#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব-২০||
★পুরো এহতেশাম ভিলা থমথমে পরিবেশ ধারণ করেছে। কারো মুখে নেই কোনো হাসি। একটু পরই হয়তো বরযাত্রীর আগমন হবে। কিন্তু কনে কোথায়? পার্লারের মেয়েরা ইফতি কে বউ সাজিয়ে রুম থেকে বের হয়েছিল। সাজ দেখতে নাহিদা বেগম রুমে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু রুম খালি। ইফতি নেই। তবে কী ইফতি পালিয়ে গেল? জাফর এহতেশাম মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ইশরা পাশেই আছে। ফারিস সবটা শুনে থম মেরে বসে রইল। ইফতি কে দেখে একটুও মনে হয়নি ইফতির অমতে এই বিয়ে হচ্ছে। ইফতি কি সত্যিই পালিয়ে গেল? নাহিদা বেগম ইশরার দিকে তাকিয়ে রইলো। ধীরে ধীরে ইশরার পাশে গিয়ে বসলো। ইশরার মাথায় হাত দিয়ে বলল,
—–বিয়েটা তুই করে নে!
মায়ের এমন কথা শুনে ইশরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো,
—-কী বললে? তোমার মাথা ঠিক আছে? ইফতিকে পাওয়া যাচ্ছে না আর তুমি আমাকে এটা বলছো?
—-ইশরা! ইফতির এই বিয়েতে মত ছিল না। আমি ভেবেছিলাম ও আমাদের জন্য এই বিয়েটা করে নেবে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসে যে এমম একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হবো ভাবতে পারিনি।
—-মা তুমি কী বলতে চাইছো? ইফতি পালিয়েছে?
—-তা নয়তো কী?
—-মা মাথা ঠিক আছে তোমার? ইফতি কোনোদিন এমন কাজ করবে না। আমি আমার বোনকে খুব ভালো করেই চিনি। আমার বোন কোনোদিন পালিয়ে যাবে না। ওর কাছে নিজের ইচ্ছের আগে পরিবারের সম্মান বেশি। ও কিছুতেই এসব করবে না।
—–তাহলে? কোথায় গেল ও?
—–মা আমি দেখছি। তুমি এদিকটা সামলাও। বিয়ে কয়দিন পর হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু আমার বোনের যদি কিছু হয়ে যায়.. থেমে গেল ইশরা। উঠে দাঁড়িয়ে ফারিস কে বলল,
—–আমার সাথে বাহিরে যাবেন?
—–(আপনি যদি বলেন জাহান্নামেও যেতে রাজি) চলুন।
ফারিসকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল ইশরা। ইশরার মন বার বার বলছে ইফতি পালাতে পারে না। ইফতি নিজেকে যতটা না চেনে তার চেয়েও বেশি ইশরা ইফতিকে চেনে। আর যাই হোক এমন একটা কাজ করার দুঃসাহস ইফতি দেখাবে না। ইশরা নিজেকে অবিশ্বাস করে নেবে কিন্তু ইফতি কে না। ইফতির গায়েব হয়ে যাওয়ার বিষয় টা ইশরার মস্তিষ্ক এলোমেলো করে দিয়েছে। ফারিস ড্রাইভিং সিট থেকে একবার ইশরার দিকে তাকালো। ইশরা মাথা এলিয়ে রেখেছে। মুখটা শুকনো হয়ে আছে। হয়তো কিছু খায় ও নি। ফারিয়া গাড়ি চালাতে চালাতে বলল,
—–এত চিন্তা করলে উনি ফিরে আসবে?
—-আমার বোন কোথায় আছে? কী অবস্থায় আছে আমি জানি না স্যার। কেন জানি না দম বন্ধ হয়ে আসছে। ইশরার চোখে পানি টলমল করছে। ফারিসের বুক মোচড় দিয়ে উঠল। শীতল কন্ঠে বলল,
—-কিছু খাননি আপনি? চলুন কিছু খাবেন!
—-খিদে নেই।
ফারিস গাড়ি থামিয়ে নিল। ইশরার দিকে তাকিয়ে বলল,
—-ইফতির কিচ্ছু হবে না। আমি নিজের বেস্ট টা দিয়ে ওনাকে খুঁজে বের করবো। আপনি এত চিন্তা করবেন না ইশরা।
ফারিসের কথা শুনে ইশরা লম্বা শ্বাস টেনে চোখ বন্ধ করে নিল। সাথে সাথে দুফোঁটা চোখের পানি কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।
★পাগড়ি ইবাদের মাথায় পরিয়ে দিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে ইশারায় কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করলো ইরফান।
ইবাদ পেছনে ফিরে পাগড়ি খুলে নিল। ইশাল ভ্রু কুঁচকে বলল,
—–কী রে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই নাকি? খুলে নিলি কেন?
—-পাগড়ী আমার বউ পরাবে আমায়।
—ওহ্ আচ্ছা! তা মহাশয় কী এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি রওনা দিবেন? তোর এত লেট হচ্ছে দেখে বউ পালিয়ে না গেলেই হয়। বলেই হেঁসে দিল ইরফান।
—-আরে না পালাবে না। আমাদের ইবাদের প্রেমে হাবুডুবু খাবে, যখন জানবে ‘মি.ডাক্তার’ নামক ব্যাক্তিটি আর কেউ না স্বয়ং ইবাদ মাহসান। বলেই চোখ মেরে দিল ইশাল।
—-আচ্ছা বকবক পরে করবি। চল দেরী হয়ে যাচ্ছে। তিন বন্ধু বেরিয়ে পড়লো। গাড়িতে বসার আগে ইরফান ইবাদ কে ডাক দিল,
—–আমি বলেছিলাম তোর বিয়েতে আমি আসবো। আমি এসেছি ইবাদ। তোর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর একটি মুহুর্তকে উপভোগ করতে। তবে শর্ত একটা ভাই, তোর বউ তুই দেখার আগে আমি দেখবো।
ইরফানের কথায় ইবাদ হালকা হাসলো।
—-কেন রে ভাই? ওর বউ তুই কেন দেখবি? পেছন থেকে বলে উঠল ইশাল।
—-আরে ভাই দেখতে হবে না ভাবীকে বউ সাজে কেমন লাগছে? আচ্ছা চল দেরী হয়ে যাচ্ছে। কথা না বাড়িয়ে সবাই গাড়িতে উঠে বসলো। এহতেশাম ভিলার উদ্দেশ্যে রওনা দিল মাহসান পরিবার।
★দিদার মাহসান ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইবাদ। তারা কেউই আশা করেনি এমন কিছু। ইবাদের উজ্জ্বল ফর্সা মুখশ্রী টি লাল বর্ণ ধারণ করেছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ইশাল আর ইরফান। ইশরা এগিয়ে এসে বলল,
—–আমার বোন পালিয়ে যায় নি। যে বা যারা আমার বোনকে সরিয়েছে আমি তাদের ছেড়ে দেব না। আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় জিনিসের ক্ষতি আমি মেনে নেব না।
—-লাস্ট লোকেশন কোথায়? গম্ভীত কন্ঠে প্রশ্ন করলো ইবাদ।
—-বান্দরবান।
ইবাদ এগিয়ে গিয়ে নাহিদা বেগমের পাশে বসে পড়লো।
—–আন্টি! ইফতিকে আমি এনে দেব। শুধু একটু সময় দিন। ইফতির কিছু হবে না। আমায় ভুল বুঝবেন না। ইবাদের কথার অর্থ কেউ বুঝতে পারলো না। ইশরার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
—–বান্দরবানের আশেপাশে খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে। আমি ইফতি কে সাথে নিয়ে তবেই ফিরবো। আপনি আমার সাথে যাবেন?
—চলুন। বাবা তুমি এদিকটা সামলাও। আসছি…
ফারিস, ইশরা, ইবাদ, ইশাল আর ইরফান বেরিয়ে পড়ে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে।
★হাত ভর্তি লাল চুড়ি, মুখে ভারী মেকাপ, পরনে বিয়ের লেহেঙ্গা, গা ভর্তি গহনা ইফতির। মাত্র ঘুম ভেঙ্গেছে। ঘুম ভাঙতেই নিজেকে একটি রুমে আবিষ্কার করলো। এটা যে ইফয়ির বাড়ি বা ইবাদদের বাড়ির রুম না তা ইফতি বুঝে গেছে। মাথা ব্যাথা করছে। ভারী হয়ে আসছে। রুমের চারপাশে একবার দেখে নিল। মাথায় থাকা ঘোমটা ফেকে দিল। ওড়না টা খুলে একপাশে রেখে দিল। বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াতেই ইফতির পায়ের প্রচন্ড যন্ত্রণা হলো। পায়ের তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হওয়ায় ইফতি আর্তনাদ করে বসে পড়ল বিছানায়। পা থেকে রক্ত ঝরছে। ফ্লোরে ছড়িয়ে আছে কাঁচ ভাঙ্গা। যা ইফতির পায়ে বিধে গেল। দু’একটা কাঁচের টুকরো ইফতির পায়ের তালুতে আটকে আছে। কাঁপা হাতে ইফতি পায়ে বিধে থাকা কাঁচ স্পর্শ করলো। শক্ত করে ধরে টান দিতেই রক্ত ছিটকে বেরিয়ে এল। ইফতি ব্যাথায় কেঁদে উঠল,
—–আহ্!!
গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর যেতেই ইশরা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। পাথরের কোণের উপর পা পরায় ইশরার পায়ের গোড়ালির উপর অনেকাংশ কেটে যায়। রক্তে প্যান্ট ভিজে গেছে। চুড়িদার পাজামা হওয়ায় ইশরা পাজামা উপরে তুলতে পারছিল না। ব্যাথায় চিৎকার করে উঠতেই ফারিস আর ইশাল পেছনে ফিরে তাকাল। দুজনেই দ্রুত ছুটে ইশরার কাছে গেল। ফারিস ইশরার পায়ের কাছে৷ অসে পড়ে। ইশাল ত্রস্তব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
—–কী হলো ঠিক আছেন?
—–একী? পায়ে আঘাত কী করে পেলেন। রক্ত তো অনেক! ইশাল রুমাল এগিয়ে দেওয়ার আগেই ফারিস পকেট থেকে রুমাল বের করে ইশরার পায়ে বেধে দিল। ফারিস উঠে দাঁড়াতেই ইশাল হাত বাড়িয়ে দিল।
—-উঠে আসুন ইশরা। ইশালের সাথে সাথে ফারিস নিজেও হাত বাড়িয়েছিল। ইশরা ইশালের হাতের দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। ফারিসের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো ।
—–হাটতে পারবেন?
—পারবো। বলেই সামনে পা বাড়াতেই ইশরা ঢলে পড়লো। পড়ে যাওয়ার আগেই ইশাল গিয়ে ধরে নিল। ইশরাকে কিছু বলতে না দিয়ে কোলে তুলে নিল। ফারিস এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ইশরা নেমে যেতে চাইলে ইশাল দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
—-বেশি ছোটাছুটি করলে আপনাকে নিয়েই খাদে ঝাপ দেব। চুপচাপ যেভাবে আছেন সেভাবেই থাকুন।
ইশালের কথা শুনে ইশরা চুপ করে গেল। ফারিসের এই দৃশ্য মোটেও ভালো লাগলো না। মুহুর্তেই মন মেজাজ বিষিয়ে দিল। ইশালের উপর জন্মে গেল ক্ষোভ, বিরক্তি আর রাগ।
★প্রচন্ড ব্যাথায় ইফতির পা ফুলে গেছে। রক্ত ঝরতে ঝরতে ফ্লোর লাল হয়ে গেছে। সেই রক্ত শুকিয়ে উদ্ভট গন্ধ নাকে লাগছে ইফতির। বিছানা থেকেএ নামার উপায় নেই। বিছানার নিচে ফ্লোরে চারপাশে ছড়িয়ে আছে কাঁচের টুকরো। একবার অজান্তেই ইফতি রক্তাক্ত হয়ে ফিরে এসেছে। সেই ব্যাথায় এখনো যায়নি। দ্বিতীয় বার সেই একই ভুল ইফতি করতে চাইছে না। সারাটা দিন অনাহারা কেটেছে। একফোঁটা পানিও পেটে পড়েনি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। প্রচন্ড দুর্বল লাগছে। প্রচন্ড তৃষ্ণা পেয়েছে। না খেয়ে থাকার অভ্যাস আছে ইফতির কিন্তু পানির পিপাসায় সে দুর্বল হয়ে পড়ছে ক্রমশ। রুমের বাহিরের দেয়ালে একটি ঘড়ি আছে। যেটা ঘন্টা পর পর টুংটাং শব্দে বেজে উঠছে আপনমনে। যার শব্দ ইফতির কানে এসে ঠেকছে। শব্দ শুনেই ইফতি বুঝতে পারছে কয়টা বেজেছে। রাত ১টার ঘন্টা একটু আগেই বাজলো। সারাটাদিন ইফতির এই বন্ধ রুমেই কেটেছে। গায়ের গয়না খুলে রেখেছে সেই অনেক্ষণ আগেই। বিছানা থেকে নামতে পারলে এই ভারী সাজও ধুয়ে নিতো। কিন্তু তার উপায় বা রাস্তা কোনোটাই নেই। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে আধশোয়া হয়ে হেলান দিয়ে বসলো ইফতি। হঠাৎই দরজা খোলার শব্দে বেজে ইফতি ফিরে তাকালো। আস্তে আস্তে দরজা খুলে যেতেই ইফতি উঠে সোজা হয়ে বসল। বাহিরে ঘোর অন্ধকার। আলো থেকে অন্ধকারে কেউ আছে কী না বুঝতে পারছে না। তবে রুম থেকে বাহিরে যেই আলো পড়েছে সেই হালকা আলোতে কারো ছায়া দেখতে পেল ইফতি। ছায়াটি ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে দরজার দিকে। ইফতি আগ্রহান্বিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল।
চলবে..?