ফুলে সজ্জিত বিছানায় বসে একের পর এক সিগারেট খেয়ে চলেছে সাদাফ,আর সমস্ত সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে চলেছে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী সাবিহার মুখে।সাবিহার কাশতে কাশতে শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম।কিন্তু তাতে সাদাফ নামক মানুষটির কোন ভাবান্তর ঘটে নি।সে তার মত করে সাবিহার উপর অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে সিগারেট খাচ্ছে।আর সাবিহা সে ত নাক মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরেছে যাতে এই বিষাক্ত ধোঁয়াটা নাক মুখ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ না করে কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না।সাবিহা এবার আর না পেরে দৌড়ে দরজার কাছে যায় দরজা খোলার জন্য কিন্তু সাবিহা ব্যার্থ হয়।কারন দরজাটা বাইরে থেকে লক করে রেখে গেছে সাদাফের ছোট বোন আর কিছু কাজিন।
সাবিহা শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে দরজা টেনে চলেছে কিন্তু দরজা খুলছে না,আজ যদি কথা বলতে পারত তবে হয়ত চিৎকার করে সারা বাড়ির মানুষকে জড়ো করতে পারত।কিন্তু আফসোস আল্লাহ তায়া’লা তার থেকে সে ক্ষমতাটা কেড়ে নিয়েছে।কথাগুলো ভেবেই সাবিহা হাটুগেড়ে দরজার সাথে হেলান দিয়ে বসে কেদে ফেলে।চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে।
সাবিহার এ অবস্থা দেখে সাদাফের ঠোঁটের কোনে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে।সে জানে সাবিহা সিগারেট এর ধোঁয়া একদমই শয্য করতে পারে না তাই সিগারেট এর ধোঁয়া সাবিহার মুখে ছেড়ে তাকে কষ্ট দিয়েছে।সে এবার হাতে থাকা সিগারেটটা ফেলে ধীর পায়ে সাবিহার কাছে যায়।আর সাবিহার থুতনি ধরে তার দিকে ফিরায়,সাবিহা চোখ ভরা জল আর অভিমান নিয়ে সাদাফের দিকে তাকায়।সাদাফ দাঁতে দাঁত চেপে এবার বলে উঠে,,,
“তোর মত বোবা মেয়েকে বিয়ে করে মানুষের কাছে আজ আমি মহান ব্যাক্তি হিসেবে পরিচিত।তকে বিয়ে করেছি একমাত্র নিজের পরিবারের জন্য কিন্তু পরিবারের চাপে বিয়ে করে যে নিজেকে মহান মনের মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করে ফেলব বুঝতে পারি নি।সারা বাংলাদেশের প্রতিটা খবরের হেডলাইনে আজ একটাই খবর।
বিশিষ্ট শিল্পপতি সাদাফ তাহসিন একজন বোবা মেয়েকে বিয়ে করে নিজেকে মহান মনের মানুষ বলে পরিচয় দিয়েছেন।সাংবাদিক গুলো আমাকে রাতারাতি কেমন হিরো বানিয়ে দিলো দেখলি!”
কথাটা বলে সাদাফ কিছুক্ষণ থামে,তারপর আবারও বাঁকা হেঁসে সাবিহাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় আর উল্টোদিকে ঘুরে বলে উঠে।
“কিন্তু আমি এতটাও মহান নই যে তোর মত বোবা মেয়েকে নিজের বউ বলে মেনে নিয়ে স্ত্রীর অধিকার দিব।শতশত মেয়ে এই সাদাফ তাহসিনের পাগল আর তার স্ত্রী কী না একজন বোবা মেয়ে!এটা ত কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
তাই ভেবেছিলাম বিয়ের কয়েকমাস পর কোন ঝমােলা করে তকে ডিভোর্স দিব কিন্তু এই সাংবাদিক গুলো ত আমাকে হিরো বানিয়ে দিল।এখন তকে ডিভোর্স দিলে আমি হিরো থেকে ভিলেন হয়ে যাব।কিন্তু সেটা ত হতে দেয়া যায় না,এমনটা হলে সেটা আমার ব্যাবসায় এফেক্ট করবে যা আমি চাই না।তার জন্য তকে আমি ডিভোর্স দিব না আর না তকে স্ত্রীর অধিকার দিব!”
কথাগুলো বলেই সাদাফ খাটে সাজানো সমস্ত ফুলগুলো খুলে ফেলার জন্য ফুলে হাত দিতে গেলে সাবিহা উঠে সাদাফের হাত ধরে ফেলে।সেটা দেখে সাদাফ ভ্রু কুঁচকে সাবিহার দিকে তাকায়,সেটা দেখে সাবিহা সাদাফের হাত ছেড়ে চোখের পানি মুছে সরে দাঁড়ায়।আর ঘরের আশেপাশে তাকিয়ে দেখে ড্রেসিং টেবিলের উপর টিস্যুর বক্স রাখা।সাবিহা সেখান থেকে একটা টিস্যু নেয় আর নিজের লাগেজ থেকে পেন্সিলের কাজল নিয়ে কিছু লেখা শুরু করে।সাদাফ এখনও ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সাবিহার দিকে আর বুঝার চেষ্টা করছে সাবিহা কী করতে চাইছে।বেশ অনেকক্ষণ পর সাবিহার লেখা শেষ হয় আর টিস্যুটা সাদাফের দিকে এগিয়ে দেয়।সাদাফ অবাক হয়ে সাবিহার দিকে তাকায় সেটা দেখে সাবিহা চোখে ইশারা করে পড়তে।সাদাফ এবার টিস্যুটা হাতে নেয় আর পড়া শুরু করে।
“আমি কথা বলতে পারি না বলে আমাকে এতটাও দুর্বল ভাববেন না যে আমি সব কিছু মুখ বুঝে শয্য করে নিব।আর মিডিয়া যেমন আপনাকে রাতারাতি হিরো বানিয়েছে তেমনি রাতারাতি আপনাকে ভিলেন বানাতেও সময় লাগবে না।
আর আমি মরে যাচ্ছি না আপনার মত অমানুষের স্ত্রীর অধিকার পাওয়ার জন্য।আমিও আমার পরিবারের চাপে পড়ে বিয়েটা করেছি,আমি চাই নি আমার এই জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে।তাই একদম আমার সাথে বাজে আচরন করতে আসবেন না,একটু আগে আমার সাথে যা করলেন এমনটা ২য় বার করলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।আমিও সাবিহা চৌধুরী।”
লেখাটা পড়ার পর সাদাফের চোখ বড়বড় হয়ে যায়।সাদাফ টিস্যু থেকে চোখ সরিয়ে রেগে উপরে তাকিয়ে দেখে সাবিহা তার সামনে নেই।সাদাফ আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সাবিহা সোফায় শুয়ে আছে।সাদাফ রাগে জিদে হাতে থাকা টিস্যুটা মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে।আর দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলে উঠে।
“হাউ ডেয়ার সী,সাহস হল কী করে আমার সাথে এভাবে কথা বলার।জাস্ট ওয়েট এন্ড সি,তোর লাইফ আমি হেল করে ছাড়ব।তোর জীবন আমি যদি নরকে পরিনত না করেছি তবে আমার নামও সাদাফ তাহসিন নয়।”
কথাগুলো বলেই সাদাফ হাতের টিস্যুটা ফেলে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়।
আর অন্যদিকে সাবিহা চোখের জল বিসর্জন দিতে দিতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
______________________________________
ফজরের আযানের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে সাবিহার,সাবিহা ঘুম থেকে উঠে একটা থ্রি পিছ নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নামায পড়তে বসে।নামায শেষে সাবিহা মোনাজাতে বলে উঠে,,,
“হে আল্লাহ আজ থেকে আমার নতুন জীবনের সূচনা হল।তুমি আমাকে শক্তি দিও আল্লাহ আমি যেন আমার তরফ থেকে আমার স্বামীর প্রতি আর তার পরিবারের প্রতি সমস্ত দায়িত্ব কর্তব্য সব ঠিক মত পালন করতে পারি।”
নামায পড়ে সাবিহা জায়নামাজটা উঠিয়ে রেখে বের হতে নিলে সাদাফের দিকে চোখ যায়।সাদাফ শুয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে,সাবিহা সেটা উপেক্ষা করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আর সাদাফ রেগে বলে উঠে,,,
“এই বোবার মুখটা কী সকাল সকালই দেখতে হল আমাকে!আজ সারাদিন নির্ঘাত ভালো যাবে না আমার।”
কথাটা বলেই সাদাফ বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে নামায পড়ার জন্য মসজিদে চলে যায়।
অন্যদিকে সাবিহা এক কাপ চা নিয়ে ছাঁদে চলে আসে,একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সূর্যোদয় দেখার জন্য।আশেপাশে আলো ফুটতে শুরু করেছে,চারপাশটা ভালোই আলোকিত হয়েছে।
সাবিহা চায়ে এক চুমুক দিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ছাঁদের মধ্যেই এপাশ থেকে ওপাশে হেঁটে চলেছে আর গতরাতের কথা ভেবে চলেছে।
গতরাতের কথা মনে হতেই সাবিহার গাল বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।সাবিহা সাথে সাথেই চোখের জল মুছে আবার আকাশের দিকে তাকায়।এভাবে বেশ কিছুক্ষণ পর সাবিহাকে কেউ বউমনি বলে ডেকে উঠে পিছন থেকে।সাবিহা চমকে পিছন ফিরে তাকায় আর দেখে তার ছোট দেওর সুজন দাঁড়িয়ে।সাদাফের তিন বছরের ছোট সুজন।সে এখন অনার্স ফাস্ট ইয়ারের একজন ছাত্র,সাবিহা তাকে দেখে মুচকি হেঁসে হাতের ইশারায় বলে উঠে,,,
“শুভ সকাল ভাইয়া।”
সুজন সেটা বুঝতে পেরে প্রতিউওরে বলে উঠে,,,
“শুভ সকাল বউমনি।তুমি এত সকাল সকাল এখানে কেন?ভাইয়া কী বকেছে তোমাকে?”
সুজন ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে কথাটা আর সাবিহা হেঁসেই মাথা নাড়ায় যার অর্থ বকে নি।তখন সুজন মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলে উঠে,,,
“আমি গতরাতে সব শুনেছি বউমনি,গতরাতে আমি ওখান দিয়েই যাচ্ছিলাম তখন তোমার আর ভাইয়ার ঘরের দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে থেমে যাই।আর যখন দরজা খুলতে যাব তখন ভাইয়ার কথা শুনে থেমে যাই।আমি সব শুনেছি বউমনি,ভাইয়ার কথায় তুমি খুব কষ্ট পেয়েছো তাই না বউমনি?তোমাকে কথাগুলো বলেছে আর আমি সেটা শুনেছি তাতে আমারই বড্ড কষ্ট লাগছে।কথাগুলো ভেবে আমি সারারাতও ঘুমাই নি বউমনি আর তোমার মনের অবস্থা কেমন সেটা কিছুটা হলেও আমি আচ করতে পারছি।আমার ভাই যে এমন চিন্তা ধারার মানুষ সেটা ভাবতেও বড্ড কষ্ট লাগছে আমার।”
কথাটা বলার সময় সুজনের গলা ধরে আসছিল চোখেও পানি টলমল করছে যেকোনো সময় ঝড়ে পড়তে পারে।আর সাবিহা সুজনের এসব কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে ইশারা করে বুঝায়।
“আমি ঠিক আছি ভাইয়া,তুমি এসব ভেবে কষ্ট পেও না প্লিজ।আর তোমার ভাইয়াও উনার জায়গায় ঠিক,কে চাইবে তার স্ত্রী এমন হোক?কেউই চাইবে না ত তুমি তোমার ভাইয়াকে ভুল বুঝো না।আমি ঠিক আছি আর সব কিছু ঠিক করে ফেলব,তুমি এসব কথা কাউকে বলো না।এসব জানলে সবাইও তোমার মত কষ্ট পাবে,আর আমি এমনটা একদমই চাই না।তুমি দয়াকরে এসব কাউকে বলো না।আমার উপর ভরসা রাখো একটু,আমি সব ঠিক করে দিব ইনশাআল্লাহ।”
সাবিহার ইশারায় বলা কথাগুলো সুজন পুরোপুরি বুঝতে পারে নি তাই সুজন বলে উঠে,,,
“বউমনি আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না ঠিক করে।”
সাবিহা এবার সুজনকে ইশারায় তার ফোন দিতে বলে।সুজন বুঝতে পেরে তার পকেট থেকে ফোনটা সাবিহার দিকে এগিয়ে দেয়।আর সাবিহা টাইপ করে সেসব কথাগুলো আবার লিখে আর এগিয়ে দেয় সুজনের দিকে।সুজন পড়ে সবটা বুঝতে পারে আর নরম গলায় বলে উঠে।
“কাউকে বলব না বউমনি তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করো না।তবে তোমার কোন দরকার পড়লে আমাকে বলো আমি তোমাকে সাহায্য করব।”
কথাটা বলেই সুজন আর দাঁড়ায় না,দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়।তার গাল বেয়ে জল পড়ছে,সে তার চোখের জলটা সাবিহাকে দেখাতে চায় না তাই সেখান থেকে চলে আসে।
#চলবে,,,
#একগুচ্ছ রক্তজবা
#লেখিকাঃ সাদিয়া সিদ্দিক মিম
#পর্বঃ১
(বিঃদ্রঃ গল্পটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের লেখার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।)