❤#ইচ্ছে_ডানা
#দ্বিতীয়_পর্ব ❤
সৌরিতা নিজেকে আড়াল করার শেষ একটা চেষ্টা করে বলল,
-” রাজীব তুমি ভুল করছ, এতটা সন্দেহ করার মত আমি কিছু করিনি। তুমি এমনটা ভাবছ কেন? কে তোমাকে এসব নিয়ে বলেছে? বলো আমাকে”
-” ফ্ল্যাটের অন্যান্য লোক কি অন্ধ? তারা চোখে দেখতে পায়না?”
-“মানে? ওরা তোমাকে কিছু বলবে আর তুমি সেটা বিশ্বাস করে নেবে? আর কে বলেছে তোমাকে এই সব কথা? তুমি আমাকে তার নামটা বলো জাস্ট। একটা মানুষ ভাইয়ের মত একটা ছেলেকে নিয়ে এরকম কুৎসা কীভাবে রটাতে পারে? ”
-” সেটা তোমার না জানলেও চলবে। আমি অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তাই এই নিয়ে কখনো মাথাও ঘামাইনি, আর প্রয়োজনও মনে করিনা। কিন্তু তা বলে এতটাও বোকা নই যে কোথায় কী হচ্ছে তা জানবোনা। আর রইল ধীমানের কথা। বয়স ছোটো বড়ো এসব কি আজকাল আর ম্যাটার করে? তাই আমাকে বোকা ভেবোনা। বুঝেছো?”
-” তার মানে, আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার কোনো সুযোগই পাবোনা?
-” জানিনা। প্লিজ যাও এখান থেকে। আর বিরক্ত করোনা আমাকে”
বিরক্তমুখে জোর গলায় কথাটা বলে উঠল রাজীব।এরপর তো আর কোনো কথা বলা চলেনা। সৌরিতা স্পষ্ট বুঝতে পারল, এই রাজীব সেই রাজীব নয়, যাকে সে চিনত, যাকে সে ভালোবাসত, বিশ্বাস করত। কিন্তু সম্পর্কের মাঝখানে এতটা অবিশ্বাস নিয়ে কি কখনো বাঁচা যায়? রাজীবের মুখ থেকে এতদিন পর একটা উত্তর পেলেও মন সন্তুষ্ট হলনা সৌরিতার।মনের মধ্যে বেড়ে ওঠা রাজীবের প্রতি সন্দেহটাও তার কিছুতেই দূর হলনা। কোনো একটা কারণ তো অবশ্যই আছে, যে জন্য রাজীব এতটা ইচ্ছাকৃতভাবে ওকে দোষারোপ করছে। এতদিন যেটুকু মনের মধ্যে আশা ভরসা ছিল, সেটুকুও নিভে শেষ হয়ে গেল। তার বদলে একটা চাপা ক্ষোভ, রাগ যেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল। আর একটাও কথা না বাড়িয়ে সৌরিতা নিজের ঘরের দিকে চলে গেল একছুটে। যাওয়ার পথে, একবার পিছনে বিছানায় বসে থাকা কর্মরত রাজীবের দিকে একদৃষ্টে তাকাল সে। মূহুর্তের মধ্যে চোখের সামনে ভেসে উঠল, অতীতের সেই সুন্দর মুহূর্তগুলোর ছবি। যেই সময় রাজীব এরকম হয়ে যায়নি, যখন ওদের মধ্যেকার সমস্ত দূরত্ব প্রায় ছিলইনা বলা যায়….
সেই সময়ও অবশ্য মাঝে মাঝে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি কে নিয়ে সমস্যা,ঝামেলা বেঁধে যেত…. পরে আবার সব ঠিকও হয়ে যেত। সেইসময় সৌরিতার কখনো একবারও মনে হয়নি যে এই ছোটো ছোটো সন্দেহ করার অভ্যেসটা একসময় ভবিষ্যতে এতবড়ো সমস্যা আকার ধারণ করবে। ওদের হাসি ঠাট্টায় কাটানো মুহূর্ত গুলোর কথা মাথাতে আসতেই আরো একবার শেষবারের মতো ছটফট করে উঠল সৌরিতার মনটা। ওর মনে হতে লাগল, কোনোভাবে কি সবকিছু ঠিক করে নেওয়া যায়না? রাজীবের অফিসের লোকজনদের সাথে যোগাযোগ করে যদি কিছু খুঁজে বের করা যায়? রাজীবের পরিবর্তনের আসল কারণটা হয়তো তখনই জানা যাবে। কিন্তু এমন কে আছে যে সাহায্য করতে পারে সৌরিতাকে!
বিভিন্ন রকম কথা ভাবতে ভাবতে সৌরিতার হঠাৎই মনে পড়ল মোহরের কথা। মোহর রাজীবের অফিসের কলিগ। অনেকদিন আগে একটা গেট টুগেদার পার্টিতে মোহরের সাথে আলাপ হয়েছিল। ভারী মিষ্টি আর মিশুকে একটা মেয়ে। ওর ফোন নম্বরটা সৌরিতার কাছে আছে, আগে মাঝে মধ্যেই কথা হত। এখন আর সময়ের অভাবে কথা হয়না সেভাবে। তবে আশা করা যায় কোনো দরকারে পড়লে মোহর ওকে ফিরিয়ে দেবেনা।একটা চেষ্টা তো করাই যায়। কথাটা মাথায় আসতেই পুরোনো ডায়রির ভাঁজে নম্বরটা খুঁজতে শুরু করল সৌরিতা, নতুন একটা সুযোগের সম্ভাবনায় ওর মনে অদ্ভুত এক উত্তেজনা শুরু হয়ে গেল যেন…
************
ফোনের ওপাশে বেশ অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পরে একট মহিলাকন্ঠ শান্ত গলায় বলে উঠল,
-” হ্যালো,কে বলছেন?”
-” হ্যালো, মোহর? আমি সৌরিতা বলছি। চিনতে পারছো?”
-” সৌরিতা? ওহহ হ্যাঁ, আচ্ছা হুম, বুঝতে পেরেছি। বলো কেমন আছো?? অনেকদিন পর’
-” হুমমম আমি ভালো আছি, তুমি??”
-” হ্যাঁ আমি বিন্দাস আছি। খুব ভালো আছি, রিসেন্ট প্রমোশনও হয়েছে আমার জানো?'”
-” ওহ্, তাই? বাহ্ ভালো খবর তো। আসলে আমি একটা দরকারে তোমাকে ফোন করেছিলাম। একটু পার্সোনাল ম্যাটার। তো আমার মনে হয় আমরা ফোনে কথা না বলে যদি সামনাসামনি কথা বলতাম, বেশি ভালো হত। তোমার কি হবে সময়? ”
-” কী ব্যাপার বলোতো সৌরিতা? মানে সিরিয়াস কিছু কি?”
মোহর একটু সন্দিগ্ধ গলাতেই এবার কথাটা বলল। দুশ্চিন্তার একটা হালকা ছায়া ওর গলাতে স্পষ্ট হয়ে উঠল……..। সৌরিতা ওর চিন্তাটা দূর করতে আর ব্যাপারটা পরিষ্কার তাড়াতাড়ি করে বলল,
-” না সেরকম সিরিয়াস কিছু না। আসলে আমি এই মুহূর্তে সবকথা তোমাকে বলতে পারছি না, খানিকটা বাধ্য হয়েই। তাই চাইছিলাম যে যদি তোমার একটু সময় হত…..”
-” ওহ্ আচ্ছা আচ্ছা। বেশ আমি তোমাকে কালকে একটা টাইম জানাচ্ছি, কোনো একটা ক্যাফেতে বা কোথাও দেখা করে কথা বলে নেব। কেমন?”
-” ওকে ওকে। থ্যাংক ইউ। খুব উপকার হলো সত্যি। তুমি আমাকে ফোন করে নিও তাহলে”
-” হুমমম। ঠিক আছে। কিন্তু কী বিষয়ে কথা বলবে সেটা কি আগে থাকতে একটু বলা যাবে? মানে আমি সেভাবে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে যেতাম তাহলে।”
-” রাজীবের ব্যাপারে। ওর ব্যাপারে কয়েকটা কথা জানার ছিল আমার। সেই জন্যই ….”
-” রাজীবের ব্যাপারে? আই মিন রাজীবদার ব্যাপারে কথা????”
-” হুমমম। প্লিজ এর থেকে আর বেশি কিছু জানতে চেওনা এখন, কেমন? কাল গিয়ে তোমাকে সব কথা খুলে বলব। ”
-” আচ্ছা ঠিক আছে। কাল দেখা হচ্ছে তাহলে। টাটা”
-” হুম টাটা”
ফোনটা রেখে মনটা একটু শান্ত হল সৌরিতার। মোহর মেয়েটা ভীষণ কাজের,চটপটে। ও যদি একটু চেষ্টা করে তাহলে একটা না একটা খবর নিশ্চয় পাওয়া যাবে। আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করতে করতে সৌরিতা মনে মনে হাজারো সম্ভাবনার কথা কল্পনা করা শুরু করে দিল…..
************
আজকের রোদ ঝলমলে দিন আর নীল আকাশটা সবাইকে যেন বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে যে শরৎকাল চলে এসেছে ইতিমধ্যে। আর খুব বেশিদিন বাকি নেই বাঙালির সেই সব থেকে বড়ো উৎসবের। চারিদিকে তাই এখন থেকেই একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। সৌরিতা বাসস্টপের কাছে দাঁড়িয়ে আশেপাশের এলাকাটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল। মোহর তাকে এই লোকেশনটাই পাঠিয়েছে আসার জন্য। ও হয়তো চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই, বা একটা ফোন করাই যায়
ওকে। স্বাভাবিকভাবে রাজীবকে না বলেই আজ এখানে এসেছে সে। খুব বেশী দেরী করাও যাবেনা। রাজীব যদি এই ব্যাপারটা জানতে পারে, তাহলে তো আরো বেশি ঝামেলার মুখোমুখি পড়তে হবে। সেই ভেবেই ফোনটা হাতে নিয়ে মোহরের নম্বর টা ডায়াল করতে যাবে সৌরিতা, ঠিক সেই মুহূর্তেই ও দেখল রাস্তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে ওর দিকে তাকিয়েই হাত নাড়ছে। মেয়েটাকে একঝলক দেখেই সৌরিতা চিনতে পারল, এই তো মোহর! এতদিন পরেও ওকে দেখে চিনতে একটুও সমস্যা হলনা সৌরিতার। মোহরের চেহারায় এতটুকু পরিবর্তন হয়নি , সেই একই রকম আছে আগের মতোই।
মোহর বেশ উৎফুল্ল ভাবে, হাসিমুখে এগিয়ে এল সৌরিতার দিকে। সানগ্লাসটা চোখ থেকে খুলে ও বলল,
-” চল এই পাশেই একটা ক্যাফে আছে, ওখানে গিয়ে বসি? তারপর না হয় শুনছি সব কথা”
-“না না,শোনো মোহর আমি একটু তাড়ায় আছি। মানে ব্যাপারটা জাস্ট তোমাকে খুলে বলছি। তারপর কী করা যায় না যায় তুমি ভেবে দেখো। কেমন?”
-” ওকে বলো আমাকে কী ব্যাপার?”
-“একজন স্ত্রী হিসেবে তার স্বামীর ব্যাপারে খোঁজখবর চালানো যে কতটা অপমানের, তা বোধহয় যে এই পরিস্থিতিতে পড়ে সেই জানে । আমি খুব বাধ্য হয়েই তোমাকে একটা প্রশ্ন করছি মোহর, সেটা হল, রাজীবের অফিসে কি কারো সাথে কোনো অ্যাফেয়ার চলছে? জানো তুমি ?”
-” এসব কী বলছ??”
-” প্লিজ উত্তর টা দাও। যেটা জিজ্ঞাসা করলাম। আমার জানাটা খুব দরকার”
-” আপাতত তো জানিনা। তার জন্য খোঁজ খবর নিতে হবে। তুমি কি চাইছ যে আমি এ ব্যাপারে খোঁজখবর করে তোমাকে জানাই?’
-” হুমমম। এটাই চাইছি আমি। মানে কোনো অ্যাফেয়ার হোক বা অফিসের এমন কোনো সমস্যা যেটার জন্য ওর মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসতে পারে? এইটাই জানতে চাইছি। তুমি কি পারবে??”
-” দেখো অফিসে থেকেই অফিসের কারো ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া যেমন সোজা মনে হয়, আবার কঠিন ও তেমনই। তবু আমি চেষ্টা করব। কেমন?”
-” সত্যি??”
-” হ্যাঁ সত্যি। একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের জন্য এটুকু তো করাই যায়। আমি চেষ্টা করব নিশ্চয়”
-” বেশ, তুমি আমাকে ফোনে তাহলে সব আপডেট জানিও। কেমন? পারলে কাল থেকেই শুরু করে দিও, তুমি যতটুকু করতে পারো”
-” হুমমমম”
-” থ্যাংক ইউ সো ম্যাচ, মোহর ”
(ক্রমশ)
(