ইচ্ছেমতি পর্ব -১৪+১৫

#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_১৪
#শামছুন্নাহার

ঈশার টেস্ট পরিক্ষার পর ঈশাকে নিয়ে মিলি আরও একবার তার বাপের বাড়ি এসে ঘুরে গেছে। মৃদূলসহ তারা চারদিন ছিল মিলিদের বাড়িতে। ঈশার এইচএসসি ফাইনাল পরিক্ষা গুনে গুনে আর মাত্র পঁচিশ দিন বাকি। এদিকে আবার মৃদুলের বিদেশ যাওয়ার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। বিদেশ হলেও সেখানে মৃদুল কোম্পানিতে জব করে। সেখানকার একটা কোম্পানির ফোরম্যান সে। মৃদুলের কোম্পানির ম্যানাজার কল করে বলেছে একমাস আগেই তাকে সেখনে ফিরতে হবে। হঠাৎ করে কি যেন এক জরুরী কাজ পড়ে গেছে যা মৃদুলকে ছাড়া সমাধান করা যাচ্ছে না। তাই তার ছুটি শেষ হবার আগেই চলে যেতে হবে।ঈশার পরিক্ষা শুরু হবার দুদিন আগে মৃদুলের বিদেশ যাওয়ার ডেইট।

অন্যান্য সকাল থেকে শীতের সকাল একটু পৃথক,একটু বৈচিত্র্যময়। শীতের সকাল আসে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে। প্রকৃতির পালাবদলের হাওয়ায় শীতের যে রূপ তা রিক্ততার রূপ। তবে এ রিক্ততা প্রকৃতিকে এক ভিন্ন সাজে সজ্জিত করে।
আবার শীতের শেষের দিনগুলো এমন হয় যে আজকে প্রচুর শীত তো কালকে একদমই সেই আবেশ নেই। কিন্তু সকালটায় একটু ঠাণ্ডাজনিত আবাশ থাকেই।

তেমনি একটা দিন। চারদিকে কুয়াশার জন্য সামনের পথটুকু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। আজকে মিহির কলেজ যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হতে একটু লেইট হয়ে গেছে। কোনোরকমে চা বিস্কিট খেয়ে রেডি হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল সে। কলেজ বাসে উঠতে তাদের বাড়ি থেকে আরও দশটাকার ভাড়ার পথ। মিহিদের ঘর থেকে বের হলেই গাড়ির রাস্তা তবে এত সকাল বিশেষ করে শীতের সময় গাড়ি পাওয়াটা একটু কষ্টকর হয়ে যায়। মিহি ঘর থেকে বেড়িয়েছে সকাল সাতটা পঁচিশ মিনিটে। এখান থেকে ভিক্টোরিয়া বাসের কাছে যেতে লাগবে দশমিনিট। কপাল ভালো রাস্তায় দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই একটা সিএনজি এসে থামে।
–“আপা কই যাইবেন?”
–“ব্রাক্ষণপাড়া।”
–“চলেন।”
মিহি চটজলদি গাড়িতে উঠে বসে পড়ল। হাতে থাকা শালটাকে তড়িঘড়ি করে গায়ে জড়িয়ে নিল। বামহাতে থাকা ঘড়ির দিকে বারবার তাকিয়ে মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে যেন বাস মিস না হয়।

–“কিরে ভাই আজকে কি ভার্সিটিতে যাবেনা নাকি?”
বাসে বসে ওয়াসিফ তার পিছনে থাকা ভিক্টোরিয়ায় পড়ুয়া ছেলেপেলেকে উক্ত প্রশ্নটি জিজ্ঞাস করে।
প্রতিউত্তরে পিছন থেকে একটা ছেলে বলে–“কি জানি ভাই,মেয়েটাতো সহজে ভার্সিটি কামাই করেনা। ”
ওয়াসিফ উচ্চস্বরে শুধালো-
–“মেয়ে না ব্রো। ভাবী বলো ভাবী।”

ওয়াসিফের অফিস শুক্রবার,শনিবার বন্ধ থাকে। সেজন্য সে শুক্রবার দুপুরে চলে এসেছে ঈশা অর্থাৎ খালার বাড়িতে। পরেরদিন সকাল সকাল ফরিদা বেগম থেকে বলেই ভিক্টোরিয়ার বাসে এসে অপেক্ষা করছে তার প্রিয়তমা সেই মেয়েটার জন্য। খালার কাছে বলে এসেছে অফিসের একটা দরকারি কাজে বের হয়েছে এবং বাড়ি ফিরতেও লেইট হবে।

ওয়াসিফ যখন বাসে এসে বসেছে সাতটা বিশ বাজে তখন। ঈশা বলেছিল সাতটা পঁচিশ-ত্রিশ এর মধ্যেই মিহি বাসে থাকে। কিন্তু এই বিশ মিনিট অতিবাহিত হওয়া ওয়াসিফের কাছে যেন দীর্ঘ একঘণ্টার মতো লাগছে। ছেলেদের সবাইকে পরিচয় দিয়েছে মিহির স্বামীরুপে। হবু বর বলেই সম্বোধন করেছে সে।
প্রথমে এসেই ছেলেদের থেকে কে কোন ক্লাসে পড়ে তা জেনে নিল। তারপর মিহির কথা বলতে কেউ চিনলো,কেউ চিনেনি। তারপর তাদেরকে বলে রাখলো যে ওয়াসিফ আর মিহির বিয়ে ঠিক করা আছে।ব্যাপারটা কেউ যেন বাজে ভাবে না নেয় এবং মেয়েটা তার সাথে রাগ বলেই সে এখানে আসা।

ভিক্টোরিয়া বাসের নিয়মাবলী শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ। সাধারণত ভার্সিটিতে যে যেমন খুশি তেমন থাকলেও বাসে কোনো অশৃঙ্খলা নেই। সামনের কয়েকটা সারিতে বসে মেয়েরা, পিছনের সারিতে বসে ছেলেরা। কলেজে যেতে যেতে যদি ভিড় হয় সেটা অন্যকথা।কলেজের তিনটা বাসে তিনটা নিয়ম। এ বাসে প্রথম তিন সারিতে মেয়েরা এরপর তিন সারিতে ছেলেরা এমন করে বসা।
মিহি বাসে ওঠে আসে সাতটা আটত্রিশ মিনিটে। এখনও অনেক সিট খালি। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন স্টোডেন্টরা এসে আস্তে আস্তে ভিড় হয়ে যাবে আধঘণ্টা পরেই। জানালার পাশের সিট দেখে একপাশে বসতেই পিছন থেকে একটা ছেলে বলে–” excouse me sis..Actually আপনি আজকে সামনে নয় পিছনে বসবেন।”
আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখালো –এই যে এখানে,ভাইয়ার পাশে।”
মিহি অবাক নয়নে তাকালো ছেলেটার পানে। মূহুর্তেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো দুয়েক সেকেন্ড। ছেলেটার ইশারা দেওয়া সিটে তাকাতে দেখলো হুডি পড়া এক যুবককে।হুডির টুপিটা মাথায় দেওয়া,বাহিরের দিকে তাকানো বলে চেহারাটা স্পষ্ট নয়। মিহি ভেবেছে সে দেড়ি করেছে বলে বোধহয় বড় ভাইয়েরা দুষ্টুমি করছে। তারপর জানালার পাশের সিটে বসে কলেজ ব্যাগটা পাশের সিটে রেখে একটা বড় করে নিঃশেষ নেয়,যেন বাসে তো ওঠেনি বরং কোনো এক যুদ্ধে বিশ্বজয় করেছে।

বাস ছেড়ে দেওয়ার মিনিট দশেক পর ওয়াসিফ ধীরপায়ে মিহির কাছে গিয়ে পাশের সিটের ব্যাগটা হাতে নিয়ে চোরের মত বসেছে। মিহির নির্নিমেষ চাহনি বাহিরের রাস্তা ও গাছপালাতেই স্থির। হাতে থাকা ফোনটা কানে দেওয়া। কাকে যেন কল করেছে তার রিং এর শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ওয়াসিফ। কলটা ধরেনি বলে মিহি যেইনা ব্যাগে ফোন রাখতে যাবে অমনি খালি সিটে পুরুষ দেখে চমকে ওঠে। ওয়াসিফ তখন মুচকিহেসে বলে–“ভয় পেয়ো না ইচ্ছেমতি। আমি ওয়াসিফ। তোমার ওয়াসিফ।”
সহসা ভয় পাওয়া মিহি অপরদিক ফিরে জামার গলা উঁচিয়ে বুকে থুতু দেয়। চটজলদি ওয়াসিফের দিকে তাকিয়ে বলে–“আপ…আপনি এখানে,এখানে কি করছেন?”
–“মেসেজের রিপ্লাই দেওনাই কেন?”

মিহি আড়চোখে তাকাতেই ওয়াসিফ ফের বললো–“ওভাবে তাকানোর কিছু নেই। নাম্বারটা আমার’ই। কবি হইছো অথচ মনের ভাষা বোঝেনা? ”
মিহি ওয়াসিফের দিকে ঘুরে বিস্মিত কন্ঠে বললো–“মানে?
তারপর সবার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে–“আর আপনি কিন্তু এখানে বাড়াবাড়ি করবেন না। দয়া করে এখানে আমাকে ছোট করবেন না প্লিজ।”
ওয়াসিফ পিছনে বসে থাকা ছেলেদেরকে ডেকে বললো–“ব্রো আমাদেরকে একটু সময় দিন,কেউ……… (একটু থেমে বলে)বোঝেনই তো!”
মিহির দিকে তাকিয়ে বলে –” ঠিক আছে। কেউ ডিস্টার্ব করবে না আমাদের আর তুমিও কারও কাছে ছোটও হবানা।”
মিহি সেই ছেলেগুলার দিকে তাকিয়ে বললো–“ভাইয়ারা আপনারা কিছু বলছেন না কেন?ওনি আমাকে ডিস্টার্ব করতেছে, আমি ওনাকে চিনি না।”
একটা ছেলে সিট থেকে মাথা উঁচিয়ে বলে–” কি ভাই মেয়েটাতো আপনাকে চিনেই না। আপনি সত্যি ওর হবু বর তো?”
বর?কার বর? কিসের বর? পাগল হয়ে গেল নাকি সব।কেউ কিছু বলছেনা কেন ওয়াসিফকে। মনেমনে বিড়বিড়িয়ে মিহি মুখে বললো–” বর? ওনি আমার বর হতে যাবে কেন – আমার তো বিয়েই হয়নি।”
ওয়াসিফ বললো–“বললাম না ভাই রাগ করছে? অভিমানে আমাকেই চিনে না। আচ্ছা আপনারাই বলেন ও আমাকে না চিনলে প্রথমেই এখান থেকে ওঠে যেতো না? আমার সাথে কথা বলতো? আপনাদের কাছে নালিশ করতো না?”
সবাই সায় দিল ওয়াসিফ ঠিক বলেছে। মিহি আর কিছু বলেনি। ওয়াসিফ বকবক করেই যাচ্ছে। ছেলেরা এত কথা বলে?ওয়াসিফকে না দেখলে মিহির বিশ্বাসই হতো না। একটা মেয়েকে ইমপ্রেস করার কতই প্রচেষ্টা। বাহ!ভাবলো মিহি। আর ওয়াসিফের অগোচরে মৃদু হাসলোও।

প্রতিটা স্টেশনে বাসটা একবার করে থামে। একজন, দুজন কিংবা একাদিক স্টোডেন্টস করে প্রতিটা স্টেশন থেকে বাসে ওঠে। বিশ মিনিট পর একটা স্টেশন থেকে দুইটা মেয়ে ওঠেছে বাসে। এরমধ্যে একটা হল মিহির বেস্টু নিধি। বাসে ওঠে যখন মিহির পাশের সিটে একটা ছেলেকে দেখতে পায় সে যেন ভরকে গেল। মিহির পিছনের সিটে বসে মিহির মাথায় টোকা মেরে অভিমানী কন্ঠে বলে–“ফকিন্নি, তুই বিয়ে করলি আর আমাকেই জানালি না?”
মিহি মাথায় হাত দিয়ে ব্যথিত হওয়ার ‘আহ’ উচ্চারিত করে পিছনে ফিরে তাকায়। বিরক্তির সহিত বলে–“সবার মতো তুইও পাগল হলি নাকি? কতবার কল করেছি ধরছিস?”
–” ফোন ধরিনি কারন গাড়ির আওয়াজে শুনতে পাইনি। (ব্যাঙ্গো করে)আর ধরলেই কি বলতি… নিধু শুন, আমার বর নিয়া আসছি দেখতে হ্যান্ডসাম, নজর দিবি না একদম…তাই তো? নাকি এটা বলতিস তোকে সারপ্রাইজ দিবো…তার চেয়ে ভালো আমি এসে দেখলাম। সারপ্রাইজ হল না বল?”
–“চুপ করবি তুই?”
–“ক্যান হয় নাই বুজি? তাইলে কি বলতি?আজকে পাশের সিটে তোকে বসাতে পারবো না ? নাকি ট্রিট…
–“নিধূ… ”

ভার্সিটির গেইটের ভিতরে এসে বাস থামলো। একে একে সবাই নামলো এবং যার যার ডিপার্টমেন্টে চলে যাচ্ছে। ওয়াসিফ আগে কখনও এই কলেজে আসেনি।মিহির জন্যই এই প্রথম আসা। ক্যাম্পাসের চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নিল। সামনের ওই গাঢ় ইটকালারের মিনারটা যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি,তার চারদিকে গাছ লাগানো। এর অপর পাশে বিভিন্ন ফুলগাছ এবং মাঝখানটায় কলেজের ভিতরে প্রবেশ করার রাস্তা। এর সামনেই আলাদা আলাদা তিনটা বিল্ডিং। বোধহয় তিনটে শাখা-অনার্স ,ডিগ্রী ও ইন্টার। আর কিছু দেখার সুযোগ হল না ওয়াসিফের।তার কারন মিহি নিধির হাত ধরে তার ডিপার্টমেন্টে চলে যাচ্ছে। ওয়াসিফ দৌড়ে গিয়ে মিহির অপর হাতটি ধরল। হঠাৎ এরকম হওয়ায় মিহি,নিধি দাঁড়িয়ে গেল।মিহি একবার হাতের দিকে তাকিয়ে তারপর ওয়াসিফের দিকে তাকায়। ঈষৎ রেগে চাপা স্বরে বলে–“এটা আমার ভার্সিটি ভুলে যাবেন না।”
–“চল।”
–“কোথায়?”
–“ধর্মসাগর পাড়।”
–“ঘুরতে আসিনি,ভার্সিটিতে আসছি। হাত ছাড়ুন। ”
–“ছাড়ার জন্য ধরিনি, চল। (নিধির দিকে তাকিয়ে বলে)’আপু আপনি ক্লাসে যান তো!’
–“আরে পাগল নাকি!ছাড়ুন। নিধু যাস না তুই।”
–“ওকে থামিও না। চলে যাচ্ছে যেতে দাও। তুমি চল তো!
–” থাপ্পড় দিবো কিন্তু এখন,ছাড়ুন!”(কান্না মিশ্রিত কন্ঠে মিহি বললো)
–“এ্যাই তুমি সেই মেয়েটা না যার মুখ থেকে ব্ল্যাক কফির মতো তিতা তিতা কথা বের হয়?”

নিধি চলে গেল তার ডিপার্টমেন্টে। মিহি একমুহুর্তের জন্য একদম চুপচাপ হয়ে গেল। ওয়াসিফ মিহির হাত ধরেই টানতে টানতে নিয়ে গেল ধর্মসাগর পাড়ের উদ্দেশ্যে।
#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_১৫
#শামছুন্নাহার

–“আমরা এখানে কেন?
–“আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই তুমি এখানে!”
–“সবসময় ত্যাড়া কথা ভাল্লাগেনা ওয়াসিফ,আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”
–“তাহলে এলে কেন?”
–“আমি আসিনি, আপনি একপ্রকার ঝোর করেই নিয়ে আসছেন।”

কুমিল্লা ধর্মসাগর পাড়। এটি একটি প্রাচীন দিঘি। একপাশটায় মানুষের চলাফেরার পথ। পূর্ব পাশটায় পানি এবং বসার জন্য উঁচুমান পিচডালা সিঁড়ির মতো লম্বা রাস্তা। সেদিকটায় বসাও যাবে, চাইলে হাটাও যায়। আর পশ্চিম পাশটায় গাছগাছালি সবুজের মনোরম। নিচে বসার বেঞ্চ রাখা। সেখানেই একটা বেঞ্চে বসে আছে মিহি ও ওয়াসিফ। তাদের বসার মধ্যকার ফাঁকটুকু জায়গা করে নিল মিহির কলেজ ব্যাগটা। তারপর মিহি এখানে আসার কারন জানতে চায়!

–” এই জায়গাটা খুব সুন্দর তাই না? এখানে একটা গাছ ছিল, ফুলের গাছ। তোমার প্রিয় কৃষ্ণচূড়া ফুল।প্রথম যখন আসছিলাম! দেখেছিলাম। এখন নেই।ভেবেছিলাম আছে তাই তোমাকে নিয়ে আসছি। তোমার মন ভালো করতে।”(ওয়াসিফ)

ওয়াসিফের প্রতিউত্তরে মিহি কিছু বললো না। এখানে এই প্রথমবার নয়,এর আগেও বহুবার এসেছে সে। বন্ধুদের সাথে,পরিবারও কাজিনরা একসাথে এসে ঘুরেছে। মন ভালো হওয়ার মতোই জায়গাটা। ছোট ছোট ঢেউ পাড়ে এসে থামছে। হৃদয়ে ছোঁয়ে যাচ্ছে মৃদুমন্দ বাতাস। এই ধর্মসাগর পাড়ের দক্ষিণ দিকে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। নামটা মনে নেই তবে মিহি যখন প্রথমবার এসেছিল তখন ডিএসপি এর দক্ষিণ দিকের রেস্টুরেন্ট থেকে বার্গার আর স্যান্ডউইচ খেয়েছিল। এখনও মনে পড়ে ঘুরতে আসার সেই দিনগুলোর কথা।

নদীর দক্ষিণ পাড় ঘেঁষে যতই পূর্ব দিকে যাবেন মুগ্ধতা আপনাকে ততই ঘিরে ধরবে। এখন সকাল দশটা আটাশ মিনিট। সকালে মানুষজনের আনাগোনা কম। বিকেল হলেই দেখা যায় কতশত মানুষ আসে এখানে। ভিড়ের প্রলেপটা বিকেলেই টের পাওয়া যায়। রাতের ডিএসপি আরও সুন্দর। দীঘিরপাড়ে যে ল্যাম্পপোস্টগুলো আছে সেই সবগুলো জ্বলে উঠে।আলোয় আলোকিত হয়ে মূহুরিত হয় ডিএসপি।

–“চল ওদিকটা যাই। বসে থাকতে ভাল্লাগতেছেনা। একটু হাটি?”

কথা বলেই ওয়াসিফ ওঠে দাঁড়ায়। মিহি তখনও জবাবহীন,নিশ্চুপ। ওয়াসিফ হুডির পকেটে হাত দিয়ে হাটা শুরু করল। মিহি তার পিছনেই। দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে সামনের দিকেই হাটছে তারা। ধর্মসাগরের উত্তর পশ্চিমে একটা ফুসকার দোকান। মিহি হাটতে হাটতে এবার ওয়াসিফের থেকে এগিয়ে। পিছন থেকে ওয়াসিফ ডাকলো –“এ্যাই ফুসকা খাবা?”
মিহি পিছন ফিরে তাকিয়ে বললো –“না।”
ওয়াসিফ দৌড়ে এসে মিহির পাশাপাশি হাটা ধরে।বললো–“মেয়েদের তো ফুসকা ফেভারিট,তোমার পছন্দ না?”
–“হুম”
–“তাহলে? আমার টাকায় খাবে না তাই তো!”
–“তা না,খালি পেট। চা বিস্কিট খেয়ে আসছি ঝাল খেলে পেটে ব্যথা হবে। ”
–“তাহলে চল নাস্তা করি?”
–“চুপ থাকুন।”
–“দুঃখিত চুপ থাকতে পারবো না। তোমাকে দেখলে চুপ থাকতে পারি না।”
মিহি আড়চোখে তাকালো। ওয়াসিফ ফের বললো–“ভার্সিটিতে সারাদিন না খেয়েই থাকতে?”
–“নিধুকে নিয়ে ক্যান্টিনে খেতাম। সে সুযোগ দিয়েছেন আপনি?”
–“বুঝলাম।”

ওয়াসিফ মিহির হাত ধরে ফের উল্টো পথে হাটা শুরু করে। মিহির হাজারও বাধা ওয়াসিফ কানে নিল না।দক্ষিণ দিকের ওই রেস্টুরেন্ট থেকে দুজনে ব্রেকফাস্ট করে। ধর্মসাগর পাড়ের উত্তরে রয়েছে শিশুপার্ক। তারপর তারা আগের ন্যায় হাটতে হাটতে শিশুপার্কে যায়। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে ওয়াসিফ আর মিহির হাত ধরেনি। যাওয়ার সময় ধরেছে কারন মেয়েটা একটু ঘাড়ত্যাড়া। জোরাজোরি না করলে যেতোই না।

শিশুপার্ক যাওয়ার পর একটা শিশুর সাথে দেখা। জীর্ণশীর্ণ দেহ। পরনে পুরোনো একটা জামা। আট-দশ বছর হবে মেয়েটার বয়স। জীর্ণশীর্ণ দেহ হলেও দেখতে খুব মিষ্টি। মেয়েটার হাতে একটা ফুলের ঝুড়ি। গোলাপ ফুলের। বাচ্চা মেয়েটা ওয়াসিফের আঙ্গুলে ধরে বলে.. “ভাইজান, ভাবীর লাইগা একটা ফুল নেন না ভাইজান। সকাল থিক্কা একটাও বেছতে পারি নাই। নেন না একটা ফুল।”

ভাবী বলাতে ওয়াসিফ একবার মিহির দিকে তাকালো আরেকবার পিচ্চি মেয়েটার দিকে। পরক্ষনেই মুখ টিপে হাসলো সে। মিহি একটু রেগে গেল কিন্তু প্রকাশ করল না। মেয়েটার গালে একটু ছোঁয়ে দিয়ে বললো–” ভাবী না মামুনী। আমি ওনার বোন হই। আপু বলবে বুঝলে? ”
ওয়াসিফ তীক্ষ্ণ চাহনিতে শুধালো –“চুপ কর মিহি,তুমি আমার বোন না বউ। বাংলিশে B o n এর nটা উল্টে u হয়ে গেছে।”
–“এখনও হয়নি ওকে। আনতাজি বকবক কম করবেন।”

মেয়েটা আবার বলে “একটা ফুল নেন না ভাইজান সকাল থিক্কা এহনও কিচ্ছু খাইবার পারি নাই”। মেয়েটার কথায় মিহি ওয়াসিফ ঝগড়া থামায়। ওয়াসিফ হাটু গেড়ে বসে মেয়েটার দু গালে দুহাত রেখে বলে–“নাম কি তোমার?”
–“মালিহা।”
–“বাহ কি সুন্দর নাম!একটা ফুল কত করে?”
–“দশ টাকা।”
–“সবগুলার দাম??”

মালিহা একটা একটা করে ফুল গুনতে থাকে। ওয়াসিফ মেয়েটাকে থামিয়ে বলে–” থাক আর গুনতে হবে না।সবগুলা একসাথে কতটাকা দিয়ে কিনছো? ”
–“দুইশো টাকা।”

ওয়াসিফ তার মানিব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে বললো–“এই নাও। এটা রাখো আর এটা দিয়ে সকালে নাস্তা করবে” বলেই আরও একশত টাকার একটা নোট দিল। প্রফুল্ল মালিহা মেয়েটা খুশিতে আটখানা। মিহি বললো–“আমি এতগুলো ফুল দিয়ে কি করবো একটা হলেই হবে।”
ওয়াসিফ মালিহার দিকে তাকিয়ে বললো–“ওকে কি ফুল দিবো ও নিজেই তো একটা ফুল!”(ওয়াসিফ)
মিহি পাঁচটা ফুল রেখে বাকিগুলা মালিহাকে দিয়ে দিল।মালিহা পাঁচটা ফুলের দাম রেখে বলে–“আমার কাছে ভাংতি নাই আপা। খুচরা টেকা থাকলে দেন।”
–“থাক তুমি রেখে দাও। বাকিগুলো অন্য জায়গায় বিক্রি করে দিও। আসি কেমন?”
–“আইচ্ছা। ”
ওয়াসিফ মিহি ফের হাটতে শুরু করল। মালিহা ওয়াসিফকে ডেকে মিহির থেকে একটু দূরে নিয়ে এসে মিহিকে দেখিয়ে বলে–“ভাইজান আপারে বুজি বেশি ভালোবাসেন?
ছোট্ট মেয়েটার কথায় ওয়াসিফ মুচকিহেসে বললো–“হ্যা অনেক।”
–“ভাইজান আপায় খুব ভালা। অবহেলা কইরা হারাইতে দিয়েন না,যত্ন কইরা বাইন্দা রাইখেন। যে হারায় হেয় বুজে হারানোর কষ্ট কি!”

বলেই মালিহা দৌড়ে চলে গেল। অবাক নয়নে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল ওয়াসিফ। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে মালিহার বলে যাওয়া কথাগুলো। মালিহা নামের পিচ্চি মেয়েটা চলে যাওয়াতে মিহি ওয়াসিফের কাছে এসে হাতে তুড়ি বাজিয়ে বললো–“এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন? চলুন ওখানে একটু বসি!”
ওয়াসিফ পিছন ফিরে মিহির দিকে তাকালো। তাকাতেই মিহি মুচকিহেসে বললো –“কি হল চলুন!”
ওয়াসিফ বললো -“ফুলগুলো আমাকে দাও তো!
–“কেন?”
–“দাও।” বলেই ওয়াসিফ মিহির হাত থেকে গোলাপফুল গুলো নিজের হাতে নিল। তারপর হাটু গেড়ে বসে আবেগময় কন্ঠে শুধালো –” আমি এক গরিব প্রেমিক ইচ্ছেমতি, তোমাকে দেওয়ার মতো আমার আর কিছুই নেই।”
মিহি হাসলো। ফুলগুলোকে নিতে নিতে বললো–“এ্যাহ, আমার ফুলগুলোই আমাকে দিতে আসছে।”
বলেই সে হাটা শুরু করলো। ওয়াসিফ চেয়ে রইল মিহির মুক্তঝড়া হাসির দিকে। পরক্ষনেই উচ্চস্বরে শুধালো –“প্রথমেও কিন্তু আমিই দিয়েছি!”
–“তখন তো আর বলেন নি!”

দুপুরেও দুজন একসাথে খাবার খেল। দুটো বেজে সাতচল্লিশ মিনিট। ওয়াসিফ বললো–“চল রুপসাগর যাই।”
–“একটু বেশিই আশা করে ফেলতেছেন না?বাড়িতে যাওয়া দরকার। ”
–“এ সুযোগটা যদি আর না আসে? থ্যাংকস আজকে আমাকে সময় দেওয়ার জন্য।”

লোকজনের ভিড় আস্তে আস্তে বাড়ছে। ওরা তখনও ধর্মসাগর পাড়ে। বেঞ্চে বসে আছে দুজন। ওয়াসিফ ঘড়ির দিকে একবার দেখে নিল। তিনটে বাইশ মিনিট।ওয়াসিফ চায় সময়টা থমকে যাক। মিহির সাথে আরেকটু সময় একসাথে কাটাতে চায়। কিন্ত সময় তো চলমান।

–“জানো ঢুবলির এক্সামের সপ্তাহখানেক পরেই ওর বিয়ে?”(ওয়াসিফ)
মিহি আশ্চর্যজনক চাহনিতে বললো–“মানে?”
–“মানে ওর বিয়ে।”
–“আন্টি বলছে ওর এক্সামের পর বিয়ে দেখবে।তারমানে এটা নয় যে ওর বিয়ে।”
–“হ্যা। আমার পরিচিত একটা ছেলে আছে বুঝছো অনেক ভালো। ব্যাংকে জব করে সে। ঈশাকে পছন্দ করেছে। খালামনি,মৃদুল ভাই সবাই জানে শুধু ঢুবলি ছাড়া। ওর এক্সামের জন্যই সবাই ওয়েট করতেছে। এক্সাম শেষ হলে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে। দেন বিয়ে।তুমি আবার এটা ওকে বলে দিও না কিন্তু!”
–“আমি কেন বলতে যাবো,বলবো না কাউকে।”
–“সালা আমাদের বিয়েটা যে কবে হবে…..একটু থেমে ম্লান কন্ঠে ফের বললো –“একটু তো ইশারা দাও, আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি মিহি।”
–“আগেও বলেছি এখনও বলছি এসব আবেগ অনুভূতি থেকে যত দূরে থাকা যায় জীবন ততই সুন্দর। ”
–“এটা আবেগ নয় মিহি। তুমি আমার আবেগ নয় যে কেটে যাবে, তুমি আমার মায়া যা সারাজীবন থেকে যাবে।”
–“এই মায়াই তো সব। জানেন, মায়া আছে যেখানে কষ্ট আছে সেখানে।”

এরপর মিহি আবেগপ্রবণ হয়ে আশিকের কথা ওয়াসিফে সবটা খুলে বলে। শেষে একটু থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে-“পৃথিবীতে অনেক গভীর ভালোবাসাও বিচ্ছেদ হয়েছে,এটা তো জাস্ট মোহ।”
–” তোমার বিষয়টা কোনো বিষয়ই নয়,এটা সিরিয়াসলি কেন নিচ্ছো?আর যদি আবেগ মোহ ধরো তবে তোমারটা ধরো, আমারটা নয়।”
–“আমরা একটু বেশিই আশা করে ফেলি। ভালোবাসতে ভালো মনের প্রয়োজন হয় তাইনা!”
–“আচ্ছা সব বাদ। শুনো,আমি চাই তুমি আমাকে কম ভালোবাসো তবুও বাসো। কিন্তু সেই ভালোবাসাটা যেন সারাজীবনের জন্য হয়।”

চলবে….
চলবে…

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here