#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_১২
#শামছুন্নাহার
সকাল এগারো’টার পরপরই মিহিরা এ বাড়ি থেকে বিদায় নিবে। বিয়ের পর মৃদূল এই প্রথম শশুড়বাড়ি যাবে। গ্রামবাংলায় এটাকে বলা হয় আরুইল্লাহ। ঈশার যদি পরিক্ষা না থাকতো তবে তাদের সাথে ঈশারও যাওয়া হতো।
ঘুম থুকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে মিহি। বালিশের পাশ থেকে ফেলে রাখা যন্ত্রটিকে হাতে নিল সে। ঈশা আসার আগমুহূর্ত মোবাইল ঘাঁটবে বলেই ডিসাইড করল মিহি।
আজ শুক্রবার। বিয়ের সাত-আট দিন হতে চললো মিলির। বাড়িতে যাবে,সবাইকে দেখবে বলে সে খুব খুশি। সেদিনের ব্যাগ গুছনো আজও সেরকম আছে।শুধু অপেক্ষা কখন যাবে!
আধঘণ্টা পরেই রুমে প্রবেশ করল ঈশা। মিহিকে দেখে বরাবরের মতো মিষ্টিহাসি উপহার দিয়ে পাশে এসে বসলো সে।
–“তোমাকে ভালো করে সময়ই দিতে পারলাম না। জানো, খুব খারাপ লাগছে তুমি চলে যাবে ভাবতে!”(ঈশা)
–” আমারও তাই। কত মজা করেছি তোমাদের সাথে।বাড়িতে মিলি আপুর সাথে ছাড়া আর কারও সাথে মিশা হয়না আমার। এখন তো একেবারে ছন্নছাড়া হয়ে গেলাম। এখানে সবাই যেন আমার আপন,নিজের পরিবার ছিল। মিস করবো তোমাদের। ”
–“আচ্ছা আমার সাথে চল।”
–“কোথায় যাবে?”
–“ছাদে।”
–“এত সকালে?”
–“হ্যা চলো”
বাড়ির সবাই এখনও ভালো করে ঘুৃম থেকে জাগেনি।মিহি ও ঈশা ছাদে গেল। সামনে মিহি,পিছনে ঈশা। ছাদের দরজার কাছে আসতেই ঈশা মিহিকে ধাক্কা দিয়ে ছাদে পাঠিয়ে দিল। সিঁড়ি অর্থাৎ দরজার এপারে ঈশা ওপারে মিহি। মিহি কিছু বলার আগেই ঈশা শুধালো–“আজকে তো চলেই যাবে দুজনে লাস্ট একবার কথা বলে নাও। প্লিজ ঝগড়া করো না যেন!”
বলেই বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দিল ঈশা।
কনকনে শীত। গায়ে শাল জড়ানো মিহির বিষয়টা বুঝতে একটু সময় নিল। ভ্রু কুঁচকে ছাদের চারদিকটা চোখ বুলিয়ে নিল একবার। যখন কাউকেই দেখল না তখন দরজার কাছে এসে বার দুয়েকবার ডাকলো ঈশাকে। কিন্তু ঈশা ততক্ষনে নিচে চলে এসেছে। হাতের মোবাইলটাও ঈশার কাছে। কি করবে ভেবে না পেয়ে গেল ছাদের পশ্চিমপাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটার পাশে। চারদিকে কূয়াশাচ্ছন্ন। বিন্দু বিন্দু শিশির জলকণা জমে আছে ফুলগুলোতে। মিহি একটা ডাল ধরে নাড়া দিতেই সেগুলো বৃষ্টির ফোটার ন্যায় নিচে পরল। মিহির মুখশ্রীতে ভেসে উঠলো মিষ্টিহাসি।
–“Good Morning”
হঠাৎ পুরুষালী কন্ঠ কর্ণে পৌঁছালেও কন্ঠটা চিনতে ভুল করল না মিহি। চোখ,মুখ খিঁচে বিরক্তিকরভাবে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। ওয়াসিফ মিহির পাশাপাশি রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। হাত’দুটো পকেটে রেখে ফিচেল হেসে মিহির কানের কাচে এসে ফের বলে–“শুভ সকাল ইচ্ছেমতি।”
মিহি ওয়াসিফের উল্টো দিক ফিরে হাসলো। শব্দহীন হাসি। যা ওয়াসিফের চোখে পড়লো না। তৎপর ঘাড় ঘুড়িয়ে দৃষ্টি রাখলো ওয়াসিফের নেত্রপল্লবে। গম্ভীর কন্ঠে বললো–“সমস্যা কি আপনার? আপনি কি আমাকে একটু শান্তি দিবেন না? যেখানেই যাই আপনার আসা লাগবে?”
ওয়াসিফ অবাক হয়ে বললো–” আমি আবার কি করলাম?”
–“আপনার জন্য আমি ঠিকমতো ড্রয়িংরুমে বসতে পারি না,বারান্দায় যেতে পারি না,একটু একা পেলেই ‘ভালোবাসি’ ‘ভালোবাসি’ বলে মাথায় তুলে দেন।দেখলেই ড্যাবড্যাব করে নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে থাকেন। ভালবাসেন অথচ অসস্তি হয় সেটা বুঝেন না?”
–“শুধুই অসস্তি হয়, বুকের বা-পাশের ধুকপুকানি বেড়ে যায় না?”
মিহির ভ্রুযুগলের মাঝবরাবরের ভাজ যেন বিরক্তিতে রুপান্তর হল। লোকটা ত্যাড়া। কোনো কথাই সহজভাবে বুঝতে চায় না।
মিহিকে চুপ থাকতে দেখে ওয়াসিফ ফের বলে–” বললে না যে?”
মিহি রেগে বলে–” না হয়না। আমি কি আপনাকে ভালোবাসি নাকি যে হৃদপিন্ডে শব্দ হবে?”
–“ভাসো। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো।”
–“ভুল জানেন আপনি।”
মিহি ঘুরে ওয়াসিফের মতো দাঁড়ালো। কৃষ্ণচূড়া গাছটা এবার তাদের পিছনে। হাত’দুটো বুকের সাথে আড়াআড়িভাবে লেপ্টানো তার। বড় একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো সে। রাগগুলো গিলে ফেলার চেষ্টা কেবল।রাগিয়ে ছেলেটাকে বুঝানো যাবে না। এটা যে মোহ তাকে কি করে বুঝালে বুঝবে? নাকি সত্যিই সে মিহির জন্য দেওয়ানা পাগল হয়ে গেছে?ভাবলো মিহি।
একটু থেমে শান্ত গলায় শুধালো -“উড়ে আসা ভালোবাসায় হুট করে কখনও জুড়ে বসতে যাবেন না।কষ্ট পাবেন আজ হোক বা কাল।”
–“কষ্টের ফল সুমধুর হয়। বাই দ্যা ওয়ে মৃদুল ভাই বিয়ে করছে কয় তারিখ যেন?”
–” ১৪ই ফেব্রুয়ারি।”
–” কথা দিলাম আগামী ১৪ই ফেব্রুয়ারি আমি তোমাকে বিয়ে করব। ভালোবাসা দিবসেই আমার ভালোবাসাকে আজীবনের জন্য কারাদণ্ডে বন্দি করবো। সাক্ষী রইল পিছনে এই ‘কৃষ্ণচূড়া’গাছটা।”
–” পুরু এক বছর?”
–” তাতে কি?ততদিন চুটিয়ে প্রেম করব।”
মিহি একগাল হেসে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে–” ততদিনে প্রেম নয়,আমার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে আপনি মামা ডাক শুনতে পাবেন।”
সবে নাস্তা শেষ করে সোফায় বসলো সবাই। তবুও নয়টা বাজে প্রায়। শুক্রবার বলেই একটু দেড়ি। ঘণ্টাক্ষানিক পরই মিহিরা রেডি হবে নিজ গন্তব্যে যাওয়া জন্য। ফরিদা বেগম মিলিকে বললেন–“দুই তিনদিনের বেশি থাইকো না বৌমা।”
ভরকে গেল মিলি। এতদিন পরে যাচ্ছে সে কিনা দু তিনদিনের জন্য যাবে? এই সাত আটটা দিন তার সাত আটটা বছরের মতো লেগেছে মাকে ছাড়া। মন খারাপ করলো সে। তার বিষণ্ণময় চেহারা দেখে ফরিনা বেগম কানে ফিসফিসিয়ে বললেন–“বিদেশী জামাই তো তাই মানা করতেছে। বুঝছো?”
মিলি বোধহয় লজ্জা পেল। ফরিনা বেগম সেদিকে না তাকিয়ে মিহির দিকে তাকিয়ে বললো–” মিহি তুই ফেসবুক চালাস না?”
–“জ্বী আন্টি। ”
–” আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দে তো!”
মিহি পলক ঝাপটালো বার দুয়েকবার। অবাক নয়নে তাকিয়ে বললো–” আপনি ফেসবুকও ইউস করেন?”
–” ইমু,ফেসবুক,হুয়াটস’অ্যাপ সব ইউস করি। নে আমার ফোনে তোকে অ্যাড করে দে আর নাম্বারটাও সেইভ করে দিস।”
বলেই মিহির দিকে তার মোবাইলটা বাড়িয়ে দিলেন।মিহি তার আইডি অ্যাড করে নাম্বারটা সেইভ করে দিল। তারপর ফরিনা বেগমের দিকে মোবাইলটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো–” এই যে এটা আমার নাম্বার। ‘মিহি’ দিয়ে সেইভ করে দিলাম।”
ফরিনা বেগম মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঘাটতে ঘাটতে বললেন–“আইডির নাম কি?”
–“Iftiya Afrin Mihi”
–“আচ্ছা। ”
‘‘প্রত্যেকটা মানুষ যেন এক একটা অধ্যায়,তাদের সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো সেই অধ্যায়ের এক একটা স্মৃতি।’’
খন্দকার বাড়ির গেইটে প্রাইভেটকার দাঁড়ানো। মিহি,মিলি আর মৃদূল বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। সবাইকে হাত দেখিয়ে বিদায় নিল আরেকবার।
–“ঘরটা কেমন খালি খালি লাগতাছেরে ফরিনা।”
কিচেনরুম থেকে ডয়িংরুমে আসতে আসতে ফরিদা বেগম শুধালেন। সোফায় বসে থাকা ফরিনা বেগম বললেন–” ঠিকই বললা আপা। কালকে দেখবা আগের মতো লাগবো তোমাগো ঘর। আমি,ওয়াসিফ চলে গেলে, দুই দিন পর ইলমা চলে গেলে একদম খালি হইয়া যাইবো।”
–” বৌমা আসবার আগে আমার মাইয়ারে কোথাও পাঠাইতেছি না। জামাই বাবা যতই কল দিক,বিজি থাক মিলি আসলেই ইলমা যাইবো।(ফরিদা)
–” মৃদূল ভাই বিদেশ থেকে আসবে,বিয়ে করবে বলতে বলতে কেমন করে দিনগুলো কেটে গেল। দেশে ফিরলো, বিয়েও করে ফেলল। কত ইনজয় করলাম সবাই। বাসায় গেলে আবার মিস করবো তোমাদের।”(ইলমা)
–
ঘরভর্তি লোকজন। সবাই মিলি আর তার জামাইকে দেখতে আসছে। মিহি ফ্রেশ হয়ে খাবার সাজাচ্ছে টেবিলে। উচ্চস্বরে শুধালো –“শুনো সবাই। জামাইকে শুধু দেখলেই হবে? খাওয়া-দাওয়া করানো লাগবে না? নাহলে তো নতুন বর বাড়িতে গিয়ে বলবে তার আদর যত্ন করা হয়নি।”
মিহির কথায় মৃদুলসহ উপস্থিত সবাই হাসলো। মিহির একটা দাদি এসে বললো–“হগ্গলে (সবাই)যা এহন। নাতিন জামাই কিছু খাইয়া নেক। দুপুর হইয়া গেল যে। যা,যা সব যা এহন(এখন)।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর জামাই বৌকে আলাদা রুমে বিশ্রাম নিতে দেওয়া হয়েছে। মিলি তার শাশুড়িকে কল করে জানিয়েছে তাদের পৌঁছে যাবার কথা।
বিকেলবেলা মৃদুল ঘর থেকে বেরই হয় নি। তার নাকি আনইজি লাগে। প্রথম প্রথম এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। তারপর সন্ধ্যায় নাস্তা করল। এভাবেই কেটে গেল দিনটা।
পরেরদিন সকালবেলা মিহির চাচাতো বোন নীলিমাসহ সবাই একসাথে নাস্তা করল। তারপর জামাই নাকি আরুইল্লাহ’র বাজার করে সেজন্য মৃদুল মিলির ছোট ভাইকে নিয়ে বাজার করতে চলে গেল। এটা নাকি সমাজের আগেরকার দিনের প্রথা। শালীদের জন্য নাকি তেল,সাবান কিনতে হয় যেটাকে বলা হয় “আরুইল্লার বাজার”।
ঘণ্টাখানেক পর মৃদুল তাদের ধরিয়ে দেওয়া লিস্টের সবকিছু এনে মিলির মায়ের কাছে দিল। মিহির চাচাতো ভাই,বোনদের সাথে আড্ডা দিয়েই মৃদুলের সময় কেটে যায়। বোরিং নয় বরং ভালোই লাগে তার। বিকেলে সবাই একসাথে ঘুরতে যায়। কেটে যায় মূহুর্তগুলো।
–
সবে ঢাকার বাসে উঠে বসলো ওয়াসিফ এবং তার মা ফরিনা বেগম। ওয়াসিফ কানে ইয়ারফোন গুজে চোখ বন্ধ করে আছে। ফরিনা বেগম তার হাত ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বের করে জানিয়ে দিল তার বোনকে বাসে উঠার কথা। গতদিন অর্থাৎ শুক্রবারে ফিরার কথা থাকলেও ফরিনা বেগম বোনের জন্য আরেকটা রাত বাড়িয়ে থেকে গেলেন। আগামীকাল ওয়াসিফের অফিস আছে বলেই আজ ঢাকা ফিরছেন তারা।
রাত দশটা।
কোনো রকম খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ফরিনা বেগম শুয়ে পড়লেন। সারাদিনের জার্নি, ক্লান্ত শরীর হেলিয়ে দিলেন বিছানায়। মূহুর্তেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলেন তিনি। অথচ ওয়াসিফ মিহিকে নিয়ে ভাবনায় ব্যস্ত। গতকাল সবার সাথে গল্প আড্ডায় ব্যস্ত ছিল বলে মিহিকে ততটা মনে পড়েনি। মনে হয়েছে ‘এইতো পাশের রুমেই আছে’। কিন্তু এখন কেমন শুন্য লাগছে তার। একলা শব্দহীন, স্তব্ধ রুমে তার যেন সবকিছু খালি খালি লাগছে। বুকের বা পাশের চিনচিন ব্যাথাটাও যেন আগের থেকে দ্বিগুণ বেড়েছে। এভাবে থাকা যায়? কি জাদু করল সেই মেয়েটা? আনমনে ভাবছে ওয়াসিফ। আর ঠোঁটের কোণায় সুক্ষ্ম হাসির রেখাটা প্রবল বেড়ে গেছে তাঁর। চোখ বন্ধ করে বুকের বা পাশে হাত রেখে নেশাযুক্ত কন্ঠে বিড়বিড় করে বললো___
–“এখানে একজন আছে। যাকে দেখলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। Heartbeat increase!”#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_১৩
#শামছুন্নাহার
সবে মিলিকে বিদায় দিয়ে মিহি ও তার মা ঘরে প্রবেশ করল। বোনের বিয়ে হয়ে গেলেও চোখেহারা হয়নি একটা দিনও। মিলির বিয়ের দশদিন হতে চললো অথচ পুরো দশদিনই সে বোনের সাথেই থেকেছে। বোন হল ঝড়ে যাওয়া পাতার মতো। বিয়ে হলে শশুড় বাড়ি যেতে হবেই। আর আগে কত দুষ্টামি, হাসি রাগ,ঝগড়াঝাঁটি হতো!কখনও খুনশুটি ঝগড়া, রাগ অভিমান, আবার এক হয়ে যাওয়ার নামই বোধহয় ভালবাসা। হাজার ঝগড়াঝাঁটির পর দিনশেষে হেসে কথা বলাটা বোনদের প্রতি আলাদা একটা টান,ভালবাসা। যা প্রতিটা ভাইবোনদের মধ্যে থাকেই।
মিলি শান্ত,ভদ্র একজন মেয়ে। মিহি কিন্ত তা নয়,বরং তার উল্টোটা। তবে ইদানীং ইন্টার পাশ করার কয়েকমাস আগে বাবার মৃত্যুর পর মিহি একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। কথা কম বলাসহ নানা পরিবর্তন তার মাঝে। আগে মিলিকে যদি কেউ কিছু একটু কটুবাক্যে কথা বলতো মিহি তাকে কথা শুনিয়ে ধুয়ে তবেই ঘরে ফিরতো। এসে মিলিকে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলতো–” আমার সাথেই পারবি আর কেউ কিছু বললে ঘরে আইসা কাঁদবি। ”
রাতে যখন দুইবোন একসাথে ঘুমাতো তখন মশারি টানানোর জন্য, কাঁথা নিয়ে ঝগড়া তো করতোই। আবার দুইবোনই একসাথে সবকথা শেয়ার করত,হাসতো। মিলিকে এখন সত্যিই মিস করছে মিহি।
দুয়েকটা দিন এভাবেই কেটে গেল। মিহিও তার আগের রুটিন অনুযায়ী চলা শুরু করে দিল। রুটিন বলতে সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে পড়তে বসা,তারপর নাস্তা করে সকাল সাড়ে সাতটার নাগাত কলেজ বাসে করে কলেজ যায়। কলেজ থেকে আসতে আসতে মাঝেমধ্যে চারটে বাজে,আবার মাঝেমধ্যে দুপুরেও চলে আসে। তারপর ফ্রেশ হয়। দুপুরে আসলে একটু ঘুমায় আর বিকেলে আসলে তার ফুলগুলোকে একটু যত্ন করে। সন্ধ্যায় পড়তে বসে। এভাবেই কেটে যায় তার দিনগুলো।
ঈশার টেস্ট পরিক্ষা শুরু হয়ে গেছে আজকে পাঁচ দিন।এরমধ্যে তিনটা এক্সাম শেষ হয়েছে।পরিক্ষার ফাঁকেফাঁকে মিহির সাথে কথা হয় ঈশার। খোঁজখবর নেয় দুজন। ওহ হ্যা,এরমধ্যে ঈশা মিহির একটা নিকনেইম দিয়েছে। মিহি আপুর বদলে ডাকনাম হয়েছে “মিষ্টি আপু”।
সবসময়ের মতো আজকেও কলেজ বাসে বসে আছে মিহি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে পড়ছে সে। গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। হঠাৎ মিহির ফোনে টুং করে একটা মেসেজের শব্দ আসে। মিহি ভেবেছে সিম অফিসের মেসেজ তাই আর সিন করে নি। মিনিট দুয়েক পর ফের দু বার মেসেজ রিংটোনের শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখলো তিনটে মেসেজ আসা। সেই নাম্বার থেকেই যে নাম্বার থেকে দুদিন আগেও রাত দশটার দিকে একটা মেসেজ আসছিল–” Hi sundhori! Kmn acho?”
নাম্বারটা অচেনা বলে মিহি আর সেদিন ঘাটলো না।সেদিনের পর থেকে আর মেসেজ আসেনি বলে সে ভেবেছে হয়তো ভুল করে চলে আসছিল। তারপর আর এই মেসেজের কথা তার মনেই ছিল না। এখন আবার সেই একি নাম্বার থেকে মেসেজ আসাতে কপালে কয়েকটা বলি রেখার ভাঁজ পড়লো মিহির। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইল মোবাইল স্কিনে ভেসে থাকা সেই অচেনা নাম্বারটির ওপর। তারপর সিন করে দেখেলো আগের মেসেজটি ছাড়া আরও তিনটে মেসেজ। সেখানে লিখা–”
” পুরুষ রুপে আটকায় না,আটকায় তার মায়ায়। যে পুরুষ তার মায়ায় পড়েছে? জীবনের শেষ নিঃশেষ অব্দি তার পাশে থেকেছে। আমিও সেটাই চাই…. তোমার সাথে বৃদ্ধ অবস্থায়ও একসাথে কাটানোর ইচ্ছে জেগেছে আমার….”
“একটু বেশিই মনে পড়ছে তোমায়…”
“সারাদিন ব্যস্ততার পর যখন রাতে একা হই তখন তোমায় ছাড়া মাথায় আর কিছুই আসে না। আমার চোখ ভর্তি ঘুম অথচ মাথায় ভর করা তুমি। রাতের ঐ আকাশ জানে….তোমায় অনেক বেশি মিস করি আমি।”
ভালবাসা সুন্দর। মেসেজগুলো মিহির ভীষণ ভালো লেগেছে। তার মনে হচ্ছে এটা ওয়াসিফ। আবার ভাবলো __”ওনি আমার নাম্বার পেল কই? ঈশা দিয়েছে? ওয়েট ঈশাকে একটা কল করে দেখি!”
যেই ভাবনা সেই কাজ। মিহি ঈশাকে কল করেছে।
সামনে বইমেলা নিয়ে বসে আছে ঈশা। বইমেলা বলার কারন- ঈশার সামনে একসাথে কয়েকটা বই মেলে রাখা। সবগুলাই যেন একসাথে পড়ছে সে।খাতা,বই,গাইডবুক মেলে স্বজোরে পড়ছে ঈশা। হঠাৎ মোবাইল ফোনে রিংটোন বেজে উঠায় চমকালো যেন।বিরক্তও হল,কিন্তু কল ধরলো না। ফের রিংটোনের শব্দে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালো সে। মোবাইলের স্কিনে তাকিয়ে দেখল “মিষ্টি আপু” সেইভ করা মিহির কল। মিহির সাথে ঈশার বিকেলে বা রাত্রিবেলা কথা হয়। এই সকালে কল দেওয়ায় ঈশা আরেকটু অবাক হল। রিসিভ করে শুধালো –“কেমন আছো মিষ্টি আপু?”
–“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?”(মিহি)
—” হুম ভালো। কি কর.. কলেজে যাচ্ছো নাকি গাড়ির শব্দ শুনা যাচ্ছে…”
—“হুম বাসে আছি। এক্সাম কেমন হয়? আজকে আছে এক্সাম? ”
–“হ্যা আছে। পৌরনীতি ও সুশাসন প্রথম পত্র পরিক্ষা। আলহামদুলিল্লাহ ভালোই হচ্ছে বাকিটা আল্লাহ ভরসা।দোয়া করিও।”
–“ইনশাআল্লাহ। আচ্ছা শুনো তুমি কি আমার নাম্বার কাউকে দিছো বিশেষ করে তোমার খালাতো ভাই ওয়াসিফকে?”
–“না তো! আর ভাইয়া তো আমার কাছে নাম্বার’ই চায় নি। কেন আবার কি হইছে?”
–“নাহ কিছুনা। আচ্ছা ভালো থাকো। আবার পরে কথা হবে হুম? মন দিয়ে পড় এন্ড এক্সাম দাও।”
–“আচ্ছা। ”
আজকে দুই ঘণ্টা হয়েছিল বলে মিহি দুপুরেই বাড়ি চলে এসেছে। তারপর সেই যে ঘুম দিয়েছে মাত্র উঠেছে।
এখন সন্ধ্যা সাতটা বেজে তিন মিনিট। ফ্রেশ হয়ে পড়ার টেবিলে বসতেই মিহির ফোনে কল বেজে উঠলো। ফরিনা বেগমের কল।
–“কিরে কেমন আছিস?”
–“আসসালামু আলাইকুম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনি কেমন আছেন?”
–“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ভালো। কি করিস?”
পুরো চল্লিশ মিনিট কথা বলার পর ফরিনা বেগম কল কেটেছেন। মিহি মনযোগ দিয়েছে তার পড়ায়।
–
রাত মানেই হাজার স্মৃতি মাথায় অঘোরপন্থী হয়। চোখ বুজে বন্ধ চোখ-কে তখন অঙ্গবিক্ষেপ হিসেবে ধরলে কয়েক হাজার ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। জীবনেতিবৃত্তের প্রতিটা সময় যেন তখন মনে পড়ে। মনে পড়ে পূর্ববর্তী করা সব কাজগুলো। সেটা যদি হাসির মূহুর্তের হয় তবে ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে একচিলতে হাসি। যদি হয় দুঃখের তবে চোখের কার্নিশ থেকে গড়িয়ে পড়ে দু ফোটা নোনাজল।
আজকের মেসেজগুলো মিহিকে অনেকটা আশিকের কথা মনে করিয়ে দিল। কি ভাবছেন প্রাক্তন কেউ? নাহ,প্রাক্তন নয় তবে কিছুটা ঔরকমই। কথার মানে বুঝতেছেন নাহ তাইনা? চলুন খোলাসা হোক।
মিহি তখন ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ, পেইজের সাথে অ্যাড তার। প্রথম প্রথম ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলায় বেশিরভাগ সময়টা ফেসবুকেই কাটাতো। আশিকের সাথে তার ফেসবুকেই পরিচয়। একটা গ্রুপ থেকে। আশিক একটা পোস্ট করেছিল সেখানে কমেন্ট করেছিল মিহি। কি যেন একটা পোস্ট ছিল যেখানে ঐ কাজটা না করলে আশিক নোবেল দিবে। মিহিও সেটা করেনি বলে নোবেল দেন বলে কমেন্ট করেছিল। সেখান থেকেই আশিক মিহিকে প্রথম ইনবক্সে নক দেয়। মিহি এক্সেপ্ট করেনি অনেকদিন। তারপর আবার অন্য পোষ্টে কমেন্ট করায় আশিকের আবদারে মিহি এক্সেপ্ট করেছিল। সেদিন থেকেই তাদের টুকটাক মেসেজ হত। কেমন আছো,কি কর,খাইছো জাস্ট এটুকুই। এভাবে মাসখানেক টুকটাক মেসেজ হবার পর একদিন আশিক নিজেই বলেছে সে তাকে ভালবাসে। মিহি ওয়াসিফের মতো তাকেও বলেছিল এটা তার মোহ ছাড়া কিছুই না। মিহি রাজি নয় বলে ওয়াসিফের মতো সেও ভালবাসি ভালবাসি বলে পাগল করে দিত। মিহি তখন বলেছিল–“আমি কখনও রিলেশনে যাবো না।”
আশিক যখন বললো –“তাহলে চল বিয়ে করি আমরা?”
–“আমার বড় একজন বোন আছে তার বিয়ে হওয়ার পর আমার বিয়ে। দেড়ি আছে। তাছাড়া যা সম্ভব নয় তা না এগুনোই ভালো।”(মিহি)
–“কেন সম্ভব নয়?”(আশিক)
–“আপনার আমার বাড়ি অনেক দূরে হয়ে যায়। আমার আব্বু-আম্মু কখনোই আমাদের মেনে নিবে না।”
–“তোমার আপুর বিয়ে হওয়ার পর আমাকে জানাবে।”
আশিকের বাড়ি ছিল ঢাকাতে। ঢাকা মানিকগঞ্জ। মিহির বাড়ি কুমিল্লা। সবচেয়ে বড়কথা হল আশিক কখনও মিহিকে সামনাসামনি দেখেই নি। নিজের কল্পনাপ্রিয় এঁকেছে মিহির ছবি। সেখান থেকেই সে এত সিরিয়াস। এদিকে মিহি ততটা গুরুতরভাবে বিষয়টা নেয় নি। সে কখনওই রাজি ছিলনা আশিকের প্রপোজালে। বরাবরের মতো মানা করে দিত আশিককে। আশিক যদি মিহিকে সত্যিও ভালবাসতো সেটা ছিল একতরফা ভালবাসা। মেসেজগুলো দেখে আশিকের কথা মনে পড়ার কারন হল আশিক সবসময় কবির মতো গুছিয়ে কথা বলতো। মিহি যখন বলতো–ঢাকাতে তো মেয়েদের অভাব নেই। সেখান থেকে কারও সাথে রিলেশন করুন!”
–“ঠিক বলেছো। অনেক মেয়ে আছে চাইলে রিলেশন কেন বিয়েও করতে পারি। কিন্তু আমি তা চাইনা।”
–“কেন চান না?”
–“কারন আমার তোমাকে লাগবে। শুনেছো তুমি? আমার তোমাকেই লাগবে।”
মিহির ফেসবুক অ্যাকাউন্টের নাম ছিল “সেই মেয়েটা “।বছরখানেক পর ঐ আইডিটা হঠাৎ করে কি যেন হয়ে গেল আর ফিরে পেল না। নষ্ট হয়ে গেছে কোনোভাবে। এরপর আর সেই আইডিটাকে খুঁজে পেল না মিহি। তারপর ইন্টার ২য় বর্ষের একদম শেষে টেস্ট পরিক্ষার পর ফের আইডি খুলেছে। নতুন আইডি তাও আবার নিজের নামেই। তখন আর নতুন করে কোনো ছেলেকেই অ্যাড করেনি। নিজের স্কুল-কলেজের কোনো ছেলে ফ্রেন্ডও না।
ইন্টার ফাইনাল দেওয়ার পর মিহি যখন ঢাকায় তার খালামনির বাসায় গিয়েছিল তখন এই নতুন আইডি দিয়েই একবার আশিকের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। চেয়েছিল সামনাসামনি একবার দেখা হোক। অনেকদিন পর যোগাযোগ করেও ছিল। কিন্তু সেদিন আশিক বললো–“সরি আপু আমি আপনাকে চিনি না।”
মিহি যখন পরিচয়ও দিল ফের উত্তর এলো আশিক নাকি কুমিল্লার কোনো মিহিকেই চিনে না। কুমিল্লা তার পরিচিত কেউই নেই।
সেদিন মিহি আশিককে ব্লক করে দিয়েছিল। অবশ্য না চিনার কথাই। কারন আইডি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর অনেক মাস তাদের কোনো যোগাযোগ হয়নি। শুধু মেসেজ হত বলে কন্টাক্ট নাম্বারও নেওয়া হয়নি। অতঃপর মিহি আশিকের সামনাসামনি আর দেখা হয়নি। মিহি ফিরে এসে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। মাঝেমধ্যে আশিককে তার খুব মনে পড়ে। আশিকের বলা কথাগুলোকে মনে পড়ে। মনে হয় যেন তার সাথে যদি সারাজীবন থাকা যায় মিহি বোধহয় হবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। যখন আশিক বলেছিলো তাকে চিনেই না সেদিন মনে হয়েছিল “এটা জাস্ট একটা Fascination, মোহ ছাড়া আর কিছুই নয়।”
চলবে….