এক মুঠো প্রেম রঙ্গনা পর্ব -১১+১২

#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১১+১২ |

———————-
চিন্তায়, দ্বিধায় নওরি সদর দরজার সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছে। বাসায় চলে আসলেও নওরির মনটা বাহিরেই রেখে এসেছে। ইরা’দের অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব নিয়ে তার ভাবনা তাকে বিরক্ত করে চলেছে। ইরা’দ তাকে “নৌরি ফুল” বলে ডাকলো, তাও রাস্তায়? লোক সমাগমে? যদিও সেরকম মানুষ ছিলো না। তবে ইরা’দের এরূপ ব্যবহার তাকে চরম পর্যায়ের ব্যাকুল করে তুলেছে। ফোনটাও ইরা’দের কাছে। ফোন নিয়েই যত ঘাবড়াচ্ছে নওরি। কতক্ষণ কেটে গেলো। এখনো কেন আসছে না ইরা’দ?

অধরে নখ ঠেকিয়ে এবার পায়চারি করা শুরু করলো সে। কপাল বেয়ে ঘ্রামের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। হাঁসফাঁস অবস্থা রীতিমতো। মিনিট দুয়েক পরে হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে। নওরি তড়িৎ দরজা খুলে দেয়। ইরা’দকে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেলো। ইরা’দ চৌকাঠে দাঁড়িয়েই ফোন এগিয়ে দিয়ে বলে,
–“আপনার ফোন।”

নওরি ছোঁ মেরে ফোনটি কেড়ে নেয়। অতঃপর বিনা-বাক্যে ইরা’দের মুখের উপর দরজা বন্ধ করতে নিতেই ইরা’দ দরজায় ভর দিয়ে নওরিকে থামিয়ে দেয়। নওরি ভয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলো। নওরির ভীত মুখশ্রী দেখে সামান্য মুচকি হাসলো ইরা’দ। অতঃপর দরজার হাতল ধরে দেয়ালে বাহু হেলিয়ে ম্লান স্বরে বলে,
–“কেমন মানুষ আপনি, কেউ সাহায্য করলে তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। জানেন না?”
–“আপনি-ই তো প্রথম দিন ধন্যবাদ নেননি।”
–“ব্যস্ত ছিলাম, তাই নেইনি। এখন তো নিতে চাই। এনাফ সময় আছে আমার!”
নওরি আমতা আমতা করে বলে,
–“ধ..ধন্যবাদ!”
–“গলা কাঁপছে কেন আপনার?”

নওরি চমকে তাকিয়ে রইলো। পিটপিট করে। ইরা’দ পুণরায় হাসলো। শব্দহীন, চঞ্চল হাসি।
–“প্রথমদিন ভেবেছিলাম আপনি বড্ড বাচাল মেয়ে। কিন্তু আপনি আমার ধারণা বদলে দিয়েছেন!”

ইরা’দ আরও কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। চঞ্চল মুখটায় হঠাৎ গাম্ভীর্য হানা দিলো। নওরি পূর্বের ন্যায়-ই পিটপিট করে চেয়ে রয় ইরা’দের পানে।
–“স্যরি!”

নওরির বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে গেছে। মানে? স্যরি কী জন্যে? কিসের স্যরি? অস্ফুট স্বরে শুধালো,
–“স্যরি.. কেন?”
–“সেদিন রাতের জন্যে। মাথা ঠিক ছিলো না আমার। তাও আপনাকে বিভ্রান্তে ফেলার জন্যে আমি দুঃখিত। আমি অসম্ভব লজ্জিত।”

————————
–“ফাইনালি কল তাহলে দিলি!”
–“কেন? তুমি কল দিতে পারোনি? কথা বলার জন্যে কাল থেকে মন কতটা উশখুশ করেছে জানো?”
–“আরে, আমি তো দেখতে চাইছিলাম তুই কতদিনে ফোনে রিচার্জ করাস। নতুন শহরে গিয়েছিস, নিজের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেছিস, সবই তোকে পারতে হবে। এজন্য-ই তোকে কল দেইনি যাতে তুই রিচার্জ করে নিজে আমায় কল দিশ!”
–“আচ্ছা রাখো এসব কথা। গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনো।”

মাহি নড়েচড়ে বসলো। বর্তমানে সে ভার্সিটিতে আছে।অবশ্য বন্ধুদের থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করছে। মাহি গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
–“হ্যাঁ বল, আমি শুনছি।”

নওরি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ইরা’দের সম্পর্কে একে একে সবটা খুলে বললো মাহিকে। মাহি সবটা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“হোয়্যাট এ কো-ইন্সিডেন্ট! সব রাজনীতিবিদ তোর পিছেই লাগছে কেন?”

নওরি ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে গেলো। ইরা’দ রাজনীতিবিদ ঠিকাছে, কিন্তু মাহি আবার কার কথা বলছে?
–“মানে?”
–“প্রিতমের মাও একজন নেত্রী! ভুলে গেছিস?”

নওরির চোখ এবার কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ওই মহিলা নেত্রী? সে তো বুঝতেই পারেনি। মাহি আবার বলে ওঠে,
–“তবে তুই যা-ই বলিশ! তোর ওই নিদ্র’র বিষয়টা সুবিধার লাগছে না। হতেও পারে প্রেম-ট্রেম ভাব এসেছে।”
–“মাহি আপু! এরকম কিছুই না। আমি সাধারণ একটি মেয়ে। সে বিরাট মাপের মানুষ। এসব স্বপ্নেও আশা করা যায় না।”
–“এর মানে তুই চাস আশা করতে?”
–“আমি কখন বললাম?”

নওরির বো”কা কথায় মাহি ফিক করে হেসে দিলো। হাসি থামিয়ে বলে,
–“মজা করছিলাম। সব বাদ দে, ওখানে গেলি ঠিকাছে, টিউশনি করাবি না? অন্যের ভরসায় কতদিন বসে বসে খাবি?”

হ্যাঁ! ঠিক একটা পয়েন্ট। নওরির মধ্যে এরকমই একটা ভাবনা এসেছিলো কিন্তু সময় স্বল্পতায় সেই ভাবনা বেশিদূর গড়াতে পারেনি।
–“ঠিক বলেছো। কিছু একটা করা দরকার।”
–“এডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিস?”
–“বই-খাতাই তো সব ফেলে এসেছি।”
–“আরে সমস্যা কী? তোর ওই বোন আছে না? কী যেন নাম.. ও হ্যাঁ, সারিফা। ওই মেয়ে তো বললি ইন্টারে পড়ছে, ওই বই-ই ব্যবহার কর। ধার নিয়ে পড়।”

নওরি মুগ্ধ হলো। এই মাহির কাছে যেন নওরির সকল সমস্যার সমাধান আছে। কী সুন্দর দু সেকেন্ডে সমস্যার সমাধান দিয়ে ফেলে। আজ নওরির ইচ্ছে করছে কৃতজ্ঞতায় মাহিকে সালাম দিতে। এত ভালোবাসে কেন তাকে মাহি?
–“তুমি এত ভালো কেন মাহি আপু?”
–“তুই যে লক্ষী, তাই।”

——————-
বইয়ের বিষয়টি সারিফার সাথে আলোচনা করে মিটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এখন টিউশনি? সেটা কই পাবে? ঢাকা শহরের কিছুই তো সে চিনে না। এছাড়া টিউশনি করানোর পূর্ব অভিজ্ঞতাও খুব কম তাঁর। এ বিষয়ে কার সাথে আলোচনা করবে সে?

এসব নানান চিন্তায় নওরি রুমের এখান থেকে ওখানে পায়চারি করছে। বরাবরের মতোই অধরে নখ। বেশি চিন্তিত হলে নওরি সবসময় একই কাজ করে থাকে। এখন বিকাল। আছরের নামায কিছুক্ষণ আগেই শেষ করেছে। ফ্রিশা রুমের এক কোণায় কুশুমের উপর আরাম করে ঘুমোচ্ছে। মিনিটখানেকের মধ্যে-ই সারিফা প্রবেশ করলো রুমে। সারিফা সেজেগুজে বেশ তৈরি হয়েই এসেছে। এ রূপে সারিফার আবির্ভাব একদমই প্রত্যাশাজনক ছিলো না। নওরি পিটপিট করে সারিফার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,
–“কোথাও যাচ্ছো?”
–“হ্যাঁ, সাথে তুমিও যাচ্ছো!”

সারিফার এমন উচ্ছ্বাসময় বাক্য শ্রবণ হতেই নওরির মাথায় যেন মাথায় ভেঙে পরলো। বলছে কী সারিফা? সে আবার কোথায় যাবে?
–“মানে? বুঝতে পারিনি তোমার কথা।”
–“আহা, আপু। ঘুরতে যাবো। আমার বান্ধুবীরাও আসবে। বেশ মজা হবে। দ্রুত তৈরি হয়ে নাও তো, সময় বেশি হাতে নেই!”

নওরি কীরূপ অভিব্যক্তি দেখাবে বুঝে উঠতে পারলো না। ঘাড় বাঁকিয়ে একপলক ফ্রিশাকে পরখ করে নিলো। সারিফা এবার নওরির বাহুডোর করে ঝাঁকালো। মৃদু। নওরি চমকে সারিফার দিকে ফিরতেই সারিফা অনুনয়ের স্বরে বলে,
–“প্লিজ আপু, চলো না। তোমার সাথে ঘোরার অনেক ইচ্ছে আমার। মাও অনুমতি দিয়েছে, তাহলে সমস্যা তো থাকার কথা না।”

নওরি মুখ ঘুচে চুপ করে থাকে। এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে। আদৌ যাওয়া কী ঠিক হবে? সারিফা যেভাবে তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে তাতে নওরির না গিয়েও উপায় নেই। নওরি হঠাৎ বলে ওঠে,
–“নিদ্র কোথায়?”
–“খেলতে গেছে। আসতে আসতে সন্ধ্যার পর।”
–“তাহলে ফ্রিশা..?”
–“আরে ধুর! মা আছে তো। ঠিক সামলে নেবে। দেখছো না মহারাণী কীভাবে ঘুমোচ্ছে। মনে হয় না সহজে ঘুম ভাঙবে। এক সেকেন্ড, তোমার বিড়াল মেয়ে নাকি ছেলে?”

নওরি মুচকি হাসলো। ঘাড় ঘুরিয়ে ফ্রিশার দিকে লক্ষ্য করে বলে,
–“মেয়ে। তবে আমার মতো ভীতু নয় সে! বেশ সাহসী।”

হাসলো সারিফা। নওরির আলতো গাল টেনে বলে,
–“তুমিও একদিন প্রচন্ড সাহসী হবে। সেই দিন দূরে নয়। এখন বাদ দাও সব, দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। আমি অপেক্ষা করছি।”

সারিফা ব্যস্ত পায়ে মুঠোফোন ব্যবহার করতে করতে বেরিয়ে গেলো। নওরি তপ্তশ্বাস ফেলে নতুন জামা নেয়ার জন্যে অগ্রসর হলো।

—————-
ইরা’দ একমনে বহুক্ষণ একটি ফোন নাম্বারের দিকে তাকিয়ে আছে। নাম্বারটা স্ক্রিনশট তোলা। যাতে ইরা’দ ভুল করেও সেই নাম্বারে কল না দিতে পারে। নিজের প্রতি আজকাল কনফিডেন্সটা হালকা হয়ে গেছে। সবক্ষেত্রে নয়, একজন মানবীর ক্ষেত্রে। মনে মনে যেই ভয়টা পেয়েছিলো ঠিক তাই, বেশ কয়েকবার স্ক্রিনে টাচ করে ফেলেছিলো, কল দেবার জন্যে। ভাগ্যিস স্ক্রিনশট ছিলো, নয়তো সত্যি সত্যি কল চলে যেত। এভাবে ক্রমান্বয়ে চলছিলো। নিখিল নাক-মুখ কুচকে ইরা’দের কান্ড দেখছে। এরে দেখে কে বলবে এ সমাজসেবক? একজন রাজনীতিবিদ?

যেভাবে একটি মেয়ের ছবিও নয়, নাম্বার দেখছে সেখানে পাক্কা পা’ গল ব্যতীত কিছুই মনে হচ্ছে না তাঁর। যার কাজের জন্যে দেখাই পাওয়া যেত সে আজ পুরোটা দিন অবসর সময় পার করছে। বড়ই অদ্ভুত। তৎক্ষণাৎ ইরা’দ আবারো কলে টাচ করে ফেললো। নিজের অজান্তেই। নিখিল শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–“ওটা স্ক্রিনশট! কল লিস্ট নয়!”

ইরা’দ হুট করে ফোন পকেটে পুরে ফেললো৷ হাই তুলতে তুলতে বললো,
–“এক কাপ চা দেন তো মামা!”

নিখিল মুখ ভোঁতা করে বলে,
–“এভাবে এড়িয়ে চলছিস কেন?”
–“কখন করলাম?”
–“এই যে, অচেনা একটি মেয়ের জন্যে পাত্তাই দিচ্ছিস না!”

বেঞ্চিতে বসে ডান ভ্রু সামান্য কুচকালো ইরা’দ। সরল কন্ঠে শুধায়,
–“কোন মেয়ে?”
–“ঢং কম কর, সবই দেখি।”
–“তাহলে তুই কিছুই দেখিশনি রা!স্কেল!”

নিখিল ভেংচি কেটে ইরা’দের বাড়ির দিকে তাকায়। হুটহাট ডানে বামে নজর চলে যায় না অজান্তে? সেরকমই নজর চলে যায় খান ভিলার গেটের দিকে। নিখিল বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিতে চাইলেও পরপর আবারও সেদিকে নজর ঘুরালো। ঈগলের মতো সূক্ষ্ম নজর দিলো। চেনার চেষ্টা করলো কাউকে। ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে বললো,
–“ওটা কী তোর কালো পরী নাকি?”

ইরা’দ চমকে নিখিলের দিকে তাকায়। ইরা’দের নজরই বলে দিচ্ছে নিখিলের কথার আগা-মাথা কিছু বুঝেনি। রোষপূর্ণ কন্ঠে শুধায়,
–“মানে?”
–“ওদিকে দেখ।”
ইরা’দ নিখিলের দৃষ্টি অনুসরণ করে গেটের দিকে তাকালো। সারিফাকে চিনতে পেরেছে। সারিফার সাথের মেয়েটাকে দেখে ইরা’দ চোখ বুজে অন্যদিকে ফিরে গেলো। হার্টবিটের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। কয়েক সেকেন্ড পার হতেই আবারও তাকালো। চাহনি বড্ড ব্যাকুল কালো রঙা জামা পরিহিত মেয়েটিকে দেখার জন্যে। তাইতো বেহায়া নজর পুণরায় সেদিকে-ই চৌম্বকের ন্যায় টেনে নিলো।

—————
সারিফা রিকশার জন্যে কিছুটা সামনে চলে যায়। বেশ বড়ো বড়ো পায়ে। দমকা হাওয়ায় নওরির জর্জেট ওড়নাটা মাথা থেকে বারবার পরে যাচ্ছিলো। তাই সেটা সামনে এগোতে এগোতে ঠিক করছিলো। এজন্য হাঁট গতিও ছিলো ধীর। এজন্যে সারিফার থেকে কিছুটা পিছনে পরে গিয়েছিলো। হঠাৎ বাতাসের ন্যায় ইরা’দ তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়। নওরি ভূত দেখার মতও চমকে যায়। আরেকটুর জন্যে দুজনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়নি। নয়তো কঠিন ধাক্কার সম্মুখীন হতো। মাস্ক পরিহিত ব্যক্তিটিকে না চিনতে পারলেও ইরা’দের চোখ জোড়া দেখে আন্দাজ করে চিনে ফেললো। ইরা’দের হঠাৎ আগমনে নওরি বেশ ভয় পেয়েছে৷ তাই সে বক্ষে থু ফেলার ভঙ্গি করলো৷ অতঃপর আশেপাশে ভীত নজরে তাকিয়ে ইরা’দের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্যে প্রস্তুতি নিতেই ইরা’দ হঠাৎ জোরালো ডাক দিয়ে উঠলো। নওরির দিকে তাকিয়েই।
–“সারিফা!!”

একের পর এক সারিফাকে ডেকেই চলেছে ইরা’দ। তাও নওরির দিকে তাকিয়ে। এদিকে নওরির ভয়ে হাত-পা জমে গেছে। এভাবে চিল্লা-পাল্লা করে ডাকছে কেন? কানের জায়গায় তো কান রইলো না। ওদিকে ফিরে ডাকুক না! এদিকে কী? নওরি আমতা আমতা করে বলে,
–“এদিকে ফিরে ডাকছেন কেন? সারিফা তো সামনে-ই আছে, ওদিকে যান!”
–“আপনার কাছে জিজ্ঞেস করেছি? আমি কীভাবে ডাকবো?”

এবার নওরির বুলি একদম বন্ধ হয়ে গেলো। এমন ত্যাড়া কথা বলার কী আছে? দুনিয়াতে কী সহজ কথার অভাব পরেছে, নাকি উনি বলাই শিখেননি। নওরির মনের মধ্যে দু, চারটা গাল-মন্দ করতে ছাড়লো না। অভদ্র ছেলে৷ কখনো, কখনো খুব ভালো সাজে আবার অভদ্রের সংজ্ঞাও দেখিয়ে দেয়। নওরি মুখ বাঁকিয়ে ইরা’দের ডান পাশ কেটে যেতে নিলে ইরা’দ আবারও পথ আটকালো। নওরি বিরক্ত হয়ে বাম পাশে যেতে নিলে ইরা’দও বাম পাশে চলে আসে। মহা বিরক্তির মধ্যে পরলো তো। চাইছে কী লোকটা?
–“পথ আগলে দাঁড়িয়েছেন কেন? সরে দাঁড়ান!”
–“আপনি যেতে পারছেন না? আমি তো আর আপনাকে বেঁধে রাখিনি!”

নওরি আর কিছু বলতে নিলে সারিফা চলে আসে। ইরা’দের উদ্দেশ্যে বলে,
–“এভাবে ডাকছো কেন? আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। না জানি নওরি আপুর কী না কী হলো!”
ইরা’দ অনিমেষ নওরির বিরক্তিতে আগলে রাখা মুখশ্রীতে নজর আটকে বললো,
–“নৌরি ফুলগুলো খুব অমায়িক হয় তাই না? এভাবে বেরিয়েছে কেন বল তো? তাঁর জামাটার মতোন আশেপাশের মানুষদের নজরও যে কালো! কিছু একটা হয়ে গেলে এর দায়ভার কে নিবে?”

–“কিছু বললে ভাইয়া?”
হুঁশ ফিরলো ইরা’দ। ঘনঘন পলক ফেলে ঘাড় বাঁকিয়ে সারিফার দিকে তাকালো। এদিকে সারিফা ইরা’দের কথাগুলো না শুনলেও নওরি শুনেছে। কাছাকাছি ছিলো বিধায়-ই শুনতে পেরেছে। ইরা’দের মুখে এরকম উক্তি শুনে নওরির নিঃশ্বাস যেন গলায় আটকে আছে।

ইরা’দ হালকা কেশে বলে,
–“কই, কিছু না তো। কোথায় যাচ্ছিস এখন?”
–“আমার কিছু ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরতে যাচ্ছি। নওরি আপু সারাদিন বাসায় থাকে, তাই ভাবলাম নওরি আপুকেও সাথে করে নিয়ে যাই!”
ইরা’দ মাথা নিচু করে নওরির দিকে তাকাতেই নওরি নজর ঘুরিয়ে ফেললো। সব কেমন এলোমেলো লাগছে তার। তীব্র এক অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরেছে। নওরি সপ্তপর্ণে ইরা’দের থেকে সরে আসে। এবং সারিফার পিছে গিয়ে দাঁড়ালো।
ইরা’দ অবাক হবার ভান করে বলে,
–“একা কেন যাবি তাহলে? আমিও যাবো। চল!”
–“না, না। তুমি ব্যস্ত মানুষ! আমাদের সাথে যাবার প্রয়োজন নেই।”
–“বেশি বকবক করিশ! দাঁড়া আমি সিএনজির ব্যবস্থা করছি।”

বলেই ইরা’দ কিছুটা দূরে গিয়ে কাকে যেন কল করলো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একটি সিনএনজি চলে আসলো। নওরি বেশ অবাক-ই হলো৷ মনে মনে ভাবলো, ক্ষমতা থাকলে মানুষ কী না করতে পারে। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিলো। কিন্তু নওরি বসেছে মাঝে। নওরির ডান পাশের সিটটা খালি। ভয়ে এবার জমে গেলো নওরি। এখন কী ইরা’দের গা ঘেঁষে বসতে হবে? গলা শুকিয়ে রীতিমতো কাঠ কাঠ। পাশে ঘেঁষে বসা সারিফার উদ্দেশ্যে কম্পিত গলায় আওড়ায়,
–“পানি হবে সারিফা?”
–“নেই তো আপু।”

পানির কথা শুনে ইরা’দ পাশের দোকান থেকেই এক বোতল কিনে আনলো। নওরির কোলে বোতলটা ছুঁড়ে মেরে আলতো হেসে বললো,
–“বেশি ভাবনা ভালো নয় নৌরি ফুল।”

বলেই নওরির দিকের লোহার গেটটি লাগিয়ে দিতে বললো ড্রাইভারকে। অতঃপর ড্রাইভারের পাশের ডোরটি খুলতে ইশারা করলো।
–“পুলিশে দেখলে সমস্যা হবে। আপনি পিছে বসুন।”
–“কচু করবে পুলিশে। আপনি খুলেন। পুলিশকে আমি বুঝে নিবো!”
–“কিন্তু..?”
–“তাড়ায় আছি, দ্রুত খুলে দিন।”

ড্রাউভার উপায়ন্তর না পেয়ে লোহার গেইটটি খুলে দিলো। নওরি পিটপিট করে ইরা’দকে দেখছে। এ ছেলেটার উদ্দেশ্য একদমই ধরতে পারে না। একেক সময়ে একেক রূপ। বহুরূপী মানুষ। হ্যাঁ, ঠিক। বহুরূপী মানব সে। সিএনজি চলতে শুরু করলে নওরি খোলামেলা বসলো। শান্তি লাগছে। বাইরে কিছুক্ষণ একমনে তাকাতেই কী মনে করে সামনে তাকালো। সিএনজির লুকিং গ্লাসে ইরা’দের সুঁচের মতো চাহনি মারাত্মক চমকে উঠলো সে। তড়িৎ সটান মেরে বসেছে নওরি। নওরির এরূপ অভিব্যক্তিতে ইরা’দ সামান্য হাসলো। শব্দহীন সেই হাসি। মাস্কের আড়ালে লুকিয়ে থাকা হাসি কেউ-ই উপলব্ধি করতে পারলো না। তাঁর বেশ ভালো লাগছে নওরিকে জ্বালাতে। মেয়েটা বড্ড ভীতু এবং সরল।

অবশেষে একটি পার্কে আসলো ওরা। আসার পথে কোনো রকম পুলিশের ঝামেলায় পরতে হয়নি তাদের। পার্কটি বেশ বড়ো। নানান মানুষদের আনাগোণায় কিছুটা ভীড় জমেছে। সারিফা নওরির এক হাত ধরে কাউকে কল দিতে দিতে সামনে এগোচ্ছে। আর ইরা’দ পকেটে দুই হাত গুঁজে নওরির পাশাপাশি হাঁটছে। নওরি কোণা চোখে একবার পরখ করে নিলো ইরা’দকে। মাস্ক এবং কালো সানগ্লাসে মুখশ্রী আবৃত। কপালে এক দুইটি চুল পরেছে অবশ্য। সিলভার কালারের একটি টি-শার্ট পরিহিত। লম্বা-চওড়া লোকটি দেখতে খারাপ না। তবে মাঝে মধ্যে মনে হয় তার ব্যবহারে বেশ ঘাটতি রয়েছে।
–“যাক, আমায় পর্যবেক্ষণের জন্য দুটো চোখ অন্তত আল্লাহ্ দিয়েছেন!”

নওরি চোখ বড় বড় করে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো। ইরা’দ নওরির দিকে তাকিয়ে হাসলো। চশমা ভেদ করে ইরা’দের চোখ গুলোকে ধরতে চাইলো যেন। সেই চোখে কী চলছে তাও দেখার বড্ড আগ্রহ জমেছে। গোধূলি লগ্নের তীক্ষ্ণ কিরণ কিছুটা সানগ্লাস ছুঁয়েছে। সেই কিরণের ঝাপটায় বুঝে নিলো ইরা’দের চোখ জোড়া হাসছে। হাসির ভাঁজে লুকায়িত বিরাট পরিসরের এক চঞ্চলতা। নওরি সঙ্গে সঙ্গে নজর ফিরিয়ে নিলো। অন্তঃস্থলে উথাল-পাতাল ঢেউ খেলছে। অসম্ভব স্রোত বয়ে যাচ্ছে তাঁর। এই স্রোত ভীষণ এলোমেলো এবং অচেনা।

ইরা’দ হঠাৎ সারিফার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“আমি আশেপাশে-ই আছি। তোদের দেখা-সাক্ষাৎ এবং আড্ডা-ফাড্ডা শেষ করে কল দিস, আমি নিয়ে যাবো বাসায়।”
বলেই ইরা’দ ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গেলো। নওরির বুঝে আসে না, এই অদ্ভুত লোকটি এত গরমের মাঝে মাস্ক এবং সানগ্লাস পরে কেন সিদ্ধ হচ্ছে? গরমের মধ্যে এসব পরে কোন পা’ গলে ঘুরে? যেমন আজিব লোক তেমনই তাঁর আজিব কারবার!

——————-
ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতেই ধপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো নওরি। নওরি শুতেই ফ্রিশা ধপ করে নওরির পেটের উপর উঠে আসে। নওরি ক্লান্ত স্বরে বললো,
–“গরম লাগছে ফ্রিশা। সরে আয়। পরে কোলে উঠিস।”

ফ্রিশা শুনলো না নওরির বাণী। পিটপিট করে নওরি দেখছে সে। নওরি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বুজে ফেললো। ভাবতে লাগলো আজকের পুরো দিনের ঘটনাগুলো। ফেরার সময় ইরা’দ আসেনি। তাঁর জরুরি কাজ পরে যাওয়ায় চলে যেতে হয়েছিলো। তবে ইরা’দ ঠিকই একটি সিএনজি ঠিক করে দিয়ে গেছে। নিজের দায়িত্বে যেন বেশ অটল মানব সে।

হঠাৎ টিউশনির কথা মাথায় এলো। আচ্ছা, টিউশনি নিয়ে নূরজাহান আন্টির সাথে যোগাযোগ করলে কেমন হয়? টিউশনির কথা বলাই যায়। নওরি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো এ বিষয়ে নূরজাহান আন্টির সাথে একবার কথা বলে নিবে। হয়তো উনি আশেপাশের বাচ্চাদের চিনে। তাহলে তাই হোক।

নওরি হঠাৎ ফোনের রিংটোন শুনতে পেলো। শব্দটি বালিশের নিচ থেকে আসছে। নওরি ফ্রিশাকে নিজের উপর থেকে সরিয়ে উঠে বসলো। বালিশের নিচে থেকে ফোন বের করলো সে। বাহিরে ফোন নিয়ে যায়নি নওরি। বাসাতেই ছিলো। ফোন হাতে নিতেই বেশ চমকালো। মাহির তরফ থেকে বেশ কয়েকবার কল এসেছে। কিন্তু কেন? খা!রা!প কিছু কী ঘটেছে? ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো তাঁর। দ্রুত কল রিসিভ করে কানে দিলো সে। পরপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“হ্যালো! এত কল দিলে যে? কিছু হয়েছে?”
–“স!!র্বনাশ হয়েছে রে নওরি!”

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here