একজোড়া পায়রা পর্ব -১৬+১৭

#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট১৬

কাজী সাহেব সব কাগজপত্র গুছাচ্ছেন।আমি আর শুভ্র পাশাপাশি বসা।শান্ত, শান্তর বাবা বিশেষ করে মা থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে।শুভ্রের বন্ধুবান্ধব শান্তকে ঘিরে রেখেছে।যাতে ও কোনো ঝামেলা করার সুযোগ না পায়।আচ্ছা!শুভ্র যে আমায় বিয়ে করছে,ওর বাবা মা কি রাজি আমায় তাদের পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করতে?আস্তে করে ফিসফিস করে বলি,,,

-আংকেল আন্টি কি আমায় মেনে নেবেন?
-কল দেম বাবা মা।আম্মু তোমায় বরণ করার জন্য বসে আছে।আম্মুই সব প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র গুছিয়ে দিয়েছেন।সো প্যারা নাই চিল।
-আপনি ভাইয়া সব আগে থেকেই জানতেন না?তাই দুজন এত প্যারা নাই চিল কাওয়া করছিলেন?
-তুমি যা ধরে নাও।

শুভ্র নিকাহনামায় সই করলো।উনার হয়ে গেলে আমি নিকাহনামায় সাইন করি।চিরদিনের জন্য আমরা একে অপরের হয়ে গেলাম।কেউ আলাদা করতে পারবে না আমাদের। শুভ্র আমার দিকে চোখ মেরে বলেন,,

-প্যারা নাই চিল।

আমি হেসে দিই।আমার এই মুহুর্তটাকে চট করে ক্যামেরা বন্দী করে ফেলে শুভ্র বন্ধু রোদ।সবাই মিষ্টিমুখ করে।শুভ্র আমার হাতে একটা কাতান শাড়ি দিয়ে বলে,,

-আম্মু নিজে পছন্দ করে কিনেছে।যাও চট করে পরে সেজে আসো।ফটোশুট হবে।তুমি তো বলেছো বিয়েতে ছবি ভালো না হলে তুমি আবার বিয়ে করবে!

উপস্থিত সবাই হেসে দেয়।খাওয়া দাওয়ার পর্ব চলছে।সবার মুখ হাস্যজ্বল।দাদি কেমন করে যেন মেনে নিয়েছে শুভ্রকে।শুধু শান্ত আর শান্তর মায়ের মুখে যেন রাজ্যের বিষন্নতা এসে গিয়েছে। শান্তর বাবাও মেনে নিয়েছেন।যা হওয়ার হয়ে গেছে।আমার সাথে শান্তর বিয়ে হলে আমরা কেউ ভালো থাকতাম না।উনি মেনে নিয়েছেন তা। আমি আর শুভ্র হেসে হেসে কথা বলছি। ঠিক সেই সময় রোদ,,,

-ভাইয়া ভাবিজী স্মাইল

বলে আমাদের মুহুর্তটাকে ক্যামেরা বন্দী করে ফেলে।

বিকেলের মিষ্টি রোদে আমরা ছাদে যাই ছবি তুলতে।আমার বাবা শখ করে কবুতর পোষেন।ছবি তুলার সময় হঠাৎ খেয়াল করলাম পাশে রেলিংয়ে একজোড়া পায়রা বসে আছে।হঠাৎ করেই পায়রা দুটোর মাঝখানে একটা কাক এসে বসে।শুভ্র কাকটাকে তাড়িয়ে দিয়ে আমায় বলে,,,

-আমি আর তুমি হচ্ছি পায়রা দুটো।আর শান্ত ব্যাটা ওই কাওয়া!

শুভ্রর কথা শুনে আমি ফিক করে হেসে দিই।পারেনও উনি।শেষমেষ কাকের সাথে শান্তের তুলনা?শুভ্রের কথা শুনে বাকিরাও হেসে দেয়।কিছু ছবি তোলা হয়ে গেলে আমি আর শুভ্র ছবিগুলো দেখছিলাম।হঠাৎ করে শুভ্র বলে উঠে,,

-এই গুলো আপ দিবে না?
-হু,হ্যাশট্যাগ মাই হাবি।
-আগে বলতে।আমি মাস্ক পরে তুলতাম ছবিগুলো।
-ঘোড়ার ডিম এত ঢং করা লাগবে কেন?
-তোমার জিনিস অন্যকেউ দেখুক তুমি নিশ্চয়ই তা চাইবে না।

ভুল তো বলে নি তালগাছটা।আমার জিনিস অন্য কেউ দেখে তাতে শকুনের নজর দেবে এটা আমি কখনোই মেনে নেবো না।ভাইয়াকে দিয়ে ঘর থেকে একটা মাস্ক আনাই।তারপর রোদকে বলি ছবি তুলতে।ইনস্টায় আপ দেবো হ্যাশট্যাগ মিস্টার এন্ড মিসেস মাস্ক।


এসেছিলাম একা।ফিরছি জোড়ায়।আমার ক্লাস আছে।সন্ধ্যায়ই রওনা দিই।ভাইয়া একটা গাড়ি মেনেজ করে দেয়। সেই গাড়িতেই আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই।রাজ্যের ক্লান্তি ভর করেছিলো আমার ওপর।ঠান্ডা হাওয়া পেয়ে আমার চোখের পাতা লেগে আসে।

হঠাৎ কারও উষ্ণ নিঃশ্বাসের স্পর্শে আমার ঘুম ভাঙে।চোখ মেলে নিজেকে শুভ্রের বাহুডোরে আবিষ্কার করলাম।আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।সারাদিনের ক্লান্তি তাকেও ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।আগে খেয়াল করিনি।আজকে খেয়াল করলাম তার চোখের পাপড়ি গুলো অনেক সুন্দর।আমার খুব হিংসা হচ্ছে।উনার চোখের পাপড়ি গুলো এত সুন্দর আর এদিকে মেয়ে হয়েও আমার চোখের পাপড়ি বিশ্রী।শুধু চোখের পাপড়ি কেন!আমার তো চোখও বিশ্রী।তবে একটা কথায় খুব হাসি পায়।উনি নাকি প্রথমে আমার চোখের প্রেমে পড়েছেন।এক বিশাল মায়ার সাগর নাকি দেখেছিলেন আমার চোখে শুভ্র।


কোনো এক কারণে এইবার রাস্তায় জ্যাম কম ছিলো।তাই তাড়াতাড়িই ঢাকায় পৌঁছাই।গিয়ে দেখি আন্টি আমায় পুত্রবধূ রূপে বরণ করার জন্য বসে আছেন।আমিই বোধহয় প্রথম মেয়ে যে রাত বারোটায় বধুবরণের ইতিহাস গড়লো!আমি ভাবতেও পারিনি এভাবে আন্টি আমায় আপন করে নেবেন।শিশির তো আমায় ম্যাম বলে দৌড়ে এসে শুভ্রের চোখ রাঙানি দেখে আমায় ভাবি বলে জড়িয়ে ধরলো!
শুভ্রের ঘরে গিয়ে দেখি ঘর পুরো গোয়ালঘর।বিছানায় জামা কাপড় পড়ে আছে।আন্টি আমাদের পেছন পেছন এসে বলেন,,,

-আমি গুছাতে গেলেই বলতো এগুলো তার বউ গুছাবে।নেও এবারর যখন বউ হয়ে এসেছোই আমার এই বাদরের দায়িত্ব তোমার।

আমি হেসে দিইই।কোনো রকমে খেয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়ি।

সকালে উঠে আন্টির কাছে কিছু সাহায্য করি।শুভ্রকে ছয়টা থেকে ডাকাডাকি করছি।সাড়ে সাতটা বেজে গেছে কোনো হুশ নেই তার।মরার মতো ঘুমচ্ছেন।নয়টা থেকে ক্লাস শুরু। আচ্ছা!সিনেমা সিরিয়ালে তো দেখেছি বউ জামাইকে চুলের পানির ছিটায় উঠায় ঘুম থেকে।আমি তো এখন উনার বউ।সেই হিসাবে উনাকে আমি চুলের পানি ছিটায় ঘুম থেকে উঠাতেই পারি!যা ভাবনা তাই কাজ!চুলের পানির ছিটা দিই উনার মুখে।পানির স্পর্শে উনার ঘুম ভাঙে।ঘুমের ঘোরে বলেন,,

-উফফ আম্মু উঠতেছি তো!
-আমি মেঘ।উঠুন।ভার্সিটি যেতে হবে।ক্লাস আছে।

উনি উঠে বাথরুমে যান ফ্রেশ হওয়ার জন্য।আন্টি মানে আমার শ্বাশুড়ি মা ইতিমধ্যে চিল্লা চিল্লি শুরু করে দিয়েছেন।

-বিয়ে করে বউ আনলো দুদিন পর বাচ্চার বাপ হবে তাও নবাব জাদার ঘুম ভাঙে না।

শুভ্র ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে আমি কাপড় চেঞ্জ করে নিই।সে ফ্রেশ হয়ে বের হলে দুজন একসাথে খেতে বসি।খাওয়া হয়ে গেলে আমি ঘরে গিয়ে রেডি হই বের হওয়ার জন্য।আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের পাশে শুভ্রর প্রতিবিম্বকে দেখতে পাই।শুভ্র এসে আমার পেছন দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে চুল ঠিক করতে লাগেন।আয়নায় প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে,,,

-শর্ট মেয়ে বিয়ে করায় ভালোই হয়েছে।কি সুন্দর আয়নায় দেখা যায়।
-খাটো বলে অপমান করলেন?
-অহংকার করলাম।কারণ আমার হার্টবিট মাপার যন্ত্র আছে।

কথাটা বলেই উনি আমায় জড়িয়ে ধরেন।প্রশান্তির শ্বাস ফেলে বলেন,,

-কি শুনতে পাও?
-ধিক ধিক ধিক ধিক ধিক ধিক
-উহু,মেঘ মেঘ মেঘ মেঘ মেঘ

বলে তিনি আমার কপালে চুমু দেন।আমি চোখ বন্ধ করে তা সাদরে গ্রহণ করি।হঠাৎ করেই ঘড়ির কাঁটায় চোখ যায়।দেরি হয়ে গেছে।নিজেকে ছাড়িয়ে বলি,,,

-রোমান্স পরে কইরেন।ক্লাস আছে।যেতে হবে।চলুন বের হই।

আমি কোনো রকমে চুলটা হাত খোপা করে ব্যাগ নিই।উনি মাস্ক পরে হাত ঘড়ি পরতে পরতে বের হন।


ক্যাম্পাসে গিয়েই দেখি এশা ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আমায় দেখে দৌড়ে আসে।

-কিরে মিসেস শুভ্র?
-তোরা আগে থেকেই সব জানতি।আমায় বলিস নি কেন?
-শুভ্র ভাইয়া না করেছিলো।তা কিছু খাওয়াবি না?বিয়ের দাওয়াত তো খাইতে পারলাম না।
-ক্লাস শেষে খাওয়াবো নি।
-আচ্ছা আমি যাই তাহলে।ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে দেখা হচ্ছে।

এশা চলে যায়।আমি ক্লাসে যেতেই ফুলের এক গাদা প্রশ্নের সম্মুখীন হই। কিভাবে বিয়ে হলো, কাহিনী কী ব্লা ব্লা।এত বড় কাহিনি কি আর এই অল্প সময়ে বলা যায়?ওকে বলি কোনো একদিন সময় করে সব বলবো ওকে।

ক্লাস শেষ করে যাই ক্যান্টিনে।শুভ্রকেও বলি আসতে।এশা আর নাবিল আগে থেকেই ওয়েট করছিলো আমাদের জন্য।শুভ্র মিনিট দশেক পর আসে।এই ব্যাটা সব সময় লেট লতিফ।শুভ্র সবাইকে ট্রিট দেয়।

-তুই তো ছক্কা মাইরা দিলি মেঘ।দেড় বছর প্রেম করেই বিয়ে করে নিলি!
-ঠোঁটের কাছে তিল আছে দুজনেরই।বুঝতে হবে তো!
-শুভ্র ভাইয়ারও আছে?
-জ্বী দুজনেরই আছে।
-দুলাভাইয়ের মুখ দেখলাম না!
-আমার জিনিস শুধু আমিই দেখবো।অন্য কারও দেখার প্রয়োজন মনে করি না।
-বেশিই হয়ে গেলো না মেঘ?আর মানুষের জামাই নাই।
-জামাই আছে তবে শুভ্র নাই।ওটা শুধু মেঘের।

আমি বলার আগেই শুভ্র এশাকে উত্তর দিয়ে দেয়।শুভ্রের কথা শুনে এশা ভেংচি কাটে
#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট১৭

“বিয়ের পর জামাই নিয়ে ঘুরিস” এই কথাটার সাথে আমরা কমবেশি সব মেয়েই পরিচিত।আর পাঁচটা বাঙালি মায়ের মতো আমার মা-ও আমায় এই কথাটা বলেছেন।বন্ধুদের সাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা বললেই আমার মা এক্টাই উত্তর দিতেন তা হলো “বিয়ের পর জামাই নিয়ে ঘুরিস”।
আমার মন খারাপ হয়ে যেত।বাবা মা খুব কড়া ছিলেন।সত্যি বলতে স্কুল জীবনে আমার কোথাও ঘুরা হয় নি।নিজের এলাকা দিয়ে যে বান্ধবীদের সাথে ঘুরবো তা আমার হয়ে উঠে নি।দাদা,বাবাও মানুষের কাছে বেশ পরিচিত ছিলো যার কারণে স্কুল বা প্রাইভেট মিস দিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সাহস আমার হয়ে উঠেনি।যদি কেউ দেখে ফেলে!অমুকের মেয়ে নাতনি ওমক জায়গায় ঘুরছে।এসএসসি দিয়ে তো ঢাকাই চলে আসলাম।পড়াশোনা টিউশনির চাপে আমার ঢাকাও অতটা ঘুরা হয় নি। শুভ্রের সাথে রিলেশনে যাবার পরও আমি ওর সাথে কোথাও ঘুরতে যাই নি খুব একটা।কিন্তু এখন তো শুভ্র আমার জামাই।তো এখন ওকে নিয়ে ঘুরাই যায়! টাংগাইল জেলায় বিয়ের একটা রিচুয়াল আছে।অন্যান্য জেলায় আছে কিনা জানি না তবে আমাদের টাংগাইলা কালচারে এটা আছে।বিয়ের কয়েকদিন পর বউ জামাইকে নিয়ে তার বাপের বাড়ি বেড়াতে যায়।এটাকে ফিরানি বলে।হিন্দু কালচারেও এই রিচুয়ালটা আছে।তারা এটাকে দ্বিরাগমন বলে।যদিও বিয়েটা অত জাকজমক করে হয় নি।তাও বাবা মা ভাইয়া বললো শুভ্রকে নিয়ে ঘুরে আসতে।
শুভ্রের সাথে এইবার আমার প্রথম ট্রেইনজার্নি।আমি ভীষণ এক্সাইটেড। সিনামার মতো তার কাঁধে মাথা রেখে পাড়ি দেবো পুরোটা পথ!


নিজের এলাকা দিয়েই জামাই নিয়ে ঘুরা শুরু করবো।আমার গ্রামের দাদাবাড়িতেই একটা প্রাচীন জমিদার বাড়ি আছে।হেমনগর জমিদার বাড়ি।জমিদার বাড়িটি বর্তমানে কলেজের তত্ত্বাবধানে আছে।হেমনগর ডিগ্রী কলেজ।কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সাংসদ এবং বাংলাদেশ অর্থাৎ মুজিবনগর সরকারের প্রথম অর্থসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান খান।

#হেমনগর_জমিদার_বাড়ি

হেরেম্ব চন্দ্র চৌধুরী ওরফে হেমচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন হেমনগরের জমিদার। কথিত আছে তিনি একজন ন্যায় বিচারক, শিক্ষানুরাগী ও সাংস্কৃতিমনা ছিলেন।

এই জমিদার বাড়ীর অবস্থান টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার হেমনগরে। যেখানে অষ্টাদশ শতাব্দীর কারুকাজ করা দ্বিতল ভবনটি আজও পুরনো ঐতিহ্য কিছুটা হলেও প্রকাশ করছে। বাড়ির সামনে রয়েছে বিরাট মাঠ। মাঠ পেরিয়ে গেলেই দেখা যায় দ্বিতল বাড়ির ছাদে দুটি পরীর ভাস্কর্য। ১০০ কক্ষবিশিষ্ট এ বাড়িটি প্রায় ৩০ একর জমির ওপর তৈরি। সামনে দরবার ঘর। দুই পাশে সারি-সারি ঘরগুলো নিয়ে গড়ে উঠেছে চতুর্ভুজাকার জমিদার প্রাসাদ। তিন ফুট প্রশস্ত দেয়ালে ঘেরা জমিদার বাড়ির মাঠের সামনে এবং বাড়ির পেছনে রয়েছে বড় দুটি পুকুর। এই উপনিবেশিক স্থাপনাটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, এর চিনি টিকরী অলংকরণ। চিনি টিকরী হলো এক ধরণের ডেকোরেশন পদ্ধতি, অনেকটা মোজাইকের মতো। এই পদ্ধতিতে স্থাপত্যের গায়ে চিনামাটির বাসন কোসনের ছোট ভগ্নাংশ ও কাঁচের টুকরা ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরণের নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। সামনের দিকের পিলার থেকে শুরু করে, দেয়াল, দরজা জানালার প্যানেল, প্রতিটা জায়গার এই অলংকরণ ছিল। নকশা গুলো মুলত: ফ্লোরাল আর জ্যামিতিক।

জমিদার হেরেম্ব চন্দ্র চৌধুরীর পিতা ছিলেন কালিবাবু চৌধুরী যিনি মূলত ব্যবসায়ী ছিলেন এবং সূর্যাস্ত আইনের আওতায় শিমুলিয়া পরগণার জমিদারি কিনে নেন। কালিবাবু চৌধুরীর ছিল চার ছেলে ও চার মেয়ে। বড় ছেলে হেরেশ্বর চন্দ্র চৌধুরী জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পান। তিনি ময়মনসিংহ জেলার মধুপুর উপজেলার আমবাড়িয়া এস্টেটে জমিদার বাড়ি বানান। কিন্তু আমাড়িয়া থেকে যমুনার পূর্বপাড় এবং সেখান থেকে মধুপুরগড় পর্যন্ত বিশাল এলাকার জমিদারি পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই তিনি গোপালপুর উপজেলার সুবর্ণখালী নামক গ্রামে দ্বিতীয় বাড়ি নির্মাণ করেন। নদীভাঙনে সুবর্ণখালী বিলীন হতে থাকলে তিনি শিমলাপাড়া গ্রামে ১৮৮০ সালের দিকে এই প্রাসাদ তৈরি করেন এবং নিজ নামে এলাকার নামকরণ করেন হেমনগর। বাড়ীটির অন্য নাম এঞ্জেল হাউজ। হেমনগরের পাশাপাশি তিনি পুখুরিয়া পরগণার একআনি অংশেরও জমিদার ছিলেন। হেরেম্ব বাবুর ছোট ভাই প্রফুল্ল চন্দ্র চৌধুরী হাদিরার সৈয়দপুর গ্রামে আরও একটি বাড়ি বানানোর চিন্তাভাবনা করে ছিলেন বলে সেখানেও একটি এলাকার নামকরণ করা হয় প্রফুল্লনগর। শিক্ষা-সংস্কৃতি বিকাশে জমিদার পরিবারের ছিল ব্যাপক ভূমিকা। জমিদার প্রাসাদের পাশে ছিল চিড়িয়াখানা, নাটকের ঘর। তদানীন্তন পূর্ব বাংলার সংস্কৃতি পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল এটি। হেরেম্ব চন্দ্র চৌধুরী ১৯০০ সালে প্রায় বিশ একর জমির ওপর শশীমুখী সেকেন্ডারি ইংলিশ হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেসময় এখান থেকে ইংরেজি শিক্ষা দেয়া হতো। ময়মনসিংহে আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ প্রতিষ্ঠায় দশজন দাতা সদস্যের তালিকায় তার নাম চার নম্বরে লিপিবদ্ধ আছে। হেমচন্দ্র চৌধুরী চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ডে অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

দেশ বিভাগের আগ মুহূর্তে কৃষক নেতা হাতেম আলী খানের নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরু হয়। বারবার আপসের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ১৯৪৬ সালে হেমবাবুর উত্তরসূরি জমিদারি গুটিয়ে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ফেলে কলকাতায় চলে যান। পরবর্তীতে পরিত্যক্ত এই বাড়িতে হেমনগর কলেজ স্থাপিত হয়।

জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৯২৫ সালে ভারতের কাশিতে মৃত্যুবরণ করেন বলে জানা যায় । কিন্তু তাঁর বংশধরেরা এখনও কলকাতার যাদবপুরে বসবাস করেন।

দেশ ভাগের সময় জমিদার হেমচন্দ্র পুরো পরিবার নিয়ে ভারত চলে যায়।তার ব্যবহারকৃত অনেক আসবাব স্থানীয় লোকজনের কাছে সংগ্রহীত আছে।দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত হয়ে থাকার পর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থসচীব এবং বঙ্গবন্ধুর সহচর ও প্রয়াত সংসদ সদস্য #খন্দকার_আসাদুজ্জামান_খান ১৯৭৯ সালে জমিদার বাড়িতে হেমনগর ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।বর্তমানে কলেজের তত্ত্বাবধানে আছে হেমনগর জমিদার বাড়িটি।

#শশীমুখী_স্কুলের_নামকরণের_ইতিহাস

স্থানীয় লোক জনের কাছ থেকে জানা গেছে জমিদার হেমচন্দ্র নিজের সৎ মা শশীমুখী চৌধুরীর নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

আমি আমার দাদা আর বুবুর কাছ থেকে শুনেছি…. হেমচন্দ্রের বাবা চেয়েছিলেন হেমচন্দ্রকে জন্মের সাথে সাথে মেরে ফেলতে।কোনো এক স্বপ্ন দোষের কারণে হেমচন্দ্রের বাবা চেয়েছিলেন নিষ্পাপ শিশু হেমচন্দ্রকে বলি দিতে।এই বিষয়টা কোনো ভাবে হেমচন্দ্রের সৎমা জেনে যায় এবং হেমচন্দ্রের মা কে গর্ভাবস্থায় হেমচন্দ্রের নানা বাড়ি পাঠিয়ে দেন।নানা বাড়িতেই হেমচন্দ্রের জন্ম হয়। কিছুটা বড় হওয়ার পর হেমচন্দ্র নিজের পিত্রালয় হেমনগর জমিদার বাড়িতে চলে আসেন।শশীমুখীর জন্যই হেমচন্দ্রকে তার বাবা মারতে পারেননি।তাই হেমচন্দ্র শশীমুখীকে খুব শ্রদ্ধা করতো।শশীমুখীর প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক হিসাবে হেমচন্দ্র শশীমুখী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।লোকমুখ থেকে শোনা হয়ে থাকে দূর দুরান্ত থেকে অনেক জমিদারের পুত্র কন্যারা হেমনগর জমিদার বাড়িতে অবস্থান করে শশীমুখী স্কুলে অধ্যয়ন করতো।

বেশ কিছুদিন আগে মৌসুমি হামিদ অভিনীত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচিত্রের( নাম আর সিনেমার নাম আমার মনে নাই।ছোট ছিলাম তো অনেক) শুটিং হয়েছিল। তাছাড়াও জমিদার বাড়িটিতে বর্তমানে সেনাবাহিনীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।অনেক শক্ত কাঠামো দিয়ে বানানো হয়েছে জমিদার বাড়িটি।আমার বাবার কাছ থেকে শুনেছি স্থানীয় মানুষরা গুপ্তধনের আশায় একবার জমিদার বাড়ির মুল ভবনের নিচে মাটি খুঁড়েছিলো।প্রায় ২-৩মিটার খোঁড়া হয়।শুধু ইট পাওয়া গিয়েছিলো।তাই বলাই যায় অনেক শক্ত ভিত্তির ওপর জমিদার বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিলো।
কিন্তু অযত্ন আর অবহেলায় আজ জমিদার বাড়িটি বিলুপ্তির পথে।আগে থেকে যদি জমিদার বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হতো তাহলে আমাদের হেমনগর জমিদার বাড়ি মহেড়া জমিদার বাড়ি থেকে কোনো অংশে কম হতো না।এখন যদি এটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে কমপক্ষে ১০০-২০০ কোটি টাকা লাগবে জমিদার বাড়ির সংস্কার করতে।ভাঙা আর পুরোনো হলেও ঘুরে বেড়ানোর জন্য এক অপুর্ব স্থান আমাদের এই হেমনগর জমিদার বাড়ি। আমার ছবি তোলার নেশা আছে। ফটো শুটের জন্য পুরোনো হেমনগর জমিদার বাড়িটি আমার জন্যে পার্ফেক্ট।বন্ধুবান্ধবরা এখানে দল বেঁধে ঘুরতে এলেও আমার এখানে খুব একটা আসা হয় নি।আসা হলেও ছবি তোলা হয়ে উঠেনি।শুভ্র বেশ ভালোই ছবি তুলতে পারে।বিয়ে হয়ে গেছে।এখন মায়ের কথা মতো জামাইয়ের সাথে ঘুরবো আর পিক তুলবো।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here