ইচ্ছে ডানা ❤️ পর্ব -০১

❤#ইচ্ছে_ডানা
#প্রথম_পর্ব❤
ফোনের নেটটা অফ করে দিয়ে পাশ ফিরে জানালার দিকে মুখ করে অলসভাবে শুয়ে পড়ল সৌরিতা। দুপুরবেলার এই সময়টুকু তার বড্ড প্রিয়। চারিদিক কেমন শুনশান, নিস্তব্ধ নিশ্চল থাকে। আশেপাশের কেউ থাকেনা তাকে বিরক্ত করার মত, বিশেষ করে রাজীব। আজকাল ওর সামান্য উপস্থিতিও যেন বিষের মত অসহ্য লাগে। ওর গলার আওয়াজ, হাঁটাচলা শব্দ সব কিছুতে একটা তীব্র ঘৃণা জড়িয়ে থাকে যেন। অথচ কয়েকমাস আগেও সব ঠিকঠাক ছিল, অন্তত সৌরিতার তাই ধারণা ছিল মনে মনে। সেই মুহূর্তে রাজীবের একটু সঙ্গ পাওয়ার সারাদিন মনে মনে উদগ্রীব হয়ে থাকত সে। বিয়ের পর পরই চোখের মধ্যে একরাশ নতুন স্বপ্নের জাল বুনে এই বাড়িতে রাজীবের স্ত্রী হয়ে এসেছিল সে। নতুন জীবন, নতুন অভিজ্ঞতা, জীবনের প্রতিটা বাঁকে বাঁকে কৌতূহল। পরিবারের একপ্রকার অমতে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল ওরা। তিন বছরের প্রেমের সম্পর্কের পরিণতি হিসেবে যখন ওদের বিয়েটা হল, কলেজের অনেক বন্ধু- বান্ধবীরা সৌরিতার ভাগ্যের প্রতি ঈর্ষাপ্রকাশ করে বলেছিল,

-” সত্যি, রিতু তুই আর রাজীবদা দুজনেই অনেক ভাগ্যবান। যে তোরা একে অপরকে সারা জীবনের মতো পেলি। সবাই তো এরকম যাকে চায়, তাকে পায়না। ভালোবাসা পূর্ণতা পাওয়ার জন্যও ভাগ্য লাগে”

সেদিন ওদের বলা কথাগুলো আজ মনে পড়লেও হাসি পায় সৌরিতার। ভাগ্য ব্যাপারটা যে এত চলমান তা তো জানা ছিলনা ওর। সেই পুরোনো রাজীব বিয়ের পর এভাবে বেমালুম বদলে একটা অন্য মানুষে পরিণত হবে, সেটাও তো কল্পনার বাইরে ছিল সৌরিতার। বিয়ের দুইমাসও পূর্ণ হয়নি এখনো ওদের, আর তার মধ্যেই এই ভাঙন। এখন মাঝে মাঝে বাড়ির কথা, সেই ছোটোবেলার পুরোনো মানুষগুলোর কথা মনে পড়লে আফশোস হয় সৌরিতার, মনে হয় বিয়ের ব্যাপারে ওদের কথাটা শোনাই বোধহয় উচিত ছিল। তাহলে আজ অন্তত নিজেকে এভাবে দোষ দিয়ে কুড়ে কুড়ে জীবনটা শেষ হয়ে যেতনা। রাজীব- তার সেই ভালোবাসার মানুষটা কী করে পারল এমনটা? বিয়ের পর পরই অন্য আরেক মহিলার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে? আর ওদের ফোনের সেই চ্যাটের কথোপকথন- যেটা সপ্তাহখানেক আগে হঠাৎ করেই চোখে পড়ে গিয়েছিল সৌরিতার। ভালো ভাবে পড়তে না পারলেও, যেটুকু কথাবার্তা চোখে পড়েছিল সেটা যথেষ্ট ছিল সৌরিতাকে ভেঙে চুরমার করে দেওর জন্য। আর সবথেকে ইদানিং যে ব্যাপারটা সৌরিতাকে ভাবায় তা হল, রাজীবের আকস্মিক চুপচাপ হয়ে যাওয়া। প্রথম প্রথম জানার অনেক চেষ্টা করেছে সে, ভেবেছিল অফিসে কোনো সমস্যা হয়েছে, বা আরো অন্য কিছু। কিন্তু রাজীব তো তাকে সেই নিয়ে কিছু বলেইনি, উল্টে বিরক্তি ভাব প্রকাশ করেছে প্রতিবার। অভিমান, কষ্টে, রাগে ধীরে ধীরে তাই নিজেকে ওর কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছে সৌরিতা। মুখে হাসিখুশি থাকলেও, ভেতরে ভেতরে সৌরিতা ভীষণ রকম মুখচোরা, অভিমানী। আর ওর সেই অভিমান ভাঙানো তো দূরে থাক, কখনো ওর সরে যাওয়ার, দূরত্ব বাড়িয়ে নেওয়ার কারণ টুকুও কখনো জানতে চায়নি রাজীব। প্রথম দিকে এত অবহেলা কিছুতেই সহ্য করতে লাগল পারতনা সৌরিতা। ভেতরে ভেতরে গুমরে গুমরে মরত, ছটফট করত। কাউকে কিচ্ছুটি বলতে পারত না। সবাই এতটা সুন্দরভাবে বর্ণনা করে তাদের সম্পর্কটাকে, এতটা সুখী ভাবে….তাদের কাছে নিজেকে নীচু প্রমাণ করতে সে কোনোভাবেই চায়না, কোনোমতেই না…. তবে এখন এসব সয়ে গেছে। এখন ঠান্ডা মাথায় সৌরিতা এটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে সেই তৃতীয় ব্যক্তিকে, যার জন্য এতটা কষ্ট অবহেলা সহ্য করতে হচ্ছে তাকে। কে সেই মেয়ে? আর তার মধ্যে এমন কী আছে, যে রাজীব এতদিনের প্রেমিকা, সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীকে এভাবে দূরে সরিয়ে রাখছে?

আনমনা হয়ে এরকম নানান কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমে চোখটা সামান্য বুজে এসেছিল সৌরিতার। হঠাৎ বাইরের দরজার আওয়াজ শুনে খানিকটা চমকে উঠল সে। রাজীব ফিরে এল নাকি? বিকেল হয়েও গেল এর মধ্যে? তাড়াতাড়ি করে বিছানায় উঠে বসল সৌরিতা। প্রতিদিন ঠিক এইসময়ে বাড়ি ফিরে একটা কাউকে ফোন করে রাজীব। সেই ফোনের কথাবার্তা আজকে শুনতেই হবে যে করে হোক। সমস্ত প্রমাণ হাতের নাগালে রেখে, খুব তাড়াতাড়িই রাজীবের মুখোমুখি হবে সে, সেদিন ঠিক কী অজুহাত দিয়ে ও নিজেকে বাঁচায় তাই দেখার অপেক্ষায় সৌরিতা….

***********

বাথরুমের শাওয়ারটা আচমকাই অফ করে দরজা দিয়ে সন্তর্পণে কান পেতে ওপাশের কথাবার্তা শোনার একটা শেষ চেষ্টা করল সৌরিতা। কিন্তু এবারেও সেই অস্পষ্ট উত্তেজিত কন্ঠস্বর ছাড়া সে আর কিছুই শুনতে পেলনা। এভাবে আর কতক্ষণই বা শাওয়ার চালিয়ে ঠায় বাথরুমে দাঁড়িয়ে থাকা যায়? শুধুমাত্র কথা গুলো আড়াল থেকে শুনবে বলেই সৌরিতা এভাবে স্নান করার ভান করে বাথরুমে ঢুকল, কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে সেটাও আর সম্ভব নয়! তাহলে উপায়? দরজাটা যে সামান্য ফাঁক করবে, তাও তো সাহসে কুলোচ্ছেনা…যদি সামনাসামনিই কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে রাজীব? তাহলে? নাহ্ এতটা এগিয়ে এসে, এরকম ঝুঁকি নেওয়ার কোনো মানেই হয়না। একটা ভুল পদক্ষেপে এতদিনের সমস্ত পরিশ্রম পন্ড হয়ে যাবে, আর সেটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায়না…..কোনো ভাবেই না….

শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তিতে ধীরে ধীরে সৌরিতার পুরো শরীরটা যেন ভারী হয়ে এল। শাওয়ার থেকে ঝরে পড়া প্রতিটা জলের ফোঁটা যেন ওর শরীর শুষে নিচ্ছে এক নিমেষে। এবার সত্যি সত্যিই জলের তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে, মাথা থেকে পা অবধি পুরো শরীরের প্রত্যেকটা ভাঁজই ভিজিয়ে নিল সৌরিতা। ঠান্ডা জলের ধারা ওর উত্তপ্ত কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল খুব ধীরে ধীরে।
চোখ থেকেও বুঝি বা খানিক নোনতা-তপ্ত জল মিশে গেল সেখানে…..
‘বিয়ে’ – জীবনের এই বড়ো, গুরুত্বপূর্ণ অংশটাকে ঘিরে ঠিক যতরকম ভাবে রঙিন স্বপ্ন বুনেছিল সৌরিতা তার থেকেও বেশি টুকরোয় ভেঙে গেছে তার স্বপ্নের আয়নার প্রতিটা কাঁচ…. সমস্ত প্রেমের গল্পে, ভালোবাসায় বিয়েটাই নাকি সফলতা? সব দুঃখ, কষ্টের শেষ?? স্বপ্নপূরণ?? ….. নাকি ওটাই আসলে শুরু? দুঃখ-কষ্টের বা স্বপ্ন ভাঙা-গড়ার?…..

*********
ভিজে মাথায় যখন বাথরুম থেকে বেরোলো সৌরিতা, ততক্ষণে ফোন রেখে ল্যাপটপে আবার নিজের কাজে মন দিয়েছে রাজীব। সৌরিতাকে কোনোরকম পাত্তাও সে দিলনা। যেন অন্য আরেকটা মানুষ থাকেই না এই ঘরে। রাগে সারা শরীরটা যেন চিড়িবিড়িয়ে উঠল সৌরিতার। মাত্র একুশ বছর বয়স ওর, ছোটো থেকে কোনো কষ্ট-সমস্যার মধ্যে বড়ো হয়নি, আর এখন এই বয়সে, যখন মানুষ একটু হেসে খেলে বাঁচে তখনই তাকে এত যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে?? সে মানছে, দোষটা হয়তো তার নিজেরই, তাও? একটা দোষের জন্য, জীবনের কটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য সারাটা জীবন এভাবে কাটাতে হবে??
আর থাকতে না পেরে সৌরিতা এবারে একটু জোর গলাতেই রাজীবের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

-” খাবেনা কিছু?”

-” না”

-” তোমার কী হয়েছে সেটা কী বলবে? মানে আজ প্রায় একমাস ধরে একটা কথা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছি আমি। আর তুমি কোনো পাত্তাই দিচ্ছ না, কেন বলবে?”

-” কিছুই না। তুমি নিজের মতো আছো, আমি আমার মতো। আর এখন অফিসের অনেক চাপ, তাই একটু ব্যস্ত। ”

-” আর কেউ করেনা, অফিসের কাজ? তাদের ঘরে কেউ থাকেনা? তুমি একাই মনে হয় অফিস সামলাও?”

-” সবাই তো সমান নয়”

-” ওকে, বুঝলাম। কিন্তু তুমি আমাকে এটা বলো,আমার সাথে এত বছর সম্পর্কে থেকে, বিয়ের পর পরই পরকীয়া করতে তোমার একটুও বিবেকে বাধল না?”

-“আমি ? অবৈধ সম্পর্ক?”

মুখে প্রচন্ড রকম একটা বিস্ময় ভাব ফুটিয়ে তুলল রাজীব। ওর মুখটা দেখেই সৌরিতার মনে হল নিজের দোষ ঢাকতে এরকম করে মুখের ভাব করছে রাজীব, আর তাতে ওর রাগটা আরো বেড়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে সৌরিতা রাজীবের ল্যাপটপ টা সশব্দে বন্ধ করে দিয়ে উঁচু গলায় বলল,

-” তুমি তাহলে কার সাথে কথা বলো প্রতিদিন? তোমার ফোনে তাহলে ওগুলো মেসেজ আসে, যেগুলো প্রাইভেট করে রাখা?”

-” তুমি পড়েছো সেগুলো? বাহ্, তাহলে তো তোমার সব জেনে যাওয়ারই কথা ”
রাজীব এবার একটু টানটান হয়ে বসল। স্থির চোখে সৌরিতা দিকে তাকিয়ে রইল সে। সৌরিতা এবার একটু উত্তর দিতে গিয়ে থমকে গেল। সন্দিগ্ধ গলায় সে ধীরে ধীরে বলল,

-” জেনে যাব মানে??? কী জেনে যাওয়ার কথা বলছ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।”

-” হুমম আমিও তোমাকে কিছু বলতে পারিনি, উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে। আর সেটারই খোঁজ করছি বর্তমানে।”

-” মানে?”

-” মানেটা খুবই সহজ। অবৈধ সম্পর্ক আমি করছি না তুমি করছ সৌরিতা??”

-” আমি????”

রাজীবের বলা কথার উত্তরে কী বলবে ভেবে পেলনা সৌরিতা। এতদিন সে রাজীবকে সন্দেহ করত, আর এখন রাজীব উল্টে তাকেই এরকম বলছে? কেন? নিজের দোষটাকে ঢেকে দেওয়ার জন্য? কারণ বিয়ের অবৈধ সম্পর্ক তো দূর, কোনো ছেলের সাথে সেভাবে কথাও বলেনি সে। তাহলে???
রাজীব অবশ্য সৌরিতার এই অবাক হওয়া দেখে বেশি বিচলিত হলোনা। স্থির গলাতেই সে বলল,

-“বেশ সরাসরিই বলি তবে। বিয়ের পর থেকেই দেখছি, পাশের ফ্ল্যাটের যে ধীমান, ও মাঝে মধ্যেই আমাদের বাড়ি আসে, বা বলা ভালো একটু বেশিই আসে। যখন তখন আসে, আমি না থাকাকালীনও আসে। এটা সন্দেহজনক নয়? তুমি আবার আমাকে সন্দেহ করছ?”

-” ধীমান?? ধীমান আমার ভাইয়ের বয়সী রাজীব। ছিঃ । ও আমাকে দিদি বলে, মাঝে মাঝে আসে ব্যস। আর তুমি এটাকে নিয়ে….. ছিঃ। আমার ভাবতেই কীরকম লাগছে”

-” আমি একা তো ভাবিনি, আরো অনেকেই ভেবেছে, অনেকে বলেছে। তাই আমি এতদূর ভেবেছি। যাই হোক, তোমাকে বিয়ে করেছি যখন তখন দায়িত্ব তো নিতেই হবে, আর তোমাকে ডিভোর্সও আমি দেবনা। তাতে লোকে আমার উপর হাসবে। সুতরাং আমি তোমার উপর কোনো অধিকার দেখাবো না, তুমি থাকো তোমার মত। আমি থাকি আমার মতো। বোঝা গেছে?”

রাজীবের শেষ কথায় আর নড়াচড়া করারও কোনো সুযোগ পেলনা সৌরিতা। হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল ওর। এসব কথা তো কখনো দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেনি। শেষে এই কারণে রাজীবের এমন পরিবর্তন? এও কি সম্ভব ? নাকি এর পেছনে আরো অন্য কোনো কারণ আছে, যেটা রাজীব ওর থেকে লুকোতে চাইছে??
(ক্রমশ)

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here