এক ফাগুনের গল্প পর্ব ২২

#এক_ফাগুনের_গল্প
#পর্বঃ- ২২

– আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে বললাম, বিশ্বাস কর আমার কোন দোষ নেই আমি পরিস্থিতির স্বীকার।

– তাই বলে আমাকে চা আনতে পাঠিয়ে দিয়ে তুমি ফ্রেশ না হয়ে মোবাইলে কথা বলো? ভেবেছিলাম যে তুমি আমি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে একসাথে চা খাবো কিন্তু তুমি তো ফ্রেশ হওনাই।

– ওহহ আচ্ছা এই কথা? তুমি কি জানো আমি কার সাথে কথা বলছিলাম?

– না তো, কার সাথে কথা বলছিলে?

– তোমার বাবার সঙ্গে।

– মানে কি? বাবা কি বলে?

– তোমার বাবা বলেন যেন আমি ভালোই ভালোই তার মেয়ে তার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে দেই। নাহলে নাকি মুদ্রার ওপিঠটি খুব খারাপ হতে পারে, মানে তার চেহারার মাঝের ভালো মানুষের মুখ আর থাকবে না।

– তারপর?

– আমিও বলে দিয়েছি যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে সে যেন চট্টগ্রামে এসে নিয়ে যায়।

– মোহনা খানিকটা আমার সামনে এগিয়ে এসে বললো, পারবে তো আমাকে ধরে রাখতে?

– আমি হাত বাড়িয়ে তার গাল স্পর্শ করে বললাম, তুমি যদি আমার সাথে থাকো তাহলে পারবো। কিন্তু তুমি যদি চলে যাও তাহলে তো আমার কিছু করার থাকবে না তাই না?

– এবার মোহনা আমাকে আবারও জড়িয়ে ধরে বললো, আমি তো চলে যাবার জন্য আসিনি।

★★

খাবার টেবিলে বাবার সাথে মোহনার বিষয় সবকিছু গুছিয়ে বললাম, সব শুনে বাবা কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল। আমি মুখের ভাত চিবানো বন্ধ করে তার মুখ পানে তাকিয়ে আছি বাবার বক্তব্য শোনা জন্য।

– বাবা বললেন, তোমরা দুজন দুজনকে যদি পছন্দ করো তাহলে তো কিছু করার নেই। কিন্তু আমি বাবা হিসাবে বলছি, এটা করা মোটেই ঠিক হবে না কারণ তার স্থানে যদি আমি থাকতাম তাহলে আমিও হয়ত তার মতো কাজ করতাম। একজন বাবার কাছে তার কন্যা কতটা ভালবাসার সেটা সেই বাবা ছাড়া কেউ জানে না।

– মোহনা বললো, আঙ্কেল আমি জানি আমার বাবা আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আমার নিজের ইচ্ছে বা পছন্দ তাকে মেনে নেওয়া উচিৎ। তাছাড়া আমি তো এমন কোন অযোগ্য ছেলে পছন্দ করিনি..! সজীব এর মাঝে টাকা ছাড়া একটা ভালো মানুষের সকল গুণাবলি আছে। টাকা দিয়ে কি হবে? টাকা সম্পদ এমন একটা জিনিস যেটা আজ আছে কাল নেই, সামান্য কিছু রোজগার করে নিজের পছন্দের সকল সখ পুরন করে চলার নামই প্রকৃত জীবন। যে মানুষ রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট কিংবা ফুটপাতের ফ্লাইওভার ব্রীজের নিচে ঘুমায় তার কোন টেনশন নেই। সে যখন ঘুমিয়ে পরে তখন আল্লাহর নাম স্মরণ করে ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু একজন সম্পদশালী ব্যক্তি সারাদিন শেষে একরাশ টেনশন করতে করতে পরেরদিন কি কি হবে সেগুলো ভাবতে ভাবতে ঘুমায়।

– দেখ মা, আমি একজন বাবা হিসেবে নিজের মত প্রকাশ করলাম, আমি তোমাকে চাই যেতে বলবো না তবে আমি বলবো যে তোমরা আরো কিছুদিন সময় নিয়ে তারপর কিছু করো। তোমার বাবাকে ভালবাসা বোঝানোর চেষ্টা করো, তিনিও রক্তে-মাংসে গড়া একজন মানুষ। তার মনের মধ্যেও ভালবাসার জন্য অনুভূতি নামক বেড়াজাল আছে। সম্পদের পিছনে ছুটলেও দিনশেষে তিনি একজন বাবা, তিনি একজন স্বামী, তিনি একজন পুরুষ।

– আমি বললাম, তারমানে তুমি বলতে চাচ্ছ মোহনা আর আমি স্যারকে বোঝানোর চেষ্টা করি? আপাতত আমাদের বিয়ে না করে তাকে বোঝানো উচিৎ?

– হ্যাঁ সেটাই বলতে চাই, মোহনা আমাদের কাছেই থাকবে সমস্যা নেই কিন্তু সেই ভাবে তোমাদের কিন্তু বোঝাতে হবে। তিনি যখন জানবেন যে তার জন্যই আজও তোমরা বিয়ে করো নাই তখন দেখবে মনে মনে অনেক আনন্দ পাবে। হয়তো আনন্দে চোখ দিয়ে অশ্রু বেরিয়ে আসবে, আরে এটাই প্রকৃত অর্থে ভালবাসার সুখ। সবকিছু ভালবাসা দিয়ে জয় করে তারপর সেই ভালবাসার মাঝে বসবাস করার মতো তৃপ্তি কোথাও নেই।

– মোহনা বললো, ঠিক আছে আঙ্কেল। Thank You এত সুন্দর করে আমাদের বোঝানোর জন্য।

– আমি চাই তোমরা দুজন একসাথে সুখী হও, কিন্তু সেই ভালবাসার জন্য যাতে কােন মা-বাবার হৃদয় না ভাঙ্গে সেটাও চাই।

★★

রাতে আমার রুমে মোহনার থাকার ব্যবস্থা করা হলো আর আমি ঘুমালাম আমার ছোটভাই (সৎভাই) এর রুমে। মনের মধ্যে সারারাত শুধু একটা চিন্তা ঘুরঘুর করছে, সেটা হচ্ছে আমি কীভাবে স্যারকে আমার আর মোহনার বিষয় রাজি করাবো? রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে তবুও চোখে ঘুম নেই, মোহনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। গভীর রাত, চারিদিকে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে, মোহনার মুখের পাশাপাশি অর্পিতার মুখটা ভেসে উঠছে। যেদিন সে আমার জন্য নুডলস রান্না করে রূপসা ব্রীজে নিয়ে গেছিল। সেদিন আমি যখন খাচ্ছিলাম তখন সে কত সুন্দর মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিল।

হঠাৎ করে নিজেকে সংযত করলাম একবার অর্পিতা আরেকবার মোহনা এমন করে কেন ভাবছি? আমি কাকে ভালবাসি? মোহনা মুখে বলেছে যে সে কখনো অর্পিতার বিষয় মন খারাপ করবে না। কিন্তু এতকিছু করার পরও যদি সে বুঝতে পারে যে আমার মনের মধ্যে এখনো অর্পিতা বাস করে তাহলে তার মন খারাপ হবে সেটাই স্বাভাবিক। হয়তো সে তার সেই মন খারাপের অনুভূতি প্রকাশ করবে না কিন্তু তার মনের ভিতরে ডুকরে কেঁদে উঠবে।

সকাল বেলা অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না কারণ মোহনা আসার পরে অফিসে নিশ্চয়ই কিছু একটা গন্ডগোল হতে পারে। কিন্তু মোহনা ও বাবা বললেন যে সমস্যা নেই যেতে হবে আমাকে। কারণ তাদের পারিবারিক বিষয় মনে হয় অফিসে বেশি প্রভাব না ও পরতে পারে। আমি যদি না যাই তাহলে নিজেকে ছোট করা হবে তাই অফিসে আসলাম।

অফিসে এসে ঘন্টা খানিক পরে একটা অপ্রত্যাশিত সংবাদ পেলাম। আমার জুনিয়র এক লোক আমার কাছে এসে ঘটনাটা বললেন, সেই ঘটনা সাজিয়ে লিখলে এমন হয়ঃ-

” তিনদিন আগে বিজন কুমার দাস ছুটি নিয়েছে তার কারণ সে বিয়ে করবে। তার বিয়ে নাকি পারিবারিক ভাবে হবে কিন্তু এই চট্টগ্রামেই অনুষ্ঠিত হবে। বিজন এর পরিবার সেই মেয়ে পছন্দ করেছে তাই ঘরোয়া পরিবেশে মোটামুটি করে বিয়ে হবে। যেহেতু বিজনের বাসা বাগেরহাট জেলা তাই তার জন্য পছন্দকৃত মেয়ের বাসাও বাগেরহাটে। মেয়ে এখানে বেড়াতে এসেছি তাই এখানেই বিয়ে হচ্ছে হঠাৎ করে। বিয়ের পরে মেয়ে আবার চলে যাবে, কারণ সেই মেয়ের পড়াশোনা এখনো চলছে। আর ছয়মাসের মধ্যেই পড়াশোনা শেষ হবে তাই তখন একেবারে তাদের গ্রামের বাড়িতে অনুষ্ঠান করে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে। কিন্তু গতকাল রাতে নাকি বিজন কুমার বাইরে থেকে বাসায় ফেরার পথে নিজের বাসার গলির মোড়ে এক সিএনজির সাথে মারাত্মক এক্সিডেন্ট করেছে। এখন সে চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি আছে। ”

হঠাৎ করে মনে পরলো বিজন কুমার যেদিন ছুটির জন্য আবেদন করেছে সেদিন আমাকে তার বিয়ের এসব কথা বলেছিল। কিন্তু আমি যেতে পারবো না বলে আগেই জানিয়ে দিলাম তবে পরবর্তীতে যাবো বলে কথা দিয়েছিলাম। কিন্তু সে হঠাৎ করে এমন এক্সিডেন্ট করেছে এটা অবশ্যই প্রত্যাশা ছিল না।

তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে পরলাম, চৌমুহনী থেকে আগ্রাবাদ গিয়ে লাকি প্লাজার পাশ থেকে রিক্সা নিয়ে মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে চলে আসলাম। বিজন কুমার কোন কেবিনে আছে সেটা আগেই জানা ছিল তাই সেই অনুযায়ী বিজনের কেবিনে গিয়ে প্রবেশ করলাম।

বিজনের কেবিনে গিয়ে আমি বিজনকে দেখে যতটা আশ্চর্য হলাম তারচেয়ে বেশি আশ্চর্য হলাম অন্য কাউকে দেখে। কেবিনের মধ্যে বিজন কুমার ব্যতীত আরো পাঁচজন ব্যক্তি আছে কিন্তু সেই পাঁচজনের মধ্যে একজনের মুখ আমার পরিচিত। সে বিজনের পায়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল, আমি প্রবেশ করার সাথে সাথে সেও আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেল।

আমি আমার সামনে এই মুহূর্তে অর্পিতাকে দেখছি, হাতে সাখা আর মাথায় সিঁদুর দিয়ে একটা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে সে।

আমার দিকে তাকিয়ে অর্পিতা কিছু ভাবলো কিনা জানিনা, তবে আমি তার দিকে তাকিয়ে ভাবছি যে,

তার হাতে সাখা কেন?
মাথায় সিঁদুর কবে উঠলো?
আর সে এখানে কেন?
বিজনের সাথে তার সম্পর্ক কি?

চলবে…?

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

7 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here