিছু বলতে যাবে তখনই ঈশা হাই তোলবার ভঙ্গিতে শুধালো-“নাকি প্রিয়তমাকে দেখতে এসেছ?”
ঈশার মাথায় টোকা মেরে ওয়াসিফ বললো- ” প্রিয়তমা আছে যেহেতু দেখবই,এটাই স্বাভাবিক নয় কি?”
ঈশা মুচকি হেসে বললো-“যা বলবেন আস্তে বলুন। নাহলে আপনার প্রিয়তমা উঠে যাবে!”
—” আগে বল এখন পড়তে বসেছিস? ” ভ্রু কুঁচকে তাকালো ওয়াসিফ।
—“সোমবার থেকে পরিক্ষা শুরু মনে হয়,যদিও রুটিন দেওয়া হয়নি। ফাইনালের আগে একটা পরিক্ষা নিতে চায় স্যাররা। অনুষ্ঠানের জন্য তো পড়া হয় না,বেশিদিনও তো নেই তাই এখন বসলাম।”
—” শুন একটা দরকারে আসছি!”
—” এই সকালে আমার রুমে আসতেই বুঝেছি। তা কি দরকার বলো!”
—“তোর ভাবী আজ চলে যাচ্ছে। যে করেই হোক আটকা ঈশা।” বিনয়ের সাথে বলছে ওয়াসিফ।
—“এটা তোমায় কে বললো? ভাবী তো আজকে যাবেই না। মৃদুল ভাই বলেছে ভাইয়া ভাবীকে নিয়ে পরে যাবে,সম্ভবত আগামী শুক্রবারে।”
—” তুই কার কথা বলছিস? মৃদুলের বউ মিলি ভাবীর কথা?”
—“হ্যা। আমার ভাবী তো ওনিই।”
কথাটা বলতে দেরি ওয়াসিফের হাতে মাথায় আরেকটা ভারি খেতে দেরি না। মুখ কুঁচকে ঈশা বললো
– “উফফফ ভাইয়া ব্যথা পাইনি বুঝি? মিথ্যে বলেছি নাকি যেভাবে তাকাচ্ছো?”
—” ওরে ঈশু তুই চুপ কর! আমি মিহির কথা বলেছি আর আস্তে কথা বল।”
—” মিহি আপু কি আমার ভাবী হয়?” কোন ভাইয়ের বউ শুনি, মিহাদ ভাইয়ের?
—” ফালতু বকিস না! মিহাদের হতে যাবে কেন? আমার হতে পারে না?আমি তোর ভাই না?”
ওয়াসিফের কথায় ঈশা ফিক করে হেসে দিল।আওয়াজটা একটু জোড়ে হতেই ওয়াসিফ ঈশার মুখ চেপে ধরে। চোখ পাকিয়ে তাকায়। ঈশা বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেলো। হাসি বন্ধ করে ফিসফিস করে বলে- “টেনশন করো না,যাও এখন। মিহি আপুকে রাখার ব্যবস্থা করছি।”
খুশিতে ওয়াসিফ ঈশাকে জড়িয়ে ধরে বললো- ” আমি জানতাম তোর কাছে এলে খালি হাতে ফিরবো না,ধন্যবাদ টুবলি!”
ভাইয়ার মুখে হাসি দেখে ঈশাও হাসলো। ওয়াসিফ ওঠে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য বারান্দা ত্যাগ করল।যাওয়ার সময় ঘুমন্ত প্রিয়তমাকে আরেকবার পরখ করে নিল সে।

ওয়াসিফ যাওয়ার পরেই মিহি ঘুম থেকে উঠলো। ফ্রেশ হতে হতেই ঈশা বইগুলো আগের জায়গায় গুছিয়ে রেখে দিয়েছে। পড়া শেষ,নাস্তার জন্য মায়ের ডাক পড়েছে,নাস্তা করবে এখন।

সবাই নাস্তা করছে। আলোচনা -তাড়াতাড়ি কমিউনিটি সেন্টারে যাবে,তাড়াতাড়ি রেডি হবে,কে কি পড়বে এসব। খাওয়া শেষে ওয়াসিফ,মৃদুল কোথায় যেন বের হল। মিলি রুমে চলে গেছে। ইলমা, ঈশা,মিহি ফরিনা বেগম ও তার ছোট বোন ফিরুজা বেগম বসে গল্প করছে। ঈশার ফুফুর মোবাইলে কল আসাতে তিনি ওঠে গেছেন। ফরিদা বেগম তার নাতনি ঐশির সাথে খেলা করছেন।

মিলি কাপড় গোছাচ্ছে। এমন সময় মৃদুল রুমে আসে। দুজন দুজনকে দেখে মুচকি হাসলো। মিলি বললো
— “আপনি কোন কোন কাপড় নিবেন এদিকে দিন গুছিয়ে নেই।”
—“মানে?তোমাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলছো?”
—“জ্বী মশাই!”
—“আজকে তো আমরা যাচ্ছি না”।
মিলি মৃদুলের দিকে তাকিয়ে মন খারাপের মতো করে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে–“যাচ্ছি না মানে? আড়াই দিনে আড়োইল্লা( আমাদের ভাষায় এটা বলে,বাকিদেরটা আমার জানা নেই) হয়। তাহলে কেন যাবো না?”
মৃদুল মিহির পাশে এসে বসলো,বললো–“যাবো না কে বলেছে? যাবো তো তবে আজকে যাবোনা”।
—” কবে যাবেন?”
—“যেদিন তোমার লজ্জাকে একেবারে খুন করতে পারি সেদিন।”
মৃদুল দুষ্টুমির হাসি হেসে মিলির দিকে তাকায়। মিলি কি লজ্জা পেল? হ্যা। মুচকি হেসে সেও মাথা নত করে ফেলেছে। হাসিটা দমে নিয়ে মৃদুলের দিকে তাকিয়ে বললো —“মজা নিচ্ছেন?”
মৃদুলের ছোট্ট উত্তর -“একদম না”।

মিলিরা আজ যাচ্ছে না। মনে পড়া মাত্রই ফের মন খারাপ করে ফেলেছে মিলি। মৃদুল লক্ষ করেছে। মিলির সোজাসুজি বসে মিলির দুই বাহুতে ধরে মৃদুল। মিলি তবুও তাকায়নি,দৃষ্টি নিচের দিকে। মৃদুল একহাতে মিলির থুতনিতে রেখে মুখটা ওপরে তুলে তার চোখে চোখ রেখে শুধালো –“রাগ করেছো পাখি?”
—“না,আচ্ছা মিহি কি চলে যাবে নাকি আমাদের সাথে যাবে?”
—“মিহি আজ চলে যাওয়ার কথা,ও যদি থাকে থাকবে। এটা ওর খুশি।”
—“ও থাকুক প্লি…জ?” মিলির আহ্লাদী অনুরোধে মৃদুল যেন আরেকবার মিলির প্রেমে পড়লো। মিলিকে বুকে নিয়ে মৃদুল বলে-“থাকবে। আমার পাখি যেহেতু চায় মিহি যাবে না। আমি বাধা দিবো দরকার পরলে!এবার আমার বিবি কি খুশি?”
—“হুম খুউউব।”

সকাল ১১বেজে দুই মিনিট। সবাই রেডি হয়ে রুম থেকে বের হল। ওয়াসিফ আগেই বের হয়ে চলে গেছে ওদিকটা সামলানোর কেউ নেই বলে। মৃদুলের মামা ফোন করে একজন কে যেতে বলেছিলো। মৃদুল যাওয়ার জন্য বের হতে গেলেই ওয়াসিফ বাধা দেয়।বললো- “আমি যাই, তুমি ভাবীকে নিয়ে একসাথে এসো। দেখতে সুন্দর লাগবে। আর হ্যা বাড়ির সবার কথা আবার ভুলে যেয়ো না।” ওয়াসিফের কথায় মৃদুল হাসলো সাথে বুকে জড়িয়ে ধন্যবাদ দিল।

মিলিকে আজকে পার্লার থেকে সাজানো হয়েছে।গোল্ডেন কালারের লেহেঙ্গা। মৃদুল চোখ ফেরাতে পারছে না। তার এমন চাহনিতে মিলি লজ্জা পেল। মিলির কাছে এসে কপালে চুমু দিতেই দরজায় কেউ নক দিল। দুজন যেন হকচকিয়ে গেল। চোখাচোখি হতেই হাসলো দুুজন, শব্দ ছাড়া এক অমায়িক হাসি!
দরজার ওপাশে মৃদুলের ছোট খালা ফিরুজা বেগম বললেন- ” মৃদুল? বাবা তাড়াতাড়ি কর,কি করছিস তুই? ছেলে মানুষদের রেডি হতে এত সময় লাগে?”
মৃদুল দরজা খুললো। মিলির হাত ধরে রুম থেকে বের হতেই সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। গোল্ডেন কালারের লেহেঙ্গার সাথে মিলিয়ে মৃদুল গোল্ডেন কালারের পান্জাবি সাথে লাল কালারের মুজিবকোট পড়েছে। ফরিদা বেগম দৌড়ে এসে ওদের জড়িয়ে ধরে বললেন — “সুখি হ তোরা সুখি হ”। মিলির থুতনিতে হাত রেখে ফের বললেন -” মৃদুল? তুই কাকে বিয়া করলি এ তো দেখি সাক্ষাৎ পরী।” ফরিদা বেগম আবেগে কেঁদেই দিলেন। মিলি তাকে সালাম করতে গেলে তিনি মিলির দু বাহু ধরে বললেন –“থাক মা,দোয়া করি সুখি হও।”
—“এখন কাঁদলে মেকাপ নষ্ট হবে আম্মু। তাই কাঁদতে পারবো না, সরি। দেরি হচ্ছে চলো তো।”

পিছন থেকে ঈশার কথায় সবাই হাসলো। রওনা দিল,কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here