❣#ইচ্ছে_ডানা
#দশম_পর্ব❣
রাজীব হঠাৎ কেন না জানি সৌরিতার মুখে ভালোবাসার কথাটা শুনে থমকে গেল একটু। কেমন একটা দ্বিধাগ্রস্ত চোখে ও তাকিয়ে রইল দরজার দিকে। সৌরিতার সেটা নজর এড়ালো না। রাজীবের এরকম পরিবর্তিত মুখ দেখে ওর মনে একটু যেন আশার আলো ফুটে উঠল। তবে কি রাজীবের সত্যিই কোনো পরিবর্তন হয়নি আদৌ? সবটাই ছিল ওর মনের ভুল ধারণা?? তাড়াতাড়ি করে এবার সৌরিতা সামান্য নরম গলায় বলে উঠল,
-” কী হলো বলো, উত্তর দাও”
-” আমি কিছু জানি না। তুমি অফিসে কেন গিয়েছিলে সেটা বলো।”
-” আমি তো উত্তর দিয়েই দিলাম। কতবার বলব?”
-” বেশ। আমি কোনো প্রশ্ন আর করবনা। তাহলে তুমিও আমাকে বারবার এত প্রশ্ন করে বিরক্ত করবেনা। মনে থাকবে??”
-” কিন্তু রাজীব, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ,তুমি নিজেও জানো আমি নির্দোষ,তোমার মুখ দেখে তাই বোঝা যাচ্ছে। তাহলেও কেন এরকম করছ, কার ভয়ে? আমাকে খুলে বলো”
-” ভয়? আমি-আমি কেন ভয় পাব? কীসের ভয়? আমি কিছুরই ভয় পাইনা। আমার ভালো লাগছেনা, এখন থামাও এই প্রসঙ্গটা।”
এই বলে বিরক্ত মুখে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল রাজীব। ওর মুখটা দেখে কিছুই যেন স্পষ্ট ভাবে আঁচ করতে পারল না সৌরিতা। কিছু তো একটা লোকাচ্ছে রাজীব ওর থেকে, কিন্তু কী সেটা? ওর ধারণা অনুযায়ী কোনো তৃতীয় সম্পর্ক?? নাকি, অন্য কোনো কারণ?
মোহর তো অন্য কোনো কারণের কথা জানেই না বলল, তাহলে??? আর কী থাকতে পারে কারণ? অনেক অনেক ভেবেও কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পেলনা সৌরিতা। ক্লান্ত চোখে ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকটা খুলল ও। এই অ্যাকাউন্টটা ওর নিজের আসল নামে খোলা নেই, রীতি দত্ত নামে, যেটা ওর ডাকনাম। নিজের ডাকনামটার দিকে তাকিয়ে মনটা ভীষণ ভাবে হুহু করে করে উঠল সৌরিতার। মা বাবা, ঠাম্মি কত আদর করে ওকে রীতি বলে ডাকত, কত ভালোবাসা ছিল সেই ডাকে। আর আজ? যে জিনিসটা আগে না চাইতেই পেয়ে যেত সে, বর্তমানে এতটুকু ভালোবাসা, অধিকার পেতে ওকে রীতিমত যেন ভিক্ষা করতে হচ্ছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পরিবারের অমতে বিয়ে করে তবে কি সে খুব ভুল করে ফেলল?……কে জানে, হয়তো এর উত্তর সময় একদিন দেবে………
****************
ফেসবুকটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ সৌরিতার মনে পড়ল সৌরদীপের কথাটা। ওকে খুঁজে দেখলে হয়না একবার? হয়তো পাওয়া যেতেই পারে…। কিন্তু ওর পদবীটা কিছুতেই মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে। কী যেন বলেছিল বেশ, একটা …..নাকি আদৌ বলেইনি?? কৌতূহলী হয়ে শুধু নাম দিয়েই সার্চ করল সৌরিতা। সামনে আসা প্রত্যেকেরই প্রোফাইল ফটো একে একে দেখতে লাগল। কাউকেই দেখে ঐ ছেলেটার মত লাগলনা তার। তা হলে কি সৌরদীপ ফেসবুক করেনা?? হতেও পারে….
অনেক খুঁজেও না পেয়ে, হতাশ হয়ে যখন নেট অফ করে শুয়ে পড়তে যাবে সৌরিতা, ঠিক তখনই স্ক্রিনের নীচের দিকে সৌরদীপ নামের প্রোফাইল ফটোটার দিকে নজর গেল ওর। চেনা চেনা লাগছে। দ্রুত হাতে ক্লিক করে, প্রোফাইলটায় ঢুকে পড়ল সৌরিতা। হ্যাঁ সেই ছেলেটাই তো! একটা কালচে নীল রঙের চেকশার্ট আর জিন্স পরে প্রোফাইল ফোটোটা দেওয়া। সামনাসামনি ছেলেটাকে তেমন ভালোভাবে দেখা হয়নি, মানে দেখার সুযোগ পেলেও চক্ষুলজ্জার খাতিরে তাকিয়ে থাকা সম্ভব হয়নি ওভাবে। কিন্তু এখন, সম্পূর্ণ নিজস্ব এই সময়টাতে একা একা বসে সৌরিতার মনে সৌরদীপের ব্যাপারে জানার জন্য অদ্ভুত ইচ্ছা জাগল।……
প্রোফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে অনেকদূর অবধি চলে গেল সৌরিতা। ছেলেটি খুব বেশি অ্যাকটিভ থাকেনা ফেসবুকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। ভালো একটা পোস্টেই কাজ করে, পরিবার পরিজনও দেখে ভালোই মনে হচ্ছে। অবশ্য ছেলেটা যে ভদ্র, ভালো তা ব্যবহার দেখলেই বোঝা যায়। তবে কথাটা ভাবার সাথে সাথেই আরো একটা সম্ভাবনা সৌরিতার মাথায় এল……..সেটা হল রাজীব, আর ওর পরিবর্তন। ওকে দেখেও তো প্রথমে ভালো, ভদ্র এসবই মনে হত। অথচ সময়ের সাথে সাথে সেই মানুষটারই কত পরিবর্তন! মানুষ নামক জীবটাকেই মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে ভয় লাগে সৌরিতার, বিশ্বাস শব্দটা মাথায় এলেই একটা তীব্র ঘৃণা, ভয় জেগে ওঠে ওর মনে।
সৌরিতার ভীষণ ইচ্ছে করতে লাগল ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে, যে ওকে আজ এতটা সাহায্য করল, এতক্ষণ ধরে ওর খারাপ সময়ে পাশে থাকল, একজন বন্ধু হিসেবে তাকে ভেবেই যায়, কিন্তু সরাসরি নিজে থেকে রিকোয়েস্ট পাঠাতে কীরকম যেন সংকোচ বোধ হতে লাগল ওর, কী ভাববে উল্টোদিকের মানুষটা ? এই ভেবে ভেবেই ওর আর এগোনোই হলনা, পাঠানো হলনা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা। তবে রিকোয়েস্ট পাঠাতঃ না চাইলেও, কখন যে ভুল করে, নিজের অজান্তেই ছবি দেখতে দেখতে সৌরদীপের একটা পোস্টে রিয়্যাক্ট পড়ে গিয়েছিল তা একদমই খেয়াল করেনি সৌরিতা। মনে মনে হাজার রকম চিন্তাভাবনা করতে করতে, ফোনটা রেখে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল সে। আজকাল আর, রাজীব তার জন্য অপেক্ষা করেনা, সেও কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। অপেক্ষা গুলো শেষ হয়ে গিয়ে এখন সেখানে জায়গা করে নিয়েছে, অভিমান আর বহু ভুল বোঝাবুঝির পাহাড়…..
************
সেইদিন ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও, কিছুদিন পরেই ঘটনাটা পরিস্কার হল সৌরিতার কাছে। সেদিনের ঘটনার পর প্রায় একসপ্তাহ কেটে গেছে। যে যার কাজে সে তার মত আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাজীব আগের মতোই অবজ্ঞা, অবহেলায় ব্যস্ত আর সৌরিতা তার কারণ খুঁজতে ব্যস্ত। এই নতুন চোরপুলিশের মতো খেলায় কার জিত, কার হার হবে তা বোঝা বোধহয় সত্যিই মুশকিল।
সৌরিতার মনে প্রথম চমকটা লাগল, যখন ও দেখল ফেসবুকে মেসেজ রিকোয়েস্ট একটা অজানা মেসেজ। আর যে মেসেজটা পাঠিয়েছে তার নামটা ভীষণ ভাবে পরিচিত, সৌরদীপ……। এই কয়েকদিনে, নিজের সময়ে অসময়ে, অবসরে যতবার পেরেছে সৌরদীপের ফেসবুক প্রোফাইলটা কতবার যে দেখেছে সৌরিতা তার ঠিক নেই। ওর প্রোফাইলের অনেক আগের দিকে অর্পিতা বলে একটা মেয়ের নাম খুব উল্লেখ আছে, কয়েকটা ছবিও বোধহয় আছে। তবে এখন আর তার কোথাও উল্লেখ নেই। তা হলে কী, ওর জীবনেও এই অর্পিতা বলে কেউ ছিল যে এখন আর নেই? হতেই ন
পারে, এতে অস্বাভাবিক কিছুই নেই। হয়তো এখন রাজীব যেরকম, সেই মেয়েটাও ওরকম ছিল, সৌরদীপকে ঠকিয়ে ছেড়ে চলে গেছে। আবার এর উল্টোটাও হতে পারে। তবে উল্টোটা হওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ সেক্ষেত্রে সৌরদীপ মেয়েটার সব ছবি রেখে দিতনা এভাবে…..
সৌরিতা মেসেজটা দেখে অবাক হয়ে গেল, ও দেখল সেখানে লেখা আছে,
-” আরেহ্, আপনি সৌরিতা তো? আপনি আমার একটা পোস্টে রিয়্যাক্ট করেছিলেন। নামটা দেখে প্রথমে বুঝতেই তো পারিনি। যাই হোক,আপনাকে রিকোয়েস্ট পাঠালাম, পারলে একসেপ্ট করবেন”
সৌরিতা এই অ্যাকাউন্ট টা খুব সম্প্রতিই খুলেছিল, একটা বিশেষ প্রয়োজনে। আর বিশেষ কারণটা অবশ্যই রাজীব সংক্রান্তই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাই এই প্রোফাইলে রাজীবের কোনো ছবি বা ওর ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই। সৌরিতার মনে আচমকাই একটা ভয় চেপে বসল, সেদিন সৌরদীপের সাথে দেখা হওয়ার সময়ও তো ও বুঝতে পারেনি যে সে বিবাহিত। আজও ফেসবুক দেখে বুঝতে পারবে না হয়তো, এইরকম করে কোনো ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়ে যাবে না তো কখনো?? কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজের মনকে বুঝিয়ে সান্ত্বনা দিল সৌরিতা। সে আর সৌরদীপ সম্পর্কে কে ই বা এমন হয় যে, সব তথ্য, সব সত্যি ওকে জানাতে হবে। ব্যক্তিগত কারণে এরকম থাকতেই পারে, তাতে ভুল তো সেরকম কিছু নেই।
অনেকগুলো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এর ভিড় থেকে,চেনা প্রোফাইলটা দেখে কাঁপা কাঁপা হাতে খুলে সেটা অ্যাকসেপ্ট করল সৌরিতা। ও দেখল সৌরদীপ এই মুহূর্তে অনলাইনই আছে। ওর মেসেজের একটা উত্তর দেওয়া কি উচিত না? ভদ্রতার খাতিরে করাই যায় একটা মেসেজ। অনেক ভেবে টাইপ করে সৌরিতা লিখল,
-” হ্যাঁ, ফেসবুকে আমার ডাকনাম দিয়েই রয়েছে আসলে। আমি একসেপ্ট করেছি। ভালো লাগল, আপনাকে এভাবে খুঁজে পেয়ে।”
এর থেকে বেশি আর কী লেখা যেতে পারে, মাথায় এলোনা সৌরিতার। তবে ও খেয়াল করল, সাথে সাথেই মেসেজটা সিন হলো, আর যান্ত্রিক একটা টুং করে শব্দ জানান দিল ও প্রান্তের মেসেজের। ব্যস্ত হাতে সৌরিতা চ্যাটবক্সটা খুলল….. ওদের কথোপকথন টা খানিকটা এভাবেই যেন শুরু হয়ে গেল।
“কেমন আছেন? ” মেসেজ টা দেখে, খানিকক্ষণ ইতস্তত করে সৌরিতা লিখল,
-” ভালো, আপনি?”
-” হুম এই আছি।, আপনি কিছু মনে করলেন না তো এভাবে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম বলে, আসলে আপনার রিয়্যাক্ট টা দেখেই, আমি কৌতূহলী হয়ে, দেখলাম ওটা আপনি। তাই আরকি”
-‘হ্যাঁ মানে, কেন জানিনা,আমার ফ্রেন্ড সাজেশনে আপনাকে দেখাচ্ছিল। তাই প্রোফাইলটা দেখতে গিয়ে ভুলবশত রিয়্যাক্ট পড়ে গেছে”
-” ওহ আই সি, কাকতালীয় ব্যাপার তা হলে! হা হা হা”
কথার সাথে কয়েকটা হাসির ইমোজিও পাঠালো সৌরদীপ। আর কথার শুরুতেই এভাবে অপ্রস্তুত হয়ে মিথ্যে বলে প্রচন্ড অস্বস্তিতে পড়ে গেল সৌরিতা। তাড়াতাড়ি করে ও অফলাইন হয়ে গেল। মিথ্যা তো বলতেই হত, সৌরদীপকে তো আর বলা যায়না, যে ইচ্ছে করেই ওকে খুঁজে ওর প্রোফাইলটা দেখছিল ও। তার থেকে এই মিথ্যেই ভালো, একটা অস্বস্তিকর ঘটনা তো এড়ানো গেল। ……
(ক্রমশ)
(