ইচ্ছে ডানা ❤️ পর্ব -০৯

❤#ইচ্ছে_ডানা
#নবম_পর্ব ❤
দূরত্ব তৈরী হলেও, সেদিন সেই সাময়িক বিচ্ছেদে সৌরদীপ আর অর্পিতার সম্পর্কের মাঝে এতটুকু ফাটল আসেনি কখনো। দূরে থেকেই ওরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ রেখেছিল দিব্যি। প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে অন্তত তিনদিন তো ফোনে কথা হতই ওদের। আর যেটুকু সময় ঐ ফোনে কথা হত, সৌরদীপ এমন ভাবেই কথা বলত, যে অর্পিতা মাঝে মাঝে ওদের মধ্যেকার দূরত্বটুকু ভুলেই যেত বেমালুম। এই তিন বছরের মাঝে বহু মনখারাপের, বহু টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে দুজনেই। এর মাঝে কখনো মনে হয়েছে জীবনটা আসলেই গুরুত্বহীন, নতুন করে আর এখান থেকে কিছু পাওয়ার নেই, আবার কখনো মনে হয়েছে যে জীবনের, এই সময়টুকুই আসলে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। একে অপরের মানসিক পরিপূরক হয়ে কখন যে ওরা সম্পর্কের অনেকটা গভীরে চলে গিয়েছিল তা বোধহয় কেউই বুঝতে পারেনি।

” ভালোবাসি” কথাটা মুখে বলা,আর মনের সর্বস্বটুকু দিয়ে ভালোবেসে যাওয়ার মধ্যে কতটা পার্থক্য আছে তা সৌরদীপ ক্রমশ ভালোভাবে বুঝতে পারছিল। আরো বছর দুয়েক পরে, চাকরিটা পাওয়ার পরে যখন কলকাতায় ফিরে এল ও, তখন প্রেমের সম্পর্কের মাঝে নতুন করে বাড়তি দায়িত্ব এসে গেছে। অর্পিতাই মাঝে মাঝে এমন ছেলেমানুষি করত যে ওর কথাবার্তা শুনে না হেসে থাকতেই পারত না সৌরদীপ। যেমন হয়তো কোনো একদিন অফিসের কোনো মিটিং এ সারাদিন ব্যস্ত আছে সৌরদীপ, সেভাবে কথা বলা হয়নি অর্পিতার সাথে…….ব্যস সেদিন ম্যাডামের অভিমান ভাঙায় কার সাধ্যি! ওর নাকি বারবার এটা মনে হত যে আরো বড়োসড়ো কেউ হয়ে গেলে সৌরদীপ আর ওকে আগের মত ভালোবাসবেনা, আগের মত গুরুত্ব দেবেনা। এই হারানোর ভয় থেকেই অর্পিতা বারবার বিয়ের প্রসঙ্গ তুলত। যদিও বিয়ের বয়স তখনও ওদের দুজনের তেমন পেরিয়ে যায়নি। তবু অর্পিতার প্রস্তাবটা সৌরদীপও ঠিক মন থেকে নাকচ করতে পারেনি। নিজের প্রিয় মানুষটার সাথে এত দূরত্ব পর, যদি একেবারে সারা জীবনের মতো কাছাকাছি আসা যায়, তবে ক্ষতি কী? আর যেখানে ওদের দুজনেরই পরিবার থেকেও এই নিয়ে আপত্তি নেই।
কিন্তু সৌরদীপ বা অর্পিতা হয়তো কেউই বুঝতে পারেনি যে আপত্তিটা স্বয়ং সেই ভগবানেরই ছিল, ওদের ভাগ্যের ছিল। মানুষ চেষ্টা করে, আশা করে প্রত্যাশিত ফলাফলের, কিন্তু অনেকটা পথ পেরিয়ে যখন আর আমাদের সত্যিই কিছু করার থাকেনা….তখনই বোধহয় ভাগ্য কথা বলে,আর সেই ভাগ্যের লেখার পরিবর্তন করবে এমন সাধ্যিও কার আছে! স্বয়ং ভাগ্যদেবতারও নেই হয়তো……..

অর্পিতার ক্যান্সারের কথাটা প্রথম যখন শুনেছিল সৌরদীপ ভয় পেলেও অতটা ঘাবড়ে যায়নি। এখন তো কত রকম প্রযুক্তি বেরিয়েছে, কত চিকিৎসা পদ্ধতি আছে, তার মধ্যে ক্যান্সারের স্টেজও ছিল সেকেন্ড। ফলে অর্পিতার সেরে ওঠার অনেক সুযোগ, আশা ছিল। সৌরদীপের হাতে তখন সবে সবে উপার্জন করা টাকাপয়সাও নেহাত কম নেই। অর্পিতার বাড়ির লোকের সাথে সাথে ও নিজের সবটুকুও উজাড় করে দেওয়ার কথা ভাবতে লাগল। কীভাবে, কোথায় নিয়ে গেলে আরো ভালো চিকিৎসা হয়, আরো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায় অর্পিতা সেই চেষ্টাই করছিল। অবশ্য নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে অর্পিতা যেন এর চিন্তাই হলনা বিশেষ। ক্যান্সার ধরা পরার পরে, সেই প্রথম দিন ওর মনে একটাই কথা ঘুরে ফিরে আসছে যে, ওর এই অবস্থা দেখে সৌরদীপ না ওকে ফেলে দূরে চলে যায়। অথচ আগে এতটা ছেলেমানুষি ভাবনাচিন্তা কখনোই তেমন করতনা। কিন্তু না জানি কেন, হঠাৎ করেই এই ব্যাপার ওর মধ্যে লক্ষ্য করতে লাগল সৌরদীপ। সবসময় কীরকম যেন একটা ভয়ে ভয়ে থাকত মেয়েটা। সৌরদীপ যতক্ষণ ওর কাছে থাকত, একমুহূর্ত চোখছাড়া করতনা ওকে। আর মুখে কেবল ঘুরেফিরে সেই একটাই কথা ,

-” আচ্ছা আমি মরে গেলে তুই আবার অন্য কাউকে নতুন করে ভালোবাসবি তাই না??”

-” উফ, অপু, তুই থামবি? কতবার বারণ করলাম এই কথাটা বলতে?? কেন বলছিস? আমি,তোর বাবা মা, তোকে সুস্থ করার জন্য এতকিছু করছি আর তুই কিনা”

-” তুই আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে কেন যাচ্ছিস?”

-” কোথায় এড়িয়ে যাচ্ছি??”

-” তাহলে বল, যে তুই আমাকে কখনো ভুলে যাবিনা? আমি না থাকলেও তুই আমাকেই ভালোবাসবি? অন্য কারোর হবিনা?”

-” তুই কোথাও যাবি না, তাই দ্বিতীয় কারোর কথা এখানে আসছে কেন?? তুই আমার সাথে শেষ অবধি থাকবি ব্যস। আমি কিছু জানিনা”

-” আর যদি ধর না থাকলাম তখন? অন্য কারোর সাথে নতুন সম্পর্কে যাবি?”

-” উফফফ, না। যাবনা। আমি তোর ছাড়া কোনোদিনও কারো হবোনা। কারোর না, বুঝেছিস??”

সৌরদীপের বলা কথাটা শুনে অর্পিতা কেমন যেন একটা অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠল। সেই হাসির অর্থ ঠিক বোধগম্য হলনা সৌরদীপের। অবাক হয়ে ও বলল,

-” কেন হাসছো?? কী হাসির কথা বললাম?”

-” হাসছি এই কারণেই যে তুমি এই কথাটা রাখতে পারবেনা।”

-” কোন কথাটা?”

-” এই তুমি আমার ছাড়া কখনো কারো হবেনা,এটা”

-” তুমি আমার উপর বিশ্বাস করোনা?”

-” করি, কিন্তু ভগবানের উপর আর করিনা। উনি কাকে কাছাকাছি আনবেন, আর কাকে কার থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন বোঝা মুশকিল। তাই বললাম”

-” বল জানিস তুই, যেটা আমি চাইব সেটাই হবে। ভগবান কী করবে??”

-” দেখা যাক”

এই বলে কথা উদাসীন ভাবে হসপিটালের বেডে শুয়ে জানালার দিকে তাকালো অর্পিতা। ওর মনে সেই মুহূর্তে কী চলছিল তা শত চেষ্টা করেও বুঝতে পারেনি সৌরদীপ। খুব রাগ হচ্ছিল তখন মেয়েটার উপর, বারবার মনে হচ্ছিল যে ওর প্রতি অর্পিতার এতটুকু বিশ্বাস নেই তাই এসব ভাবছে। আর সবথেকে বড়ো কথা হল, যেখানে ডাক্তার আশ্বাস দিয়েছেন যে ও সুস্থ হয়ে যাবে সেখানে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা আসছেই বা কেন? কিন্তু ঐ যে ভাগ্য! ঐ একটা জিনিস যার কাছে বারবার হেরে গেছে সৌরদীপ। জীবনে যতবার উঠে দাঁড়াতে চেয়েছে, ঠিক ততবারই ভাগ্য ওকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে নীচে নামিয়ে দিয়েছে।

সেদিনের ঘটনার পর ঠিক এক সপ্তাহ পরেই চিরদিনের মতো ওর হাত টা ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যায় অর্পিতা। ওর জ্বলন্ত চিতার সামনে দাঁড়িয়ে যখন সেই কথা গুলো মনে পড়েছিল সৌরদীপের , কঠিন মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে জীবনে মরে যাওয়ার আগে অবধি অন্য কারো সাথে কোনোরকম সম্পর্কে যাবেনা ও। সারা জীবন অর্পিতার স্মৃতি , আর ওর সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো নিয়েই বেঁচে থাকবে। অর্পিতার ধারণা টাকে ভুল প্রমাণিত ও করে দেবেই……

তারপরে এতগুলো দিন, মাস, বছর কেটে গেছে। অবসরের বাইরে, কাজের চাপে অর্পিতাকে আর সেভাবে মনে পড়েনা। শুধু এই রাতের একা মুহূর্তগুলো, যখন কাঁধে মাথা রেখে কাঁদার মত কেউ নেই পাশে থাকেনা, সান্ত্বনা দেওয়া, মনের অবস্থাটা বোঝার মত কেউ থাকেনা, ঠিক সেই সময় গুলো খুব মনে পড়ে মেয়েটাকে। মনে হয়, এই তো এখনই হয়তো অর্পিতা ওকে ফোন করবে,ফোন করে ঠিক আগের মত রেগে যাবে, ওর রাগ ভাঙাতে ভাঙাতেই একটা সময় সময় ফুরিয়ে যাবে, তারপর নতুন একটা সকাল হবে। নতুন করে আবার ওরা বাঁচার স্বপ্ন দেখবে। এমন একটা আলাদা পৃথিবীতে ওরা যেতে পারবে যেই দুনিয়ায় এখনো জীবিত আছে অর্পিতা, ওদের সেই না হওয়া স্বপ্নটা পূর্ণ হবে। তারপর নিজের স্ত্রী করে, নিজের খুব কাছে অর্পিতাকে সামলে রাখবে সৌরদীপ, কোনো বিপদের আঁচটুকু লাগতে দেবেনা।
আর এই সব ভাবতে ভাবতেই ঐ একাকী রাতগুলোয় ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পরে সৌরদীপ। ঘুম যখন ভাঙে তখন বাস্তব সামনে আসে,সেখানে অর্পিতা বলে আর কেউ থাকেনা। কাজের চাপে, নতুন মানুষদের কথাবার্তায় অর্পিতা নামটা ক্রমশ ধূসর হয়ে যায়। ওকে করা সব সব প্রতিজ্ঞা গুলো মিথ্যে প্রমাণিত হতে থাকে। মাঝে মাঝে ব্যাপারটা আঁচ করে চমকে ওঠে সৌরদীপ। কিন্তু ঠিক তখনই সময় হেসে ক্ষতের প্রলেপ নিয়ে চলে আসে, প্রকৃতির নিয়মের মাঝে পড়ে অসহায় মানুষ গুমরে মরে। এছাড়া আর করারই বা কী আছে তার………

***********

দরজাটা সজোরে বন্ধ করে গটগট করে ঘরের ভেতর ঢুকে এল রাজীব। সৌরিতা এতক্ষণ বসে এই মুহূর্তটারই অপেক্ষা করছিল। আজ যে নতুন একটা নাটক হবে তা বোঝাই যাচ্ছে। রাজীব ঠিক কী বলে সেটা শোনার অপেক্ষায় রইল সৌরিতা। রাজীব অবশ্য প্রথমেই সরাসরি কিছু বললনা। ব্যাগটা সোফার উপর ছুঁড়ে ফেলে ও সৌরিতার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,

-” আজ অফিসে কী করতে গিয়েছিলে??”

-” বললাম তো, ঐদিকে একটা দরকারে গিয়েছিলাম। তাই ভাবলাম ঘুরে আসি”

-” তা আজকাল বাইরে বেরোলে আইবুড়ো সেজে বেরাতে হয় নাকি? না ঐ ধীমান গিয়েছিল সাথে,মান সম্মানের ভয়ে ওরকম সেজে গিয়েছিলে?”

-” রাজীব!! ধীমানের প্রসঙ্গ এখানে আসছে কেন? আই কতবার বলব, যে ওর সাথে এরকম কোনো সম্পর্ক নেই?? আমি একাই গিয়াছিলাম,আর আমি সধবা সেজেই গিয়েছিলাম, হাতে শাঁখাটা বেড়ে গিয়েছিল, তাই খুলে রেখেছিলাম।”

-” আর সিঁদুর? আমার দেওয়া বলে আর পরতে ইচ্ছে করেনা তাই তো?”

-” উফ, আরে চুলে ঢাকা ছিল। কেন এরকম করে কথা বলছ রাজীব? তুমি আমাকে আর এতটুকু ভালোবাসো না?? কী হয়েছে তোমার??”

এতক্ষণ পরে আর ধৈর্য্য ধরে রাখা সম্ভব হলনা সৌরিতার । ও চিৎকার করে উঠল। আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে,যাই হয়ে যাকনা কেন। আর সহ্য করা যায়না,সব সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে রাজীব এইবার। ……

(ক্রমশ)

❤(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here