#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ০৯ |
————————
নওরি মূলত পালিয়েছিলো বারান্দা দিয়ে। মাহি বড়ো সেই টিনটা রাতে গিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলো এবং ফ্রিশাকে নিয়ে চলে গেছিলো। নওরি কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে খুব কষ্টে সেইখান দিয়ে বের হয়েছিলো। সেই ছাদের দরজা ছিলো বন্ধ। নওরি চিন্তায় পরে যায়। কীভাবে বের হবে এখন? মাহি দরজা কেন লাগিয়ে দিয়ে গেলো?
পরিশেষে উপায়ন্তর না পেয়ে বাড়ির সাথে লাগোয়া আম গাছটির দিকে ছুটে যায়। নওরি দেয়াল টপকাতে জানে। মাঝেমধ্যে-ই সৎ মায়ের ভয়ে তাকে দেয়াল টপকাতে হয়েছিলো। সেই অনুসারে ভেবেছিলো গাছও হবে দেয়ালের মতোই। এজন্য পন্থা না পেয়ে গাছের ডাল বেয়ে ধীরে ধীরে নামলো।
তবে যতটা সহজ ভেবেছিলো সবটা ততটা সহজ ছিলো না। হাতে পায়ে অসংখ্য চট পেয়েছিলো সে। প্রথমে ব্যাগটি ফেলে। অতঃপর লাফ দিতে গিয়ে কু!কুর চলে আসে, যার ফলে আরেকটুর জন্যে মুখ থুবড়ে পরেনি। ভয়ে এবং কাটা স্থানের জ্বালায় রীতিমতো কাঁপছিলো নওরি। থরথর করে।
কু!কুরটা চলে যেতেই নওরি আল্লাহ্’র নাম নিয়ে লাফ দেয়। লাফ দিতে গিয়ে হাঁটু এবং পা ছিলে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে কোনো রকমে ব্যথা গুলো সহ্য করে নিয়েছিলো সে। আশেপাশে তাকিয়ে নির্জন রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে নওরি। মাহি বেশ দূরেই অপেক্ষা করছিলো ফ্রিশাকে নিয়ে।
শুকিয়ে যাওয়া ক্ষ’ত গুলোকে দেখতে দেখতে নওরি অতীতে বিচরণ করছিলো। মানুষের সময় কতটা বিপরীত হলে এইরকম ঝুঁকি নেয়। মাহির কথা বড্ড মনে পরছে তাঁর। বাবাকেও ভীষণ মনে পরছে। কেমন আছে ওরা?
নওরি ফোন হাতে তুলে কল দিতে চাইলো মাহিকে। কিন্তু তাঁর মনে পরলো সিমে রিচার্জ করা নেই। এখন? এখন তাহলে কী হবে? নওরি ব্যস্ত ভঙ্গিতে আশেপাশে চাইলো। নিদ্র’র কথা মাথায় আসলো। কিন্তু নিদ্র কোথায়?
আশেপাশে খুঁজলো নিদ্রকে। নিজের রুমে আসতেই দেখলো ফ্রিশা একুরিয়ামে হামলা চালিয়েছে। একুরিয়ামের ঢাকনার উপর বসে নখ দিয়ে ঘঁষছে! নওরি দ্রুত ভঙ্গিতে ফ্রিশাকে কোলে তুলে নিলো। কী কেলেঙ্কারি বাঁধাচ্ছিলো ফ্রিশাটা। ফ্রিশা যেন তাও ছুটতে চাইছে একুরিয়ামের দিকে। নওরি না পেরে ধমক দিলো। ফ্রিশা মুখ ভার করে চুপসে রইলো। হুট করে কোল থেকে নেমে ঘরের কোণায় চলে গেলো। নওরি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ফ্রিশাকে কোণা থেকে কোলে নিয়ে বাহিরে বেরিয়ে আসলো। এবং ঘরের দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়ে বললো,
–“আন্টিকে বলে দিবো যেন দ্রুত-ই এই রুম থেকে একুরিয়ামটা সরিয়ে ফেলে। মাছের এত লোভ ভালো না ফ্রিশা। খাওয়াবো আমি তোকে। টাটকা তাঁজা মাছ।”
–“মিঁয়্যাও!”
নওরি লিভিংরুম অতিক্রম করতে গিয়ে দেখলো নূরজাহান তাঁর বড়ো ছেলে তুষারের সাথে ভিডিও কথা বলতে ব্যস্ত। অন্য সোফায় নূরজাহানের স্বামী সৈকত সাহেব পত্রিকা পড়ছেন এবং ফাঁকে ফাঁকে চা খাচ্ছে। চা খেতে গিয়ে সামনে নজর যেতেই নওরিকে দেখতে পেলো। নড়েচড়ে বসলেন সৈকত সাহেব। হালকা গলা খাঁকারিও দিলেন। নওরি ইতস্তত সহিত সালাম দিলেন সৈকত সাহেবকে। তিনি চায়ের শূণ্য কাপটি টি-টেবিলে রাখতে রাখতে থমথমে গলায় বললেন,
–“ওয়া আলাইকুম আসসালাম।”
নূরজাহান নওরিকে দেখতেই চমৎকার হাসলেন। মুহূর্তে-ই পিছের ক্যামেরা দিয়ে নওরিকে দেখিয়ে বলে,
–“ও হচ্ছে নওরি। এই নওরি, এদিকে আয়! আমার বড়ো ছেলের সাথে পরিচিত হয়ে যা।”
নওরি জানে না পিছের ক্যামেরা ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে নূরজাহানের বলা বাক্যে ভীষণ হকচকালো। সে মোটেও প্রস্তুত নয় নূরজাহানের বড়ো ছেলের সঙ্গে পরিচিত হতে। নওরি ধীর গলায় শুধায়,
–“না, না আন্টি। আপনি কথা বলুন, আমি নিদ্রকে খুঁজছি।”
বলেই কোন রকমে পালালো নওরি। দূর দেশের এক লোকের সাথে আবার কিসের পরিচয়? এমনিতেই সৈকত সাহেবের অসন্তোষ ভাব, নওরি ইতিমধ্যেই বেশ ভীত।
–“ওটাই তোমার বান্ধুবীর মেয়ে?”
–“হ্যাঁ। খুব সরল মেয়েটা। ওর মধ্যে যেন আমার বান্ধুবীর প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে।”
——————-
নিদ্র মুখ ভার করে বসে আছে। নওরি নিদ্র’র পাশে বসে নিদ্রকে দেখছে। হঠাৎ কী এমন হলো যে চঞ্চল নিদ্র’র গালে হাত? অতশত না ভেবে নওরি মৃদু স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“কী ব্যাপার?”
–“নিদ্র ভাইয়াকে ভেবেছিলাম ব্লেকমেইল করবো কিন্তু সেই সুযোগ ভাইয়া দিলো না!”
নওরি চমকালো, হকচকালো। তাঁর স্মরণে এলো গত রাতের অব্যক্ত সময়টুকু। ইরা’দ ব্লেকমেইল নিয়ে কিছু বলেছিলো। হ্যাঁ, মনে পরেছে। কিন্তু গতকালের বেপরোয়া ব্যবহার এবং আজকের গম্ভীর স্বভাব কোনোটাই মেলাতে পারছে না সে। মুহূর্তে-ই মস্তিষ্কে হানা দিলো ইরা’দকে নিয়ে থাকা কঠিন জট। এই জটে খুলতে গেলে নওরি যেন আরও আটকা পরে যাচ্ছে।
নওরি কী গতকালের কথা বলবে? নাহ, বলার প্রয়োজন নেই। পরবর্তীতে পুণরায় কথা উঠবে এ বিষয়ে। পাঁচ কান হলে তো আরও বিপদ। এই পরিবারে আশ্রয় নিতে এসে নিজের দুর্নাম ছড়াতে চাচ্ছে না সে। এখনো তাঁর অনেক কিছু করার বাকি।
নওরি যখন ভাবনায় মশগুল তখন অসাবধানবশত তাঁর হাতাটা কিছুটা উঠে যায়। যার ফলে বেরিয়ে আসে চুড়িতে পাওয়া আ!ঘাতের কালচে দাগ। এখনো সেই দাগ নওরির হাতে কিঞ্চিৎ দৃশ্যমান। নিদ্র অকারণ বশত সেদিকে তাকাতেই অনায়াসেই সেই দাগ গুলোকে চিহ্নিত করে ফেললো। উৎকন্ঠা হয়ে নওরির হাত টেনে বলে,
–“তোমার কী হয়েছে নৌরি ফুল? হাতে কীভাবে ব্যথা পেয়েছো?”
নওরি নিদ্র’র পানে ভয়াতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দ্রুত হাত আড়ালে নিয়ে নিলো। নিদ্র তখনো উত্তেজিত। নওরি সবসময় ফুল হাতার জামা পরে। তাই তাঁর ক্ষ!ত চিহ্ন, কালচে দাগ গুলো আড়ালে থাকে। কিন্তু তাও সাবধানের মার নেই। তাইতো নওরি দুহাতের হাতা টেনে-টুনে হাতের মুঠোতে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু এমতাবস্থায় এভাবে ধরা খাবে কে জানতো? মিথ্যার সুরও নওরির গলা দিয়ে বের হচ্ছে না। মহা ঝামেলায় ফাঁসলো তো।
যখন নিদ্র নওরিকে প্রশ্ন করতে ব্যস্ত। তখন হুট করেই ইরা’দ রুমে প্রবেশ করলো। নওরি চমকে তড়িৎ উঠে দাঁড়ায়। ইরা’দ ভাবেনি যে নওরি নিদ্র’র সাথে এই রুমে অবস্থান করবে। তাই সেও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে। নওরি একবার নিদ্র’র দিকে তো তাকাচ্ছে তো একবার ইরা’দের দিকে। ইরা’দকে দেখতেই নিদ্র অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে ফেলেছে। ইরা’দ পরিস্থিতি স্বভাবিক করতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে শুধায়,
–“অসময়ে চলে এসেছি বোধহয়! আপনি থাকুন, আমি আসছি।”
নওরি অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“না, না। আমি যাচ্ছি।”
বলেই নওরি সময় ব্যয় না করে বেরিয়ে পরলো। অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছে তাঁর। তীব্র অস্বস্তি। এই অস্বস্তি কাটাতে রুম ত্যাগ করতেই হবে। নওরি নিজের রুমে এসে দরজার সাথে পিঠ ঠেকালো। অস্বস্তি কাটছে না যেন। হঠাৎ কী মনে হতেই চমকালো নওরি।
–“এক মিনিট। উনি কী ‘আপনি’ সম্বোধন করলো? গতকাল না তুমি করে বললো? আজ হঠাৎ…?”
———————
নওরির যাওয়ার পানে তাকিয়ে ইরা’দ ফিরে তাকালো। গাল ফুলিয়ে বসা নিদ্র’র দিকে তাকালো। ধীর পায়ে কয়েক ধাপ এগিয়েও গেলো। সপ্তপর্ণে নিদ্র’র পাশে বসতেই নিদ্র নাক কুচকে বললো,
–“একদম কথা বলবে না আমার সাথে।”
–“আচ্ছা বললাম না। শুধু লিটল নিদ্রার কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে এসেছি!”
নিদ্র ঘুরে তাকালো ইরা’দের পানে। পিটপিট করে ইরা’দের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“কিসের প্রশ্ন? তুমি তো আমার চাইতেও বড়ো, আমি তো পড়ি মাত্র ওয়ানে। আমি কী করে উত্তর দিবো?”
ইরা’দ হাসলো। শব্দহীন হাসি। নিদ্র মাথাভর্তি চুলে আলগোছে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে লহু কন্ঠে শুধায়,
–“এমন কখনো হয়েছে, তুমি আমার থেকে কিছু চেয়েছো আর আমি দেইনি?”
–“একদম না?”
–“বরং না চাইতেও বেশি পেয়েছো, তাইতো?”
নিদ্র ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। ইরা’দ পুণরায় দৃঢ় কন্ঠে বলতে লাগে,
–“আমি কখনোই তোমায় তুষারের অনুপস্থিত বুঝতে দেইনি। সবসময় তোমার সব সখ, আহ্লাদ, চাওয়া আমি পূরণ করেছি। এমতাবস্থায় তুমি কী চাও তোমার নিদ্র ভাইয়াটা কারো সামনে মাথা নিচু করুক?”
নিদ্র মুখটা ভার করে বলে,
–“না।”
–“তাহলে তোমার কী প্রয়োজন আমাকে ব্লেকমেইল করার? এমন তো না যে আমি তোমার চাওয়া গুলো পূরণ করি না।”
নিদ্র পিটপিট করে ইরা’দের দিকে তাকিয়ে ভার গলায় বললো,
–“আমি বুঝতে পারিনি ভাইয়া। ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি আমার বেস্ট নিদ্র ভাইয়া। আসলে আমি লামিয়া এবং ইমাদের কথায় ফেঁসে গেছিলাম। ওরা বলে তোমায় নাকি কেউ ব্লেকমেইল করতে পারে না, এমনকি আমিও না। এজন্য….”
মাথা নিচু হয়ে নিদ্র’র। ইরা’দ নিদ্রকে নিজের সাথে জড়িয়ে আলতো স্বরে বলে,
–“আচ্ছা ঠিকাছে। কিছু হয়নি। ভুলে যাও সব।”
নিদ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ বলে ওঠে,
–“আমার নৌরি ফুলের খুব কষ্ট নিদ্র ভাইয়া।”
——————-
–“ফাউন্ডেশন হবে সারিফা? যেটা আমার গায়ের সাথে যেকোনো মিশে যাবে?”
নওরির হঠাৎ কন্ঠস্বরে সারিফা চমকে দরজার দিকে তাকালো। নওরি কাচুমাচু ভঙ্গিতে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সারিফা অস্ফুট স্বরে বললো,
–“হবে, কিন্তু হঠাৎ?”
নওরি ফোঁস করে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে ধপধপ পায়ে সারিফার দিকে এগিয়ে এলো। অতঃপর স্বল্প শব্দে বললো,
–“হাতের দাগগুলো খারাপ দেখায়।”
–“কই দেখি।”
নওরি জুবুথুবু অবস্থায় হাতা তুলে সারিফাকে দেখালো। সারিফা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রয় নওরির হাত জোড়ার দিকে। আলতো স্বরে বললো,
–“আন্টিকে বলিও না সারিফা। অনুরোধ রইলো।”
——————–
দুপুর বেলা। মেঘলা আকাশ। শীতল হাওয়ায় চারিপাশ মুখোরিত। কাঠফাটা রোদের বদলে ঠান্ডা পরিবেশ সত্যি হৃদয়ে প্রশান্তি দেয়ার মতো। ঘামে চুপচুপে হওয়া ব্যস্ত মানুষগণ আলিঙ্গন করে নিচ্ছে এই ঠান্ডা মৌসুমকে। আকাশে কুঞ্জ কুঞ্জ কালো, রূপালী রঙের মেঘে আবৃত। মাঝেমধ্যে প্রবল বেগে গর্জে উঠছে মেঘ।
ইরা’দ ফোনে কথা বলতে বলতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলো। সুন্দর এই পরিবেশ উপলব্ধি করতেই সে ফোন কেটে সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। চোখ বুজে। ধুলোমাখা, ব্যস্ত শহরের গন্ধ নিতে নিতে সে ক্লান্ত। প্রাকৃতিক ঘ্রাণ উপভোগ করতে চায় সে। প্রবলভাবে, প্রখরভাবে।
হঠাৎ কী মনে হতেই চোখ মেলে তাকালো। মাথা ঘুরিয়ে উপরের বারান্দার দিকে তাকালো। মুহূর্তে-ই যেন থমকালো, বিমূর্ত হলো। এ কোন নারীকে দেখছে সে? এই নারীতে কী তাঁর সর্বনাশ লিখন? তাহলে কেন হৃদপিন্ড তীব্র শব্দে ওঠা-নামা করছে? কেন? ভেঁজা চুলে, হাসি-মাখা, স্নিগ্ধ রূপের নওরিকে দেখে ইরা’দ যেন স্থির হয়ে রইলো। প্রবল বাতাসে নওরি উম্মুক্ত চুলগুলো অসমান্তরাল, খোলাখুলি ভাবে উড়ছে। এরকম এক দৃষ্টি নজরবন্দি করে ফেললো ইরা’দ। অনুভব করলো খুব অল্প সময়েই এই মেয়ের প্রতি তাঁর আলাদা মোহ কাজ করছে। কিন্তু এই মোহ কতটুকু মানানসই? আবেগের বয়স ছেড়ে এসেছে আরও আগেই। তাহলে? এই অনুভূতির নাম কী?
খোলামেলা পরিবেশ নওরি উপভোগ করার পূর্বেই হঠাৎ নজর গেলো নিচে। ইরা’দকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো যেন। দ্রুত ভেতরে চলে গেলো নওরি। ভেতরটা কাঁপছে তাঁর। এর মানে কী এতক্ষণ ইরা’দ এখানেই দাঁড়িয়েছিলো?
নওরির ভয়াতুর দৃষ্টি এবং ছুটে পালানো ইরা’দকে হাসালো। নিরব, প্রাণখোলা হাসি। ইরা’দ আরও কিছু মুহূর্ত বারান্দার দিকে তাকিয়ে ঘুরে সামনের দিকে ফিরলো। হাত দুটো রেলিঙ এ প্রসারিত করে মেঘে আবৃত আকাশের পানে তাকালো। কিছু সময় অতিবাহিত হলো। পরিবেশ শান্ত, শৃঙ্খল। ইরা’দ মেঘ জমায়িত আকাশের পানে স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করে গুণগুণিয়ে গেয়ে উঠলো,
–“সোহাগের হাওয়ায়, মেঘেদের ডানায়
এই মন বেখেয়ালে,
অন্তরালে স্বপ্ন রেখে যায়!”
হঠাৎ নিদ্র’র কথা মনে পরলো। গান থামিয়ে গভীর ভাবনায় বিভোর হয়ে পরলো ইরা’দ।
–“আমার নৌরি ফুলের খুব কষ্ট নিদ্র ভাইয়া!”
কিসের কষ্ট? এইটুকুনি মেয়ের আবার কিসের কষ্ট? বিষয়টি বেশ ভাবাচ্ছে ইরা’দকে।
–“ফুলেদের আবার কষ্ট আছে? হয়তো আছে, নয়তো সময়ের ব্যবধানে তাঁরা কেন শুকিয়ে যায়? তাদের পাঁপড়ি’রা কেন ঝরে যায়? কিন্তু… মেয়েটা তো নিতান্তই এক পিচ্চি।”
#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১০ |
——————-
আজ ভালোমতোন সিটকিনি দিয়ে ঘুমিয়েছে নওরি। গত রাতের ঘটনা মস্তিষ্কে এতটাই গভীর দাগ কেটেছে যা নওরি কল্পনা করতে পারে না। কী কেলেঙ্কারি এক কান্ড৷
ভোর ছয়টা। নামাজ সেরে নওরি রান্নাঘরে ঢুকেছে৷ এতদিনে নওরি যতটুকু বুঝেছে নূরজাহান ঠিক সাতটায় রান্নাঘরে ঢুকে। ঘুম চোখে নিয়ে সর্বপ্রথম এক পাতিল গরম পানি দিবে। এটা অবশ্য সৈকত সাহেবের জন্যেই। তিনি রোজ অফিসে যাবার পূর্বে গোসল সেরে যান। উষ্ণ পানির রমরমা গোসল!
নওরি প্রথমে নাস্তার জন্যে জিনিসপত্র খুঁজতে লাগলো। নাস্তা অর্ধেক হতেই ঘড়ির দিকে তাকালো সে। সাতটা বাজতে কিছুক্ষণ। নওরি তৎক্ষণাৎ ব্যস্ত হাতে এক চুলো খালি করে বড়ো পাতিলে পানি ভরে চুলোয় চড়িয়ে দিলো।
নওরির রুটি বেলার মুহূর্তে-ই নূরজাহান ঘুমের ঘোরে রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন। নওরিকে রুটি বেলতে দেখে ঘুম উড়ে গেলো নূরজাহানের। গোল গোল চোখে পুরো রান্নাঘরে চোখ বুলিয়ে নিলো। সবই ঠিকঠাক।
চুলোর একপাশে থাকা আলু ভাঁজির কড়াই থেকে ধোঁয়া উড়ছে। চুলোতেও গরম পানি চড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মেয়েটা এতকিছু কখন করলো? নূরজাহান ব্যস্ত সুরে শুধায়,
–“এ কী! এসব কী করছো তুমি?”
নওরি রুটি বেলা থামিয়ে হাতের উল্টোপিঠে ঘর্মাক্ত কপাল মুছতে মুছতে মৃদু গলায় শুধায়,
–“ভালো লাগছিলো না। তাই করে ফেললাম। রুটি বেলা প্রায় শেষ। নাস্তার সময়ের আগে ভেঁজে দিবো, গরম গরম খেতে ভালো লাগবে।”
নূরজাহান নওরির কথা শুনলেন না। তড়িৎ নওরির হাতের বেলুনীটা কেড়ে নিয়ে বলেন,
–“আমি করে নিবো। এতক্ষণ যা করার করেছো আর নয়। ভালো না লাগিলে বাহির থেকে ঘুরে আসবে। তাও রান্নাঘরে গরমে সিদ্ধ হবার প্রয়োজন নেই, বুঝেছো?”
আলতো হাসলো নওরি। ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পরলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একমনে তাকিয়ে রইলো বাড়ির বাগানটার দিকে। ফ্রিশা বর্তমানে নওরির পায়ের উপর হাত-পা মেলে ঘুমোচ্ছে।
–“গতকাল বাগানটায় যাওয়া হয়নি। আজ বড্ড লোভ লেগেছে বাগানে যাওয়ার, মালিদের সাথে একটু আলাপ করার!”
মনের অফুরন্ত ভাবনা নিয়ে আরও মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয় বাগানটার দিকে। কী মনে করে ফ্রিশাকে কোল পা থেকে আলতো করে সরিয়ে রুমের ভেতর চলে গেলো। ওড়না গায়ে ভালো করে জড়াতেই ফ্রিশা তাঁর পিছু নিলো। নওরির হাব ভাবে ফ্রিশা বেশ বুঝে নিয়েছে খোলামেলা পরিবেশে নিজেকে আবারও হারাতে চলেছে।
বাগানে আসতেই ফ্রিশা এদিক সেদিক ছুটাছুটি শুরু করে দিলো। নওরি একপলক ফ্রিশার দিকে তাকিয়ে এদিক ওদিক আনমনে ঘুরতে লাগলো। এই বাগান দেখে নওরির মনে পরে গেলো প্রিতমের সাথের কালো মুহূর্তটি। বিষাদে গা শিরশির করে উঠলো নওরির। কতটা ভয়ানক ছিলো সেই দিনটি। সব থেকে বড়ো দোষ ছিলো প্রিতমের চাহনিতে। চাহনিতে স্বচ্ছতার রেশ ছিলো না। অদ্ভুত, গা গুলিয়ে আসা চাহনি ছিলো।
হঠাৎ নওরি অতীত ভুলে এক হলদে ফুলের সন্ধান পেলো। এই ফুলের নাম জানে না সে। তবে সবুজের সমারোহে হলুদ ফুল গুলো অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। নওরি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রয় ফুলগুলোর দিকে।
হঠাৎ কী মনে হতেই একটি ফুল ছিঁড়ে হাতে নিয়ে নিলো সে। এমন সময় কর্কশ কন্ঠে নওরি চমকে উঠলো।রোশপূর্ণ, ভারী পুরুষালি কন্ঠ। নওরি পিছে ফিরতেই দেখলো হাতে গাছে পানি দেয়া বালতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক মধ্যবয়সী লোক। লোকটি এগিয়ে এলো নওরির দিকে।
–“কে তুমি মেয়ে? ফুল ছিঁড়েছো কেন?”
নওরি আমতা আমতা করে শুধায়,
–“আমি নওরি। নূরজাহান আন্টির দূসম্পর্কের আত্নীয়।”
লোকটি কিছুক্ষণ চুপ রইলো। হয়তো মন-গহ্বরে নামটি নিয়ে তীব্র রেশারেশি চলছে তাঁর। নওরি নূরজাহানের স্বামীর নাম মনে করার চেষ্টা করলো। হয়তো চাচা তাকেই চিনবে। মাথায় কিছুটা জোর খাটাতেই নামটি মনে এলো নওরির। সময় বিলম্ব না করে লোকটির উদ্দেশ্যে বললো,
–“সৈকত আঙ্কেলের ওয়াইফ নূরজাহান আন্টি।”
———————-
সকাল দশটা। মাহির সাথে কথা বলতে মন বড্ড আনচান করছে তাঁর। হাতে কিছু খুচরো টাকা নিয়ে নওরি নূরজাহানের কাছে গেলো। নিদ্র স্কুলে এবং সারিফা কলেজে। বর্তমানে কিছু কাপড় কাঁচতে ব্যস্ত সে। কাজের বুয়া আজ আসেনি এখনো। তাই সৈকত সাহেবের কাপড় গুলো নিজেই ধুঁতে বসেছেন। নওরি ইতস্তত পায়ে এগিয়ে গিয়ে বলে,
–“আন্টি?”
মাথা উঁচু করে তাকালেন নূরজাহান। নওরিকে দেখে জোরপূর্বক হেসে বলে,
–“হ্যাঁ বলো।”
–“মোবাইলে রিচার্জ করে কোন দোকানে? একটু বলে দিবেন?”
হাসি উড়ে গেলো নূরজাহান। চোখ-মুখে একরাশ বিস্ময় ফুটিয়ে বলে,
–“কেন? হঠাৎ?”
–“মোবাইলে টাকা নেই আন্টি। জরুরি কলেরও একটু তাড়া আছে।”
–“তাহলে আমারটা দিয়ে কল করে নাও।”
পরমুহূর্তে নূরজাহানের কী মনে হতেই আফসোসের সুরে বললো,
–“আমারও তো ফোনে ব্যালেন্স নেই। গতকালই ভাবীর সাথে কথা বলতে গিয়ে ফুরিয়েছে।”
–“তাহলে আপনি-ই দোকানটি চিনিয়ে দিন আন্টি। আমি যেতে পারবো।”
নূরজাহান কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
–“বামপাশের গলি দিয়ে কিছুদূর হাঁটলেই রিচার্জ এবং বিকাশের জন্যে একটি দোকান পাবে। সাবধানে যাবে।”
নওরি মাথা নাড়িয়ে একপলক রুমের দিকে তাকালো। ফ্রিশাকে রুমে বন্ধ করে এসেছে সে। নওরি কোনোক্রমেই চায় না ফ্রিশা রাস্তাঘাটে তাঁর সাথে আসুক। এমনিতেই অচেনা জায়গা। হারিয়ে ফেলার ভয় বেশি।
খান ভিলার ডানপাশে কিছুটা দূরত্বে একটি টঙ আছে। মোটামুটি রকমের, খুব বেশি বড়ও না। ওটা যেন ইরা’দের জন্যে এক আস্ত ভালোবাসা স্বরূপ! সেখানে বসে বর্তমানে নিখিলের সাথে চা পান করছে।
নিখিল তার বেস্টফ্রেন্ড। হিন্দু ধর্মালম্বীর হলেও তাদের মধ্যে ধর্মের ভেদাভেদ কখনোই ছিলো না। ধর্ম নিয়ে শেষ কবে কথা বলেছিলো সেটাও তাদের মনে নেই।
কয়েকজন বন্ধু মিলে টঙের ছাউনিতে করা কাঠের বেঞ্চগুলোতে বসে নানান আলাপ – আলোচনায় ব্যস্ত। বেশিরভাগ কথাই হয় রাজনীতি নিয়ে। এখন ইরা’দ মোটামুটি ফ্রী। শুধু বুধবারে প্রসাশন অফিসে গিয়ে তাঁর হাজিরা খাতায় সাইন করে আসতে হয়।
এছাড়া আশেপাশে কোনো সম্মেলন অথবা জনসভা বসলে সেদিকেও যেতে হয়। তবে এই সপ্তাহ কোনোরকম সম্মেলন বা কোনো কাজের তাড়া নেই। তাই হয়তো নিশ্চিন্তে টঙে বসে আড্ডা দিতে পারছে।
হঠাৎ নিজ বাড়ির গেটের দিকে নজর যেতেই ইরা’দ থমকালো। ভ্রু কুচকে বোঝার চেষ্টা করলো আদৌ সঠিক দেখছে কী না! কিন্তু তা নয়। সঠিক-ই দেখছে। ওটা নওরি! নওরি এদিক ওদিক সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে বামপাশের দিকে হাঁটা দিলো।
ভেতরটা খুঁতখুঁত করে উঠলো ইরা’দের। ভোরেও নওরিকে দেখেছিলো সে। বাগানে। ইরা’দ যে বারান্দায় ছিলো সেটা নওরি খেয়াল করেনি। তবে নওরি বাড়ির বাহিরে কেন, কোথায় যাচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। হঠাৎ নিখিলদের চমকে দিয়ে ইরা’দ উঠে দাঁড়ালো। নিখিল মাথা উঁচু করে ইরা’দের দিকে তাকালো। ইরা’দের থমথমে চাহনির আগা-মাথা কিছুই বুঝলো না সে। গোল গোল চাহনি নিক্ষেপ করে নিখিল বললো,
–“কী হলো?”
–“তোরা চা খা। আমি একটু আসছি!” রাশভারী কন্ঠস্বর।
নিখিল ইরা’দের উক্তির বিপরীতে প্রশ্ন করার পূর্বেই ইরা’দ হন্তদন্ত পায়ে চলে গেলো। নিখিল ঘাড় বাঁকিয়ে ইরা’দের হঠাৎ চলে যাওয়া দেখছে। অন্যমনস্ক হয়ে ইরা’দের একজন সহকারীর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“আবার কী হলো এর? কই যাচ্ছে? অদ্ভুত তো!”
———–
–“নৌরি ফুল, দাঁড়ান!!”
ভরাট, শীতল পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে নওরির চলমান পা জোড়া দমে গেলো নিমিষেই। কানের পাশ দিয়ে যেন শিহরণ বয়ে গেলো তাঁর। চমকে পিছে ফিরে তাকালো নওরি। ইরা’দকে দেখে নিঃশ্বাস আটকে গেলো যেন। ইরা’দ এগিয়ে আসলো নওরির দিকে। দুই হাত দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। নওরি ভীত নজরে ইরা’দের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরা’দ সেই চোখে তাকাতেই নওরি সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি নত করে ফেললো।
–“কোথায় যাচ্ছেন?”
–“পা..পাশেই!”
–“হঠাৎ?”
–“রিচার্জ করব!”
–“তো আপনার যাওয়ার কী দরকার? আমায় দিন।”
“আপনি” সম্বোধনটা নওরির বুকে তীরের মতো বিঁধছে। এতটা সম্মান পেয়ে তাঁর দাঁড়িয়ে থাকতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। এ জীবনে এতটা সম্মান দিয়ে কেউ কখনো কথা বলেনি তাঁর সাথে। লোকটা এমন কেন? কী চায় সে? কেন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রূপ দেখায়? নওরির জানা নেই, সত্যি কিছু জানা নেই তাঁর। ইরা’দ নামক ব্যক্তিটি এক গোলকধাঁধা, এক চক্র। যেই চক্রকে ঘিরে হাজারো রহস্য।
–“চুপ আছেন যে? সংকোচ হচ্ছে?”
ইরা’দের হঠাৎ বলা বাক্যে নওরির ধ্যান ফেরে৷ আমতা আমতা করে বলে,
–“জ্বী, না। আসলে নাম্বার জানি না আমি!”
ইরা’দ হতভম্বের মতোন তাকিয়ে রইলো নওরির পানে। এ যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। কোনো মেয়ে নিজের নাম্বার জানে না? নিজের পার্সোনাল নাম্বার? এ তো আজ-কালকার জামানায় একদম অসম্ভব। ইরা’দ নিজের বিস্ময় দমিয়ে বলে,
–“কী সিম?”
–“রবি।”
–“তাহলে আপনার ফোনটি দিন। আমি রিচার্জ করে আসছি। আপনি বাসায় যান!”
–“না, না! আমি যেতে পারবো।”
ইরা’দ এদিক ওদিক তাকালো। মূলত এসব আবাসিক এলাকা গুলো ভীষণ নিরব থাকে। আশেপাশে মানুষও দেখা যায় না খুব একটা। তবে রিচার্জের দোকানটি আবাসিকের মধ্যে পরেনি। লোকালয়ে পরেছে। বেশ কিছুটা দূরেও বটে!
ইরা’দ হঠাৎ নওরির হাতের ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলে,
–“ওখানটায় বখাটে ছেলেদের আড্ডা আছে। আপনি একা সেখানে একদমই নিরাপদ নন। বাসায় যান! আমি রিচার্জ করে আসছি!”
ইরা’দ যেতে নিলে নওরি আটকে বলে,
–“টাকাটা নিচ্ছেন না..?”
ইরা’দ আলতো হেসে বলে,
–“টাকার সংকট পরেনি আমার। ওটা রেখে দিন!”
ইরা’দ চলে যেতে নিলে নওরি হঠাৎ বলে ওঠে,
–“আমি আপনার কাছে ঋণি হতে চাই না।”
ইরা’দ দমে গেলো। ফিচেল হাসি দিয়ে পিছে ফিরে বেশ সরল কন্ঠে বলে ওঠে,
–“কিছু কিছু ঋণ দেখতে এবং ভাবতে সুন্দর। সৌন্দর্য নষ্ট করতে নেই। বাসায় যান।”
————————
~