#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট১৫
দুদিন হলো শান্ত আমাদের বাসায় এসেছে।লোকটা সারাক্ষ্ণ আমার রুমের আশেপাশে ঘুর ঘুর করে।খুব বিরক্ত লাগে।ভাইয়াকে বললাম ভাইয়া শান্তকে বললো যাতে সে আমায় ডিস্টার্ব না করে।ছেলেটা ভাইয়ার সাথে কথাকাটাকাটি লাগিয়ে দেয়।শান্তর ভাষ্যমতে আমার মতো একটা ক্যারেক্টরলেস মেয়েকে যে ও বিয়ে করতে চাইছে এটা নাকি আমার ভাগ্য।কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ভাইয়া রাগের মাথায় শান্তকে মারতে নিলে আমি গিয়ে ভাইয়াকে আটকাই।দাদিও রাগারাগি করেছে।বাসায় যা হচ্ছে তার মূলে নাকি আমি রয়েছি।বিয়ের তোরজোর শুরু হয়ে গেছে। কালই আমার শান্তর সাথে বিয়ে।শুভ্রকে বললাম। কেমন যেন একটা গা ছাড়া ভাব ওর মধ্যে।ও কি আমায় ঠকালো?মন মেজাজ একদম ভালো নেই আমায়।শুভ্রকে যতবার ফোন করে বলছি ততবারই সে একটাই উত্তর দিচ্ছে “প্যারা নাই চিল”।উনি কি একটুও বুঝতে পারছে না আমি কতটা প্রেসারে আছি? উদাসী মন নিয়ে শুভ্রকে কল দিই।ওয়েটিংয়ে পাই।মিনিট পাঁচেক পর কল ব্যাক করেন সে।
-ওয়েটিংয়ে পেলাম!
-আসিফের সাথে কথা বলছিলাম।বাই দ্যা রাস্তা কেমন আছো?
-কেমন আছি মানে?গতকাল থেকে আমি আপনাকে কি বলতেছি?কোনো কথা সিরিয়াসলি নিয়েছেন আমার?
-প্যারা নাই চিল।
-উফফ!কি যে শুরু করেছেন!ভাল্লাগে না বলে দিলাম।
-তোমার যেমন রাগ করতে ভালো লাগে তেমন আমারও রাগাতে ভালোলাগে।
-কালকের পর থেকে রাগানোর জন্য এই মানুষটাকে আর পাবেন না।
-প্যারা নাই চিল।বিজি আছি।আল্লাহ হাফেজ।টেইক কেয়ার।আর অলওয়েজ মনে রাখবা প্যারা নাই চিল।
-ঘোড়ার ডিম।
আমি রাগে ফোন কেটে দিই।বিরক্তির সাথে ফোনটা বিছানায় ঢেল দিই।দেখি ভাইয়া দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মুচকী মুচকী হাসছে।আমি ধমকের সুরে চিৎকার দিয়ে বলি,,,
-হাসির কি আছে এখানে?
ভাইয়া আবার হেসে দাদিকে নকল করে বলে,,
-আস্তে কথা কবার পারোস না?
হ্যাঁ করো।সবাই আমায় নিয়ে হেয়ালিই করো।আমি যে কি পরিমাণ প্রেশারে আছি তোমরা কেউ বুঝবে না।আর বোঝার চেষ্টাও করবে না আমি জানি।ভাইয়া আমার কাছে এসে বসে।গাল টিপতে নেবে ঠিক সেই সময় আমি ওর হাত ধরে হাতটা এক ঝটকায় হাতটা বিছানায় ফেলে দিই।তীব্র রাগ আর অভিমান নিয়ে বলি,,,
-তোরা কেউ আসবি না আমার কাছে।
-রাগ হয়েছে?
-রাগ?রাগ করতে গেলে মানুষ হওয়া লাগে ভাইয়া।তোরা কেউ আমায় মানুষের কাতারে ফালাসই না।তো আমি কেন রাগ করবো?
-শুভ্র কি বললো?
-দুইদিন যাবৎ যা বলছে!প্যারা নাই চিল কাওয়া
-তুই ডিস্টার্বড?
-ভাই এখন আমি সব কিছুর প্রতিই ডিস্টার্ব।কিছুই ভাল্লাগছে না আমার।কালকে আমার লাইফ বরবাদ হয়ে যাবে আর তোরা সবাই প্যারা নাই চিল কাওয়া হাঁস মুরগী লাগিয়েছিস।যা তুই ভাই।আমার রুম থেকে বের হ।একটু একা থাকতে দে আমায়।
হাতজোড় করে অনুরোধ করি ভাইয়াকে।ভাইয়া চাপা হাসি নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।কোনো রকমে রাতে খাবারের সময় ডাইনিং টেবিলে হাজিরা দিতে যাই।দাদি,ভাইয়া,আব্বু,শান্ত,শান্তর বাবা-মা বসেছে খেতে।মা বেড়ে বেড়ে সবাইকে খাওয়াচ্ছে।আমি মাকে সাহায্য করতে গেলে দাদি আমায় কড়া গলায় হুকুম দেন শান্তর পাশে বসার।অশান্তির ভয়ে আমি আর দাদির কথা ফেলতে পারিনি।স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাও কোরআনে বলেছেন অশান্তি যুদ্ধ হতেও ভয়াবহ। তাই অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গিয়ে শান্তর পাশে বসি। আমায় পাশে বসতে দেখে হারামজাদাটা খাবে কি?মুচকী মুচকী হেসেই পেরে উঠে না।মনটা বলছে গরম ডাল শালার ওপর মুখে ছুড়ে দেই।
-পোলাডারে খাওন বাইড়া দে।
-পারবো না গো দাদি।হাত আছে সে নিয়ে নিয়ে খাক।
দাদির কথার জবাবে আমি বলি। দাদি আমায় ধমক দিয়ে বলেন,,,
-জামাইরেই তো বাইড়া খাওয়াবার কইছি!মুখে মুখে এবা কইরা উত্তর দিলে তোর মুখ ভাইঙা দিমু।
আমি কেঁপে উঠি।ডালের বাটিটা এগিয়ে এনে মুচকী হাসি দিয়ে শান্তকে বলি,,,
-আপনার ডাল লাগবে?দেবো ডাল?
-তুমি ভালোবেসে যা দেবে আমি তাই ই গ্রহণ করবো মেঘরাণী।
লাজুক কন্ঠে মুচকী হেসে বলে শান্ত।আমার রাগে ক্ষোপে দাঁত কিড়মিড় করছে।অনেকটা ইচ্ছাকৃত ভাবেই গরম ডাল শান্তের গায়ের ওপর ফেলে দিই আমি।ঘটনার আকষ্মিকতায় শান্ত হকচকিয়ে যায়। লাফ দিয়ে উঠে পড়ে সে।আমি না বুঝার ভান করে বলি,,,
-এ বাবা পড়ে গেল ডাল।সরি শান্ত।
-না না ঠিক আছে মেঘরাণী।আমি ক্লিন হয়ে আসছি।
শান্ত পরিষ্কার হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে চলে যায়।আমার এ হেন কাজে দাদি আমার ওপর খুব চড়াও।
-মায়ে কিচ্ছু হিকায় নাই মেয়াডারে।জামাই বাড়িয়ে গেলে কি করবো?ওই মেহের।যা ছি পোলাডারে ওষুধ দে গা। কষ্ট পাইবো তো পোলাডায়! গরম ডাইল ফালাইছে মাইয়ায়!
-আমার খিদা লাগছে গো দাদি।খাবার দেও আমায়।
ভাইয়া বলেন।দাদির সাথে তাল মিলিয়ে শান্তর মাও বলে,,,
-যা বলেছেন খালা!সামান্য ডাল দিতে গিয়ে কেউ এমন করে?অন্য কেউ হলে তো কষিয়ে চড় বসিয়ে দিতো এই মেয়ের গালে।
-কিছু যদি না ই শিখে থাকতাম তাহলে এই পাঁচ পাঁচটা বছর ঢাকা শহরে থাকলাম কিভাবে?
আমি জবাবে বলি।এই মহিলার জন্যই ছেলে গোল্লায় গেছে।ছেলেকে কোনো শাসন করেনি এই মহিলা।আংকেল শাসন করতে গেলে উলটা আংকেলের ওপর ক্ষেপেছে।আর আংকেল তো কি বলবো!বউয়ের সামনে ভেজা বেড়াল।বেটায় একদম বউ পাগলা।মুখের ওপর জবাব দেওয়ায় অনেকের কাছেই এটা বেয়াদবি হয়ে যায়। দাদি আরও ক্ষেপে যায় আমার ওপর।কড়া গলায় ধমক দিয়ে বলেন,,,
-চুপ বেয়াদব ছেমড়ি।
দাদির ধমক খেয়ে আমি চুপ হই।কোনো রকমে খাবারের টেবিলে হাজিরা দিয়ে আমি আমার ঘরে আসি।আমার ঘর আর শান্তকে থাকতে দেওয়া ঘরটা পাশাপাশি। ঘরে ঢুকতে যাবো ঠিক সেই সময় কেউ আমায় হেঁচকা টানে শান্তর ঘরে নিয়ে যায়।আমি আন্দাজ করতে পারি।এ শান্ত ছাড়া কেউ হবে না।ঘটনার আকষ্মিকতায় আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি।চোখ খুলে শান্তকে দেখি আমি শান্ত মুখোমুখি। আন্দাজ ভুল হয়নি তাহলে। শান্ত আমায় দেয়ালের সাথে চেপে ধরেছে।মুখ থেকে সিগারেটের বাজে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
-তুই ইচ্ছে করে আমার ওপর গরম ডাল ফেলেছিলি তাই না?
রাগে গড়গড় করতে করতে বলে শান্ত।আমি দুর্গন্ধে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলি,,,
-বেশ করেছি ডাল ফেলেছি।আমার বাপের খেয়ে আমি ডাল ফেলেছি আপনার কী?কতদিন আর ভালোমানুষের মুখোস পড়ে থাকবেন?
-খুব তো কথা ফুটেছে মুখে।বিয়ের পর দেখা যাবে তুই এত কথা বলিস কিভাবে!
-ইনশাআল্লাহ বিয়েটা হবে না।
-কেন তোর কাস্টমার শুভ্র এসে তোকে বিয়ে করবে নাকি?
-মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ।
কথাটা বলেই শান্তকে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে দিয়ে চড় লাগাই আমি।চড় খেয়ে শান্ত পাগলা কুকুরের মতো ক্ষেপে যায়।হিংস্র হায়নার মতো আমার পেছনে ছুটতে লাগে।আমি দৌড়ে রুম থেকে বেরুই।ভাইয়াকে দেখে গিয়ে ভাইয়ার পেছনে লুকাই।ভাইয়াকে দেখে শান্ত থেমে যায়।ভাইয়া শান্তর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,,,
-দেখ শান্ত তুই কিন্তু লিমিট ক্রস করছিস!
শান্ত কিছু না বলে ওর ঘরে চলে যায়।আমি ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিই।
-প্লিজ ভাইয়া আমায় বাঁচা।এই জানোয়ারটার হাতে আমায় তুলে দিস না।
ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,,
-কাঁদিস না বোন।
★
লাল শাড়ি পরে সেজে শান্তর পাশে বসে আছি।সামনে কাজী সাহেব বিয়ের জন্য যাবতীয় কাগজ গুছাচ্ছেন।এখানে আসার আগে শুভ্রকে ফোন দিয়েছিলাম।সে একই কথা বলেছেন প্যারা নাই চিল!মেঘ নাকি শুভ্রর!খুব হাসি পাচ্ছে কথাটা মনে করে।তাচ্ছিল্যের হাসি।আমি শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তার অপেক্ষা করবো।আমার বিশ্বাস সে আসবে।কিন্তু আবার দ্বিধাদ্বন্দেও আছি।শুভ্র আমায় ঠকালো না তো? এরই মধ্যে কাজী সাহেব সব গুছিয়ে ফেলেছেন।শান্ত কাবিন নামায় সাইন করছে।ওর সাইন হয়ে গেলে আমার সাইন করার পালা আসে।আমি অসহায় দৃষ্টিতে ভাইয়ার দিকে তাকাই।ভাইয়া আমায় ইশারায় আশ্বাস দেন।এখনো আশ্বাস? কিসের আশ্বাস?সব তো শেষ হয়েই গেলো।আমি কাঁপা হাতে সাইন করতে যাবো ঠিক সেই সময় ভুতের মতো এসে উদয় হয় শুভ্র।সাথে ওর বন্ধুবান্ধব। সবাই উঠে দাঁড়ায়।আমি তখন সোফায় বসেই উনার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।আমার ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি।একেবারে সেজে গুজে বরের বেশে এসেছে।
-কে তুমি?
শান্ত প্রশ্ন ছুড়ে মারে।শুভ্র ভাব নিয়ে বলেন,,,
-আমি মেঘের জানপাখি।তাই না মেঘ?
কথাটা বলেই আমায় চোখ মারেন শুভ্র।দাদি শুভ্রকে বলেন,,
-ওই ছেমড়া তুই কেরা ভালা কইরা ক!
-আপনার নাতিন জামাই।
-ছেমড়া কয় কি! আমার নাতিন জামাই শান্ত।
-বিয়ে ঠিক আপনি করছেন না মাই ডিয়ার দাদি শ্বাশুড়ি?
-হ করছি তো?
-মত নিয়েছেন মেঘের?
-মাইয়াগো বিয়ার মত নেন লাগে নাকি?আমগোর তো মত নেয় নাই।যারে আমগো বড়জনরা ভালো বুঝছে তার লগেই বিয়া হইছে
-এখন যুগ আপডেট হয়েছে।মেয়ের মত ছাড়া বিয়ে হয় না।
-কোন হাদিসে আছে।তুই দেহা আমায়।
-দেহান তো যাইবো না।নেডে সার্চ দিয়া শুনাই কি বলেন মাই ডিয়ার দাদি শ্বাশুড়ি!
উফফ পুরো হিরোর মতো এন্ট্রি।জিতেছি আমি।আমি তো প্রায় আশায়ই ছেড়ে দিয়েছিলাম।শুভ্র নেট থেকে সার্চ দিয়ে দাদিকে সে হাদিস শোনায়।
আবু সালামাহ বর্ণিত।আবু হুমায়রা(রা) তাদের কাছে বর্ণনা করেন যে, নবী (সা) বলেছেন,কোনো বিধবা নারী বা কুমারী মেয়েকে তাদের মত ছাড়া বিয়ে দেওয়া যাবে না।( মুসলিমঃ১৪১৯)
হাদিস শুনে সবার মুখ কালো হয়ে গেছে।কাজীও শুভ্রের সাথে সহমত পোষণ করেন।শুভ্র এসে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে,,,,
-Will you marry me Megh?
-Yes!I will
চলবে,,,ইনশাআল্লাহ