ইস্ক সাহেবান পর্ব -০৪

#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-৪||

—–এই প্রথম বার আমি তোমার কথায় দ্বিমত করছি। তোমার এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব না। দিদার মাহসানের চোখে চোখ রেখে কঠিন কন্ঠে বলল ইবাদ। ইবাদের এমন কথা শুনে দিদার মাহসান বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ইবাদের সামনে এসে দাঁড়ালো তিনি। সত্যিই ইবাদ এই প্রথমবার দিদার মাহসানের নেওয়া সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে বিরোধিতা করছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর ইবাদ কে নিজের রুমে ডেকে এনেছিলো দিদার মাহসান। ইবাদের সামনে নিজের মতামত পেশ করতেই ইবাদ যে তার ঘোর বিরোধিতা করবে তা স্বপ্নেও কল্পনা করেন নি দিদার মাহসান। ইবাদের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ইবাদকে জিজ্ঞেস করলেন,

—-আমার সিদ্ধান্তে ভুল কি ইবাদ? তুই কেন মেনে নিতে পারছিস না?

—-দাদু তুমি ভুল করছো। আমি কোনোদিন তোমার সিদ্ধান্ত অমান্য করিনি আজ যখন করছি নিশ্চিত কোনো না কোনো কারণ আছে। আমি ইফতি কে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবো না। ইফতিকে নিয়ে আমি ওসব ভাবিই না দাদু।

—-আমি কারণ জানতে চেয়েছি ইবাদ!

—–দাদু ইরফান ওকে ভালোবাসে। ও ইরফানের কাছে অনেক কিছু দাদু। আর ইরফান এটা শুনলে তুমিতো জানোই…..

—-তুমি কি চাইছো? ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন দিদার মাহসান।

—-দাদু আমি চাই ইফতির সাথে বিয়ে হোক। তবে আমার সাথে নয় ইরফানের সাথে। ইরফান নিজেও……..

—–এনাফ ইজ এনাফ ইবাদ! এক হাত উঁচিয়ে ইবাদকে থামিয়ে দিলেন দিদার মাহসান। দিদার মাহসানের চোখ মুখে কাঠিন্যেতা প্রকাশ পেয়েছে। শক্ত কন্ঠে ইবাদকে বলল,

—-ইরফানের সাথে আমি ইফতির বিয়ে হতে দেব না। কারণ ইফতি সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ।

—-তুমি ইরফান কে অসুস্থ বলছো দাদু?

—-নাহ্! আমি বলছি ইফতি সুস্থ একজন মেয়ে। আর আমি ইফতিকে আমার নাতবউ হিসেবে চাই। কোনো অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের বউ না।

—–দাদুউউ!

—-চিৎকার করলে সত্যিটা তুমি বদলাতে পারবে না ইবাদ। তুমি ইরফানের ডাক্তার তাই তুমি চাইতেই পারো। তোমার পেশেন্ট এর সমস্ত ইচ্ছে পূরণ করা যেমন তোমার দায়িত্ব ঠিক তেমনই আমার নাতনীকে কার সাথে বিয়ে দেব না দেব সেটা আমার দায়িত্ব। আমি আমার দায়িত্ব থেকে পিছ পা হবো না। আমার কথায় শেষ কথা ইফতি মাহসান পরিবারেরই বউ হবে। ইবাদ মাহসানের বউ রুপে ইফতি এই ঘরে আসবে। ইফতিকে এখানে আনার এই একটাই কারণ আমার। আমি আমার ইচ্ছে অপূর্ণ থাকতে দেব না ইবাদ। তোমার ইচ্ছে না থাকলেও ইফতি এই পরিবারেরই একজন হয়ে উঠবে। নিজের দাদুকে ইবাদ কখনো এমন কঠিন ভাষায় কথা বলতে দেখে নি। আজ ইবাদ দিদার মাহসানের এই রুপ দেখে রীতিমতো অবাক। দিদার মাহসানের কঠিন আওয়াজ এর সামনে ইবাদ চুপসে গেল। একবারও বলতে পারলো না সে একজন কে ভালোবাসে। বলতে পারলো না এক অদেখা রমনীকে নিজের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে ইবাদ। যাকে ইবাদ দেখেনি তারই মায়ায় নিজেকে বন্ধি করে নিয়েছে। যার কন্ঠস্বর শুনলে ইবাদের মস্তিষ্ক শান্ত হয়ে যায় সেই রমণীকে ইবাদ প্রচন্ড ভালোবাসে বলতে পারলো না। বলতে পারলো না, নিজের সাহেবান কে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে ইবাদ। একদিকে নিজের দাদুর আদেশ, অন্যদিকে নিজের বন্ধুত্ব, আর অপরদিকে তারই সাহেবান এর ঘায়েল করা ভালোবাসা। কোনটা বেছে নেবে ইবাদ? এই কোন বিপাকে পড়লো ইবাদ? কাকে রেখে কাকে বেছে নেবে? ভালোবাসা বেছে নিতে গেলে নিজের দাদুর আদেশ অমান্য করতে হবে। আর দাদুর আদেশ মেনে নিলে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে নিজের ভালোবাসা আর বন্ধুত্বকে।

সকাল বেলা ইফতির ঘুম তাড়াতাড়িই ভেঙ্গে গেল। নামাজ শেষে আর ঘুম হয়নি ইফতির। তাই নিচে নেমে এলো। মারিয়াম কে রান্না ঘরে কাজ করতে দেখে ইফতি মারিয়ামের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

—–কি করছো?

—-সবার জন্য নাস্তা বানাইতেছি।

—–আমি হেল্প করি?

—–না না আপা তোমার হেল্প লাগবো না। আমি একাই পারুম। তুমি গিয়ে টেবিলে বসো। কি লাগবে বলো আমি দিতেসি।

—-আরে আমার কিছু লাগবে না। এত সকালে আমি কিছু খাই না। তুমি আমাকে বলো না আমি একটু হেল্প করি।

—-ওহ্ হেল্প করতে চাও? তাইলে এককাজ করো এই কফি দুইটা ভাইসাবের রুমে দিয়া আসো। ওরা হয়তো উইঠা পরছে। ইরফান ভাইয়ের আবার সকালে কফি লাগে। ভাইসাবের ও লাগে।

—-এটা তুমি দিয়ে এসো। আমাকে বলো এখানে কি করতে হবে আমি করছি।

—-পরোটা ভাজতে পারো?

ইফতি ঠোঁট উলটে দু’পাশে না সূচক ইশারা করলো। মারিয়াম হেঁসে দিলো,

—-আমি পরোটা ভাইজা নি। তুমি যাও দিয়া আসো।

——আচ্ছা দাও। কিন্তু যদি বকে দেয়।

—–আরে দিবো না। যাও তো তুমি।

—–আচ্ছা। বলেই ইফতি ইবাদের ঘরের দিকে গেল। ইবাদের রুমে ঢুকেই ইফতি দেখলো বিছানায় ইরফান ঘুমাচ্ছে। উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে ইরফান। কোমর অবধি ব্ল্যানকেট। ফর্সা পিঠ টা দেখা যাচ্ছে। ইফতি চোখ সরিয়ে নিলো। বেড সাইড টেবিলে কফির মগ রেখে পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়। রুমের কোথাও ইবাদ কে পেলো না। কফির মগ একটা রেখে আর একটা ট্রে তে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই ইফতি থমকে দাঁড়ালো। চট করে পেছনে ফিরতেই দেখলো ইরফানের ফর্সা পিঠে অজস্র দাগ। এলোপাথাড়ি কালো দাগ দেখে ইফতির বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। দেখে মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছে মত মেরেছে বেল্ট বা লাঠি দিয়ে। কিছু কিছু দাগ কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। আর কিছু কিছু দাগ এখনো লাল হয়ে আছে। কে আঘাত করলো এভাবে? হাত বাড়িয়ে ইরফানের পিঠের দাগ স্পর্শ করতে চাইলো ইফতি। কিন্তু করলো না। হাত সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই ইবাদের মুখোমুখি হলো। ইবাদ হয়তো ওয়াশরুমে ছিলো। ইফতির দিকে তাকিয়ে ইবাদ ভ্রু কুঁচকালো। খোলা চুল এলোমেলো হয়ে আছে। নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। চোখে পানি টলমল করছে। এই বুঝি কেঁদে দেবে। ইবাদ এই প্রথম ইফতি কে ভালোভাবে দেখলো। চোখ সরিয়ে ইরফানের দিকে তাকাতেই ইবাদ ইরফানের পিঠের দাগ দেখতে পেল। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ইরফানের পিঠ ঢেকে দিলো। পেছনে ফিরে ইফতি কে কিছু বলার আগেই ইফতি চলে গেল।

খাবার টেবিলে সবাই এসে বসেছে। দিদার মাহসানের পাশেই বসেছে ইফতি। মাথা নিচু করে রেখেছে। ইফতির মলিন চেহারা দেখে দিদাদ মাহসান খানিকটা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

—–কি হয়েছে দিদিভাই?

ইফতি চুপ। ইফতিকে চুপ থাকতে দেখে দিদার মাহসান ইফতির মাথায় হাত রাখলো। দিদার মাহসানের দ্বিতীয় ডাক শুনে ইফতি চমকে তাকালো।

——-জি নানাভাই।

—–কি হয়েছে? অন্যমনস্ক হয়ে আছিস যে?
দিদার মাহসানের কথা শেষ হতেই ইফতি ইরফানের দিকে তাকালো। বলল,

—–না কিছু না।

——তোর জন্য একটা গিফট আছে দিদিভাই!

——-কি গিফট নানাভাই?

——–আগে খাওয়া শেষ কর তারপর দেব।

——-আচ্ছা।

★—————আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি। আমি চাই আপনি আজীবন আমার ঘরে থাকুন। আমি পুতুলের মত আপনাকে সাজিয়ে রাখবো। ইরফানের এমন প্রস্তাবে ইফতি ত্রস্তনয়নে তাকালো। পাশেই ইবাদ দাঁড়িয়ে আছে। সকালে খাওয়ার পর ছাদে এসেছিলো আর তখনই ইরফান এমন একটা প্রস্তাব দিয়ে বসবে ইফতি ভাবতেও পারে নি। ইফতি কে চুপ থাকতে দেখে ইরফানের চেহারার রঙ বদলে গেল।

—–কি হলো চুপ করে আছেন যে?আমার আনসার?

—-দে….ইফতি কিছু বলার আগেই গাড়ির হর্নের শব্দ শুনে নিচে তাকালো। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে ইফতির মা বাবা। ইফতি নিজের মা বাবাকে দেখে যেন সব ভুলে গেল। দৌঁড়ে চলে যেতে চাইলে ইরফান হাত ধরে নেয়।

—-আমার উত্তর না দিয়ে আপনি কোথাও যেতে পারবেন না।

—-দেখুন ভালো আপনি বাসেন, কিন্তু আমি না। আপনাকে নিয়ে আমি এসব চিন্তা করি নি। আর না একদিনে এক দেখাতে ভালোবাসা হয়। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।
ইফতির মুখে অন্য কাউকে ভালোবাসি কথাটা শুনেই ইরফান ইফতির হাত ছেড়ে দিলো। দু-কদম পিছিয়ে যেতেই ইবাদ ইশারায় ইরফান কে না করে। ইরফান পিছিয়ে যেতে যেতে ছাদের কিনারায় চলে যায়। ইফতি কিছু না বলেই চলে গেল। ইফতি চলে যেতেই ইবাদ ইরফানের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

——কি হলো তোর? এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন?

—-ইবাদ ও আমাকে রিজেক্ট করলো? আমাকে ও এভাবে না করে দিলো।

—–ইরফান ও বুঝতে পারে নি। আমি ওকে ঠিক মানিয়ে নেব। তুই চিন্তা করিস না।

—-ওকে আমার লাগবেই। ওর ইচ্ছে না থাকলেও ও আমারই হবে। আমি ওকে আমার বউ রুপে দেখতে চাই। আমার বউ রুপে। আর যদি তা না হয় তাহলে….. ইরফানের চোখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। কপালে দুপাশের রগ ফুলে উঠেছে। হাতের মুঠো শক্ত করে নিজেকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইবাদ ইরফানের এমন অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি ইরফান কে জড়িয়ে ধরে। এই মুহুর্তে কোনো অঘটনই ঘটতে দেওয়া যাবে না।

চলবে….…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here