একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-০৫
রোকসানা আক্তার
———উফস,সেই ভয় পেয়েছি!
সোফার উপর বসতে বসতে বলল অশ্রু।রুমকি মাথার হেলমেটটা ড্রেসিং টেবিলের উপর এক ঝাটকায় রেখেই পেছন ঘুরে আলবোলা হয়ে বলে,
———আমিতো আরো!বুকের স্পন্দনের গতি দ্বিগুণ মাএায় বেড়ে গিয়েছিল যেন রাস্তায়ই দম যায় যায় আমার এরকম অবস্থা!
———হুমম। আল্লাহ আমাদের এতটা বিপজ্জনক পথ থেকে রক্ষা করেছেন তারজন্যে হাজারো শুকরিয়া!
বলেই অশ্রু জানলার পর্দা বরাবর দৃষ্টি এঁটে।পর্দার দিকে তাকানোর পরই অশ্রুর ছলাৎছলাৎ মুখখানা কী ভেবে যেন মুহূর্তে বিষন্নতায় রূপ নেয়।রুমকি তা খেয়াল করে টপকে অশ্রুর গাঁ ঘেঁষে বসে।দু’কাঁধে হাত রেখে বলে,
———কি হয়েছে রে অশু?হঠাৎ মুখটা তোর এত বিষন্ন বিষন্ন লাগছে!
অশ্রু কাঁধ থেকে রুমকির হাত সরিয়ে সোফা থেকে দাড়ায়।ভার মুখে বলে,
———তেমন কিছু নয়।ভয় হচ্ছে ভীষণ।
———কীসের ভয়?
———ওই অরুন যদি আমার মা-বাবা-বোনের কোনো ক্ষতি করে …..
———উহহ,তুই ফাও টেনশন নিচ্ছিস!সেরকম কিছুই হবে না!এখন ওর কুকর্মের রেকর্ডগুলো ফাঁস করে দিলেই দেখবি ব্যাটার মুখ কই লুকায়!
অশ্রু নিজের মনের উপর জোর চেপে আবার চঞ্চলকর হয়ে রুমকির দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
———রুমকি আমরা যেমনটি ভাবি তেমনটি নাও হতে পারে।অনেক সময়তো দেখিস হিতে বিপরীত হয়।
———তাহলে তুই বলতে চাচ্ছিস রেকর্ডগুলো ভাইরাল করবো না,এটাই ত?
———তাও না!আমার কেন জানি ভয় ভয় লাগছে।তুই যদি আজ না থাকতি তাহলে ও আজ আমায়….
বলেই কেঁদে দেয় অশ্রু।
রুমকি তা দেখে অশ্রুর কাছে আসে।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
———হয়তো ও তোর সাথে খারাপ কিছু করতে চেয়েছিল যেটা তুই ভাবতেও পারিস নি।সেকারণে তোর এখন এরকমটা লাগছে। তবে, এখন এরকম মনে হবেই ,পরে এর ঘোর কেটে গেলে আবার ঠিক হয়ে যাবি।
বলেই রুমকি অশ্রুর চোখের পানি মুছে দেয়।
অশ্রু এবার স্বাভাবিক হয়ে বলে,
——— তোর সিম অফ করছিস ত রুমকি?
———এখন জিজ্ঞেস করছিস?হা হা হা হা। সেটাতো সেই অনেক আগেই অফ করে ফেলেছি।আচ্ছা,আর কথা না বাড়িয়ে এবার চল দু’জনে একটু খাওয়াদাওয়া করে নিই।এমনিতে পেটটা খালি। পেটটাকে শান্ত করে তারপর আমরা রেকর্ডগুলো নিয়ে বসবো।
———আন্টি ঘুমাচ্ছে?
———হুম মা ঘুমচ্ছে বোধহয়।আচ্ছা চল এবার।
বলেই রুমকি অশ্রুর হাত টেনে ডাইনিংএ নিয়ে যায়।রুমকির বাসার কাজের মহিলা খাবার গরম করে টেবিলে নিয়ে আসে।রুমকি ভাঁজপ্লেট থেকে দুটা প্লেট নামিয়ে নেয়।একটা নিজের জন্যে এবং একটা অশ্রুর জন্যে।দু’প্লেটে ভাত বেড়ে নেয়।ভাত বাড়া শেষ হলে তরকারির ঢাকনা উঠিয়ে অশ্রুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
———তরকারি কোনটা খাবি চিকেন নাকি ইলিশের কোরমা?
———তোর ইচ্ছে।
———দুটোই দি।
———আরেহ না।একসাথে আমি এত খেতে পারি না!
———তাহলে দুজনে ইলিশের কোরমাটা খাই।ইলিশের কোরমা ত তোর হেব্বি ফেভারেট,না?
অশ্রু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।।।
———ওকে এবার তাড়াতাড়ি খাবার শেষ কর।
বলেই রুমকি খাওয়া শুরু করে দেয়।
অশ্রু ধীরশান্তে মুখে দু’নালা তুলার পর পরেই অন্য চিন্তায় মগ্নতা হয়ে পড়ে।অন্যমগ্নতায় ভাতের দানা কচলাতে থাকে। মুখে ভাতের নালা তুলে না।রুমকি মাথা নুইয়ে খেতে খেতে বলে,
———তরকারিটা কেমন হয়েছে রে অশ্রু?
অশ্রু রুমকির কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে প্লেটের হাত রেখেই অন্যদিক তাকিয়ে আছে।অশ্রুর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রুমকি মাথাতুলে তাকায় আর বলে,
———আবার কি হলো তোর?
অশ্রুর টনক নড়ে উঠে।অপ্রস্তুত হয়ে বলে,
———নাহ নাহ কিছু না।এইত খাচ্ছি।
তা দেখে রুমকিদের বাসার কাজের মহিলাটি ভ্রু কুঁচকে আনে।পিঞ্চ করে বলে,
———অশ্রু আপা মনে হইতাছে অনেক চিন্তা করতাছে।
রুমকি কাজের মহিলার কথায় থতমত খেয়ে বসে। হালচোখা হয়ে বলে,
———তেমন কিছু নয়।
———তাইলে?
ইসস এই কাজের লোকগুলোও না একটা কারণ পেলেই প্যাঁচিয়ে ধরে।রুমকি এই প্রসঙ্গকে চাপা দিতে অন্য প্রসঙ্গ টেনে বলে,
———মা খেয়েছে?
———হু,খালাম্মা ত হেই কহন খাইসে।আপনেগো লাইগা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও আপনাগো আওনের হদিস পায় নাই।তয় মেলা থাইকা কি কি কিনলেন?
———এত কথা না বাড়িয়ে যাওতো এখন এখান থেকে।খালি প্যাঁচাল পাড়ে।
রুমকির কথায় কাজের মহিলা মুখটা গোমড়া করে চলে যায়।
আজ রুমকিও প্ল্যানিং এর কথা চাপা রেখে তার মাকে মিথ্যে বাহানা দেয়।সে অশ্রুকে সঙ্গে নিয়ে আজ চুড়ি মেলায় যাবে,আসতে নাকি অনেক দেরী হবে।তাছাড়া দেরী হয়ে গেলে অশ্রুকে সঙ্গে করে নিয়েই বাসায় ফিরবে,একা আর আসবে না।প্ল্যানিং মতো তাই করে এবং অরুনের বাসা থেকে সোজা অশ্রুকে নিজের বাসায় নিয়ে আসে।আর অশ্রুও রুমকির ব্রার্থডের বাহানা করে প্ল্যানিং আরো মজবুত হয়।।
দুজনের খাওয়া শেষ করে।অশ্রু সবটা আর খেতে পারেনি।কিছুটা এঁটে রেখে বেসিনে হাত ধুঁয়ে নেয়।তারপর দুজনে রুমে আসে।অশ্রু গিয়ে বিছানার উপর বসে। আর রুমকি দরজা বন্ধ করে টি-টেবিলের উপর থেকে ল্যাপটপটা হাতে নেয় এবং বিছানার উপর পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। রুমকি তার ফোন থেকে রেকর্ড দুটো ল্যাপটপে নেয় এবং এডিটিং কাজ চালাতে থাকে।
এডিটিং প্রায়ই শেষ হয়ে আসলে রুমকির ফোন বেজে উঠে।রুমকি উদাস মনে মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকায়।একটা আননউন নাম্বার থেকে কল!রুমকি তা দেখে হতভম্ব! এতরাতে কল, তাও আনউন নাম্বার!অশ্রু পাশ থেকে কাঁপা কন্ঠে বলে,
———ক-কে কল করেছে?
———জানি না অশ্রু!একটা আননউন নাম্বারহ!
———র-র-রিসিভ করে দেখ কে হতে পারে!
রুমকি চোখবুঁজে আস্তে আস্তে রিসিভিং-এ টাস করে।আলতো কানের কাছে ফোনটা গুঁজে বলে,
———হ্যা-হ্যা-হ্যালো কে?
ওপাশ থেকে খিলখিল প্রতিধ্বনির আওয়াজ শুনতে পায়! আর কড়াকড়া গলায় বলে উঠে,
———ভাবতো কে হতে পারি?
কন্ঠটি খুব সুস্পষ্ট হতেই অশ্রু আৎকে উঠে।কন্ঠটি রুমকিরও বুঝতে অসুবিধা হয়নি।রুমকি অশ্রুর কাঁধে হাত রেখে কুল হতে বলে।তারপর রুমকি নিজের টাল সামলে বলে উঠে,
———ফটকাবাজ,তাই না?
———ফটকার এখনো কিছু দেখিস নি।তবে দেখবি!তোরা এখন যেখানে আছিস,নাউ এড্রেসটা পুঙ্খানুপুঙ্খ আমার মুখস্ত! চাইলে এখনই এসে তোদের দুজনের মাথার খুলি উড়িয়ে দিতে পারি।নিজেদের খুব চালাক ভাবিস না?চালাক কত প্রকার ও কি কি তা আমি দেখিয়ে দিব!!অপেক্ষা কর শুধু।আর হ্যাঁ ভদ্রতার সহিত আবারো বলছি যদি নিজেদের ভালো চাস তাহলে এখনই রেকর্ডটা ডিলিট করে দে।যদি না করিস তাহলে তোদের আমি কি করি তা স্বপ্নেও ভাবতে পারবি না।এইটা আমার থার্ডবার ওয়ার্নিং।আর ফোর্থবারের সময় মিস্টার অরুন জয়ের ভূমিকম্প। কিপ মাইন্ড ইউর মেমোরি।
রাখলাম।সি এ নাইস ড্রিম!
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলেই অরুন কলটা কেটে দেয়।অশ্রু ভয়ে কাঁপতে থাকে।তবে রুমকির মাঝে তেমনটি দেখা যাচ্ছে না।সে এখনও স্বাভাবিক!রুমকি ফোনটা সাইডে রেখে আবার ল্যাপটপে হাত লাগায়!তা দেখে অশ্রু বাঁধা দেয়।
———সত্যিই ভাইরাল করবি?
রুমকি হতভম্ব অশ্রুর চোখের দিকে তাকায়। উদাস মনে বলে,
———মানে?
———রুমকি, ও তোর পার্সোনাল নাম্বার পেয়ে গেছে এবং আমাদের বর্তমান ঠিকানাও জানে।এখনতো আমরা আরো বিপদের মধ্যে আছি।যদি এখনই…
রুমকি অশ্রুর মুখের কথা টেনে নিজেই বলে উঠে,
———যদি এখনই ভাইরাল করি তাহলে ও এখানে এসে আমাদের মেরে ফেলবে,তাই না?হোয়াট ডু ইউ মিন অশ্রু?তুই কি বোকা?ওদের ত লোকের অভাব নেই সো নাম্বার পাওয়াটাও ওদের কাছে অসম্ভবের কিছু নয়।
অশ্রু মাথানিচু করে ফেলে।সে কেনজানি নিজের মনকে মানাতে পারছে না।ভেতর থেকে কোনো একশক্তি তাকে বারবার বাঁধা দিচ্ছে—না অশ্রু এমনটি করিস না। করিস না। অশ্রুর চুপ থাকা দেখে রুমকি অশ্রুর পিঠে হাত বুলায়।বলে,
———প্লিজজ কুল ডাউন,কুল ডাউন অশ্রু।জানি তুই এখন ভয়ে আছিস!কিন্তু জানিস ভয় পেলে কখনো জয় করা যায় না। ও এখন আমাদের হুমকি দিচ্ছে ওর সম্মানের কথা ভেবে।জানিস তো, দেশের মানুষ ওদের সাপোর্টার ।যদি একবার দেশের মানুষ ওদের কুকীর্তির কথা জানতে পারে তখন মুখে জুতো ছুড়ে মারবে। আর ঘৃণিত হিসেবে ঠাই পাবে প্রতিটি মানুষের অন্তরে।তাহলে আমরা ওই ঘৃণিত মানুষগুলোকে কেন নয়নের মণি কোঠায় জায়গা দিব?ওরা যোগ্য?তাহলে অযোগ্যকে কেন দিব,বল?কেন সাধারণ পাবলিক ওদের আরাধনা করে আসবে?কেন?কেন?মনে রাখিস অযোগ্যের জায়গায় অযোগ্যতেই হয়। কখনো যোগ্যতাতে হয়না।
মনে সাহস রাখ অশ্রু। দেখবি যা হবে সব ভালো হবে।শান্তমনে একটু ভেবে দেখ!
অশ্রু রুমকির দিকে ফকফক চোখে তাকিয়ে থাকে।মনে মনে কিছু একটা ভেবে বলে,
———এখন রেকর্ড ভাইরাল করবি।এটাইতো?
———তোর সম্মতির অপেক্ষায়!
অশ্রু চোখবুঁজে দম নেয়।আর মনে মনে সাহস জোগানোর প্রস্তুতি নেয়।মনকে ভাবায়—সাহসী হও,সাহসী হলে শএুর প্রতিঘাত করতে পারবে।ভয় পেও না, ভয় পেলে হেরে যাবে।মনে রেখ পৃথিবীটা সত্যের পূজারী।তাই মিথ্যেকে কখনো প্রশয় দেওয়ার মানে হয়না।সত্য প্রতিষ্ঠা কর,অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখতে শিখ।দেখবে দেশ,সমাজ তোমাকে নমস্কার করবে।
ভাবতে ভাবতে অশ্রু চোখের পাতা হালকা ফাঁক করে।আর রুমকির হাত চেপে সম্মতি দেয়।সাথে সাথে রুমকি ফেইসবুক, ইউটিউব,টুইটার সামাজিক যোগাযোগের সবগুলো সাইডে ছড়িয়ে দেয় অডিও রেকর্ডটি।
ইউজারদের কাছে একে একে ছুটে যায় এই অডিও রেকর্ডটি।হাজারো angry,sad,haha এর রিয়েক্ট ভেসে চলে সামাজিক সাইডে।আর কমেন্টে বেয়াদব,কুত্তা,জারজ ইত্যাদি বুলি একের পর এক আসতে থাকে।
তাহলেএকটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-০৬
রোকসানা আক্তার
———রুমকি,এখান থেকে আমাদের অন্য জায়গায় চলে যাওয়াটা বেশি ব্যাটার হতো না?
চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল অশ্রু।
———তুই ভয় পাচ্ছিস?
———সেরকম কিছু না।অরুনতো আমাদের এ এড্রেসটা জানে তাই আপাতত বাসাটা আমাদের জন্যে নিরাপদ না।
রুমকি অশ্রুর কথায় হেসে উঠে।টি-টেবিলের উপর চায়ের কাপটা রেখে হাত দিয়ে মুখ মুছে নেয়।তারপর হাসি থামিয়ে বলে,
———তুই বেকার টেনশন নিচ্ছিস।আরে বাবা,এখন ওর বাসায় গিয়ে দ্যাখ ব্যাটা বিড়ালের মতো লেজ গুঁটে বসে আছে।সামাজিক সাইডে যে দোলাই খাচ্ছে তাতেই মনে হয় দুপুরের লাঞ্চ আর করা লাগবে না।হা হা হা হা। তবে যাইহোক,এখন এতকিছু আর ভাবিস না।মনে সাহস রাখ।জাস্ট এনাফ।
———রেকর্ডটা তো সব সাইটে ফেইক আইডি দিয়ে পাবলিসড করেছিস,না?
———হু।
কথা শেষ করে তারপর দুজনে আবার চা খাওয়ায় মন দেয়।
পাশের রুমে বসে বসে রুমকির মা টিভি দেখছেন।তিনি কিছু একটা দেখে রুমকিকে ডেকে উঠেন।
———জ্বী,মা আসছি।
উঠেই রুমকি অশ্রুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
———তুই থাক অশ্রু।আমি একটুপর আসছি।
———আচ্ছা।
রুমকি রুম থেকে বের হয়ে তার মায়ের কাছে আসে।বলে,
———মা কেন ডাকলে?
———রুমকি দেখতো,এই ছেলেটা ভুট্টো পোদ্দারের ছোট ছেলেটা না?
রুমকি তার মায়ের দিকে তাকিয়ে অমনোযোগে উওর করে,
———কোন ভুট্টো পোদ্দার?
———আরেহ আমার দিকে না টিভির দিকে তাঁকা।
রুমকি তার মায়ের কথায় টিভির দিকে তাকাতেই চোখদুটো ঝলসে উঠে।আরে এ’তো অরুন।মাছরাঙা টিভিতে এখন লাইভে কথা বলছে!রুমকি টাল সামলে তার মাকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
———ক-ক-কি হ-হয়েছে মা?
———আরেহ কাল রাত নাকি সামাজিক সাইডে একে নিয়ে মিথ্যে রেকর্ড ফাঁস হয়েছে এখন এটা নিয়ে বাঁধাবাঁধি ঝামেলা।
রুমকি তার মায়ের কথায় কেঁপে কেঁপে ঢোক গিলে আর চোখদুটো বড় করে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে অশ্রুকে ডেকে উঠে।অশ্রু রুমকির উৎকন্ঠার ধবনি শুনে তড়িঘড়ি বাইরে আসে।এসেই বলে,
———কি হয়েছে রুমকি?
রুমকি শব্দ বিহীন হাত উঁচিয়ে অশ্রুকে টিভির দিকে ইঙ্গিত করে।অশ্রু রুমকিকে অনুসরণ করে টিভির স্ক্রিনে থাকাতেই বুকটা তার ধুকপুক আওয়াজ করে উঠে।শরীরের রক্ত হীম হয়ে আসে।শরীরের লোমগুলো কাঁটা দিয়ে দাড়িয়ে যায়।আর থম মেরে হতবাক চাহনিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।রুমকি পা হালকা পেছনে হটে অশ্রুর গাঁ ঘেঁষে দাড়ায় এবং অশ্রুর বাম হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে।
—–””জ্বী,মিস্টার অরুণ, গতকাল রাত আপনাকে নিয়ে সামাজিক সাইডগুলোতে একটা অডিও রেকর্ড ভাইরাল হয়েছে সে ব্যাপারে অবশ্য আপনি জানেন। তো এ ব্যাপারে আপনি কী বলতে চান?আর দর্শক/ইউজার বলেন তাদের ব্যাপারে আপনার কি বলার আছে?আসলে বিষয়টা নিয়ে আমরা দর্শক যারা আছি তা নিয়ে খুবই শোচনীয় অবস্থায় আছি।””
অরুন উপস্থাপকের কথায় মেকি হাসি দেয়।অনেকটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
—–””এখন আমি কি উওর করবো নিজেই বুঝতেছি না।আসলে ব্যাপারটা হলো কাল রাত আমি যখন ডিনারটা সেরে ফেইসবুক লগ ইন করি তখন আমার পেইজের পোস্টে নানান জন নানান মন্তব্য করতে থাকে।সাডেন সবার এধরনের মন্তব্য সত্যিই চোখ দুটো যেন থেকেও নেই।কি বলছে লোকজন এসব?অথবা আমিই বা কি করেছি!
বিষয়টা নিয়ে আমি হ্যাজিটেশনে পড়ে যাই।পরে,খোঁজ নিয়ে দেখি অনেকগুলো ফেইক সাইড থেকে আমাকে নিয়ে ভ্রান্তিমূলক অডিও রেকর্ড ফাঁস করেছে।মাই গড! তখনতো আমার কোমায় যাওয়া অবস্থা!
সো এখন আমি দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলছি—আপনারা কোনোকিছু ভালোভাবে না বুঝে না শুনে প্লিজজ কাউকে নিয়ে বাঁজে মন্তব্য করবেন না।ভয়েস আমার মতো শুনালেই যে এটা আমি হয়ে যাবো এমন নয়!আর একটা ভয়েসই যে ওই অপরাধী প্রমাণিত হয় এমন না।প্রায়ই সময়তো ইউটিউব, ফেইসবুকে ভুলবাল নিউজ পেয়ে থাকে তখন সেগুলোও কি সত্যি হয়ে যায়?না।আসলে এখানে আপনাদেরও দোষ দিয়ে লাভ নেই।দোষ হলো কিছু ইউজারদের যারা ইন্টারনেটের অপব্যবহার করছে!
তাই আইটির কাছে আমার কাইন্ডলি রিকুয়েষ্ট যারা ভুলভ্রান্তি মূলক ধারণা সামাজিক সাইটগুলোতে ছড়াচ্ছে তাদের উপর কঠোর নজরদারী করুন।এতে মানুষও বিভ্রান্ত থেকে মুক্ত পাবে এবং দেশটাও ফেইক থেকে বাঁচবে।”
উপস্থাপক হাসি দিয়ে বলেন,
———””মিস্টার অরুণ অনেক রেগে আছেন বোধহয়!””
————”তো কি!পাগল বানিয়ে দিয়েছে কালরাত থেকে সবাই আমাকে!”
———যারা এরকম করেছে তাদের নিয়ে আপনার কি মতামত?
———কিছুই না। তারা শুধু শুধলে যাক এটাই।
———আচ্ছা,আচ্ছা!
“”””
রুমকি স্ক্রিনে দৃষ্টি রেখেই বিড়বিড়িয়ে বলে,
———ব্যাটা আবার আমাদের বাঁচিয়ে দিচ্ছে!
অশ্রু কোনো উওর না তুলে রুমকির হাত টেনে রুমের দিকে নিয়ে আসে।
———এখানে এনেছিস কেন?উপস্থাপনা সম্পূর্ণটা দেখাতো শেষ করি?
———রুমকি,এখানে আমাদের জন্যে একমুহূর্তেও সেইভ না!আমাদের অন্য কোথাও যেতে হবে।ওই অরুন আইনের সহায়তা কেন নিতে চায়নি,জানিস?
———কেন?
———ও নিজেই আমাদের শায়েস্তা করবে সেই ভেবে।আমি তোকে প্রথমেই বুঝাতে চেয়েছি আইন ওদের এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে না।আমার বাবাও অনেক সময় সত্যকে সত্য বলে প্রতীয়মান করতে পারে নি।অনেক গুলো মিথ্যে রিপোর্ট লিখতে হয়েছে।
কারণ তখন টাকা দিয়ে মিথ্যেকে কেনা হয়েছে আর মিথ্যেই সত্য হয়েছে।তবে আমরা এখন ভয়ে মিথ্যকে মেনে নিব এমন না।কারণ,একটা অডিও রেকর্ডে আমাদের সত্য কিছুতেই প্রমাণিত হবে না।
———তাহলে এখন কি করবো?
———এখন ওসব চিন্তা বাদ।এখন আমাদের শুধু আত্মসম্মান বাঁচাতে হবে।ওই জানোয়ার আমাদের….
বলেই অশ্রু মাথা নিচু করে টপটপ চোখের পানি ফেলে।
রুমকি অশ্রুর কাঁধে হাত রেখে বলে,
———আচ্ছা আমরা এখনই বের হব।টেনশন নিস না অশ্রু।তবে মাকে কি বলবো?
অশ্রু মাথা উঠিয়ে তড়িঘড়ি চোখের পানি মুছে।বলে,
———বলিস এখন আমরা লমিজাদের বাসায় যাবো ওকে দেখতে।ওর টাইফয়েড সেকারণে। একটা রিজন দেখালেই হবে।
———ওকে।
তারপর দুজনে মাথায় হেলমেট পড়ে ব্যাম্বু বাইকে বসে।আর অজানা গন্তব্যে রওনা করে।তারা জানে না এখন তারা কোথায় যাবে,কোথায় থাকবে।শুধু এটুকুই মাথায় এখন যে করেই হোক ওই জানোয়ারের থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হবে!!
রুমকির বাইকের গতি খুব দ্রুত।তড়িৎ বেগে ছোট ছোট গাছ,বড় বড় দালানকে পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে।রুমকির থুতনির নিচে হালকা চুলকে উঠে।সে চুলকানোর টাল সামলাতে না পেরে বাম হাত ব্রেক থেকে সরিয়ে থুতনির দিকে নিয়ে আসতেই হুট করে বাইকটা একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খায়।গাড়ির সাথে ধাক্কা খাওয়ায় অশ্রু নিচে পড়ে যায়।রুমকি তড়িঘড়ি ব্রেকটা কষে রাখার কারণে সে বেঁচে যায়।অশ্রু প্রচন্ড ব্যথা পেয়ে আর্ত্মনাদ করে উঠে।।রুমকি বাইক থামিয়ে তড়িঘড়ি অশ্রুকে গিয়ে ধরে।অশ্রুর পা,হাত কিছুটা অংশ থেতলে যায় এবং পেঁটে অনেক ব্যথা পায়।আল্লাহ নাহ করুক তেমন মারাত্মক এক্সিডেন্ট হয়নি।
যে গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগে ওই গাড়ির লোকটি গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।আর অপরাধী কন্ঠে বলে,
———আই’ম স্যরি।আমি বুঝতে পারি নি ধাক্কা যে লেগে যাবে।
রুমকি ভদ্র লোকটির দিকে টানা চোখে তাকায়।লোকটির পড়নে স্কিন জিন্স,গাঁয়ে হাতা ফোল্ড করা টি-শার্ট,হাতে ঘড়ি, চোখে ডায়মন্ড গ্লাস এটা হলো গেট-আপ।আর সৌন্দর্য্যের কথা বললে “সুন্দর” একটা শব্দেই এনাফ।বলতে গেলে সবদিক দিয়ে মাশাল্লাহ।
ভদ্রলোকটি কথার প্রসঙ্গ টেনে আবার বলে,
———আচ্ছা উনাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সবচেয়ে ভালো হতো আই থিংক!
রুমকির এবার নড়েচড়ে উঠে।আর হায়তায় করে বলে,
———হ্যাঁ হ্যাঁ।
বলেই রুমকি অশ্রুকে উঠানোর চেষ্টা করে।অশ্রুর পা-পেঁটে প্রচন্ড ব্যথার কারণে রুমকিকে ধরে দাড়াতে কষ্ট হয়ে যায়।তা দেখে ভদ্র লোকটি রুমকিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
———আপনার যদি প্রবলেম না হয় তাহলে আমিও আপনাকে হ্যাল্প করতে পারি?
রুমকি দু”পাশে মাথা নাড়ে।ভদ্র লোকটি সম্মতি পেয়ে ওপাশ হয়ে অশ্রুকে ধরাধরি করে গাড়ির দিকে নিয়ে যায়।রুমকি চটকে বলে,
———আমারতো বাইক আছে!
———বাইকে করে নিয়ে গেলে উনার যেতে কষ্ট হবে।তাছাড়া উনি পড়েও যেতে পারেন।
———নাহহ তা বলছি না।আমি বলতে চাচ্ছি অশ্রু গাড়ি করে আপনার সাথে যাক,আর আমি আমার বাইক নিয়ে পেছন পেছন আসতেছি।কারণ বাইকটাতো আর মাঝরাস্তায় ফেলে রাখা সম্ভব না।
———হুমম,সেটাই।আচ্ছা ঠিক আছে।আমি তাহলে গাড়িতে উঠছি।
ভদ্র লোকটি অশ্রুকে আলতো ধরে গাড়িতে বসায়।আর নিজে গাড়ির সিটে বসে গাড়ি রান করে।রুমকিও গাড়ির পেছন পেছন আসতে থাকে।অতঃপর অশ্রুকে হাসপাতালে নিয়ে আসে।
তারপর নার্স অশ্রুর হাত-পাঁয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়।।আর ডাক্তার কিছু ওষুধের প্রেসক্রিপশন লিখে দেন।ভদ্র লোকটি প্রেসক্রিপশন নিয়ে তড়িঘড়ি ফার্মেসি থেকে ওষুধগুলো নিয়ে আসেন।তা দেখে রুমকি চমকে বলে,
———এর কী প্রয়োজন ছিল,বলুন?আমিই নিজে গিয়েইতো নিয়ে আসতে পারতাম।
ভদ্র লোকটি হাসতে হাসতে বলে,
———নো প্রবলেম।মানুষ হয়ে মানুষের জন্যে একটু আধটু করতেই পারে।
———তাই বলে….!
———আচ্ছা বাদ দিন।
ভদ্র লোকটি অশ্রুর দিকে তাকিয়ে প্রসঙ্গ টেনে আবার বলে,
———এখন কেমন অনুভূত হচ্ছে?
অশ্রু মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।মানে এখন মোটামুটি ভালো।
রুমকি ফিসফিস করে অশ্রুকে বলে উঠে,
———দেখ লোকটা কত্ত কিউট!আমিতো সেই ক্রাশ খাইছি!
অশ্রু মুঁচকি হাসে।হাসি দেখে লোকটি অপ্রস্তুতের মধ্যে পড়ে যায়।হম্বিতম্বি হয়ে বলে,
———আমার ব্যাপারে কিছু বলা হচ্ছে?
———নাহ,নাহ।আচ্ছা আমাদের সাথে এতদূর আসলেন অথচ আপনার নামটাই জানা হলো না!(রুমকি)
———জ্বী,আমার নাম ইমতিয়াজ পোদ্দার।আপনাদের?
———জ্বী,আমার নাম রুমকি।আর ওর নাম অশ্রু।
———ওহ। বাসা কোথায় আপনাদের?
———আমার ধানমন্ডি, ওর মিরপুর।।আপনার?
ভদ্র লোক মৃদু হাসি দেয়। হাসিমুখে বলে,
———আমার যেখানে কাঁত,সেখানে রাত।আই মিন কখনো বাংলাদেশে,কখনো বিদেশ।এইযে কাউকে আজ না জানিয়ে আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে ল্যান্ডিং করলাম অথচ প্রথমই আপনাদের সাথে গন্ডগোল পাঁকালাম।
———এসব বলবোন না।সবকিছু মানুষ ইচ্ছে করে না।তাছাড়া দোষ আমারও ছিল।ব্রেকটা ভালোভাবে কষতে পারিনি।
——— দোষ কারো না।হ্যাপী?
ইমতিয়াজ পোদ্দারের কথায় অশ্রু এবং রুমকি খিলখিল হেসে ওঠে।বলে,
———আচ্ছা আচ্ছা।
———যদি প্রবলেম না থাকে তাহলে আপনাদের কারো নাম্বার আমায় দিতে পারবেন?কারণ আমার কারণে উনি এক্সিডেন্ট করলেন যদি উনার অবস্থার কথা না জিজ্ঞেস করতে পারি তাহলে আমার মন থেকে অপরাধ বোধ যাবে না।
———নো প্রবলেম,নো প্রবলেম।
বলেই রুমকি ফ্রী মাইন্ডে নিজেরর পার্সোনাল নাম্বার দিয়ে দেয় যেটা সে কাল নতুন কিনেছিল।ইমতিয়াজ পোদ্দারকে খুশিমনে নাম্বার নেয়।মোবাইলে নাম্বার তোলার পর তাড়াহুড়ো ভাব দেখিয়ে বলে,
———আচ্ছা, তাহলে আমি যাই।দেরী হয়ে যাচ্ছে আমার।সময় সুযোগ হলে কোনো একদিন দেখা করবে।বায়।।
———বায়য়।
ইমতিয়াজ পোদ্দার চলে যায়।ইমতিয়াজ পোদ্দার চলে যাওয়ার পর রুমকি অশ্রুকে তোষামোদে বলে,
———লোকটা কত্তটা রসিক এবং কিউটের ডিব্বা,না?
———প্রেমেইতো পড়ে গেলি মনে হয়!
———আরেহ দূর চিনি না,জানি না আবার প্রেমে পড়বো!জাস্ট ভালো লেগেছে এটাই বলেছি!
———ভালোলাগা থেকেইতো ভালোবাসা
চলবে…
(এই ইমতিয়াজ পোদ্দারটা কে, বলুনতো???) এর শেষ পরিণতি কি!পরবর্তীতে কি হবে অশ্রু এবং রুমকির সাথে!?তা পরবর্তী পার্টে জানবো!!
চলবে…
(ভয়ে আছি😁)