এক ফাগুনের গল্প পর্ব ২১

#এক_ফাগুনের_গল্প
#পর্বঃ– ২১

আমি মোহনার সামনে বসলাম, মোহনা খাটের ওপর বসে আছে আর আমি তার সম্মুখে নিচে বসে হাত দিয়ে আমার দিকে তাক করিয়ে দিয়ে খানিকটা তাকিয়ে রইলাম। চোখের পানি টলমল করছে আর কিছু বেয়ে বেরিয়ে এসেছে, কপোল ভিজে যবুথবু।

– বললাম, কখন এসেছো?

– আড়াইটার দিকে বাসায় পৌঁছেছি।

– কিছু খেয়েছ?

– হুম।

– বাসা চিনলে কীভাবে? অসুবিধা হয়নি?

– না, আমি বাসে করে জিইসি মোড় এসেছি আঙ্কেল আমাকে জিইসি মোড় গিয়ে নিয়ে এসেছেন।

– কিন্তু বাবার সাথে তোমার যোগাযোগ হলো কেমন করে সেটা না জানা আমি। আর কেনই বা তুমি হঠাৎ করে চট্টগ্রামে এসেছো সেটা জানতে চাওয়া আমার কৌতূহলি মন।

– তুমি আগে অফিসের পোশাক পাল্টে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসো তারপর না-হয় বলি?

– সমস্যা নেই বলো তুমি, স্যার জানে?

– হ্যাঁ এতক্ষণে হয়তো জেনে গেছে।

– কান্না করো কেন? আর চোখ মুখ কেমন যেন ভয়ে বিস্মিত হয়ে যাচ্ছে, কারণ কি?

– সত্যি বলবো?

– অবশ্যই সত্যি বলবে।

– আমি তাদের সবাই কে ছেড়ে শুধু তোমার জন্য চলে এসেছি, জানিনা তুমি আমাকে কতটা আপন করে নেবে? কিন্তু বিশ্বাস করো এ ছাড়া যে আমার মাথায় আর কিছু আসে নাই। এখন তুমি যদি আমার ভালবাসা গ্রহণ করে আমাকে নিজের কাছে রাখতে না চাও তাহলে আমি কি করবো? সেই ভয়ে আছি, তাছাড়া যদি বকাবকি করো?

– আচ্ছা আমি কি তোমাকে গালি দিয়েছি?

– না।

– তাহলে চোখ মুছে তারপর বসো।

– আমাকে ফিরিয়ে দেবে না তো?

– আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলাম। তারপর তার দিকে তাকিয়ে বললাম, আগে দেখি পরিস্থিতি কেমন হয়? তারপর ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কি করবো?

– মোহনা এবার খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল, আর আমার বুকের উপর ঝাপিয়ে পরে কান্নার আওয়াজ বাড়িয়ে দিল। তারপর বললো, তোমার দুটি পায়ে পরি আমাকে তাড়িয়ে দিও না সজীব। বিশ্বাস করো আমি মরে যাবো, তোমার এই বুকটা ছাড়া আমি আর কিছু চাই না।

মোহনা এমন ভাবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে আর কান্নার আওয়াজ এতটা মায়াবী লাগছিল যা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। সত্যি ভালবাসা এমন হয় নাকি? সত্যি ভালবাসা কি মানুষকে অন্ধ করে ফেলে? সত্যিকারের ভালবাসা কি তার ভালবাসার মানুষের জন্য পৃথিবীর সবকিছু তুচ্ছ মনে করে?
তাহলে অর্পিতা তো আমাকে ভালবেসেছে, কিন্তু সে কেন এমন করলো না? সে কি আমাকে মোহনার মতো করে ভালবাসতে পারে নাই? তার ভালবাসার মধ্যে কি এতটা অপূর্ণতা লুকিয়ে আছে?

– বললাম, আমার জীবনটা অনেক রহস্যময় তাই সেই জীবনের সঙ্গে মিলে তোমার জীবন কেন শুধু শুধু তুচ্ছ করতে চাও?

– ভালবাসা থাকলে সবকিছু জয় করা সম্ভব, তোমার ভরসায় আমি সবকিছু করতে পারি।

– তোমাকে বিয়ে করলে আমার চাকরি চলে যাবে এটা পুরোপুরি নিশ্চিত, তারপর আরেকটা নতুন জব যোগাড় করতে কষ্ট হবে। চাকরি চলে গেলে আমার সৎমায়ের এই সুন্দর ব্যবহার পরিবর্তন হয়ে যাবে।

– কেন? আমার কাছে তো অনেক ভালো মনে হয়েছে তোমার মা-কে। আর বাবার অফিস ছাড়া অসংখ্য কোম্পানি আছে, তোমার মতো অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোক চাকরির জন্য বেশিদিন আর ঘুরতে হবে না। দরকার হলে তুমি আমি দুজনেই ইনকাম করবো তবু এসব বাহানা দিকে আমাকে ছেড়ে দিও না। তুমি যে সকল অজুহাত দিবে সেগুলো জগতের প্রতিটি মানুষ এর জীবনে ঘটে থাকে। হয়তো কারো জীবনে কম আবার কারো জীবনে অনেক বেশি।

– তুমিও ইনকাম করবে?

– হ্যাঁ করবো, কেন পারবো না আমি?

– অবশ্যই পারবে, বোরকা পরে এক ব্যাগ চকলেট নিয়ে রাস্তায় নেমে যাবে তারপর বাসের মধ্যে বিক্রি করতে থাকবে।

– ওই শয়তান…! একদিন বিক্রি করেছি বলে তুমি সে কথা বারবার বলছো কিন্তু।

– ফাজলামো করলাম।

– কখন বিয়ে করবে?

– আগে বলো বাবার সাথে কীভাবে কথা হলো?

– তোমার মোবাইল কোথায় ছিল আজকে?

– আর বলো না, সকাল বেলা অফিসে যাবার সময় মোবাইল নিতে মনে ছিল না। তুমি গতকাল রাতে মোবাইল বন্ধ করার পরে অনেকবার চেষ্টা করেছি কিন্তু বারবার বন্ধ পেলাম। সকাল বেলা অনেকবার চেষ্টা করছি কিন্তু তবুও সেই একই সমস্যা। তারপর নাস্তা করে ভুলে মোবাইল ফেলে চলে গেছি আমি।

– গতকাল রাতে তোমার সাথে রাগ করে মোবাইল কল কেটে দিয়ে আমি বাবার সামনে গিয়ে সবকিছু জিজ্ঞেস করেছি। বাবা কেনই বা তোমাকে চট্টগ্রামে বদলি করেছে আর কেন শিমু মেয়েটি কে তোমার পিছনে লাগিয়েছে? খুব উত্তেজিত আর চিৎকার চেচামেচি করে বাবার কাছে বারবার কারণ জিজ্ঞেস করেছি। তখন বাবা হঠাৎ করে আমাকে চড় মেরে বসে, আর পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে।

– তারপর?

– সকাল বেলা মা-বাবা ঘুম থেকে ওঠার আগেই আমি তাদের দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দিলাম। নিজের সাথে যা যা আনার ইচ্ছে ছিল সবকিছু রাতেই গুছিয়ে রেখেছি। সকাল বেলা খুব ভোরে সব নিয়ে বেরিয়ে পরলাম, বৃদ্ধ দারোয়ান কিছুই বুঝতে পারে নাই। গুলিস্তান থেকে আমি সরাসরি আসলাম নারায়ণগঞ্জ চিটাগং রোড, তারপর সেখান থেকে টিকিট কেটে রওনা দিলাম।

– বাহহ বেশ বুদ্ধি, নেক্সট…!

– কুমিল্লা এসে তারপর তোমার নাম্বারে কল দিলাম বারবার কিন্তু রিসিভ হচ্ছিল না। খুব কান্না পাচ্ছিল তখন বিশ্বাস করো, ভাবলাম তুমি যদি কল রিসিভ না করো তাহলে আমি এই শহরে কার কাছে এসে থাকবো? প্রথমে ভেবেছিলাম গতকাল রাতে রাগ করে কল কেটে দিয়ে বন্ধ করেছি তাই তুমিও হয়তো রাগ করে রিসিভ করো না।

– হাহাহা তারপর?

– একদম হাসবে না বলে দিচ্ছি, তুমি জানো তখন আমি কতটা টেনশনে ছিলাম? আরেকটু টেনশন যদি করতাম তাহলে স্ট্রোক করে ফেলতাম।

– আচ্ছা বলো।

– যখন তুমি রিসিভ করছিলে না তখন নিজের উপর নিজের রাগ হচ্ছিল, তখন ভাবলাম কেন রাগ করে মোবাইল বন্ধ করলাম? এরপর হঠাৎ করে আঙ্কেল রিসিভ করলেন, আমি সালাম দিয়ে তাকে বললাম যে আমি সজীব এর অফিসের বসের মেয়ে। তখন আমি জানতে পারি যে তুমি মোবাইল বাসায় রেখে অফিসে চলে গেছো। আমি আঙ্কেলকে বললাম যে আমি চট্টগ্রামে আসতেছি তিনি যেন আমাকে একটু কষ্ট করে বাসায় নিয়ে যায়। তারপর আমি বাসের মধ্যে করে জিইসি মোড় এসে নামলাম আর তোমার বাবা গিয়ে নিয়ে আসলেন।

– তাহলে এবার আমাকে মেলা মেলা ধন্যবাদ দাও।

– কেন কেন?

– আমি মোবাইল বাসায় রেখে গেছি তাই তো তুমি আসতে পারলে নাহলে তো পারতে না।

– কেন? তোমার কাছে মোবাইল থাকলে তুমি কি আমাকে নিয়ে আসতে না?

– না, ভালো করে বুঝিয়ে ঢাকা শহরে ফেরত পাঠিয়ে দিতাম।

– তারমানে আমি যে আঙ্কেলের মাধ্যমে আসলাম তাতে তুমি রাগ করেছ?

– এসেই যখন পরেছো তখন রাগ করে কি হবে?

– একটা কথা বলবো?

– বলো।

– সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে এসেছি তাই আমার সেই ত্যাগের বিনিময়ে দুচোখের অশ্রু উপহার দিও না। এক বুক ভালবাসা দিতে না পারো, সমস্যা নেই তোমার নীরবতার মাঝে আমি সুখ খুঁজে নেবো।

– এমন করে কেন বলছো? আমাকে কি তোমার খুব খারাপ মানুষ মনে হয়?

– সেটা যদি মনে হতো তাহলে সব ছেড়ে তোমাকে ভালবেসে পাগল হলাম কেন?

– মায়ের কাছে গিয়ে এক কাপ কড়া করে চা নিয়ে আসো, আমি ততক্ষণে কাপড় পরিবর্তন করি।

– আচ্ছা ঠিক আছে, Love You.

– Love You too.

মোহনা রুম থেকে বেরিয়ে যাবার মিনিট খানেক পরই বিছানায় আমার মোবাইল বেজে উঠলো। তাই মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি স্যার কল দিছেন, আমি মনে হয় সামান্য ভীত দিশাহীন বোধ করলাম। কিন্তু রিসিভ করে বললামঃ-

– আসসালামু আলাইকুম স্যার।

– ওয়া আলাইকুম আসসালাম, কেমন আছো সজীব?

– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ স্যার আপনি কেমন আছেন?

– কীভাবে ভালো থাকবো বলো? মোহনার পাগলামি আমাকেই পাগল করে দিচ্ছে, তাই আর শান্তিতে থাকতে পারলাম না।

– সেটাই স্বাভাবিক।

– মোহনা চট্টগ্রামে গেছে তাই না?

– হ্যাঁ আমাদের বাসায় আছে।

– ওকে নিয়ে কি করা যায় বলো তো? মানসম্মান সব শেষ করে দিল।

– কিছু করার নেই স্যার, ভালবাসার উপর কেউ তো কখনো জোর করে সফল হতে পারে নাই। আমার মনে হয় আপনিও পারবেন না মোহনার মন থেকে আমাকে মুছে নিতে। তাই বাস্তবতা মেনে নিয়ে মেয়ে যা বলে তাই করুণ, কি আর করবেন?

– মানে কি সজীব?

– মানে হচ্ছে আপনি আমাদের বিয়ে মেনে নিন, আর তাছাড়া কোন উপায় নেই স্যার।

– সেটা কোনদিন সম্ভব না, এখন আমি তোমাকে যা বলি তাই করো।

– কি করতে হবে আমাকে?

– তুমি মোহনার সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাকে ঢাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করো। তুমি এমন ভাবে তার সাথে ব্যবহার করবে যাতে সে আমাদের কাছে ফিরে আসতে রাজি হয়।

– আর আপনি থাকবেন সম্পুর্ণ ফেরেশতা, তাই না?

– মানে?

– মানে হচ্ছে আমি মোহনাকে বিয়ে করবো, আপনি যদি রাজি না হন তবুও আমি ওকে বিয়ে করবো। যে মানুষ আমার জন্য এত কষ্ট করে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারবো না।

– কি বললে তুমি? আমার কথা শুনবে না?

– নাহহ, আপনার কথা যদি শুনতে হয় তাহলে তো ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে হবে। আর সেগুলো করলে তার দুচোখ ভর্তি থাকবে অজস্র পানি, কিন্তু আমি আর মোহনার চোখের পানি ঝড়াতে চাই না। তার চোখে যেন আর কোনদিন পানি না আসে সেই ব্যবস্থা করতে চাই, আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন যেন আপনার মেয়েকে ভালো রাখতে পারি।

– আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না সজীব, মুদ্রার এক পিঠ দেখেছো কিন্তু অপর পিঠ কিন্তু ভালো নাও হতে পারে সেই ধারণা আছে তোমার?

– স্যার আপনি একজন বহুরূপী মানুষ সেটা আমি অনেক আগেই বুঝতে পারছি। আপনার সম্পর্কে নতুন করে কিছু জানাতে হবে না।

– তাহলে আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর নাহলে চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরে তোমার লাশ ভাসিয়ে দিয়ে তারপর আমার মেয়ে নিয়ে আসবো।

– স্যার আপন বনে বনবিড়াল ও রাজা হয়ে যায়, এটা আমার শহর তাই এখানে আপনার দাপট কিন্তু চলবে না। আপনি ব্যবহার করবেন আপনার টাকা, প্রশাসন আর কুবুদ্ধি। কিন্তু আমি ব্যবহার করবো শুধু আপনার মেয়ের ভালবাসা আর আমার নিজের এলাকার ক্ষমতা। যদি সাহস থাকে তাহলে চলে আসেন চট্টগ্রামে, খেলা হপ্পে। আল্লাহ হাফেজ।

মোবাইল কল কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ স্ক্রিনের দিকেই তাকিয়ে রইলাম, তারপর আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি দরজার সামনে মোহনা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ ভর্তি রাগের দৃষ্টি, মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখনই ওই মুখ থেকে বেরিয়ে আসবে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত কিংবা অন্য কিছু।

– মোহনা বললো, তুমি আমার সাথে এমনটা করতে পারলে সজীব?

.

.

.

চলবে…?

.

.

.

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here