এক ফাগুনের গল্প পর্ব ১৮

#এক_ফাগুনের_গল্প
#পর্বঃ-১৮

মোহনা তার মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল, আমি মূল দরজা দিয়ে ঢুকতেই সে দৌড়ে এসে তার মা-বাবা আর এতগুলো পুলিশের সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে দিল। আমি সম্পুর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম, কিছু একটা বলতে গিয়ে বলার মতো শব্দ সাজিয়ে উঠাতে পারলাম না।

– মোহনা কান্নার আওয়াজ বাড়িয়ে দিয়ে বললো, কোথায় ছিলে তুমি? কি হইছে তোমার? খালুর সেই এলাকার পুলিশ তামিম হাসান ধরা পরেছে গতকাল। সে বললো তোমাকে নাকি তার লোকজন মিলে লঞ্চ থেকে মেরে ফেলে দিয়েছে।

– আমি মোহনার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, আগে সমস্ত কিছু শোন তারপর নাহয় কান্না করো ঠিক আছে?

– কোথায় ছিলে তুমি? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি সত্যি সত্যি মারা গেছো, তোমার লাশ খুঁজে পাবার জন্য পুলিশ লাগানো হয়েছে সেই নদীতে।

– কি বলছো তুমি? এতকিছু হয়ে গেছে?

– নয়তো কি? হারামজাদা পুলিশ যেভাবে বলছিল তাতে বিশ্বাস না করে উপায় আছে? আমি তো প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে কেবিনে চলে গেছি তাই হয়তো রাগ করে তুমি আমার সাথে লঞ্চে দেখা করো নাই। বিশ্বাস ছিল যে লঞ্চ যখন ঘাটে ভিরবে, তখন ঠিকই আসবে তুমি। কিন্তু তুমি না আসাতে বড্ড কষ্ট পেয়েছি, একবারও তোমার বিপদের কথা বুঝতে পারিনি।

– ঠিক আছে সমস্যা নেই, এখন তাহলে পুলিশদের যেতে বলে দাও, আমি তো এসে গেছি।

– একজন পুলিশ বললো, ঠিক আছে আমরা এবার গেলাম আপনি বিশ্রাম করুন। আর সেই এলাকায় খবর নিয়ে তাদের বিস্তারিত আরো তথ্য জানিয়ে সহয়তা করুন।

পুলিশ চলে যাবার পর স্যারও অফিসে চলে গেল, আমি নাস্তা করে রুমের মধ্যে বসলাম। আন্টি আর মোহনা আমার পাশেই বসে আছে, আমি মোহনার মোবাইল দিয়ে হাতিয়ার সেই আঙ্কেলের ছেলের নাম্বারে কল দিলাম। গতকাল আসার সময় তার নাম্বার লিখে এনেছিলাম তাই সেটাই ডায়াল করে কল দিলাম।

কল করে একটা ভালো খবর জানা গেল, আমার সে নষ্ট মোবাইল পাওয়া গেছে। তিনি বললেন যে আজ নাকি তাদের গ্রামের একজন ঢাকা আসবে তাই আমি অনুমতি দিলে সে তার কাছে মোবাইল পাঠিয়ে দেবে। আমি তাকে পাঠিয়ে দিতে বললাম আর এই নাম্বার মানে মোহনার নাম্বার তার কাছে দিতে বলে দিলাম। মোবাইল গুরুত্বপূর্ণ নয় কিন্তু সিমের মধ্যে পরিচিত অপরিচিত অনেক মানুষের নাম্বার পাওয়া হচ্ছে বড় প্রাপ্তি।

– মোহনা বললো, তুমি কি পুলিশ তামিম হাসানকে আগে থেকে সন্দেহ করেছো নাকি অনুসন্ধান করে বের করার পরে?

– বললাম, আমি প্রথম চিঠি পাবার পরেই তাকে সন্দেহ করেছি। কারণ লাশ সনাক্ত করার সময় সে একটা ফাইল লিখেছিল তখন তার লেখা দেখেছি। তার হাতের লেখা খুব ভালো একদম কম্পিউটার টাইপ করার মতো মনে হয়। আর রাতের চিঠিও ঠিক সেভাবেই হাতের লেখা ছিল, তারপর থেকে আমি তাকে সন্দেহ করেই এগোতে থাকি।

– তুমি সবকিছুর তথ্য আমার খালাতো বোন মরিয়ম এর কাছে দিয়ে এসেছো তাই না?

– হ্যাঁ, মরিয়ম আলাদা একটা মেয়ে তাই তার কাছে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার ভুল হয়েছে কারণ আমি যদি আমাকে লক্ষ্য করার কাউকে দিতে বলতাম তাহলে মরিয়ম দিতো। আর আমার প্রতি আক্রমণ হবার বিষয় তার নজরে পরতো, তাহলে এতটা কষ্ট করতে হতো না।

– যা হয়েছে ভুলে যাও, এখন ওখানকার সবকিছুই পুলিশ আর আমার খালু মেনেজ করবে।

– আমি একটা বিষয় অবাক হলাম কারণ তামিম তোমার বাবার অফিসের সকল তথ্য সংগ্রহ করেছে। এবং আমি কোন অফিসে ডিউটি করি আর কোথায় কোথায় আমাদের শাখা আছে মোটামুটি সব জানে। লোকটা আমাকে পথ থেকে সরানোর জন্য অনেক কিছু করেছে। এমনকি তোমার খালুর সাথে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আমাদের এলাকা থেকে বিতাড়িত করেছে। তবুও শেষ রক্ষা হলো না।

|
|

খুনের ঘটনার সাথে আমার আর কোনো যোগাযোগ নেই, খুনি ধরা হয়েছে তাই বাকি কাজগুলো এখন আদালত আর উকিল শেষ করবে। আমি সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি, চট্টগ্রামে চলে যেতে হবে তাই সময় নষ্ট করে লাভ কি? রাতেই মোহনা আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা মোবাইল উপহার হিসেবে দিল। আমি কোন আপত্তি না করে গ্রহণ করলাম, গ্রহণ করা ঠিক হয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না। তবে কেন যেন মনে হলো না গ্রহণ করলে ঝামেলা করতে পারে মোহনা, তাই নিলাম। পরদিন নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে আসা সেই লোকের কাছ থেকে নষ্ট মোবাইল পেলাম। সিমের মধ্যে পুরনো সকলের নাম্বার ফিরে পেয়ে আনন্দিত লাগছে।

এর একদিন পরে স্যার আমাকে সাথে নিয়ে অফিসে এলো, আমি আন্দাজ করতে পারি নাই কি হইছে? অফিসে এসে বরাবরের মতো চায়ের ওর্ডার দিয়ে আমাকে বললেনঃ-

– এই অফিসে তোমার স্থানে নতুন একজন জয়েন করেছে সজীব, সে কাজ করছে চারদিন ধরে।

– জ্বি সেটাই হবার কথা, কারণ আমি যেহেতু থাকছি না তাই কাজের স্থান তো ফাঁকা রাখা যাবে না।

– ঠিকই বলেছো, তোমাকে বলেছিলাম বরিশাল থেকে ফিরে এলে তোমাকে চট্টগ্রামে বদলি করা হবে মনে আছে?

– জ্বি স্যার, আমি মোটামুটি যাবার জন্য প্রস্তুত।

– ভেরি গুড, যদি আজকে রাতের গাড়িতে যাবার বন্দোবস্ত করা হয় তাহলে যাবে?

– জ্বি স্যার যাবো কারণ আমাকে যেখানে কাজ করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে সেটা নিশ্চয়ই খালি আছে তাই না?

– হ্যাঁ তুমি গেলে পরদিনই যোগ দেবে।

– ঠিক আছে স্যার তাই হবে।

– তাহলে চা খেয়ে বের হও, বাসায় গিয়ে বিশ্রাম কর আর আমি তোমার আন্টিকে বলে দিচ্ছি যে তুমি রাতে চট্টগ্রামে চলে যাবে।

– ঠিক আছে স্যার।

– আরেকটা প্রশ্ন ছিল।

– জ্বি বলুন।

– মোহনার সাথে তোমার কি কোন ধরনের আলাদা সম্পর্ক এ কয়েকদিনের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে?

– চোখে পরার মতো বা বলার মতো কিছু সৃষ্টি হয়নি তবে আমাদের মাঝে কথা হতো।

– বরিশালের খুনের রহস্য বিষয় আমি কোন প্রশ্ন করছি না, কেন জানো?

– না জানি না, তবে আন্দাজ করতে পারি যে আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি তাই বহিরাগত এসব বিষয় নিয়ে কথা বৃদ্ধি করা আপনার অভিপ্রায় নয়।

– ঠিক বলেছ, যদি তোমাদের কিছু হতো তাহলে তো চিন্তা করতাম যেমন তোমাকে খুঁজে পাচ্ছি না তখন আমি ঠিকই পুলিশকে বলেছি।

– জ্বি স্যার আপনি ঠিক আছেন।

– ওকে যাও তাহলে? সবকিছু গুছিয়ে নিও, আর আমি বাসায় ফেরার আগেই যদি তোমার গাড়ির সময় হয়ে যায় তাহলে বেরিয়ে পরবে। আমি মাঝে মাঝে চট্টগ্রামে গেলে তোমার সাথে দেখা হবে। আর তাছাড়া তোমাকেই কিন্তু মাঝে মাঝে হেড অফিসে আসতে হবে।

– সমস্যা নেই স্যার, আসি আসসালামু আলাইকুম।

★★

টিকিট কেটে আসলাম।
গেট দিয়ে বাড়িতে ঢোকার সময় দেখি মোহনা তার রুমের বেলকনিতে দোতলায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি চোখ অবনত করে ভিতরে গিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দেখি মোহনা বসে আছে। অবাক হলাম কারণ সে এর মধ্যে নিচে চলে এসেছে? আমি পিছনে চারিদিক তাকিয়ে আবার সামনে তাকালাম, আর সাথে সাথে মোহনা আমার হাত ধরে টান দিয়ে ভিতরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

– বললাম, দরজা আটকালে কেন?

– তোমার সাথে কথা আছে আমার।

– তাই বলে বন্ধ করতে হবে?

– হ্যাঁ কারণ আমি চাইনা কেউ বিরক্ত করুক।

– কেউ দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

– আরে রাখো তোমার সর্বনাশ! নিজের জীবনের সুখ দুঃখ নিয়ে যেখানে টানাটানি সেখানে এসব তুচ্ছ সর্বনাশ ভয় পাই না।

– তুমি না পেলেও আমি পাই।

– তাতে আমার কি?

– তোমার কি মানে?

– তুমি নাকি আজ রাতে চলে যাবে?

– হ্যাঁ।

– তুমি কোন যায়গা যাবে না, হাত পা ভেঙ্গে তারপর বিছানায় শুইয়ে রেখে দেবো।

– ফাজলামো করো না।

– কিসের ফাজলামো? আরে সজীব ফাজলামো তো তুমি করছো আমার সাথে, এতো অনুরোধ করে শুধু একটু ভালবাসা চাই। আর তুমি বারবার আমাকে আঘাত করে যাচ্ছ, আরে বাবা বললাম তো যদি সত্যি সত্যি কোনদিন অর্পিতা ফিরে আসে তাহলে আমি চলে যাবো। তোমাদের পথের কাটা হয়ে আমি থাকবো না, থাকবো না, থাকবো না।

– আচ্ছা ভেবে দেখি, এবার দরজা খোলো।

– আমাকে ভালবেসে I Love You বলে জড়িয়ে না ধরলে আমি দরজা খলবো না।

– জোর করছো?

– দরকার হলে তাই করবো, হাত পা ভেঙ্গে তারপর বুকের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকবো।

– কি হাস্যকর ব্যাপার স্যাপার।

– একদম হাসবে বলে দিচ্ছি, কতবড় কলিজা আবার হাসো তুমি?

– বেশি করে হাসবো তাতে তোমার কি?

– যতখুশি হাসবে সমস্যা নেই কিন্তু এখন তাড়াতাড়ি I Love You বলে জড়িয়ে ধরো।

– যদি না ধরি?

– বুক চিরে কলিজা বের করে ওজন দিয়ে দেখবো সেটা কতবড় হয়েছে?

– তাহলে তাই করো।

– এবার মোহনা রাগে শূর্পনখা হয়ে অভিমানে কষ্টে কান্না করে দিল, মুহূর্তের মধ্যে দুচোখ ভর্তি জল বের হয়ে গেল। তার সুন্দর দুই গাল বেয়ে সেই চোখের পানি গড়িয়ে যাচ্ছে, এতদিন পরে লক্ষ্য করলাম মোহনার ঠোঁটের পাশে ছোট্ট একটা তিল আছে।

আমি কিছু একটা বলতে চাইলাম ঠিক তখনই পকেট থেকে মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। আমি বের করে দেখি একটা অপরিচিত বাংলালিংক নাম্বার থেকে কল এসেছে। রিসিভ করে বললামঃ-

– আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?

– ওয়া আলাইকুম আসসালাম, কেমন আছো?

– আলহামদুলিল্লাহ, কিন্তু কে আপনি?

– আমি অর্পিতা।

– আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম, মুখ থেকে কথা বের করতে গিয়েও বের করতে পারলাম না।

– সে বললো, কি হলো? আমার সাথে কথা বলতে চাও না? ভুলে গেছো সজীব? তোমার সানজিদা তথা অর্পিতার কথা ভুলে গেলে তুমি?

চলবে….
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here