একজোড়া পায়রা পর্ব -০৭

#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট৭

আজকে রাস্তায় শুভ্রকে দেখে উনার সম্পর্কে আমার ধারণা সম্পুর্ণ পালটে যায়।হঠাৎ করেই কেমন যেন হৃদয়ে আলাদা একটা জায়গা দখল করে নেয় তার কাজটা।বন্ধুদের নিয়ে নিজ হাত শহরের ছিন্নমুল মানুষদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন তিনি।শুভ্র সব সময় মাস্ক পরেন আমি জানি।তবে এখন দেখছি উনার সব বন্ধুরাও মাস্ক দিয়ে নিজেদের মুখ ঢেকে রেখেছে।একজন বৃদ্ধাকে দেখলাম উনার মাথায় হাত বোলাতে।কিছু মনে হয় বলছিলো বৃদ্ধাটা।দূর থেকে শুধু ঠোঁট নাড়ানিই দেখলাম।আমিও এখানে এসেছি কুকুরদের খাওয়াতে।সপ্তাহের একটা দিন আমি আশেপাশের কুকুরদের খাওয়াই।এরই মধ্যে সব গুলো আমায় ঘিরে ধরেছে।আমি বিস্কিট পাউরুটি গুলো ভাগে ভাগে কুকুর গুলোকে খেতে দিই।ফুটপাতের এক পাশে ঝেড়ে ধুলো সরিয়ে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে শুভ্রকে দেখতে লাগি।হঠাৎ একটা বাচ্চা মেয়ে এসে বলে,,,

-আপু ফুলের মালা নিবেন?

মেয়েটার ডাকে আমার ধ্যান ভাঙে।দেখি হাতে একটা বেলীফুলের মালা।অসম্ভব ভালো লাগে আমার বেলী ফুল।এর গন্ধ শুভ্রতা দুটোই মন পাগল করার মতো।

-কত করে?
-বিশ টাকা করে বিক্রি করি।আপনি দশটাকা দেন।ফুলগুলা একটু বাসি হইয়া গেছে তো!

আমি ব্যাগ থেকে একশো টাকা বের করে মেয়েটার হাতে গুজে দিই।মেয়েটা মলিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,,

-আপু আমার কাছে তো ভাংতি নাই!
-রেখে দাও।
-আপু গরীব হইতে পারি ছোটলোক না।
-আরেহ ধুর বোকা মেয়ে।তুমি আমায় আপু বললে না?আর আপু ভালোবেসে কিছু দিলে কেউ এমন কথা বলে?কিছু কিনে খেও।নাও,এইবার মালাটা আমার বেণুনীতে পরিয়ে দাও।

মেয়েটার আমার বেণুনীতে পরিয়ে দিয়ে রাস্তার বিপরীত পাশে শুভ্র আর ওর বন্ধুদের কাছে যায়।সেখান থেকে একটা খাবারের প্যাকেট নিয়ে নিজের গন্তব্যের দিকে যায়।এতক্ষণ আমি রাস্তার ফুটপাতে বসে ওদের কাজ মুগ্ধদৃষ্টিতে দেখছিলাম।হঠাৎ দেখি আমার দিকে আসিফ আঙুল দিয়ে ইশারা করে ভাবী ডাক দিলো।ভরা রাস্তায় কি কাজটা করলো!আমি লজ্জায় জিহবায় কামড় দিয়ে হাত দিয়ে মুখ লুকাই।আমায় দেখে শুভ্র রাস্তার এপাশে আসেন।হাতে থাকা ছোট কাগজের টুকরো দিয়ে ধুলো ঝেড়ে ফুটপাতে আমার পাশে বসেন।

-কেমন আছো?
-জ্বী আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
-তোমার সাথে রোজ দু’বেলা দেখা হয়।ভালো থাকবো না তো কি থাকবো!আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ তোমায় আমার ভার্সিটিতে নিয়ে এসেই ফেলছেন।

আমি মুচকী হাসি।উনি আমার লম্বা বেণুণীতে তাকিয়ে বলেন,,,

-ভালো মানিয়েছে বেলী ফুলের মালা তোমার লম্বা চুলে।
-আপনি রাজনীতির সাথে যুক্ত তাই না?
-হ্যাঁ,কিন্তু এই প্রশ্ন করলে যে!
-বর্তমান রাজনীতিতে তো নেতারা শুধু পাব্লিকের ধান্দা টাকা খাওয়ার ধান্দা খুঁজে।আর আপনি দেখলাম উলটো।

আমার কথা শুনে শুভ্র তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়।আমি কৌতুহল নিয়ে উনার দিকে তাকাই।উনি আবার সেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলেন,,,

-আমি জানি এটা শুধু তোমার ভেতরের কথা না।বাংলাদেশের ম্যাক্সিমাম মানুষেই রাজনীতির লোক বলতে বাটপারকেই বুঝে।ম্যাক্সিমাম পলিটিকাল মেম্বাররাই শুধু গেটাপ আর মুখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে।তারা ভাবে কালো কোর্ট আর সাদা পাঞ্জাবী পরলেই বঙ্গবন্ধু হওয়া যায়।কিন্তু না,বাংলাদেশে হাজার বছরের মধ্যে আমরা কোনো বঙ্গবন্ধু পাবো কিনা তা সন্দেহ।আমার রাজনীতিতে আসার একমাত্র কারণ বঙ্গবন্ধু।যাকে আমি শুধু বইয়ের পাতায় পড়েছি।উনার কর্মকাণ্ড আমার হৃদয়ে গেঁথে গেছে।সেই থেকে রাজনীতিতে আসা।তবে পলিটিশিয়ান লোক না বলে আমায় একজন ভলেন্টিয়ার বললেই আমি খুশী হই।

উনি নিজের সম্পর্কে এতকিছু আমায় বলে দিলেন?অবাক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকাই।উনি ঘড়ি দেখে বলেন,,,,

_চারটা ছুঁই ছুঁই।নিশ্চয়ই এখন শিশিরকে পড়াতে যাবে?

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাই।উনি রাস্তার ওপাশ থেকে বাইক নিয়ে আসেন।আমায় বলেন,,

-আমিও বাসায় যাবো।চাইলে যেতে পারো আমার সাথে।
-না,না।একটু পর বাস আসবে।আমি যেতে পারবো।
-বাসে প্রবলেম হয় না?
-হয় একটু আকটু।কিন্তু কি আর করার?

সংকুচিত কন্ঠে আমি বলি।উনি বলেন,,,

-তো উঠে পরো বাইকে।নাকি আমায় বিশ্বাস করতে পারছো না?

একেবারে কলিজার ইমোশনে পিন মেরে দিলো ব্যাটাটা।আমি আর না করতে পারলাম না।বেশ দুরত্ব মেনে উঠে পড়ি তার বাইকে।উনি বাইক স্টার্ট করেন।বাইক চলতে শুরু করে।আমায় নামিয়ে দিয়ে উনি বাইক গ্যারেজে রেখে আসেন।আমি ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বের করে উনাকে দিই।

-চকলেট কেন?
-আজকে যা করলেন তা আমার ভালো লেগেছে।আর আমি কারও ওপর খুব খুব খুব খুশী হলে তাকে চকলেট দিই।
-তাহলে তুমি আমার ওপর খুব খুব খুব খুশী হয়েছো?

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলি।কলিংবেলে চাপ দিতেই ভেতর থেকে আন্টি শিশিরকে দরজা খুলতে বলেন।শিশির এসে দরজা খুলে আমাকে আর শুভ্রকে দেখে বলে,,

-ওয়াও!ভাইয়া ভাবী…..

শুভ্রের চোখ রাঙানিতে থেমে যায় শিশির।রান্নাঘর আর ড্রয়িংরুমটা পাশাপাশি। আন্টি যদি শুনে যায় তাই বোধহয় শুভ্র শিশিরকে থামিয়ে দেয়।ডাইনিং টেবিলে আগেই বই খাতা নিয়ে বসে ছিলো শিশির।আমি গিয়ে ওকে পড়ানো শুরু করি।শুভ্র নিজের রুমে চলে যায়।কিছুক্ষণ বাদে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে আবার নিজের রুমে যায়।কথা হলো উনি যখন নিজের রুম থেকে আসলেন আবার খাবার নিয়ে নিজের রুমে গেলেন তখনও উনার মুখ মাস্ক দিয়ে ঢাকা ছিলো।বাইরে মাস্ক পরেন স্বাভাবিক। কিন্তু ঘরেও?নিজেকে কি উনি আড়াল করতে চান আমার থেকে?

-ভাইয়া কি সব সময় মাস্ক পরে শিশির?

প্যারাগ্রাফ লিখছিলো শিশির।আমার আকষ্মিক প্রশ্নে ঠাস করে আমার দিকে তাকায় সে।কৌতুহল নিয়ে বলে,,,

-নাহ ভাবী।কেন?
-তাকে মাস্ক ছাড়া কখনো দেখি নাই তো তাই আর কি!
-ভাইয়া বাইরের মানুষের সামনে মাস্ক পরে শুধু।
-হুম বুঝলাম।লিখো তুমি।

শিশির লেখায় মন দেয়।কেন যেন কোনো একটা অজানা কারণে উনার মুখ দেখার বড্ড কৌতুহল জাগছে।এমনিতে লোকটার ফাজলামোর জন্য আমার তাকে ভালোলাগতো না।কিন্তু আজকের কাজের পর থেকে কেমন একটা আলাদা টান অনুভব করছি লোকটার প্রতি।প্রেমে পরে গেলাম না তো লোকটার?নো মেঘ নো।ইটস হারাম মেঘ।তোর না শান্তর সাথে বিয়ে ঠিক!ওয়েট!ঐ জানোয়ারটাকে তুই বিয়ে করবি?নো নেভার।ঐ জানোয়ারটার থেকে বাঁচার জন্যই তো তুই প্রেম করার জন্য ভালো ছেলে খুঁজছিস।ঐ ভালো ছেলে যদি শুভ্র হয় তাহলে ক্ষতি কি?ধুরধুর, কি সব উল্টাপাল্টা ভাবছি।এরই মধ্যে দেখি তালগাছটা আবার সেই মাস্ক পরে প্লেট হাতে করে ড্যাং ড্যাং করে রুম থেকে আসছে।আমি তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারলাম,,

-মাস্ক পরে খান কিভাবে?

উনি মুচকী হাসেন।ডাইনিং টেবিলের এককোণে প্লেটটা রেখে বেসিনে হাত ধুতে না ধুতেই আন্টির চিৎকার।

-বানরের বাচ্চা।অসভ্য ছেলে।কতবার বলেছি সীমে নিজে প্লেট ধুয়ে ফেলবি।এখানে মেঘ শিশিরকে পড়াচ্ছে আর হারামজাদা মেঘের সামনে এঁটো প্লেট রেখে গেলেন।

আন্টির বকা খেয়ে শুভ্র বাধ্য হন প্লেট ধুতে।আমার সামনে আন্টি তাকে এভাবে ধুলেন না জানি বেচারা কত লজ্জা পেয়েছে।আমি মুখ টিপে হাসি।


সেদিনের ঘটনার পর থেকে শান্তকে পুরোপুরি ইগ্নোরে ফেলে দিয়েছি।এ নিয়ে দাদি কিছু বললে আমি কিছু বলে দেওয়ার আগেই বাবা দাদিকে কথা শুনিয়ে দেয়।নিহান ইদানীং কম মেসেজ দিচ্ছে।শুনলাম নতুন রিলেশনে গিয়েছে।গার্লফ্রেন্ড নিয়েই বিজি হয়তো।শুভ্রকে রাত বারোটার পরে অনলাইনে পাই।বেশ ভালোই কথা হয় উনার সাথে।অনেকটা ফ্রেন্ডলি হয়ে গেছি আমরা।আমিও তার সাথে এমন ভাবে জড়িয়ে গিয়েছি কী বলবো!কোনো কিছু তার থেকে লুকাতে পাই না।আমার মন খারাপ থাকলে নিমিষেই সে মন ভালো করে দেয়।অন্যদের মেসেজ পেলে খুব বিরক্ত লাগে কিন্তু তার মেসেজ পেলে অজান্তেই হেসে দেই আমি।হয়তো এইগুলোই প্রেমে পরার লক্ষণ।এশা তো বলেই দিয়েছে আমি গেছি!তখন আমি জিজ্ঞাস করেছিলাম,,

-কিভাবে বুঝলি।
-ঐ অকারণে মুচকী মুচকী হাসা প্রেমে পরার লক্ষণ।

এশার কথা শুনে খানিকটা লজ্জা পাই।যাই হোক প্রেমে পড়লে পড়লাম!ঠোঁটের কাছে তিলটা স্বার্থকতা পাবে।ভাবতেই লজ্জা লাগে আমিও প্রেমে পরেছি!

-আচ্ছা আপনি আমাকে কি ভাবেন?

শুভ্রকে মেসেজে জিজ্ঞাস করি।সে আমার মেসেজে লজ্জা পাওয়া ইমুজির রিয়াক্ট মেরে রিপ্লাই দেয়,,,

-প্রেয়সী।কিন্তু তুমি তো পাত্তা দাও না

উউউ পাত্তা দিই না বলে।আসলে আমি পাত্তা দিই।কিন্তু বুঝতে দেবো না ঐ অনেকটা ‘ঝাঁপ দিবো আমি প্রেমের পুকুরে,কিন্তু ডুববো না’

আমি তার মেসেজে স্যাড রিয়েক্ট দিই।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here