#একই_সুতোয়_বাঁধা
পর্ব-১৪
সপ্ত শীখা
সায়নের মন টা খুব ভাল লাগছে। আজ সে নিজের জন্য একটা ফ্ল্যাট নিতে পেরেছে। ঢাকা মহানগরীর বুকে একটা চার রুমের ফ্ল্যাট পাওয়া আজকাল সোনার হরিনের মতই। আজ সেই অসাধ্যটিও সাধন করে ফেলেছে সায়ন। নতুন ওঠা একটা বিল্ডিং এর চারতলায় নিয়েছে ফ্ল্যাট টা। এখন ফার্নিচার কিনতে যাচ্ছে। সব সাজিয়ে গুছিয়ে বাবা মা কে খবর দেবে আসার জন্য। সারপ্রাইজ হবে একটা !
আজ তিন বছর হয় একটা প্রাইভেট কম্পানিতে চাকরি করছে সায়ন। মন দিয়ে কাজ করায় বেশ দ্রুতই উপরে উঠে গেছে। এরই মাঝে শেষ করেছে মাস্টার্স টা। বিয়েশাদির চিন্তা এখনো আসেনি অবশ্য মাথায়। সাইকার ঘটনার পর থেকে এসব ব্যাপারে সে খুবই ভীত।
আজ অফিসে নতুন লোক নেয়া হবে। সে উপলক্ষ্যে একটু দ্রুতই বাসা থেকে বেরুল সায়ন। যদিও কম্পানির মালিক রা এই নিউ রিক্রুটের কাজ করে থাকেন কিন্তু সায়ন এবং আরো কয়েকজন অফিসার কে এর পরবর্তী পর্যায়ের কাজগুলো করতে হয়।
অফিসে ঢুকে দেখে একটা উৎসব উৎসব ভাব। সবাই ভাল ভাল কাপড়ে একেবারে ফুলবাবু সেজে এসেছে। সায়ন মুচকি হেসে এগিয়ে যেতেই সজল এসে পাশে দাঁড়াল।
— দোস্ত, আজকেই এত দেরি করলি !
— কই দেরি ! আগেই তো আসলাম !
— স্যাররা আরো আগে এসে গেছে। ইন্টারভিউ শুরুও হয়ে গেছে। এখন অবশ্য আমাদের কাজ নাই… চল না চা খেয়ে আসি ?
— আচ্ছাহ… চল। শেষ হইলে আবার আসব।
তিন ঘন্টা পরে প্রত্যাশিত ডাক এল। সায়ন সজল এবং আরো কয়েকজন তৈরি হল নতুন রিক্রুটদের কাজ বুঝিয়ে দিতে।
— দোস্তোওওওও আমার জন্য দোয়া কর যেন নতুন দের মধ্যে একটা গফ পায়া যাই…
— তুই জীবনে পাবিনা। শালা গরিব ! চল চল।
সিনিওর বস সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন নিউ রিক্রুটস কে। পাঁচজন নতুন কর্মী নেয়া হয়েছে যার মাঝে সায়নের কাছে পড়েছে এক মহিলা। একে আগামী এক মাস ট্রেইন করবে সায়ন। সম্পূর্ন বোরকাবৃতা। নিকাব ও পরিহিত। সায়ন যেয়ে হ্যালো বলতে নিকাবের মাঝে একমাত্র দৃশ্যমান বস্তু… তার চোখ… বড় বড় হয়ে উঠল।
— মিস জান্নাতুল ফেরদৌস ?
— হুম…
— আমি আপনার মেনটর। আই অ্যাম শাহিনুর রহমান সায়ন।
— জি… আসসালামু আলাইকুম স্যার।
— ওয়ালাইকুম আসসালাম…
— স্যা-স্যার, সরি টু বদার কিন্তু আমি কি এই পর্দা মেইন্টেন করে চাকরি করতে পারব ? প্লিজ কোন সমস্যা হলে বললে ভাল হয়…
— না না সমস্যা নেই কোন। আসুন… ঘুরে দেখিয়ে দিই অফিস টা ? তারপর কাজ শুরু করব আমরা।
💚💚💚💚💚
— সত্যি নাকি রে পুষ্প ! সে তোর সিনিয়র কলিগ !
— হু সত্যি… এই দেখ নীরা, আমার বুকের ভেতর কেমন জোরে ধুকধুক করছে !
নীরা হাসল। পুষ্পর মনে কি চলছে তা ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারছে ও। মুখটা লাল হয়ে আছে। এর মানে হল ভয়ানক উত্তেজিত সে। ব্যাপারটা অদ্ভুত বটে… দুনিয়াজোড়া এত ছেলে থাকতে সায়ন কেই পুষ্পর মেন্টর হতে হল !
— শোন পুষ্প… আমার না মনে হয় এসব আল্লাহর ইশারা। উনিই তোদের মেলাতে চান…
— বল ইনশাল্লাহ… সায়ন আমার স্বামী না হওয়া অব্দি আমি ওকে নিয়ে কিচ্ছু ভাবতে চাইনা। ওকে না পাবার সম্ভাবনাই বেশি… সেক্ষেত্রে অন্যের হক নষ্ট করব কেন বল…
— পুষ্পরানী… মুখে যাই বলো মনে যে কি কি ভেবে নিয়েছ এতদিনে তুমিই জানো হুহ হু !
পুষ্প একটু হাসল। মন কি আর বশে থাকে ! সেই ছোট্টবেলার ভালবাসাটিকে সামনে সর্বক্ষণ থাকতে দেখলে কেই বা কাজ করতে পারে ! গতদিনে পুষ্পর ও তাই হয়েছে। জানা কাজ ও বোকার মত আনাড়িপনা দেখিয়েছে। কিই বা করে… সায়ন যে পাশে থাকে !
পুষ্প আর নীরা এখন একই সাথে ঢাকায় একটি হস্টেলে থাকে। নীরার বিয়ের আলাপ চলছে। পুষ্পর অধিকাংশ বান্ধবিরই বিয়ের কথা চলছে, কারো তো হয়েও গেছে ! পুষ্পর বাবা মায়ের যেন কোন মাথাব্যথাই নেই মেয়ের বিয়ে নিয়ে ! ব্যাপারটা নিয়ে পুষ্প খুশি থাকলেও অনেক সময় মাথায় প্রশ্ন আসে। কেন এমন নির্লিপ্ত তারা ? এমন তো তখনি হতে পারে যখন মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়… বা ঠিক থাকে ! এমন কিছু কি হয়েছে !
ছোটবেলার একটা স্মৃতি মাঝে মধ্যে মনে পড়ে পুষ্পর। প্রচন্ডরকম সাজিয়ে একটা ঘরে বসে ছিল ও। কট কট করে বাতাসা আর মুড়ালি খাচ্ছিল। এর মাঝেই খেলাচ্ছলে কি যেন বলতে বলেছিল বাবা… আর মা কাঁদছিল। কি সেটা ?
💙💙💙💙💙
সায়ন কফির কাপটা হাতে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঠান্ডা হয়ে সর পড়ে গেছে। আবার বানাতে হবে। কফি নিয়ে অন্যের চিন্তায় মশগুল থাকার এই হল ফল…
নতুন যে রিক্রুটের দায়িত্ব সায়ন পেয়েছে তার নাম জান্নাতুল ফেরদৌস। এতে দোষের কিছু নেই কিন্তু সমস্যা হল পুষ্পর নাম ও তাই ছিল। অবশ্য মেয়েদের মাঝে এটা কমনেস্ট নাম।
আজ দুদিন হয় কাজ শেখাচ্ছে তাকে সায়ন। মেয়েটা নেকাবে মুখ ঢেকে রাখে সবসময়। এই ব্যাপারটা বড় ভাল লাগে সায়নের। পবিত্র মনে হয় । কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, সায়ন যতক্ষন কথা বলে মেয়েটা অপলক চেয়ে থাকে ! মনে হয় চোখের পাতিও ফেলে না। আর লেকচার শেষে যখন সায়ন কাজটা করতে বলে তখন কিছুক্ষন ঘেটেঘুটে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় সায়নের দিকে। রাগ হলেও সেই চোখের কাতর দৃষ্টির মায়ায় রাগ জল হয়ে যায় সায়নের। আবারো শেখায়। এবার শেখে সে। কিন্তু কথা হল… প্রথমবার যদি নাই শিখবে তো অমন হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে করেটা কি ? কেবল সায়ন কে দেখে ?
— এইই রাজু ! রাজুউউউউউ !
— আসি বাই !
রাজু সায়নের কাজের ছেলেটা। বেশ অনেকদিন আছে। চোদ্দ বছরের ছেলেটাকে চায়ের দোকান থেকে ছাড়িয়ে এনেছিল সায়ন।
— দেখতো রাজু… আমি দেখতে কেমন ?
— রাজপুত্তুরের লাহান সুন্দর… ক্যান বাই ?
— আচ্ছা বল তো… মেয়েরা কি আমাকে দেখলে দুনিয়া ভুলে তাকিয়ে থাকবে ? যেকোন মেয়ে ?
— হাচা কইতাম ?
— হু বল।
— দুনিয়ার কোন ভালা মাইয়াই ব্যাগানা পুরুষের দিকে হাক কইরা চাইয়া থাহে না। এক যদি আপ্নেরে পছন্দ করে খুব তাইলে সারাদিন চাইয়া থাক্ত ফারব চক্ষের পলক ফরত না।
— ভালই তো গবেষনা করছিস মেয়েদের নিয়ে !
— আন্নের কাছে আউনের আগে হোডেলে কাম হরতাম না ? কত্ত মাইয়ারা আইত ! অই থিক্কাই-
— বুঝেছি। এখন যা আরেকটা কফি করে দে। এটা সর পড়ে গেছে।
রাজু বেরিয়ে যেতেই সায়ন হেসে ফেলল। রাজুর কথা মানলে তো বলতে হবে… জান্নাতুল ওর প্রেমে পাগল ! হা হা… প্রথম দেখাতেই কেউ প্রেমে পাগল হয় নাকি !
তবে বলতেই হবে… জান্নাতুলের বোরখাবৃত মুখের ফাঁকে কেবল চক্ষু দুটিই দেখতে পায় সায়ন। কালো নিকাবের জন্য আরো রহস্যময় লাগে চোখগুলো। এত গভীর ! সায়ন লোভ এড়িয়ে চলছে… দুটি চোখের প্রেমে হুট করে পড়ে গেলে লোকে বলবে কি !