ইচ্ছেমতি পর্ব -২৩+২৫+২৬ ও শেষ

#ইচ্ছেমতি #পর্ব_২৪ #শামছুন্নাহার কথায় আছে ‘যার যায়,সে জানে’। প্রিয়জনকে হারানোর কষ্ট কতটা পীড়াদায়ক তা কেবল যার যায় সেই জানে,বুঝে। প্রিয়জন হারানোর মতো পীড়া আর কোনো কিছুতে নেই। এই কষ্ট আমাদের সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে যায়। সহজে ভোলা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। রোমানের মৃত্যুটা তার বাবা-মা সহ্য করতে পারেনি। এই পরিবারের বংশের প্রদীপটা নিবে গেল অকালেই। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঝড়ে পড়ে বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান রোমান, চলে গেল না ফেরার দেশে। হায়রে জীবন! মা বাবা আগে থেকে সব জেনেও ছেলেটার মৃত্যুটা কেন যেন সইতে পারছেন না। শত হলেও সন্তান তো,আর তারাও যে বাবা-মা! তবে জেনেশুনে নষ্ট করলেন মেয়েটার জীবন। প্রতিটা মানুষই ডিপ্রেশনে ভোগে। কেউ ঘরের অন্ধকারে,কেউ মনের অন্ধকারে। আর দিন শেষে প্রতিটা মানুষ একা। ভীষণ একলা! ছেলেটার মৃত্যুর চল্লিশদিন পার হওয়ার পরপরই মিহি বাপের বাড়ি চলে আসে। শাশুড়িও আর বাধা দেয়নি মেয়েটাকে। মিহির নতুন করে আরেকটা জীবন শুরু করার প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন। আসার সময় বলেছিলেন –” আমাকে ক্ষমা করো মা। তোমায় আর আটকাবো না,ফিরে যাও তুমি।” মিহিও চলে এল। আসার আরেকটা কারন আছে অবশ্য। তিনমাস এগারো দিনের সংসার হলেও রোমান মিহির স্বামী। এটা অস্বীকার করার নয়। ছেলেটার মৃত্যু মেয়েটাকে প্রতিনিয়ত ভাবায়। খুব কাছ থেকে দেখা। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে থেকে কিভাবে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, ঠোঁটের আশপাশটা কিভাবে ঘাঁ হয়ে ঝলসে গেছে,সটান হয়ে শুয়ে থাকা ব্যক্তিটা নিঃশেষ ছাড়া হাত-পা কিছুই নাড়াচ্ছিল না। থেরাপি নেওয়ার পর চুলগুলো ঝড়ে পড়েছিল। শুকিয়ে গিয়েছিল একদম। ভুলতে পারছে না মিহি। রোমানের চেহারাটা মনে পরে বারবার। এই তিনমাসেই কত স্মৃতি জমা হল লোকটার সাথে। মিহির মন খারাপ হলেই ঘুরতে নিয়ে যেত। তখন ওয়াসিফের কথা ভেবে ওগুলো ভালো না লাগলেও এখন সেই দিনগুলোরকে ভীষণ মনে পড়ে,মিস করে। – মেয়েটা নতুনত্বভাবে জীবন শুরু করেছে। চাইলেই তো আর সহজে নতুনভাবে জীবন শুরু করা যায়না। রোমানদের বাসা থেকে আসার পর নিজেকে দশবারো দিন সময় দিয়েছে ঠিক হওয়ার জন্য। গতকাল থেকে পূর্বের মতো ভার্সিটি যাওয়া শুরু করেছে মিহি। ভাগ্যেক্রমে প্রথমদিনই ঈশার সাথে দেখা। ঈশার সাথে কথোপকথন হল অনেকক্ষণ। পুরোনো সিমটা চেইঞ্জ করে মিহির বিয়ের আগের সিমটা ইউস করছে এখন। নতুনভাবে শুরু করলেও রোমানের কথা তার মনে আছে। মাঝেমাঝে তার সাথে কাটানো সময়গুলো মনে পড়লে ভীষণ কান্না করে মিহি। – কেটে গেল আরও পনেরোষোলো দিন। মিলির ডেলিভারির ডেইট এ মাসের শেষে। পুত্র সন্তানের বাবা হবে বলে মৃদুল খুব খুশি। প্রথম সন্তান যা হয় সবাই তাতেই খুশি। এরমধ্যে আরেকটা সুখবর আছে। ঈশাও প্রেগন্যান্ট। শিয়র হওয়ার জন্য ডাক্তাররের কাছে গেলে ডাক্তার বলেছেন বেবি কনসেপ্ট করেছে দু মাস হয়।একি সাথে দুটো খবর শুনে সবাই খুশি। – প্রতিদিনের মতো আজও ভার্সিটি যাচ্ছে মিহি। কলেজ বাসে বসে বসে নিধির সাথে আলাপন করছে সে। কথোপকথন করতে করতে একসময় কলেজে পৌঁছে যায় তাঁরা। বাস থেকে নেমে যেই না হাটতে যাবে পিছন থেকে ওর হাতটা কেউ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। হঠাৎ হাত ধরায় চমকে যায় সে।পিছনে ফিরে মিহি একবার হাতের দিকে তাকায় আরেকবার যে হাতটা ধরেছে তার দিকে। এতদিন পর চিরচেনা মুখটা দেখে মিহি যেন থমকে যায়। কালো শার্ট সাথে কালো জিন্স পরিহিত সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি আর কেউ নয়, ওয়াসিফ। মিহি নিধির দিকে তাকালো একবার। মিহি,নিধি দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ওয়াসিফ ও মিহি দুজনে চোখাচোখি হল একবার। দুজনের চাওয়াচাওয়িতে যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে সেটা বরাবরই মিহি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর ওয়াসিফের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো–“আপনি এখানে?” নিধি চলে যাচ্ছে ক্লাসের দিকে। মিহি ডাকলো।প্রতিউত্তরে নিধি বললো–” তোরা কথা বল আমি আসছি।” বলেই সে আর দাঁড়ালো না। দ্রুত প্রস্থান করল। এ কয়দিনে মিহির সবকিছু নিধি শুনেছে,জানে। সে ইচ্ছে করেই ওয়াসিফ আর মিহিকে একসাথে রেখে চলে গেল। মিহি ওয়াসিফের দিকে তাকিয়ে ফের বললো–“এখানে কেন এসেছেন?” –“চল।” –“কোথায়? –” আজকে যাবো রুপসাগরে।” –“আমার এসবে মুড নেই ওয়াসিফ। আপনি যান।” –“সে জন্যই তো নিয়ে যাবো।” বলেই ধর্মসাগরের মতো মিহির হাত ধরে টানতে টানতে তাকে রুপসাগরে নিয়ে গেলো। – ওয়াসিফ মিহিকে নিয়ে কান্দিরপাড়ে এসে কান্দিরপাড়ের ‘দিনা হোটেল’ এ সকালের নাস্তা করে। নয়টা পঞ্চাশ বাজে তখন। নাস্তা শেষ করে সেখান থেকে সিএনজি নিয়ে কুমিল্লা ক্যান্টরমেন্টে যায়। ক্যান্টরমেন্টে নামলেই তিন রাস্তার মোড় দেখা যায়। তারপর এখান থেকে পশ্চিম দিকের বা ঢাকায় যাওয়ার রাস্তা হেটে গেলেই ‘নাজিরা বাজার’। লেগুনায় গেলে পাঁচটাকা ভাড়া আর হেটে গেলে দশটাকা। ওয়াসিফ,মিহি হেটে হেটেই গেল। ওরা আগে কখনও রুপসাগরে যায়নি তাই রাস্তায় কিছু লোকজনের সাহায্য নিয়েই নাজিরা বাজার থেকে সেনাবাহিনীর চেকাপ পয়েন্টের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল। অবশেষে পৌঁছালো রুপসাগর পার্কে। রুপসাগরের পার্কে প্রবেশ করতে টিকেট কাটতে হয়। জনপ্রতি পঞ্চাশটাকা। ওয়াসিফ দুটো টিকেট কাটলো। টিকেটের দাম কমাতে বললে তারা বললো যদি এখানকার সেনাবাহিনীদের কারো আত্বীয় হয় তবে তাদের কাছ থেকে টিকেটের অর্ধেক মূল্য নেওয়া হয়। তা না হলে পঞ্চাশটাকাই দিতে হবে। ওয়াসিফের পরিচিত কেউ নেই বলে সে পঞ্চাশ টাকা দিয়েই টিকেট দুটো কিনে। তারপর ভিতরে যায়। ও হ্যা,ভিতরে প্রবেশ করার আগে ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বার লিখে মেটাল ডিরেক্টর দিয়ে শরীর তল্লাশী করে নেয়। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকায় এটি বেশি নিরাপদ। রুপসাগরের জায়গাটা একটা চোখ ধাঁধানো জায়গা।এই জায়গাটা সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত একটি পার্ক। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। সবুজের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ বলা যায়। সবুজ ছায়াঘেরা পার্কটি নিমিষেই দূর করে দেয় সকল ক্লান্তি। শিশুদের নিয়ে বেড়ানোর জন্য চমৎকার জায়গা এটি। মাঝেমাঝে বন্ধ থাকলেও পার্কটি এখন সবার জন্য উন্মুক্ত। দূরে ছোট ছোট ঢিলার মতো পাহাড় এর সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণে। এরসাথে রয়েছে বিরাট বড় দিঘী/লেক, দিঘী/লেকের পাড়ে পর্যটকদের বসার জন্য রয়েছে ব্যাঞ্চ। দিঘীর মাঝখানে বিভিন্ন ভঙ্গির ২৫টি ঘোড়ার সমন্বয়ে ভাস্কর্য এবং মিউজিক্যাল ফাউন্টেইন, বোড ক্লাবের কাজ শেষ হয়েছে। তাছাড়া হরেক রকমের ফুলের বাগান ও পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ যে কারোরই মন জুড়িয়ে যায়। দীঘির পাড়ে মাঝখানে যেখনটায় ব্যাঞ্চ রাখা সেখানে রয়েছে একটি ক্যাফেটেরিয়া। সেখানে হরেক রকমের সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায়। ওয়াসিফ মিহিকে নিয়ে ফের কিছু খাইলো। তারপর সেখান এসে দীঘির পাশের রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ হেটে একটা ব্যাঞ্চে গিয়ে বসলো। মিহির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল–” রোমানের কি হয়েছিল মিহি?” রোমানের কথা মনে পড়তেই মিহির নেত্রকোনে জমা হল মুক্তোর মতো ঝিকঝিক করা জল। ওয়াসিফের সেটা চোখে পড়ল। হাত বাড়িয়ে মুছে দিতে গেলেই মিহি শব্দ করে কেঁদে উঠে। ওয়াসিফ দুবাহু মেলে মিহিকে আবদ্ধ করে নিল বাহুডোরে। পিঞ্জিরের এতদিনের লোকায়িত দগদগে দাগটা মূহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল। ওয়াসিফ ঢিমে যাওয়া গলায় শুধালো–“আমাদের প্রতিদিন দেখা হয় না। কিন্তু বিশ্বাস কর! আমি তোমাকে প্রতিদিন,প্রতিক্ষণ ভালোবাসি।” ওয়াসিফ মিহিকে তার বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চোখেরজলটুকু মুছে দিল। নরম গলায় শুধালো-” বল রোমানের কি হয়েছিল?” –” ক্যান্সার। ” –” এই শহরের কাকটাও জেনে গেছে,আমার মনটা তোমার মনে পড় গেছে। দেখেছো নিয়তি!( ফিচেল হেসে বলে) বলেছিলাম না নিয়তির কাছে যদি আমরা হেরে যাই একদিনের জন্য হলেও তোমাকে চাই? রোমান তো আর ফিরবে না তাই না?এটা বোধহয় আমাদের একটা বড় সুযোগ। নিয়তি আমাদের এক করতে প্রস্তুত। চল বিয়ে করি,আজ এবং এখন।” –“আমি বিবাহিতা, বিধবা ওয়াসিফ। একজন ধর্ষিতা। আপনি কি আমায় বিয়ে করবেন?” ওয়াসিফের রয়েসয়ে উত্তর –“তোমার শরীরের প্রতি আমার কোনো লোভ নেই ইচ্ছেমতি। তোমার সাথে থাকা’ই আমার বরাবরের লোভ। অনেক কষ্ট আর ক্লান্ত আমি। এবার মানসিক শান্তি চাই । মানসিক শান্তির অপরনাম কি জানো? প্রিয়মানুষ। আমার প্রিয়মানুষ তো তুমি!” –” আমার গল্পটাও একটু শুনুন?” –“আমি তোমার অতিত শুনতে চাই না। চাইনা তুমি কষ্ট পাও।” –” আমি বলতে চাই। প্লিজ শুনুন। ” মিহির চাওয়াকে পূর্ণতা দিয়ে ওয়াসিফ আগের ন্যায় বলে–” আচ্ছা বলো।” #ইচ্ছেমতি
#পর্ব_২৫
#শামছুন্নাহার

–” প্রথমে যদি শুরু করি তবে আপনাকে দিয়ে শুরু করতে হবে। আপনার করা দুষ্টামি, পাগলামিগুলো কেন যেন হঠাৎ করে ভালো লাগতে শুরু করল। সেই ধর্মসাগর পাড়ে একসাথে পুরোটা দিন কাটানোর পর থেকে মনে হয় যেন আপনার প্রতি একটু বেশিই ঝুকে গেছিলাম। আপনাকে নিয়ে ভাবতাম। আশিকের কথা বলাতে আপনি যে আমাকে বুঝিয়েছিলেন? সেদিনের পর থেকে আশিককে আর একটি বারেও মনে পড়েনি। যাই হোক,তারপর কত কথা জমা হল সংগোপনে।ভেবেছিলাম আজই বলবো। তবুও কথাগুলো আর বলা হল না। কেমন করে যেন এই আজটাও ফুরিয়ে গেল। হঠাৎ দেখতে এসে বিয়ে। কতশত কল করেছি ঈশার ফোন দিয়ে কিন্তু আপনি রিসিভ করলেন না। সেদিন ভীষণ কেঁদেছি আপনার জন্য। ব্যাপারটা শুধু ঈশাই বলতে পারবে। সবটাই তো আর নিজের ইচ্ছেমত হয়ে ঔঠে না!
মিহির কথা বলার মাঝখানেই ওয়াসিফ বললো–“ঢুবলি আমাকে সব বলেছে। আর জেনেছি বলেই তোমার জন্য পাগলামিটা আরও বেশি বেড়ে গেছিলো।”
অভিমানী কন্ঠে মিহি শুধালো –” তাহলে কলগুলো রিসিভ করলেন না কেন?”
ওয়াসিফ একগাল হেসে বললো– “ফোনে চার্জ ছিল না পাগলি। সেদিনের জন্য কি অভিযোগ করছো?”
–” যদি বলি হ্যা?”
ঠোঁটের হাসির রেখা আরেকটু প্রসারিত করে ওয়াসিফ শুধালো–“যেখানে অভিযোগে অভিমান লেগে থাকে সেখানে ছেড়ে যাওয়ার চেয়েও থেকে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। এটা বোঝো না?”
মিহি কিছু বললো না। দুয়েক সেকেন্ড থেমে বললো
–” কোথায় যেন ছিলাম? ও হ্যা বিয়ের কথা। শেষমেশ বিয়েটা হয়েই গেল। কত আম্মুর কাছে বলেছি,আপু, খালামনিকে বলেছি কেউ শুনলো না আমার কথা।সবার এক কথা- ‘ছেলেটা ভালো,চেনাজানা পরিচিত। বড়লোক, বাপের এক ছেলে,টাকা পয়সার অভাব নেই করে ফেল।’ সন্ধ্যার পরপরই বাপের বাড়ি বিদায় নিয়ে স্বামীর বাড়ি যাত্রা। সেখানে কয়টায় পৌঁছালাম আমার জানা নেই। গাড়িতেও প্রচুর কান্না করেছি বলে মাথা ব্যাথায় আর কোনোদিকে খেয়াল ছিল না আমার। জানেন, গাড়িতে যখন আমি কান্না করছিলাম? রোমান আমাকে খুব বুঝিয়েছিল। আমি নাকি বাচ্চাদের মতো কাঁদি। হাসানোর জন্য অনেক কথা বলেছিল। কিন্তু কেন যেন আমি তাকে স্বামীরুপে মানতে পারছিলাম না। পারছিলাম না তাকে আমার জীবনসঙ্গী ভাবতে।বারবার আপনার চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছিলো। তারপর গাড়ি থেকে নেমে আমাকে ডিরেক্টলি আমাদের বেডরুমে নিয়ে গেল। একটু বসে থাকার পরেই রোমান রুমে আসে। খুব ভয় পাচ্ছিলাম, যদি অধিকার চায়? তাঁর হাতে বিরিয়ানির প্লেট। আমাকে খেতে বললো। আমি খাইনি। রাগে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। সে বারান্দায় চলে গিয়েছিল। আসলে আমি তখন বুঝিনি সে আমাকে সময় দিয়েছিল নিজেকে স্থির করতে। তারপর দ্বিতীয় দিন।”

বলে মিহি একটু থামলো। ওয়াসিফ বললো–” আমাকে এগুলো বলছো কেন? ”
তারপর মিহি আবার বলতে শুরু করলো-
–” আপনার জানা দরকার। সকালে নাস্তা করার পর ওনি আর আমি রুমে ছিলাম। আমার তখনও ভয় কাটেনি। আমার শাশুড়ি ছিল একটু মধ্যবয়স্কা টাইপের মহিলা। পায়ে ব্যাথা তাই কাজ করতে অসুবিধে হয়। এ সুযোগে ওনাকে ইগনোর করে কাজের দোহাই দিয়ে যেই না বের হব তখনি ওনি পিছু ডাকে। ভয়ে সিটিয়ে গেলাম। আমার দৃষ্টি ছিল নিচের দিকে। ওনি প্রশ্ন করল-” কোথায় যাচ্ছো? ”
আমি আস্তে বললাম–” আপনার আম্মুর কাছে। ওনি তো কাজ করতে পারবে না তাই…..
তিনি আমাকে পুরো কথা বলতে দিলেন না। তিনি বললেন–” এখানে এসো। রহিমা খালা আছে ওনি সামলে নিবে।”
আমি নড়লাম না। নিজের জায়গায়তেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভয়টা যেন বাড়লো। এক্ষণি অধিকার চেয়ে বসবে বুঝি? মাথায় কতসব আবোলতাবোল কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। ওনি ততক্ষনাৎ ডাকলো –” কি হল মিহি, আসো এখানে?”
ধীরপায়ে এগিয়ে ওনার কাছাকাছি যাওয়াতেই খাটের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে বললেন -“এখানে বসো।”
আমিও চুপচাপ বসলাম। তিনি বলতে শুরু করলেন–” এত ভয় পাচ্ছো কেন আমি বাঘ নাকি ভাল্লুক? তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি যেটা জানানো খুব দরকার। বলি?”
আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। মুখে কিছু বললাম না।তিনিও শুরু করেন–” বিয়েটা আমি করতে চাইনি মিহি।তোমার লাইফটাকে হেল করার কোনো ইচ্ছা আমার ছিলো না। তার জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ”

তার কথায় আমি অবাক হলাম। মনযোগ দিয়ে শুনতে লাগলাম। তারপর তিনি ফের বলেন__

–“আমি একজন ক্যান্সার রোগী মিহি। যেকোনো সময় আমার মৃত্যু হতে পারে। সে জন্য আমি চাইনি সত্যিটা জেনেশুনে এ জীবনে আর কারো হাত ধরতে,চাইনি আরেকটা জীবন নষ্ট করতে।”
বলেই রোমান থামলেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি বড় বড় চোখ করে। অবাক দৃষ্টিতে। বুঝতে পারছিলাম না তখন কি করা উচিৎ আমার,কি বলা উচিৎ, নাকি তাকে শান্তনা দেওয়া উচিৎ। আমার এমন চাহনিতে সে বললো–” ডোন্ট মাইন্ড। তোমার প্রশ্ন আসতেই পারে তবে বিয়েটা কেন করলেন? বলছি। আমার গলাতে সমস্যা ছিল। ভেবেছিলাম আজ বাদে কাল ঠিক হয়ে যাবে। ব্যাথার ঔষধ সেবন করে সেটাকে কমিয়ে রাখতাম। যদিও প্রথম প্রথম এতটাও ব্যাথা লাগতো না। এর মধ্যে আমি আবার আমার একটা দাঁত ফালাইছিলাম,ভেবেছিলাম সেজন্যই বোধহয় গলা পর্যন্ত ব্যাথা করে। অনেকদিন পর ব্যাপারটা আব্বু আম্মুকে জানাই এবং আমরা ডক্টরও দেখাই। কিন্তু কোনো রোগ ধরা পড়ছিল না। একটা হসপিটাল নয় বরং কয়েকটা হসপিটালের কয়েকজন বড় বড় ডক্টর দেখাই কিন্তু কোনো লাভ হল না। কেউ রোগের কারন ধরতে পারে না। শুধু ব্যাথার ঔষধ দিয়ে দেয়। না ধরা পরার একটা কারন আছে সেটা হল বারবার মাথা এবং দাঁতের ব্যথা ডক্টর দেখাইছিলাম। ঐ যে বললাম না ভেবেছিলাম দাঁতের থেকে গলা হয়তো ব্যাথা করে? যাইহোক, কয়েকমাস এভাবে কেটে গেল ডক্টর দেখাতে দেখাতে। একদিন খেয়াল করলাম গলায় টন্সিল এর মতো টিউমারটা বড় হচ্ছে। আম্মুকে দেখানোর পর অফিস বন্ধ করিয়ে সেদিনই ডক্টর দেখাতে নিয়ে গেল।দুদিন পর রিপোর্ট এল। রিপোর্টে আমার ক্যান্সার ধরা পড়লো। আব্বু-আম্মু বেহাল হয়ে পড়েন। ডক্টরের সাথে আবার একান্ত ভাবে কথা বলি আমি,আব্বু আর আম্মু। ওনি জানালেন- ‘এটার আর চিকিৎসা নেই। অনেক দেড়ি করে ফেলেছেন আপনারা। আমাদের হাতে আর কিছুই করার নেই। এমনিতে থেরাপি নিবেন আর যতদিন বাঁচতে পারে। ধন্যবাদ আবার আসবেন।’

চেম্বার থেকে বেড়িয়ে আম্মুর সেকি কান্না। সেদিন প্রথম আব্বুকেও কাঁদতে দেখি। বাসায় আসার পর সপ্তাহখানেক যাওয়ার পর আম্মু আর আব্বু মিলে আমার বিয়ের কথা চিন্তা করে। আমাকে জানানোর পর আমি ডিরেক্ট মানা করে দেই। প্রয়োজন নেই জেনেশুনে আর কারো জীবন নষ্ট করতে। আব্বু-আম্মুকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু তারা এই ফরজ কাজ আদায় করবেনই। আমার অগোচরে কত মেয়ে দেখছে তার হিসাব নেই। আমি সম্মতি দেই না বলে তারা এগুতে পারছিল না। তারপর একদিন আম্মু আমাকে কসম কাটায়। বিষটা না জেনেই কসম দিয়ে দিলাম। পরে শুনি আমার বিয়ের জন্য আম্মু কসম দেওয়াইছে।নিজের অনিচ্ছা সত্বেও তোমাকে দেখতে যাই।যদিও আমি জানতাম না যে মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। আমাকে বলা হল একটা আন্টির সাথে জরুরী ব্যাপারে দেখা করবে।গিয়ে দেখি পাত্রীপক্ষের বাসায় । বাসায় এসে এটা নিয়ে একটু ঝগড়া হয়।তারপরেও আব্বু-আম্মুকে অনেক বুঝালাম। আব্বুর থেকে আম্মুই বেশি ব্যাপারটা এগুলো। উল্টো আমাকে বুঝাতো ‘ বিয়ে ফরজ,এটা সম্পূর্ণ বাবা-মায়ের দায়িত্বের উপরে পরে। যদি তোকে বিয়ে না দেই হাশরের ময়দানে আমার জবাব দিতে হবে বাবা। তাছাড়া তুই কিন্তু আমাকে ওয়াদা করেছিস। ‘ মেনে নিলাম ওয়াদা দিয়েছি তাই বলে এ কদিনের জন্য একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে? আম্মুর কান্নার জন্য ঘরে থাকা যায়না। পরে বিয়েটা ঘুরে এক দেড়মাস পর তোমার সাথে আমার বিয়েটা হয়। আমাকে তুমি ক্ষমা করো মিহি। আমি… আমি সত্যিই নিষ্ঠুর। ‘ বলে ওনি কেঁদেই দিলেন। জানেন, আমার খুব খারাপ লেগেছিল। অদ্ভুত একটা মায়া সৃষ্টি হল তার জন্য। দ্বিতীয় দিন আমাদের কালরাত্রি ছিল। পরেরদিন বাড়িতে আসার কথা ছিল কোনো এক কারনে আসা হল না। সেদিন ছিল বিয়ের তিনদিন। রাতের বেলা তিনি প্রথম আমার কাছে এসেছিলেন। আমি মানা করতে পারলাম না।মাথায় ঘুরছে’ ছেলেটা ক্যান্সার রোগী,যেকোনো সময় মারা যেতে পারে। তাকে অবহেলা করা কি ঠিক হবে?’… নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি কাছে আসে সেটা তো ধর্ষণই তাই না ওয়াসিফ। আমি সেদিন প্রথম ধর্ষিত হয়েছিলাম ওয়াসিফ।”

বলেই মিহি আবার কাঁদতে থাকে। ওয়াসিফ নিশ্চুপ। মিহিকে শান্তনা দেওয়ার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না সে। মিহি ওয়াসিফের দিকে তাকিয়ে চোখ ভেজা কন্ঠেই শুধালো— “জানেন রোমান যখন অসুস্থ হয়ে পড়লো? আমার হাত ধরে বলেছিলো – আমি আর বেশিদিন নেই মিহি। আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি মারা যাবার পরদিনই তুমি বাড়িতে চলে যাবে এবং আগের মতো সুন্দরভাবে জীবনযাপন করবে যদিও তা সম্ভব না কিন্তু চেষ্টা করবে। কথা দাও।’ আমি তখন তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলাম। শত হলেও সে তো আমার স্বামী!”

একটু থেমে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে ওয়াসিফের চোখে চোখ রেখে বলে–” সবকিছুই তো শুনলেন।তারপরেও বলবেন আপনি আমাকে বিয়ে করবেন বা করতে চান?”
ওয়াসিফ ফিচেল হেসে বলে-” মানুষ তাকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়,যার কাছে সে নিজেকে খোঁজে পায়।আমিও তোমার মাঝে আমাকে খুঁজে পাই ইচ্ছেমতি। কারন আমি মুগ্ধ কেবল তোমাতে। সো আর দেড়ি নয়,ফেব্রুয়ারির জন্য আর বসে থাকতে পারবো না। আজই বিয়ে করবো তোমাকে। এখন,এই মূহুর্তে। ”
মিহি চোখ বড় বড় করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে
–” পাগল নাকি? এটা সম্ভব না ওয়াসিফ। আন্টি নিজেই এখন আমাদের মেনে নিবে না।”
–” সম্পর্ক শেষ হয়,মানুষ ও অভ্যাস বদলায়। কিন্তু মায়া আর ভালোবাসা ঠিক আগের মতোই রয়ে যায়।যারা সত্যিকারের ভালোবাসতে জানে এবং ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে তারা কখনওই কোনো কঠিন পরিস্থিতির কারনে প্রিয়মানুষকে ছেড়ে চলে যায় না। আর তোমার বিষয়টা আমার কাছে সামান্যই মাত্র।আমি তো তোমাকে আর হারাতেই দিবো না!”
–” বললাম তো আন্টি….

মিহিকে বলতে না দিয়ে ওয়াসিফ বলে

–“এ্যাই তুমি সেই মেয়েটা না, যার মুখ দিয়ে সারাক্ষন ব্ল্যাক কফির মতো তিতা তিতা কথা বের হয়?”

কিসের মধ্যে কি বললো ওয়াসিফ? ভাবতেই মিহি চোখ পিটপিট করে তাকালো। তা দেখে ওয়াসিফ শব্দ করে হাসলো। ওয়াসিফের সাথে মিহিও খিলখিলিয়ে হাসলো।
হাসির মাঝেই ওয়াসিফ পেন্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে বললো -“দাঁড়াও আম্মুকে একটা কল দেই।”

ফরিনা বেগম রান্না ঘরে কাজ করছেন। মোবাইলের রিংটোন বাজতেই তিনি দ্রুত ড্রয়িংরুমে গেলেন। যেতে যেতেই ফোনটা কেটে গেল। হাতে নিয়ে দেখলেন ওয়াসিফের কল। পরপর আরেকবার কল আসতেই রিসিভ করে কানে তুলেন। ফোন ধরতেই ওয়াসিফ বলে

–“আম্মু আমি মিহিকে বিয়ে করতে চাই।”
–” কই তুই?”
–” আমি কি বলেছি তুমি শুনেছো?”
–” পাগল হয়েছিস তুই?”
–“তোমার অনুমতি নিতে কল করেছি। তুমি কি বলো?”
–” তুই মিহিকে পাবি কই?”
–” মিহি আমার সাথেই আছে। আমি ভালো থাকতে চাই আম্মু।”
–” তবে আর দেড়ি কিসের? মিহি রাজি না থাকলে তুলে নিয়ে আয়। প্রয়োজনে ধরে নিয়ে আয়। আমি অপেক্ষা করছি।”

ফোনের ওদিক থেকে শুনা যাচ্ছে মিহি বলছে–” আমি আমার পরিবারের বিরুদ্ধে কখনওই যেতে পারবো না।”

ততক্ষণে ওয়াসিফ কল কেটে দিয়েছে। মিনিট দশেক পর ফরিনা বেগম ওয়াসিফকে ফের কল করলেন।
–” হ্যা আম্মু বলো।”
–” ঈশা বাড়িতে আছে। তুই আজ ওখানে চলে যা। রাতের বাসে আমি আসছি। আগামীকাল তোদের বিয়ে দিয়ে তবেই বাসায় আসবো। মিহির মায়ের সাথে মাত্র কথা বললাম।”
–” শাশুড়ি আম্মাজান কি বললো?”
–” বাদরটাকে দিবো এক চড়,ফাজিল ছেলে। এসে বলছি। রাখ এখন।”

মিহি ওয়াসিফ খুশি। কাল তাদের চারহাত এক হবে।অপেক্ষার প্রহর গুনছে দুজন। রাত্রের এগারোটায় ফরিনা বেগম ঈশাদের বাড়িতে এসে পৌঁছায়।


পরেরদিন সকালে ফরিনা বেগম মিহির জন্য কিছু কেনাকাটা করে। দুপুরে মিলির শশুড়বাড়ির সবারসহ দাওয়াত ছিল মিলির বাবার বাড়িতে।
বিয়ের লগ্ন উপস্থিত। কাজী এসেছেন মেয়ের সম্মতি নিতে। মিহি একটু নড়েচড়ে বসলো। বুকের ভেতরে উথালপাতাল শুরু হয়েছে। প্রিয়জনের সাথে মিল হবে জেনেও এক অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করছে সে। পরে কেঁপে কেঁপে গুনে গুনে তিনটে শব্দ বলেই দিল।জীবনকে জুড়িয়ে দিল এক ভালোবাসার মানুষের সাথে।
এরপর কাজী গেলেন ছেলের কাছে। সম্মতি জানতে চাইলে ছেলেটা কোনো দ্বিধা ছাড়াই বিনাবাক্যে বলে দিল-‘ আলহামদুলিল্লাহ কবুল।’

#ইচ্ছেমতি
#অন্তিমপর্ব_২৬
#শামছুন্নাহার

ওয়াসিফ ও মিহির বিয়েটা অবশেষে সম্পূর্ণ হল। এক পৃথিবী চাওয়া মানুষটাকে আজ নিজের করে পেল ওয়াসিফ। এক সাগর ভালোবাসা জমা এ হৃদয়ে স্থান পেল প্রিয়জন। হালালভাবে এ জীবনের জন্য মিহিকে গ্রহণ ও আপন করে নিল সে।

ওয়াসিফ, মিহির বিয়েতে স্বার্থহীনভাবে যদি কেউ সবচেয়ে বেশি খুশি হয় সেটা হল ঈশা। মিহিকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে সে কেঁদেই দিয়েছিল। মিহির জন্য বরাবরই বড্ড টান তার!

বিয়ের একঘণ্টা পরপরই সবাইকে বিদায় দিয়ে ওয়াসিফ, ফরিনা বেগম ও মিহি রওনা হল ঢাকার উদ্দেশ্য। ঢাকা থেকে পরিচিত কাউকে দিয়ে প্রাইভেট কার নিয়ে এসেছে ওয়াসিফ। তখন বাজে বিকেল চারটা। কুমিল্লা দাউদকান্দি আসার পর ওরা জ্যামে পড়ে। দাউদকান্দিতে এমনিতেও যানজটের সমস্যা বেশি থাকে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ওয়াসিফ মিহির কাধে মাথা রেখে বললো–“পানি খাবে?”

হঠাৎ শুয়ে পড়াতে মিহি কিছুটা চমকালো। সামনের সিটে বসে থাকা ফরিনা বেগমের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে ওয়াসিফের কানে ফিসফিসিয়ে বলে–” কি করছেন? উঠুন। ঠিক হয়ে বসুন। সামনে আন্টি বসে আছে তো, যদি দেখে ফেলে!”
ওয়াসিফের একরেখা উত্তর –” দেখুক।”
তারপর মিহির আচঁল টেনে ঘার্মান্ত মুখশ্রীটা মুছে আবার বললো–“উফ! প্রচুর গরম। পানি খাবে?”
–“হু।
ওয়াসিফ পানি খেয়ে মিহির দিকে বোতলটা এগিয়ে দিল। মিহি ঢকঢক করে অনেকটা পানি পান করে পাশে রেখে দিল। প্রায় আধঘণ্টা পর গাড়ি চলা শুরু করল।ওয়াসিফ মিহির কাধ থেকে মাথা তুললো না। বরং নির্লজ্জভাবে শুয়ে রইলো আগের মতোই। এদিকে মিহি কিছুক্ষণ পরপর একবার ফরিনা বেগমের দিকে তাকায় আরেকবার ওয়াসিফকে সোজাভাবে বসতে বলে।

নয়টা কি সাড়ে নয়টা।
ওয়াসিফরা বাসায় পৌঁছালো। মিহির কাছে অবাক করা বিষয় ওয়াসিফের বাবা মোশারফ চৌধুরী হাতে ধান দূর্বা ঘাস অর্থাৎ যেগুলো ফরিনা বেগম গ্রাম থেকে আসার সময় নিয়ে আসেন সেগুলোকে একটা ডালাতে করে ডালা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। শুধু তাই নয়,রাতের খাবারটাও তিনি রান্না করে রেখেছেন ওদের জন্য। বসে অপেক্ষা করছেন কখন তারা আসবে!
আসার পর ফরিনা বেগম বরণ করে নতুন বউকে ঘরে তুলেন। তারপর মিহিকে শাড়ী বের করে দিয়ে ফরিনা বেগম চলে যান ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে একটু জিরিয়ে নিল তারা। মিহিকে আলাদা একটা রুমে বসিয়ে রেখেছে। আধঘণ্টা পর ওয়াসিফ এসে দরজায় হেলান দিয়ে বলে–” এই যে ম্যাডাম খেতে আসুন। আমি কিন্তু রোমানের মতো বিরিয়ানির প্যাকেজ নিয়ে রুমে আসবো না। অতটাও রোমান্টিক বর পাওনি মেয়ে!”

মিহি ওয়াসিফের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওয়াসিফ বলে–” প্লিজ আজকের দিনটায় এটলেস্ট ব্ল্যাক কফির মতো তিতা তিতা কথা বলো না!”
মিহি হাসলো। ওয়াসিফের সাথেই ড্রয়িংরুমে গেল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করেন সহপরিবার একসাথে।

ওয়াসিফের বাবা মোশারফ চৌধুরী মিহিকে সহজেই মেনে নেন। ওয়াসিফ যে মেয়েটাকে পছন্দ করতো বা ভালোবাসতো এটা তিনি জানতেন না। কাজের কারনে তাকে বেশিরভাগই বাহিরে কাটাতে হয়। ওয়াসিফ যখন খুব অসুস্থ হয় তখন ফরিনা বেগম তাঁর কাছে সব খুলে বলেন। মিহির পূর্বাবধি সব জানার পরও ছেলের ভালোর জন্য তিনিও মিহিকে মেনে নেন।

ফরিনা বেগম মিহিকে তাদের বেডরুমে নিয়ে যান। মিহিকে ভেতরে দিয়ে তিনি চলে আসেন। ভেতরে যাওয়ার পর মিহি অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। খাটের মাঝখানে সটান হয়ে শুয়ে সুয়ে আছে ওয়াসিফ যেন আগে থেকেই সে প্রস্তুত। দরজায় ছিটকিনি আটকিয়ে মিহি দুপা এগুলো সামনের দিকে। কোমরে দুহাত রেখে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে ওয়াসিফের দিকে। মিহিকে দেখে ওয়াসিফ মুচকিহেসে কাছে ডাকলো।বললো- ” এদিকে এসো। অনেকদিন যাবদ ঘুমাইনা।আজকে একটা শান্তির ঘুম দিবো।”
প্রতিউত্তরে মিহি কিছু বললো না। ঠিক তখনি ওয়াসিফ মুখে বিরক্তিপ্রকাশক একটা শব্দ করে চটজলদি উঠে বসলো। তৎক্ষণাৎ খাট থেকে নেমে গিয়ে আলমারি খুলে মিহিকে বললো–” চোখ বন্ধ কর তো!”
–” কেন?”
–” কর না!”
মিহি চোখ বন্ধ করার দু তিন সেকেন্ড পরেই ওয়াসিফ বললো–” এবার খুলো।”
মিহি চোখ খুললো। সামনে হাটু গেড়ে বসে আছে ওয়াসিফ। মিহি অবাক হয়ে মুচকিহেসে বললো–” কি?
–” হাতটা দাও।”
মিহি হাতটা সামনে বাড়াতেই ওয়াসিফ ডায়মন্ডের একটা আংটি মিহির আঙ্গুলে পড়িয়ে দিল। কারন সে জানে মিহির গোল্ড থেকে পাথরের জিনিসপাতি বেশি পছন্দ। মুখে শুধালো –” ভালোবাসি ইচ্ছেমতি। আমার চোখে এই মূহুর্তে তোমার জন্য প্রেমময় ঝিলিক তুলছে দেখতেছো তুমি? বুঝতেছো তো? এ ঝিলিক আনন্দের ঝিলিক। মনে রেখো মরনের আগ অব্দি আর তোমার পিছু ছাড়ছি না, তোমাকে তো নয়’ই।”

বলে ওয়াসিফ মিহির হাতে চুমু দিয়ে ওঠে দাঁড়ায়। আলমারি থেকে ফের টাকা বের করে মিহির দিকে এগিয়ে বলে–” এই নাও এখানে দেনমোহর না কি যেন বলে, সবটাই আছে। তবুও আমি ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে। ক্ষমা কর। ”
–” ছিঃ কি বলছেন এসব। এটা রেখে দেন আপনার কাছে। আমার লাগবে না।”
–” এটা তোমার। তোমারটা তোমার কাছেই রাখো।” অধিকার আছে তো।”
–” এটুকুই? যদি বলি সব কিছুর অধিকার চাই?”
–” যদি বলি সেসব তোমারই!”

অনেকক্ষণ গল্প করার পর মিহি লাইট অফ করে খাটের কাছাকাছি আসতেই ওয়াসিফ মিহির এক বাহুতে ধরে টেনে বিছানায় শুইয়ে দিল। কোলবালিশের মতো মিহিকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে রইল কিছুক্ষণ। মিহি অন্ধকারের অস্পষ্ট দেয়ালের দিকে দৃষ্টি রেখে চুপচাপ শুয়ে রইল। ওয়াসিফ কি যেন মনে করে মিহির গালে একটা চুমু দিয়ে আবার মিহির কানের নিচে মুখ গুঁজে শুয়ে পরল। জীবনে পারফেক্ট মানুষ থাকার চেয়ে মানসিক শান্তি দিবে এমন একটা মানুষ থাকা খুবই প্রয়োজন। ওয়াসিফের অশান্ত মনে শান্তির আগমন ঘটে। তারপর গভীর নিদ্রায় নিদ্রারত হল সে। অনেকদিনের অপেক্ষার প্রহর শেষে শান্তির ঘুম দিল সে। জমা করে নিল দুজনের ভালোবাসার কিছু সুপ্ত অনুভূতি।

সকালে ওয়াসিফ তখনও ঘুমে। ফরিনা বেগম মিহিকে ডেকে ওয়াসিফের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারে মিহিকে বলে দিল। তারপর মিহিকে এক কাপ চা দিয়ে ওয়াসিফকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ডেকে নিয়ে আসতে বলে দিলেন। শাশুড়ির কথামত মিহিও চা নিয়ে রুমে আসে। সবে ওয়াসিফের ঘুম ভাঙ্গলো। মিহির হাত থেকে চা নিয়ে বললো–” আহ কত দিনের অপেক্ষা! কিছুটা সিনেমার মতো হয়ে গেল তাই না? প্রতিদিন আম্মু নিয়ে আসতো আর আজ থেকে এ দায়িত্ব তোমার হয়ে গেল মিহি।”
–” তাড়াতাড়ি করুন। আন্টি ফ্রেশ হয়ে যেতে বলছে। ”
–“এত সকালে আবার কোন আন্টি আসলো?”
–” আরে আপনার আম্মু। ফরিনা আন্টি। ”
–” এখনও আন্টি? ”
মিহি হেসে বললো–” আর হবে না।”

বিকেলবেলা
সোফায় বসে চায়ে চুমুক দিয়ে ফরিনা বেগম বললেন
–” আজকে কেন যেন এনিলার কথা খুব মনে পড়ছে রে ওয়াসিফ। আমি যদি চাইতাম আজকে ওয়াসিফের বউ থাকতো ওই লোভী এনিলা।”
মিহি একবার ওয়াসিফের দিকে তাকিয়ে আরেকবার ফরিনার দিকে তাকিয়ে বললো- ” কে এনিলা?”
ওয়াসিফ বলে–” ছাড়ো তো ওর কথা। বাদ দাও ওসব।”
ফরিনা বেগম বললেন–” ছাড়বো কেন? শুন মিহি, আমাদের একটা আত্মীয়দের বাসায় গিয়েছিলাম, দিয়াবাড়িতে। বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল বুঝলি? ওয়াসিফ এনিলাকে দেখে দিওয়ানা হয়ে গেছে প্রেম করার জন্য।আমাকে এসে বললো বিয়ে করবে ওকে। আমি মেয়েটাকে দেখে বললাম পরিক্ষা করে দেখ মেয়েটা কেমন? কারন আমার কাছে ওকে ভালো লাগেনি।তারপর আমার প্ল্যান অনুযায়ী ওয়াসিফ গিয়ে বলে সে তাকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চায় মেয়েটা রাজী হয় নাই। এটা ছিল প্রথমবার। তারপর দ্বিতীয়বার দেখা হওয়াতে যখন ফ্যামিলি স্টেটস সহ আমাদের সব কিছু জানলো তখন মেয়েটা রাজী। ওয়াসিফ তখন আমার কথা’ই বুঝলো মেয়েটা ভালোবাসায় না বরং টাকা আর ধনসম্পদের লোভে ওয়াসিফকে বিয়ে করতে চায়। ব্যস আর কখনও আমার কথার অমত হয় নাই আমার ছেলেটা। পরে খবর নিয়ে দেখল মেয়েটা আসলেই বাজে,বেয়াদব। এরপর তোর দেখা। ওটা তো দিওয়ানা ছিল। তোর বেলা বলবো দিওয়ানা পাগল।কোনোকিছুতে এত সিরিয়াস হতে আমি ওয়াসিফকে দেখিনি। তোকে আমার প্রথমেই ভালো লেগেছিল। আমি বলবো তুই ভাগ্যবতী। তুই আমার ছেলেটাকে আর কখনও কষ্ট দিস না মিহি। কখনও ছেড়ে যাস না।ছেলেটাকে তুই দেখে রাখিস।”

হাসির মধ্যেই হঠাৎ ফরিনা বেগম ইমোশনাল হয়ে গেলেন। মিহি তাঁকে শান্তনা দিয়ে স্থির করলেন। তারপর ওয়াসিফ মিহি রুমে চলে আসে। ব্যালকনিতে গিয়ে দুজন পাশাপাশি দাঁড়ায়। ব্যালকনিতে যাওয়ার সময় ওয়াসিফ মিহির চোখগুলো বেধে দিয়ে বললো –“তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
বলে ব্যালকনিতে নিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দিল।সামনেই মিহির প্রিয় কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ। যদিও গাছে ফুল নেই এবং গাছটা ততটা বড় নয়। মিহির দিকে তাকিয়ে ওয়াসিফ বলে–” বৃষ্টিভেজা কৃষ্ণচূড়ার রং মাখানো ভালোবাসা তোমার জন্য প্রিয়।”
যেদিন শুনেছি এটা তোমার খুব পছন্দ?সেইদিন আমি কুমিল্লা থাকতেই কলিকে দিয়ে এটা বারান্দার একপাশে লাগিয়ে দেই। যেন তুমি আসলেই এই গাছের ফুলকে দেখতে পারো। আমি অফিসে গেলে ফুলের সাথে কথা বলতে পারো।”
একটু থেমে বললো
–” মূহুর্তটা সুন্দর না? নীল আকাশ আর কৃষ্ণচূড়ার মাঝে তুমি আর আমি!”
মিহি হাসলো। ওয়াসিফ বললো-
–” আমি নতুন আরেকটা জব করছি জানো? আব্বুর অফিসে। ‘গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রি’ কোম্পানির ম্যানাজার আমি। আমাদের বিয়ের খুশিতে এই খুশির সংবাদটা দিতেই ভুলে গেছি।সরি।”
–” কংগ্রাচুলেশনস।”

শরৎকাল। ওদিকে ভাদ্র মাসের প্রায় শেষের দিকে।ভাদ্রমাসের ভেপসা গরম। তবুও হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে চারপাশটায়। পরিবেশটা মন্দ নয়। সেই বাতাশের সাথে কোথা থেকে যেন উড়ে আসছে কাশফুল। কিন্তু নিচে তাকালেই গাড়ির শব্দ, মানুষের চলাচল দেখে মাথা ঘুরে যায়। ওয়াসিফ মিহির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মিহির হাতে নিজের হাত রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে গান গায়-

‘আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি তোমার দ্বিধায় পুড়ে ছাই
এমন দ্বিধা পৃথিবীতে চেয়েছি পুরোটাই’

মিহির বিয়ের তিনদিন।
সকাল নয়’টার দিকে খবর এল মিলির ছেলে হয়েছে।সবাই খুব খুশি। আজকে মিহির বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মিলি এখন বাবার বাড়িতে আছে। ওখানে সবাই মিলিকে নিয়ে টেনশনে ছিল এবং ব্যস্ত। নতুন জামাই এই ঝামেলার মধ্যে ভালো করে আপ্পায়ন করতে পারবে না বলে মিহির মা নীলুফা বেগম ফোন করে বলেছেন ওরা যেন আরও দুইতিন পরে যায়।

সন্ধ্যার একটু পর। ওয়াসিফের হঠাৎ ইচ্ছে হল মিহিকে নিয়ে রাতের শহর ঘুরার। কাল থেকে অফিসে যাবে তাই আজকেই ঘুরতে যাবে সে। এতে ফরিনা বেগমের কোনো বাধা নেই। কারন ঢাকা শহরে এটা কোনো ব্যাপারই নয়। তাছাড়া তিনি চান মনভাঙা হৃদয় দুটো নতুন করে সতেজ হোক। ভালো থাকুক ছেলে মেয়ে দুজনেই। খুশিতে রাঙ্গিয়ে তুলুক তাদের জীবনকে।
ওয়াসিফ মিহিকে একটা শাড়ী পছন্দ করে দিয়ে সে নিজেও শাড়ীর সাথে ম্যাচিং করে পান্জাবি পড়ে নিল।মিহির শাড়ীটা হল গাড় নীলের মধ্যে সাদা রঙ্গের কাজ করা, সুতি মতো কিছুটা। সেই সাথে মিলিয়ে নিজের পছন্দ ঝুমকো কানের দুল,খোঁপায় গেঁথে নিল বেলি ফুলের গাজরা। ওয়াসিফ পড়লো হলুদ কালারের একটা পাঞ্জাবি। বেরিয়ে পড়লো দুজন।

যমুনা ফিউচার পার্ক ওয়াসিফদের বাসার একদম কাছে। বারান্দায় দাঁড়ালেই যমুনার পিছনটা দেখা যায়। তবে সামনে দিয়ে ঘুরে গেলে মিনিটপাঁচেক লাগে হেটে যেতে। ঘণ্টাখানেক যমুনায় ঘুরাফেরা খাওয়া-দাওয়া করে বাহির থেকে ফোসকা আর ঝালমুড়ি খেয়ে বাসার পথে রওনা দেয় ওরা। রাতের শহরে হেটে চলার মজাই আলাদা। রাস্তায় আসার পর একপর্যায়ে ওয়াসিফ বললো–” কাছে আসো কোলে নেই।”
মিহি ছিল ওয়াসিফের একটু সামনে। পিছনে তাকিয়ে বলে –” পাগল নাকি! ”
–” আরে বাসা তো সামনেই। এটুকুই তো!”
–” সামনেই বেশি মানুষ থাকে ওয়াসিফ। কোলে নিয়ে হাটলে সবাই তাকিয়ে থাকবে আর লোকে পাগল বলে ডাকবে আপনাকে।”
ওয়াসিফ মাথা চুলকিয়ে একবার নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে। তৎক্ষণাৎ মাথা তুলে উচ্চস্বরে বলে–“লোকে পাগল বলুক মাতাল বলুক আমি তোমার পিছু ছাড়বো না।”

তারপর দ্রুত পা ফেলে মিহির পাশাপাশি এসে মিহির হাতে হাত রেখে সুর ধরে–

ও প্রিয়…
এখন তো সময় ভালোবাসার
এ দুটি হৃদয় কাছে আসার
তুমি যে একা আমিও একা
লাগে যে ভালো
ও প্রিয়……

— হ্যাপি ইন্ডিং—

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here