একজোড়া পায়রা পর্ব -১৮

#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট১৮

দু দিন থেকেই চলে আসি ঢাকায়।শিশিরের সামনে পরীক্ষা শ্বাশুড়ি মা ননদিনীর সব পড়ার দায়িত্ব আমায় দিয়ে দিয়েছেন।শ্বশুর মশাইও নাকি ছটি নিয়ে আসছেন আমায় দেখতে।অনেকেই বলে শ্বশুর বাড়ি নাকি যমের বাড়ি। শ্বশুর শ্বাশুড়ি নাকি অনেক অত্যাচার করে।এগুলো শুনে আমি পণ করেছিলাম করলে বিয়ে মা-বাবা মরা ছেলেকেই বিয়ে করবো। কিন্তু আল্লাহ যা করেন তা তো ভালোর জন্যই করেন।হুটহাট এভাবে বিয়ে না হলে ওই দজ্জাল মহিলা আমার শ্বাশুড়ি হতো কতই না অত্যাচার করতো মহিলা আমার ওপর!কিন্তু শুভ্রের মা পুরোপুরি আলাদা।উনি নাকি আগে থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন যে শুভ্র আমায় পছন্দ করে।মায়ের মন তো, বলতেও হয় না।ঠিকই বুঝে ফেলে সন্তানের মনের কি অবস্থা।আমার শ্বাশুড়ি মা ছেলেকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলেন।কিন্তু কৈশোরে দাদার হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ তার।আমার দাদা শ্বশুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাংসদ ছিলেন।প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে হত্যা করেছে বলে ধারণা করা হয়।মামলা হয়েছিলো কিন্তু ওই বাংলাদেশের নড়বড়ে আইন!বিচার হয়নি।এতদিনে হয়তো মামলার কাগজপাতি উই পোকায় খেয়ে ফেলেছে।খুব নাকি ভালো মানুষ ছিলেন আমার দাদা শ্বশুর।বেশ জনপ্রিয়তা ছিলো তার।শুভ্রের দাদা মারা যাওয়ার পর প্রতিপক্ষের ভয়ে শুভ্ররা ঢাকায় চলে আসে।বছর পাঁচেক আগে আমার দাদি শ্বাশুড়ি মারা যান।আমার শ্বশুর মশাই একাই ছিলেন। কোনো ভাইবোন নেই তার।বাড়িতে জমিজমা গুলো লিজ দেওয়া।

ইদানীং শুভ্র খুব বিজি।হুটহাট করে বাহিরে চলে যান।আবার হুটহাট করে আসেন। ব্যপারটা আমার খুব বিরক্ত লাগে।কোনো কিছুই উনার নিয়মিত নয়।যখন যা মন চায় তাই ই করে বসেন।

শিশির আর আমি টেবিএ এক সাথে বসে পড়ছি।শাশুড়ী মা ঘুমে।এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ।এই অলস দুপুরে কে আসতে পারে?ওড়না?আমার ওড়না কই!ধ্যাত ভালোলাগে না।দরকারের সময় ওড়না নেই!বাধ্য হয়ে গামছা দিয়ে ঘোমটা দিয়ে যাই দরজা খুলতে।দরজা খুলে শুভ্রকে দেখতে পাই।আমায় এমন ভিখারিনীর বেশে দেখে সে ফিক করে হেসে দেয়।আমি ঝাড়ি মেরে বলি,,,

-হাসার কি আছে?
-এমনি হাসলাম।
-মনে হয় ক্ষেত থেকে উঠে এসেছেন।সোজা ওয়াশরুমে যাবেন।আমি জামা কাপড় রেখে আসছি ওয়াশরুমে।
-জানতে আমি আসবো এখন?
-উহু।তবে এটা জানতাম যে হুটহাট নোংরা হয়ে আসবেন।আর এসেই নোংরা শরীরটা নিয়ে বিছানায় ধপাস করে পড়বেন।
-টুরু লাপ।এই জন্যই তো আমি আমার জানপাখিকে এত ভালোবাসি।

আমার নাক টিপে বলে শুভ্র।আমি ভেংচি কেটে বলি,,,

-ঢং না করে পরিষ্কার হয়ে আসেন যান।

শুভ্র ওয়াশরুমে যান।আমি রান্না ঘরে পা বাড়াই তার খাবার গরম করার জন্য।উনি ওয়াশরুম থেকে এসে ডাইনিং টেবিলে বসেন।নিশ্চয়ই গামছাটা বিছানায় ফেলে রেখে এসেছে।মাথাটা যে ভালো করে মুছবে তাতেও ব্যাটার আলসেমি।রুমে গিয়ে দেখি আমার ধারণাই ঠিক।বেছে বেছে আমার বালিশের ওপরই রাখতে হলো তার ভেজা গামছাটা!আমায় দেখে শিশির বলে,,,

-আমি ভাইয়াকে না করেছিলাম ভাবী যাতে ভাইয়া বিছানায় গামছা না রাখে।ভাইয়া আমার কথা শোনে নি।উলটো মেরেছে আমায়।
-আপনামে কেউ কিছু জিজ্ঞাস করে নাই মেডাম।আপনি পড়ুন।

শিশিরের কথার উত্তর দিই আমি।শিশির পড়ায় মন দেয়।আমি গামছাটা নিয়ে গিয়ে উনার মাথা মুছে দিই,,,

-মাথাটাও মুছতে পারেন না ঠিকমতো
-তুমি আছো কি জন্য,?
-অহ আচ্ছা, সব কাজ আমিই করবো?
-জ্বী মেডাম।

মাথামোছা হয়ে গেলে আমি গামছাটা রোদে মেলে দিই।উনি দেখি তখনও প্লেট সামনে নিয়ে বসে আছেন।

-এখনো খান নি?
-বাবু খাইছো?
-সেটা আপনার না জানলেও চলবে।খান।

কথাটা বলে আমি উনার প্লেটে ভাত বেড়ে দিই।উনি না খেয়ে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছেন।

-কি হলো খান!
-তুমি খাইছো বাবু?
-হুম খাইছি।
-কত আনরোমান্টিক তুমি। সিনামায় দেখো না জামাইয়ের জন্য বউ ওয়েট করে আর তুমি…
-সিনামায় দেখেন না জামাই টাইমের খাওয়া টাইমে খায়?আর আপনি…..

আমার ঝাড়ি খেয়ে সাহেব ভাত খেতে লাগেন।আমি উনার পাশে বসে উনার খাওয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগি।উনি আমার দিকে এক লোকমা এগিয়ে দিয়ে বলেন,,,

-খাও।
-নাহ আপনি খান!
-বিয়ের আগে কোনো ঢং করিনি।এখন ঢং করবো।তুমিও আমার সাথে করবে।হালাল ঢং।নাও এখন খাও।

আমি হেসে দিই।হালাল ঢং।আমার হাসি দেখে উনি বলেন,,,

-আগে খাও।

আমি খাবার মুখে নিয়ে খেতে লাগি।উনি খেতে খেতে বলেন,,,

-স্ত্রীকে খাইয়ে দেওয়া সুন্নত।
-তোমরা পারোও।

শিশিরের কথায় আমরা পিছন ঘুরে তাকাই।দেখি সে দরজায় হেলান দিয়ে আমাদের কথাবার্তা মুখ টিপে শুনছে।শুভ্র গিয়ে শিশিরের কান মুলে ধরে।

-ভাবী গো বাঁচাও।
-কিসের ভাবী বাঁচাও।তুই আমাদের কথা শুনবি চোরের মতো করে আর আমি তা মেনে নেবো?

শিশিরের কথা জবাব দেয় শুভ্র।আমি গিয়ে শুভ্রর হাত থেকে শিশিরকে বাঁচাই।মেয়ে আমার পেছন লুকিয়ে শুভ্রকে ভেংচি কাটে।শুভ্র তেড়ে যায় শিশিরকে মারতে।এবার আমিও শাশুড়ীমার ডায়লগ দিই,,,

-বিয়ে করে বউ এনেছিস দুইদিন পরে বাচ্চার বাপ হবি আর এখনো বাদ্রামি করিস!
-আম্মুরে কপি করছো মেঘ।
-করলে করলাম।শ্বাশুড়ি মা কেই তো কপি করেছি।যান রেস্ট নিন।

শুভ্র আর কিছু বলেন না।শিশিরকে নিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে ঘরে যান তিনি।আমি সব গুছিয়ে রুমে যাই।গিয়ে দেখি শুভ্র একরকম শিশিরের ঘাড়ের ওপর বসেই ওকে পড়াচ্ছে।লেখার এদিক ওদিক হলেই ঠাস ঠাস দিচ্ছে।আমায় দেখে শিশির বলে ওঠে,,,

-ভাবী ভাইয়া মারছে।

শিশিরের কথা শুনে শুভ্র ভেংচি কেটে বলে,,

-ভাবী ভাইয়া মারছে।সারাদিন এত ভাবী ভাবী করিস কেন?কখনো তো ভাইয়া ভাইয়া কর‍তে দেখি না।
-তুমিই তো বলতে ম্যামকে ভাবী ডাকতে।
-আবার ম্যাম!দেবো এক…
-উফফ থামো তোমরা।শিশির অনেক পড়ছো তুমি।যাও এখন টিভি দেখো গিয়ে।ব্রেণেরও রেস্ট দরকার।এক টানা পড়লে পড়ায় মন বসবে না আর যা পড়েছো তাও ভুলে যাবে।

আমার কথা শুনে শিশির চলে যায়।আমি বই পত্র গুছিয়ে চুল বাঁধতে ড্রেসিন টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াই।শুকিয়ে গেছে চুল।তাই হাল্কা করে একটা বেণি করে নিই।আমি আবার সব সময় চুল খোলা রাখতে পারি না।গার্ডারটা গিট্টু দিতে গিয়ে খেয়াল করি উনি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন।আর মুচকী মুচকী হাসছেন।

-তোমায় না আজকে অনেক সুন্দর লাগছে মেঘ।
-কুৎসিত হলাম কবে আমি?
-একটা কথা বলবো?
-হুম বলেন।
-একটা হালাল চুমু দিই?
-হালাল চুমু মানে?
-বিয়ের পর সব হালাল না?তাই আর কি….

উনার এইধরনের কথা শুনে আমার বরাবরের মতো এইবারও হাসি পেলো খুব।আমি কপাল এগিয়ে দিয়ে বলি,,,

-দেন দেন কপালে একটা চুমু দেন।

আমি কপালে তার ভালোবাসার পরশ পাবার জন্য চোখ বন্ধ করে কপাল এগিয়ে দিই।ওমনেই উনি আমার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেন।আমি ভেবাচেকা খেয়ে যাই।চোখ দুটো অক্ষিকোটর থেকে বের হয়ে যাওয়ার অবস্থা!মিনিট দুয়েক পর উনি আমায় ছাড়েন।ছেড়ে দিয়েই কেমন ঢং করে লজ্জায় হাত দিতে মুখ খানা ডাকেন।আমি তো লজ্জায় আর ঘটনার আকষ্মিকতায় পুরোই স্তব্ধ।

-লজ্জা লজ্জা!

শুভ্রের কথায় আমার ধ্যান ভাঙে।এই লোকটা এত ঢং করে কেন বুঝি না।ঢং মেয়েরা করবে। ছেলেরা কেন ঢং করবে?ঢং জিনিসটা ছেলেদের জন্য বড্ড বেমানান।কেমন একটা হ্যালালেলা লাগে ছেলেদের ঢং করতে দেখে।মন বলে গিয়ে মারি বিড়ালের মতো এক থাব্রা।সোফা থেকে একটা কুশান উনার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলি,,,

-হুদাই মেয়েদের মতো ঢং করবে!

লজ্জায় আমি ড্রয়িংরুমে শিশিরের কাছে চলে যায়।গিয়ে ওর সাথে কার্টুন দেখতে বসে পড়ি।কিছুক্ষণ বাদে দেখি শুভ্রও এসে গেছেন।এই ব্যাটা এমন বিড়ালের মতো পিছু পিছু ঘোরে কেন?

-বাংলাদেশের খেলা হচ্ছে।

কথাটা বলেই ঠাস করে রিমোট নিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে দেন শুভ্র।ঘোড়ার ডিমের ক্রিকেট খেলা।বুঝি তো না ই। আর এখন পর্যন্ত দেখলাম না বাংলাদেশকে কাপ আনতে।লেগে যায় ঝগড়া।আমি শিশির এক টিম আর শুভ্র একাই এক টিম।বাংলাদেশে হয়তো এমন কোনো ঘর নেই যেখানে এই খেলা দেখা নিয়ে ঝগড়া হয় না।আগে ভাইয়া বাবা খেলা দেখতো আর মা দাদি রাগারাগি করতো এই নিয়ে।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ
থাকার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here